আগে মানুষ তালপাতার পুঁথি পড়ে শিখত,আজ শেখে ইউটিউব দেখে।যুগের পর যুগ,বছর,দিন বদলে যায় কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় না।আজও অনেকেই কালো বা চাপা গায়ের রংয়ের মানুষদের ‘পারফেক্ট’ পদবাচ্য বলে মনে করেন না।সমাজের সেইসব নাকউঁচু, ডিগ্রিপ্রাপ্ত অথচ অশিক্ষিত,বেয়াদপ,অসামাজিক মানুষগুলোকে সপাটে চড় কষিয়েছে দৈনিক ভাস্কর সংবাদপত্র গোষ্ঠীর একটি সিদ্ধান্ত। তা কী সেই সিদ্ধান্ত? সংস্থার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি জারি করে বলা হয়েছে বর্ণ অর্থাৎ পাত্রীর গায়ের রং উল্লেখ থাকলে পাত্র চাই-পাত্রী চাই কলামে সেই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে না।
যাঁরা ভাবছেন এ আবার এমন কী বিপ্লবের কথা? কজন লোকই বা আজকের দিনে ‘আমি সাদা তুমি কালো’ এমনধারা বিচার করে? ক’জন লোককেই বা কালো বলে গান্ধীজীর দক্ষিণ আফ্রিকা কাণ্ডের মত ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে? হলপ করে বলা যায় আজকের সময়ের নিরিখে ফর্সা,গৌর বর্ণ, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ ইত্যাদি নিয়ে যা হয়ে চলেছে তা সামাজিক অপরাধের নিরিখে কম কিছু নয়।
আর এর হাতেগরম উদাহরণ পেতে চাইলে যে কোনও রবিবার কলকাতা থেকে সর্বাধিক প্রচারিত, বহুল প্রচারিত, দ্রুত প্রচারিত জাতীয় বিজ্ঞাপন দেওয়া যে কোনও একটি সংবাদপত্র নিয়ে বসে পড়ুন। খুলে ফেলুন বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপনের পাতা।যেমন ৬ মার্চ, ২০২২ এর আনন্দবাজার পত্রিকার ‘ইত্যাদি’ ট্যাবলয়েডে একটি ‘পাত্রী চাই’ কলামের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে EB ব্রাহ্মণ 40/5’9” নর MBA নামী MNC তে উচ্চপদে কর্মরত দাবিহীন পাত্রের ফর্সা সুন্দরী সুশিক্ষিতা অনুর্দ্ধা 36 ব্রাহ্মণ পাত্রী চাই।
এইরকম যেকোনও একটি কাগজ খুলে পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনে চোখ রাখলেই আপনি বুঝতে পারবেন আজও জীবনসঙ্গী খুঁজতে জাত-পাত,গোত্রর মত অবিজ্ঞানের চাষ করার পাশাপাশি ফর্সা,গৌর বর্ণ,সুন্দর,সুন্দরীদের খুঁজে চলেছে মানুষ। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে এক এক জনের চাহিদা শুনলে খোদ সুন্দরী প্রতিযোগিতার কর্মকর্তারাও চমকে যাবেন।যেমন ‘ভাল ছেলে’র পাত্রী হতে এক কন্যাকে সুশিক্ষিত,সুচাকুরে, উচ্চ বর্ণ বা স্ববর্ণ,উপযুক্ত উচ্চতার পাশাপাশি সুন্দরী,ফর্সা,নিদেনপক্ষে উজ্জ্বল গৌর বর্ণ হতেই হবে।না হলেই নম্বর কাটা।লোকে সাদা-কালো নিয়ে মুখে বড় বড় কথা বললেও বিয়ের বাজারে কালো মেয়ে যে কেউ চায় না তার ঘোষিত প্রমাণ এই বিজ্ঞাপনগুলো।তবে শুধু পাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপন নয়, বিয়ের বাজারে দাম পেতে,মেয়েকে তুলে ধরতে পাত্রীপক্ষর বিজ্ঞাপনেও ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ,সুশ্রী,স্লিম – এইসব শব্দবন্ধের ছড়াছড়ি।
আর এইখানেই ঢাকঢোল পিটিয়ে গায়ের রং দিয়ে মানুষ (পাত্র-পাত্রী) চেনার ধারাবাহিক ব্যবস্থাকে নাকচ করে দিয়েছে দৈনিক ভাস্কর সংবাদপত্র গোষ্ঠী।বলা হয়েছে, গায়ের রং নয়, মানুষের ব্যক্তিত্বই তাঁর সৌন্দর্যের পরিচায়ক।প্রত্যেকেরই আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে,ভাবনা আছে,মর্যাদা আছে। আর এই ঘুণধরা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা।
বর্ণবৈষম্যের বিজ্ঞাপনেই পাতা রঙিন
আজও একজন মানুষের গায়ের রং তাঁর জ্ঞান,বোধ, শিক্ষা, আচরণ এমনকি কখনও –কখনও মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। আর এ প্রশ্ন তোলে শিক্ষা,সংস্কৃতিতে আধুনিক হয়ে ওঠা এই সমাজ।
জাত-পাত, ধর্ম, ভাষা, গোষ্ঠী, অঞ্চল নিয়ে দিনরাত চুলোচুলি করা ভারতীয়দের কাছে গায়ের রং একটা বড়ো ফ্যাক্টর।পরিবারে নাতি বা নাতনি ফর্সা হয়েছে দেখলে বাড়তি এক মুখ হাসি খেলেই যায় মা-বাবা,দাদু-ঠাকুমাদের।আর যদি কালোও হয় তাহলে সামনে চলে আসে সান্ত্বনা দেওয়ার সেই বিখ্যাত ছড়া—‘কালো জগতের আলো’। অন্যদিকে মেয়ে কালো হয়েছে শুনলে তো বাড়ি জুড়ে ঘোর অমাবস্যা নামে। কারণ জীবনে হাজার কঠিন পরীক্ষায় পাশ করলেও বিয়ের বাজারে অগ্নি পরীক্ষায় নামতেই হয় সে মেয়েকে - যেখানে ফর্সা মেয়ের কদর সবসমইয়েই বেশি।
বছর দুয়েক আগে এই ইস্যুতেই বড়সড় প্রশ্ন তুলেছিলেন মার্কিন মুলুকের বাসিন্দা হেতাল লাখানি। পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের বিখ্যাত ওয়েবসাইট ‘শাদি ডট কম’-এ গায়ের রং বিচার করে পাত্র-পাত্রী খোঁজার একটা ফিল্টার দেওয়া হত। তা নিয়ে প্রথমে ফেসবুকে সরব হন মেঘান নাগপাল নামের এক ‘শাদি ডট কম’ ব্যবহারকারী। ফেসবুক পোস্ট দেখেই ‘শাদি ডট কম’-এর এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পিটিশন দায়ের করেন হেতাল লাখানি। পান বহু মানুষের সমর্থন। আর তার জেরেই ওয়েবসাইট থেকে গায়ের রং-এর ফিল্টারটা সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় এই ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট।
ভেবে দেখুন রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার সনদ ঘোষণার প্রায় ৭২ বছর পরে আমরা জীবনসঙ্গী নির্বাচনের জন্য গায়ের রংয়ের হিসেব করছি। পাত্র-পাত্রী কলামে মহিলাদের উচ্চতা কিংবা গায়ের রং দিয়ে বিচারের প্রবণতা নিয়ে নানা ক্ষেত্রে নানা সমালোচনা হলেও ( জাত-পাত-গোত্রর প্রসঙ্গ না হয় এই প্রসঙ্গে বাদই রাখলাম) এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ করতে কাউকে দেখা যায়নি।সেখানে ব্যবসার বড় ক্ষতি হবে জেনেও দৈনিক ভাস্কর-এর এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বহু মানুষ।কারণ আমাদের মতো দেশে ফর্সা পাত্রী খোঁজার প্রথা, অপরাধেরই সমগোত্র।তবে শুধুমাত্র দৈনিক ভাস্কর কেন, একই পদক্ষেপ কেন নেবে না দেশের অন্য সংবাদপত্রও।কেন বন্ধ হবে না এমন বিজ্ঞাপন?