প্রতি বছরের মত গত কালও নির্বিঘ্নে সমাধা হল বিজেপির নবান্ন-অভিযান। পুরোদস্তুর নির্বিঘ্ন কি-না, তা নিয়ে কেউ কেউ তর্ক জুড়তে পারেন বটে– তবে, আয়োজনের ঔপচারিকতায় যে বিশেষ ভাটা পড়ে নি, তাতে সন্দেহ নেই। নরম-গরম ভাষণ, দু-একটি পাথরবাজি, পুলিশকর্মীকে মার এবং জ্বলন্ত পুলিশ ভ্যানের ছবি: আনুষ্ঠানিকতা নেহাত কম ছিল না! তার সঙ্গেই ঘন হয়ে উঠছে একটি প্রশ্ন: এই রেওয়াজি পদযাত্রায় আদৌ লাভের লাভ কিছু হল কি? বিক্ষিপ্ত কিছু দৃশ্যমালা রচনা করা-ব্যতীত, আদৌ কি স্থিতাবস্থার পানাপুকুরে দু-একটি ঢিলও ছোঁড়া গেল?
প্রশ্নটা জটিল। দেখছিলাম, কিছু উৎসাহী বাম যুবনেতা তাঁদের অতীতের অ্যালবাম থেকে টেনে এনেছেন নবান্ন-যাত্রার ছবি, প্রমাণ করতে চেয়েছেন: নবান্ন চলো’র আসল ঠিকেদার তাঁরাই, ভুইফোঁড় বিজেপি নয়। অর্থাৎ, নবান্ন চলো’র স্বতঃসিদ্ধতা নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন নেই– গোলমালটা কেবল তার ব্যাটনটা কার হাতে থাকছে, এই নিয়ে।
কথাটা কি ঠিক? কেন্দ্রীভূত জনসমাবেশ কি এই যুগে নেহাতই অসার ও ভোঁতা রাজনৈতিক অস্ত্র নয়?
খোলসা করা যাক। প্রথম কথা, কাল মমতা আদৌ নবান্নে ছিলেনই না। ছিলেন মেদিনীপুরে। অর্থাৎ, নবান্নের চোদ্দো তলায় আসীন নেত্রীকে টলাতে যাচ্ছেন– এমন বার্তার প্রতীকী ব্যঞ্জনা যতটা, বাস্তবতা ছিল না তার ছিটেফোঁটাও। সেই বাস্তবতা বরং বেশ অস্বস্তিকর, এবং, তার মোকাবিলা করার মত আত্মনিরীক্ষণের সুবুদ্ধি আদৌ বিরোধীদের আছে কি-না, সে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
নবান্নের ম্যাপটা যদি দেখা যায়, তা হলেই এই বাস্তবতার প্রথম সূত্রটা বেরিয়ে আসে। নবান্ন কিন্তু সাবেক মহাকরণের মত কলকাতার মধ্যবিন্দু নয়, শাসনতন্ত্রের প্রতাপশালী ভরকেন্দ্র নয় মোটেই। এক নিরিখে তার জ্যামিতিক অবস্থানটুকু বেশ প্রান্তেই বলা চলে– নবান্ন ঘেরাও করতে গেলে অতঃপর গঙ্গা পেরিয়ে কসরত করতে হবে কিঞ্চিৎ। মহানগরীর দৃষ্টিসীমার প্রান্তে নবান্নের এই যে অবস্থান, তা একটা বড় বদলের প্রতীকও বটে। নবান্নের চোদ্দো তলায় যে সরকার আসীন গত তিনটি মেয়াদ, এই নির্বাচনের আগে তারা স্লোগান দিয়েছিল: দুয়ারে সরকার! অর্থাৎ, ক্ষমতা আর কোনও নির্দিষ্ট সার্বভৌম কেন্দ্রে সীমিত থাকবে না, ছড়িয়ে যাবে আম-মানুষের দরজায় দরজায়। সেই বিকেন্দ্রীকরণ আদৌ পুরোপুরি হয়ে উঠেছে কি-না, হলেও কতটুকু, বা, তার চরিত্র কেমন: এই প্রশ্ন এখানে ততটা গুরুত্ববহ নয়, যতটা ওই স্লোগানটুকু।
এই প্রাথমিক সূত্রটা মনে রাখলে নবান্নযাত্রার মত কেন্দ্রীভূত, ঘন, জমাট-বাঁধা কোনও রাজনৈতিক সমাবেশের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, আজ, যে যুগে আমার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক একটি বুড়ো আঙুলের ছাপে নির্ধারিত হয়ে যায়, যে আমলে প্রশাসনিক সুযোগসুবিধা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়– সেই যুগাবস্থায়, অতি উত্তেজিত হয়ে নবান্ন চলো’র ডাক দেওয়ার প্রাসঙ্গিকতা কী? হায় রে কবে কেটে গেছে একুশ জুলাই-কাল! মমতা যে কাল আদৌ নবান্নতেই ছিলেন না, জেলা সফরে চক্কর কাটছিলেন– তার থেকে এই সত্যই বেরিয়ে আসে যে ২০২২-এর নবান্ন কোনও বাস্তিল দুর্গ নয়। ক্ষমতা চলমান, ক্ষমতা বিশ্লিষ্ট, ক্ষমতা ঘূর্ণমানও বটে৷ নবান্নের একতলার পলেস্তারা খসিয়ে দিলেও সেই ক্ষমতাগাত্রের এক চুলও ইতরবিশেষ হবে না।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে কেন্দ্রীভূত সমাবেশের যাথার্থ্য নিয়ে। গত বিধানসভা ভোটের আগে দুটি বড় শক্তি তাদের কলজে প্রমাণ করতে ব্রিগেড হাঁকিয়েছিল। একটি বিজেপির সভা, অন্যটি সিপিএম, কংগ্রেস ও আব্বাসের অধীন সংযুক্ত মোর্চা। পক্ষান্তরে, বিজয়ী তৃণমূল আদৌ কোনও সভাই করে নি সে বার। বরঞ্চ, আইপ্যাকের পেশাদার কর্মীরা গ্রামে চরকিপাক কেটেছেন, পয়সার বিনিময়ে তথ্যের ভাঁড়ার উজার করে এনেছেন কর্ত্রীর জন্য। মোদী যে দিন কলকাতায় স-মিঠুন গর্জনরত, মমতা সে দিন শিলিগুড়িতে। বাইরে ওঁরা যতই যুক্তি দ্যাখান না কেন, করোনার জন্য সাবধানতা ইত্যাদি– বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিকতায় দীক্ষিত টেকনোক্র্যাট অন্তত জানেন, এই কেন্দ্রীভূত সমাবেশের এই যুগে অনেক নিস্তেজ। এখন নির্বাচনী প্রচারণা হাজির হয় আম-মানুষের আঙুলছাপে, মোবাইল-পর্দায়। ব্রিগেডে দশলাখি ভিড় চমৎকার দৃশ্য-আবহ তৈরি করতে পারে, এবং ওইটুকুই।
লন্ডনে যখন একুশ শতকের গোড়ায় পর পর যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ হচ্ছিল, প্রায় লাখখানেক লোক জমায়েত হচ্ছিলেন, লন্ডনের মেয়রকে জিগ্যেস করা হয়, এই যে এত বিপুল সমারোহ– আপনি কী বলবেন? উনি না-কি উত্তর দিচ্ছিলেন: তামাম লন্ডন শহরে থাকে পাঁচ লক্ষ লোক৷ যে অবশিষ্ট চার লক্ষ ঘরে থেকে গেলেন সে দিন, তাঁরা আসলে আমাদেরই সমর্থক!
আধুনিক গণজমায়েত মোটেই নিউটনের গ্র্যাভিটি না। কোনও অমোঘ ক্ষমতাকেন্দ্রের চৌম্বকীয় মাধ্যাকর্ষে জড়ো হয় না জন-বলয়। ক্ষমতার সঙ্গে তার লেনদেন অধুনা অঞ্চলভিত্তিতে নানা প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যার অনেকটাই বিমূর্ত। মমতা, সেই হিসেবে, প্রশাসনের অছি– তার সর্বময় কর্ত্রী। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে টাকা পাঠানো সেই মমতাকে যত দিন না রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ করা যাচ্ছে, মোটা মাথায় মনে হয়: গ্রহণযোগ্য বিকল্পের পথে যাওয়া সহজ নয়।
কাল অবশ্য কুনাট্য থামে নি এখানেই। প্রথম প্রহরেই উর্দিবাহিনীর হাতে স্বয়ং ধরা দিয়েছেন মিছিলের মুখ, খোদ বিরোধী দলনেতা। অবশ্য, কাহিনিতে মৃদু টুইস্ট ছিল! শুভেন্দু জানিয়েছেন, খোদ বিচারপতি রাজশেখর মন্থার ফরমান রয়েছে শিয়রে: ফলে, শুভেন্দু অধিকারীকে গ্রেফতার করা অসাংবিধানিক এবং বেআইনি।
এখানেই দ্বিতীয় ভুল৷ মমতাশাহির রাজত্বে বিরোধীরা কেবলই আদালত ও বুরোক্রেসির ওপর নির্ভরশীল৷ মাথায় রাখতে হবে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষ চালান না। বছরের পর বছর, এদের অদক্ষ দীর্ঘসূত্রিতায় চোট খেতে খেতে মানুষ হতাশ, বিরক্ত। বস্তুত, আদালত কখনও কখনও গণক্ষোভের প্রশমনে চমৎকার বাফার-এর কাজও করে। আনিস খানের মৃত্যু নিয়ে সারা রাজ্য হুলস্থূল, আচমকা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে মহাকরণ অভিযান! অসাবধানতার ল্যাজে প্রথম পা। পুলিশের দাঁতনখ আর লাঠি-ওঁচানো দেখে মুহূর্তে মিছিল এলোমেলো, যানজট, ভোগান্তি, আর সেটাই বাধ্যতামূলক শিরোনাম। তার পর? কেস হল, মামলা গড়াল কোর্টে, বিচারপতির রায় নতমস্তকে মেনে-নেওয়ার গণতন্ত্রে যে আদালতই শিরোধার্য! গণক্ষোভ চাপা পড়ে গেল দ্রুত, আদালত আর তদন্তকারী সংস্থার প্রশ্নাতীত পারঙ্গমতার কাছে। ঠিক এ ভাবেই বগটুই থেকে হাঁসখালি... আগুনের স্মৃতিগুলি ক্রমে ধূসর হয়ে এসেছে৷ অতীতে সারদার মত থিতিয়ে-যাওয়া, থম-মারা, ঠাণ্ডা ও ম্যাদামারা উদাহরণও কম নেই– দীর্ঘসূত্রিতায় যার ফল অশ্বডিম্ব। তার খেসারত আজও চোকাতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের, যারা রাজনীতি আর প্রতারণার অসাধু চক্রে আস্থা বিনিয়োগ করেছিলেন৷
তা হলে, কী করণীয়? কে-ই বা আদর্শ? ভাঙনকালে কোনও একটা সাদা-কালো গাজর হয়তো আমাদের সামনে ঝোলে না। তবু, থেকে থেকে মনে পড়ে শুভ্রা ঘোড়ুইয়ের কথা, প্রত্যন্ত হাওড়ার গ্রামনিবাসী যে গরিব মহিলা সটান পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছিলেন জোকা হাসপাতাল চত্বরে। তাঁর যুক্তি ছিল: পার্থ চট্টোপাধ্যায় অসৎ, লোভী, দুশমন৷ সাবেক নীতিমালা যে আমলে এসে ভেঙে গেছে পুরোপুরি, ফেয়ার আর ফাউল একাকার, সেখানে, সু আর কু-এর ওপর এই বিশ্বাস-স্থাপনা চমকপ্রদ বই কী৷
বস্তুত, বুরোক্রেসি অপরাধীকে নিয়ে যায় জনতার থেকে পাহাড়প্রমাণ দূরত্ব বজায় রেখে, জনতা আর অভিযুক্তের মধ্যে তৈরি করে দেওয়াল। এই নাছোড় ও শীতল ব্যূহর ওপর সপাটে একটি নধর চটি ছুঁড়েছিলেন শুভ্রা। বঙ্গেশ্বরীর হুকুমত-বিনা যে রাজ্যে এক গোছা গাছের পাতাও স্বেচ্ছায় নড়ে না, সেখানে এই বীরোচিত প্রতিস্পর্ধার মশলা তিনি পেয়েছিলেন কোত্থেকে, সে কূট তক্কোও না-হয় মুলতুবি থাক৷
কেবল ওই চটির ঘা-টুকু থেকে থেকে আঘাত করুক আমাদের।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।