কিছু গল্প বলি। সালটা সম্ভবতঃ ১৯৫৭। স্কুলের ক্লাস টু’তে পড়ি। ক্লাস টিচার জানালেন – যারা যারা দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছ তারা ফর্ম নিয়ে যাও। কাল অভিভাবকের থেকে সাইন করিয়ে নিয়ে এসো। তাহলে তোমাদের স্কুল ফি হাফ হয়ে যাবে। আমি হাত তুললাম এবং ফর্ম নিয়ে বাড়ি গেলাম।
কিন্তু পরের দিন আমার বাবা-মা সেই ফর্মে সাইন করতে রাজি হলেন না। তাঁরা লজ্জিত, বললেন আমরা দেশভাগের সময় ঘরবাড়ি ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি বটে, কিন্তু রিফিউজি নই। আমাদের কোলকাতায় ভাড়া বাড়ি আগে থেকেই ছিল। আমরা বর্ডারে অন্য অনেকের মত শরণার্থী ক্যাম্পে উঠি নি। ওদের কনসেশন থুড়ি অনুদান দরকার। আমরা কেন ওদের ভাগে থাবা বসাব? ওঁরা কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? আমি জানি না। কারণ, তখন পার্কসার্কাসের তিন কামরা এবং একটি বাথরুম পায়খানাওলা ভাড়াবাড়িতে আমরা বাইশ জন গাদাগাদি করে থাকি।
কয়েক বছর আগে দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার ঘোষণা করল যে কাজ করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রোজ যাতায়াত করা মেয়েরা সরকারি কার্ড করিয়ে নিলে ওদের ভাড়া এক পয়সাও লাগবে না। সরকার ১০০% ভর্তুকি দেবে। ভিলাইয়ে আমাদের মত পেনশন প্রাপ্ত বুড়োদের আড্ডায় সবাই বিরূপ। কেজরিওয়াল নিজের পকেট বা ওর পার্টির ফান্ড থেকে অনুদান দিক, আমাদের ট্যাক্সের পয়সায় মোচ্ছব কেন?
ওঁরা খেয়াল করছেন না যে ওঁদের দেওয়া আয়কর ও সম্পত্তি কর সরকারের আয়ের ৫০% থেকেও কম। বাকিটা অপ্রত্যক্ষ কর, যেমন জিএসটি। এবং সমস্ত গরীবগুর্বোরা এই ট্যাক্স দেয়। কখন? যখন ওঁরা বাসে রেলে চড়েন, দোকান থেকে জামাকাপড়, খাবারের জিনিস এবং অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। সিনেমা দেখেন, মোবাইল কেনেন ইত্যাদি।
এছাড়া আছেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তরা। যেমন সরকারি চাকুরিজীবি এবং ব্যাংক ও রেলওয়ে কর্মীদের পেনশন এবং গ্র্যাচুইটি যা বেশিরভাগ কর্পোরেট সেক্টরের চাকুরিজীবিদের নেই। আবার পাবলিক সেক্টরের অধিকাংশ বিভাগে পেনশন নেই (ধরুন ইস্পাত এবং কয়লা শিল্প)। এছাড়া এদের অধিকাংশ আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা পান। এর বিশাল ব্যয়ভার বহন করে সরকার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে মহিলারা পেতেন ৫০%, পুরুষেরা ৪০%; এছাড়া ‘সিনিয়র’ বলতে মেয়েদের বয়েস ৫৮, যদিও পুরুষদের ৬০। কোভিড যুগে ওসব বাতিল হয়ে গেছে।
পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর লোকেরা সারাজীবন কমদামে রেশন এবং বিনামূল্যে বা নামমাত্র খরচে চিকিৎসা পান। আমরা মনে করি - ওঁরা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আমাদের রক্ষা করেন, তাই এটুকু ওঁদের প্রাপ্য।
আর রয়েছেন মন্ত্রী, এমপি ও এমএলএ’র দল। এঁরা তো চাকরি করেন না, জনসেবা করতে এসেছেন। কিন্তু এঁরা তিনবছর সংসদ বা বিধানসভায় থাকলেই আজীবন পেনশন পাবেন, সপরিবারে রেল ও বিমান ভ্রমণে এবং চিকিৎসায় বিশেষ সুবিধে পাবেন। একজন তিনবার এম এলো এ হলে এই নিয়মের জোরে তিনটে পেনশন পাবেন। (বলা ভাল, পাঞ্জাবের নতুন মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান এই নিয়ম নিজের রাজ্যে খারিজ করে দিয়েছেন)।
এঁদের আন্দোলন করতে হয় না। নিজেরাই কিছুদিন পরে বিল আনেন এবং বিনা বাধায় পাশ হয়ে যায়।
আরও রয়েছে। ধরুন ভারত রত্ন শচীন তেন্দুলকর। ২০০৩ সালে তাঁর অনুরোধে ফিয়েট কোম্পানী থেকে উপহার পাওয়া ফেরারি গাড়ি দেশে আনার জন্য ১.২০ কোটি টাকার আমদানি শুল্ক ভারত সরকার ছাড় দেয়।
এখানে আমি বিশাল ইনফর্মাল সেক্টরের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষদের কথা ধরছিই না, যদিও তাঁরাই ভারতের শ্রমশক্তির ৯০%। তাঁদের কোন পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি কিছুই নেই, এমনকি বাজার চড়তে থাকলে মহার্ঘ ভাতাও নেই। কিন্তু পেটে খিদে আছে, পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব রয়েছে।
তাহলে তাঁদের কী আছে? রয়েছে রেশন কার্ড, যা দিয়ে চাল-গম-চিনি কেনা যায়, কিন্তু তরিতরকারি, দুধ, তেল নুন ওষুধ নয়। হ্যাঁ, তাদের রয়েছে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প। সেটা কোন রাজ্যে আম্মা-চাওল, কোথাও চাউর বাবার কৃপায় ২ টাকা কিলো চাল, কোথাও ডিম-ভাত, কন্যাশ্রী স্বাস্থ্যশ্রী, রূপশ্রী এবং স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। এছাড়া রয়েছে সরকারি হাসপাতাল যার গ্রামাঞ্চলে ডাক্তার-কম্পাউন্ডার-ওষুধের ঘাটতি নিয়ে কিছু বলা বাহুল্যমাত্র।
ভর সন্ধ্যেয় এতসব যুক্তি-তক্কো-গপ্পো মাথায় ভিড় করে এলো। কারণ, আমি মাত্র শেষ করেছি একটি পঁচিশ পাতার চটি বই—স্বাতী ভট্টাচার্যের লেখা ‘অনুদানের লজ্জা’, প্রকাশক অবশ্যই গুরুচণ্ডালী।
স্বল্প পরিসরে স্বাতী সহজ প্রসাদ গুণসম্পন্ন ভাষায় আলোচনা করেছেন অনুদানের বিভিন্ন দিক নিয়ে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। একটু পরে বোঝা যায় কেন স্বাতীর বইটি সচরাচর চর্বিতচর্বণের থেকে আলাদা। এখানে স্বাতী সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন অনুদানের ভালোমন্দ, করাপশন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’ খেউড়।
কিন্তু ওঁর অনুসন্ধানের মূল কথাটাই হল অনুদানের নৈতিক ভিত্তি বা আদৌ কোন এমন কিছু আছে কিনা। উনি প্রশ্নটিকে দেখেছেন দাতা ও গ্রহীতা দু’পক্ষের দিক থেকে। যদিও প্রসঙ্গক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ এবং বিদ্যাসাগরের উল্লেখ রয়েছে কিন্তু স্বাতীর তাত্ত্বিক কাঠামোটির আশ্রয় দার্শনিক বৃন্দা ডালমিয়ার ‘হ্রী’ বা নৈতিক লজ্জা যা মানুষকে সংবেদনশীল করে।
স্বাতী এই ধারণাটি হুড়মুড় করে পাঠকের মাথায় গজাল মেরে গোঁজাতে চাননি একেবারেই। বরং উনি শাস্ত্রীয় সংগীতের আলাপের মত করে ধীরে ধীরে নিজের কাঠামোটিকে গড়েছেন। শুরু করেছেন বহু আলোচিত ‘অনুদান উচিত কি অনুচিত’ প্রশ্নটি নিয়ে। কখন উচিত কখন নয়? দেখিয়েছেন প্রশ্নটি অমন স্থান-কাল-নিরপেক্ষ হতেই পারে না। ওঁর তাত্ত্বিক কাঠামোয় রাষ্ট্র দাতা, নাগরিক গ্রহীতা। এখন এই ঔচিত্য এবং তার নৈতিকতা নির্ধারণের ভার কার উপর? দাতা রাষ্ট্রের না গ্রহীতা নাগরিকের?
আবার একটা গল্প বলি। সত্তর দশকের দোরগোড়ায় ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে (তখন দক্ষিণ-পূর্ব মধ্যপ্রদেশ) উগ্র ছাত্র আন্দোলন হয়। দাবিগুলো শুনুন একবার।
এক, রায়পুরের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল টেলরিং শপ কানহাইয়া টেলর্সে ছাত্রদের জামাকাপড় সেলাই করার দাম কমাতে হবে।
দুই, সিনেমা হলের টিকিটেও স্টুডেন্ট কনসেশন চাই। কলেজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখালে যেন আদ্দেক দাম নেওয়া হয়।
খেয়াল করুন, ওই দর্জি দোকান বা সিনেমা হল কোনটাই সরকারের নয়। তবু ছাত্রদের অনুদান দিতে সরকারের আশীর্বাদ চাই। আর দুটো দাবির একটাও শিক্ষার মান বা সুলভ হওয়ার প্রশ্নের সঙ্গে কোনভাবেই যুক্ত নয়।
এইখানেই স্বাতী এনেছেন আমাদের হিন্দু পুরাণ কথায় রাষ্ট্রধর্মের বা নৈতিকতার উল্লেখ। আলোচনা করেছেন পাশ্চাত্য উপযোগিতাবাদীদের মাপদণ্ড—ফল দিয়ে বিচার করতে হবে কাদের অনুদান পাওয়া উচিত, কাদের নয়। প্রশ্ন তুলেছেন মিড ডে মিল উচিত বটে, নইলে আধপেটা খাওয়া বাচ্চারা স্কুলে আসবে না। কিন্তু বিনামূল্যে জুতো দেওয়ার ঔচিত্য আছে কি? জুতো না পেলে বাচ্চারা স্কুলে আসবে না কি?
বিপরীতে দাঁড় করিয়েছেন বামমার্গী লিবেরালদের, যাঁরা মনে করেন ওয়েলফেয়ার স্টেটে রাষ্ট্রের দায়িত্ব দুর্বল প্রান্তিক নাগরিকদের বেসিক নীডসের ব্যবস্থা করা। “জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনও সম্পদ যদি নাগরিক স্বয়ং সংগ্রহ করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের থেকে সেটা পাওয়ার অধিকার নাগরিকের আছে। সেই অধিকার পূরণে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। অনুদান তার অন্যতম উপায়”। (পৃঃ ১৬)।
স্বাতী প্রশ্ন তুলেছেন—কোনটা নাগরিকদের অধিকার কোনটা নয়? যেমন কোন জায়গায় নেমন্তন্নের আশা করে ডাক না পেলে মন খারাপ হয় বটে, কিন্তু ‘নেমন্তন্নের ডাক পাওয়া’ কি অধিকারের মধ্যে পড়ে?
আবার গ্রহীতার দিক থেকে উঠেছে আত্মসম্মানের প্রশ্ন। স্বাতী দেখিয়েছেন অপারগ না হলে অনেকেই অনুদানের লোভ করবেন না। কোভিডে ফুড কিচেনের সময় দিল্লিতে বা কোলকাতায় রেড বিগ্রেডের ক্যান্টিনে ফ্রিতে খাবার খেতে অনেকেই লজ্জা বোধ করেছেন। কেউ চেয়েছেন বদলে কোন কাজ করে দিতে, কেউ চেয়েছেন কিছু দাম দিতে।
কিন্তু স্বাতীর প্রশ্নঃ কেন আর্থিক রূপে সম্পন্ন অনেক পরিবার এলপিজি গ্যাসের অনুদান স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে চান না? কেন সেটাকে নিজের অধিকার মনে করেন?
এখানে আমি স্বাতীকে একটি প্রশ্ন করতে চাই।
ইদানীং যে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ নিয়ে জোর তর্কাতর্কি চলছে যার মানে বোধহয় আমি হরিদাস পাল এবং গৌতম আদানী –দুজনেই রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট আয় বা ভাতা (ধরা যাক দশ হাজার টাকা) পাব, সেটাকে উনি কীভাবে দেখবেন?
বার্কলের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রণব বর্ধন এর স্বপক্ষে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় একগাদা প্রবন্ধ লিখেছেন।
সাবভার্সিভ রাইটিং বা চোরাগোপ্তা অবধারণা
আমার ব্যক্তিগত মত –এই বইটি একটি সাবভার্সিভ রাইটিং, অবশ্যই সদর্থক অর্থে। আশা করি স্বাতী অপরাধ নেবেন না। কথাটা আমার মনে হয়েছে স্বাতী যেভাবে ‘হ্রী’ শক্তির আলোচনা শুরু করে ‘লজ্জিত রাষ্ট্র’ তত্ত্বটি দাঁড় করিয়েছেন তার থেকে। এটি আমার মত সাধারণ পাঠকের অনুদান নিয়ে চিন্তার মূল ধরে নাড়া দিয়েছে।
অনুদান কাকে বলে?
আমার মনে হয়, যদি নাগরিকের (ব্যক্তি বা সমুদায়ের) কোন বস্তু বা পরিষেবার ব্যয় (আংশিক বা পুরোপুরি) উপভোক্তার বদলে সরকার বা রাষ্ট্র বহন করে তাহলে সেটুকু অনুদান বলে ধরতে হবে; এতে সাবসিডি (ভর্তুকি) এবং গ্রান্ট( দান) দুটোকেই সামিল করতে হবে। অর্থাৎ নাগরিকের কাঁধ থেকে খরচের বোঝা কমে গিয়ে যতটুকু সরকারের কাঁধে চাপল তার সবটাই দাতার (রাষ্ট্রের) কাছ থেকে গ্রহীতাকে (নাগরিককে) দান দেওয়া।
সেই দান কতটুকু?
বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফেই এর একটি ছবি এঁকেছেন স্বাতী। জনৈকা বাগদী বৌ দিনের শুরু থেকে শেষ অব্দি হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন এ অফিস থেকে সে অফিস, তাঁর কাঁধের ঝোলায় নানান দলিল-দস্তাবেজ-কার্ড। আধার, ভোটার, রেশন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড তো এলিমেন্টারি। তিনি নিজে পান ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার,’ ‘আনন্দধারা’; তাঁর কৃষক স্বামী পান পি এম কিসান কার্ডে বছরে ছ’হাজার, জন্ম থেকে অসুস্থ একটা বাচ্চা পাবে ‘মানবিক’ প্রকল্পে মাসে হাজার টাকা, ছেলে পাচ্ছে যুবশ্রী ভাতা মাসে দেড় হাজার। মেয়ে পাচ্ছে পড়াশুনা ইত্যাদিতে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি। এগুলোর কি অপব্যবহার হচ্ছে? স্বাতীর উদাহরণে ছেলেটি ওই টাকায় মোবাইল রিপেয়ারিং দোকান খুলেছে। স্বপ্ন দেখছে ইলেক্ট্রিক্যাল রিপেয়ারিং এর ব্যাপারে টেকনিক্যাল ডিপ্লোমার জন্যে ভর্তি হতে।
সমাজের আয়কাঠামোর নিচের দিকের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেকখানিই জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বদান্যতার ছোঁয়া।
নির্মল শৌচাগারে গ্রামের মানুষের প্রাতঃকৃত্য থেকে শুরু করে আদিবাসীদের কুয়ো বানাতে অনুদান, আবাস যোজনায়ও সবার মাথার উপরে ছাদ বানিয়ে দেওয়ার অনুদান। মেধাবী এবং গরীব ছাত্রদের জন্যে বৃত্তি, রিসার্চের স্কলারশিপ বা আমার মত বুড়োদের জন্যে পেনশন, একা থাকা গরীব বিধবাদের জন্যে পেনশন এগুলোও তো বিভিন্ন নামে অনুদান।
প্রশ্ন ওঠেঃ এই যে আমরা যারা বিভিন্ন খাতে বিভিন্ন সময়ে হাত পেতে রাষ্ট্রের অনুদান নিচ্ছি এতে আমাদের আত্মসম্মানে ঘা লাগে না? আমাদের এভাবে রাষ্ট্রের বদান্যতায় লজ্জা করে না?
লজ্জা? কার লজ্জা?
মরেচে! আমার রোগ হল যেকোনো ইস্যুতে একটা গল্প না বলে থাকতে পারিনে।
তারাশংকরের সেই রাঢ় এলাকার জিপসীদের মত ভবঘুরে নাচ দেখানো বাজিকরী মেয়েটির গল্প মনে করুন। সেই যে এক পুলিশের সেপাই এবং অমনই কিছু পুরুষ মেয়েটিকে একটু আড়ালে নিয়ে কিছু পয়সা ধরিয়ে নগ্ন নৃত্য করতে বলেছিল। মেয়েটি নাচতে নাচতে গাইছিলঃ
" হায় গো মরি বস্ত্র হরি তুমি মোরে লাজ দিবা!
তোমার লাজে আমি মরি নইলে আমার লাজ কিবা।"
লজ্জা কার পাওয়া উচিৎ?
দার্শনিক বৃন্দা ডালমিয়ার তত্ত্বের হাত ধরে স্বাতী সওয়াল করেন কেন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে অমৃত মহোৎসবের যুগেও বিশাল সংখ্যক নাগরিককে রাষ্ট্রের অনুদানের ভরসায় বেঁচে থাকতে হয়? কেন তাদের শিক্ষায় এবং উপযুক্ত ইকোসিস্টেমের নির্মাণের মাধ্যমে আজও ক্ষমতাবান করে তোলা গেল না?
তাহলে লজ্জা তো দাতা-রাষ্ট্রের পাওয়া উচিৎ , গ্রহীতা-নাগরিক কেন লজ্জা পাবে?
কিন্তু এভাবে কি আমরা এক পরজীবী শিরদাঁড়া- নোয়ানো নাগরিক সমাজের দিকে নেমে যাচ্ছি না?
স্বাতী তা মনে করেন না। কারণ উনি দেখেছেন কোভিড লকডাউনের সময় কীভাবে বিভিন্ন সেবা সংস্থা পরিচালিত লঙ্গরে দিনের পর দিন মিনিমাগনায় খেতে মানুষ লজ্জা পেয়েছেন। কোথাও তাঁরা পয়সার অভাবে গায়ে খেটে দিতে চেয়েছেন অথবা সুলভ মূল্যে খাওয়ার দাম দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণ বঙ্গে রেড ক্যান্টিনে পরের দিকে গ্রহীতার যা আত্মসম্মানের অনুভূতিকে স্বীকৃতি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে খাবার দেওয়া হয়েছে।
লজ্জা যা কুণ্ঠিত করে না
বৃন্দা ডালমিয়ার মহাভারতে নৈতিকতার প্রশ্নে উঠে এসেছে সংস্কৃত ‘হ্রী’ শব্দটি, যার অর্থ ‘লজ্জা’। বৃন্দা বলছেন এ হল ‘অধর্মবিমুখতারূপ সঙ্কোচ’। এই লজ্জা স্বার্থপর হয়ে অধর্ম করতে অন্যের ক্ষতি করতে বাধা দেয়। এ হল ‘গঠনমূলক লজ্জা’। (পৃঃ ১৮)। যা আত্মগ্লানিতে লোককে কর্ম বিমুখ অবসন্ন না করে বরং অন্যের কল্যাণ করতে নিয়োজিত করে। কারণ যে নির্লজ্জ, তার আদর্শ বিচ্যুতির বোধ তৈরি হয় না, তাই নিজেকে সংশোধনের ইচ্ছাও তার হয় না। সে ভিড়ের মধ্যে অন্যকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বিরিয়ানির প্যাকেট ছিনিয়ে আনে।
এর বিপরীতে এই লজ্জা মানুষকে বিনীত করে, অকারণ সুবিধা নেওয়া থেকে বিরত করে, সকলের মধ্যে ‘সমতার দ্বারা ন্যায়ও নিশ্চিত করে’।(পৃঃ ১৯)
এই বোধ থেকে বৃন্দা বলেন ভাল চিন্তা করতে গেলে কেবল মস্তিষ্ক নয়, হৃদয় চাই। সত্য যে খোঁজে তাকে ন্যায়ের জন্য লড়তে হবে’।(পৃ-২০)
তাহলে সমতার বোধ এবং ন্যায়ের বোধ অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত!
এবার স্বাতী বলছেন ভারতে বিপুল ক্রমবর্ধমান অসাম্যের দায় রাষ্ট্রের, কারণ তার তৈরি আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোকে অবলম্বন করেই এই অসাম্য তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে, টিকে থাকছে।। অতএব, এই ব্যর্থতার লজ্জা থেকে উৎপন্ন বিনীত ভাব এবং রাষ্ট্রের কোর্স কারেকশনের চেষ্টা হিসেবেই অনুদানকে দেখা উচিত।
বিপরীতে কেউ বলতেই পারেন—ইল্লি আর কী! অনুদান রাষ্ট্রের লজ্জার অনুশোচনার ফলাফল? আমরা কি দেখিনি কীভাবে ইউপি বিধানসভার নির্বাচনের আগে সে রাজ্যের গরীবের দ্বারে দ্বারে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের দু’বান্ডিল ফুড প্যাকেজ (তাতে তেল এবং নমকও ছিল) মার্চ অবধি পৌঁছে দেওয়া হল এবং এপ্রিল থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। তারচেয়ে বড় কথা, নেতারা বুক ফুলিয়ে বলছিলেন যে এই ‘লাভার্থী’ ক্যাটেগরি ওদের ক্যাপটিভ ভোট ব্যাংক, ফল বেরোলে দেখা গেল তাঁরা খুব একটা ভুল বলেন নি।
তাহলে কি বৃন্দা ডালমিয়া এবং স্বাতীর চিন্তার ধারা ভুল? মনে হয় না।
ওঁদের মতে অনুদান অসাম্য দূর করার একমাত্র মহৌষধ নয় বটে, কিন্তু সঠিক লক্ষ্যে অনুদান অসাম্য দূর করতে খানিকটা সহায়ক হয় । কয়েক বছর আগে কোলকাতার ডঃ রণবীর সমাদ্দারের ভারতে ছ’টি রাজ্যে এ’বিষয়ে এম্পিরিক্যাল স্টাডি একই সিদ্ধান্তে এসেছে।
তবে রাষ্ট্রপরিচালক হ্রী এবং সমতার পথে হেঁটে অনুদান দিচ্ছে কিনা তা বোঝার জন্য ওঁরা দুটো লিটমাস টেস্ট রেখেছেন।
দুটো লিসমাস টেস্ট
এক, যারা ক্ষমতার বিরোধী বা অপছন্দের সেই ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীকেও বিনা -ব্যতিক্রম অনুদান দেওয়া হচ্ছে কিনা। নইলে বিভেদমূলক অনুদান অসাম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
দুই, রাষ্ট্রপরিচালকের (দাতার) দেওয়া অনুদান নাগরিকের (গ্রহীতার) থেকে কোন প্রতিদানের আশা শূন্য কিনা। উপরে আমার দেওয়া একটি রাজ্যের বিধান সভার ‘লাভার্থী’ যোজনা এই সিন্ড্রোমের ভাল উদাহরণ। অর্থাৎ স্বাতীরা গ্রাউন্ড রিয়েলিটের ব্যাপারে জাগ্রত। ওঁদের থিওরি কোন গজদন্তমিনারের বায়বীয় দার্শনিকতা নয়।
আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় স্কুলে পড়া তৈত্তিরীয় উপনিষদের শ্লোকঃ
শ্রদ্ধয়া দেয়ম্, অশ্রদ্ধয়া অদেয়ম্। শ্রীয়া দেয়ম্ ধীয়া দেয়ম্ ভীয়া দেয়ম্।।
দান যেন বিনীতভাবে নম্রতার সঙ্গে দিই, কদাপি অশ্রদ্ধা অবজ্ঞার সঙ্গে নয়।
আজকের নাগরিক, বিশেষ করে প্রান্তবাসী মানুষজন বলদর্পী রাষ্ট্রের থেকে অনুদান নেওয়ার সময় কি অনুরূপ শ্রদ্ধা আশা করতে পারে?
এবার স্বাতী একধাপ এগিয়ে অনুসিদ্ধান্ত টানছেনঃ ‘যিনি উপযুক্ত গ্রহীতা, অর্থাৎ অন্যায় অসাম্যের জন্যে যিনি ক্ষতিগ্রস্ত, বিপন্ন, তাঁর অনুদান নেওয়াই কর্তব্য। কারণ তা নাহলে অসাম্য চলতে থাকবে’। (পৃঃ ২১)
একইভাবে কোন মহিলা যদি ভাবেন যে স্বামী চাইলে তাঁর হাতে কন্যাশ্রী বা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনুদানের টাকা তুলে দিতেই হবে—সেটাও সমান ভুল। কারণ সেটা নারী-পুরুষ অসাম্যকে পোক্ত করছে।
আবার সম্পন্নরা যখন বঞ্চিতের জন্য নির্ধারিত ঘর-টাকা-জমিরূপী অনুদান নিজেরা বঞ্চিত না হয়েও নিয়ে নেন তাতে অসাম্য বাড়ে। কিন্তু অন্যেরা নিচ্ছে , রাষ্ট্র যখন দিচ্ছে তো আমি কেন ছেড়ে দেব –এই মানসিকতা তাঁদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
কিন্তু হ্রী-প্রণোদিত হয়ে বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করার মানুষও আছেন আমাদের দেশে। ভারতে এককোটিরও বেশি লোক রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি ছেড়ে দিয়েছেন। (পৃঃ- ২২)
শেষ পাতেঃ
দেখা যাচ্ছে স্বাতী অনুদানের সার্থকতা, বিফলতা সবই খুঁটিয়ে দেখছেন কেবল অর্থনীতির যুক্তি বা উপযোগিতাবাদীদের চোখ দিয়ে নয়, বরং উনি এনেছেন এর সঙ্গে নৈতিকতার প্যারামিটার। কিন্তু নৈতিকতার Absolute কোন মানদণ্ড আছে কি?
উনি মনে করেন—নেই। বৃন্দা ডালমিয়া এবং তাঁর সহযোগীরা তৈরি করেছেন ‘কেয়ার এথিক্সে’র তত্ত্ব সেটা উচিত অনুচিতের তফাতের জন্য কোন ইউনিভার্সাল অ্যান্ড নেসেসারি বিধির ধার ধারে না। মহাভারতে অনেক সময় যে আপাতবিরোধী নৈতিক আদর্শ দেখি তাঁর উদাহরণ দিয়ে এঁরা বলেন কোন পরিস্থিতিতে কে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই প্রেক্ষিতকে বুঝতে হবে।
একইসঙ্গে এঁদের এই ‘অবজার্ভেশন’ বা আধুনিক মনন – যে কোন ন্যায়সম্মত, ধর্মসম্মত কাজ কোথাও না কোথাও কোন না কোন অন্যায়ের বা অধর্মের জন্ম দেবে—আমাদের বিষণ্ণ করে। আমরা বুঝতে পারি, রাষ্ট্রনেতা যে প্রয়োজনকে স্বীকার করে অনুদান দেবে, সে অবশ্যম্ভাবী রূপে উপেক্ষা করবে আরও অগণিত প্রয়োজনকে। তাই স্তন্যটাকে ‘যদি নৈতিক হতে হয়, তবে নির্লজ্জ হলে চলবে না’।
আর অনুদান নেওয়া নাগরিক কেন লজ্জা পাবেন, বরং উদ্ধত রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করবেন—নাগরিককে যে বাধ্য হয়ে অনুদান নিতে হচ্ছে তার জন্যে রাষ্ট্র লজ্জিত নয় কেন?
এমন একটি সাবভার্সিভ বইয়ের শেষে লেখিকার অমোঘ উচ্চারণঃ
“ সলজ্জ রাষ্ট্র, সপ্রশ্ন নাগরিক, এই হল গণতন্ত্রের বুনিয়াদ”। (পৃঃ ২৪)
---------------------------------------------------------------------------------------------
বাজিকরী মেয়ের গান।