সমীর ঘোষ,
উত্তরের জন্য ধন্যবাদ। ভবানীপ্রসাদ সাহু ও তাঁর লেখালিখি ও পত্রিকা বিষয়ে আমার কিছু ধারণা আছে, আমি শুধু তথ্যসূত্রগুলো চেয়েছিলাম। কেন চেয়েছিলাম, সেটা হয়ত পরিষ্কার হয়নি, তাই ব্যাখ্যা করে বলি একটু। আপনি যেভাবে বছর ধরে ধরে নাস্তিকতার পরিসংখ্যান হাজির করেছেন, তা যদি সত্যি হয়, তবে তাতে একটা দীর্ঘমেয়াদি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, যা যুক্তিবাদী নাস্তিকের কাছে বাস্তবিকই হতাশাজনক। সংক্ষেপে তা এই রকম --- ১৯৯২ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০.৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ১৯ শতাংশ, ২০০২ সালে ১৫ শতাংশ, ২০১২ সালে ১৩ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১১ শতাংশ এবং ২০১৭ সালে ৯ শতাংশ। পরিসংখ্যানটি ধারাবাহিক, এবং বার্তাটি তদনুযায়ীই দ্ব্যর্থহীন, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বার্তাটি সত্য কি? প্রশ্নটা কেন জাগছে, সেই কথাটা জানাবার জন্যেই এ মন্তব্য।
এখানে ছয়টি বছরের তথ্য আছে, যার প্রথম তিনটি আপনি পেয়েছেন একটি পুস্তিকা থেকে (যা আমার হাতে নেই), এবং পরের তিনটি আপনি সংগ্রহ করেছেন উইকিপিডিয়া থেকে। দুটোর কথা আলাদা করে বলা যাক।
পুস্তিকাটি যেহেতু এই মুহূর্তে আপনার হাতেও নেই, অতএব তার তথ্যের উৎস যাচাই করার সুযোগ নেই, তাই এ ব্যাপারে আমি যা জেনেছি সেইটা বরং ব্যক্ত করি। আমার ধারণা, বিশ শতকের শেষের দিক থেকে উন্নত দেশে ধর্মবিশ্বাসের সমীক্ষা সংক্রান্ত উচ্চমানের প্রামাণ্য কাজকর্ম শুরু হয়ে গেলেও, একুশ শতকের আগে সারা পৃথিবী জুড়ে এ ধরনের গণনার অস্তিত্বই ছিল না আদৌ। ২০০৭ সালে মার্কিন ধর্ম-সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টাকরা ছোটোখাটো কাজের ফলাফলগুলোকে এক জায়গায় করে প্রথম বৈশ্বিক স্তরে একটি মোদ্দা পরিসংখ্যান খাড়া করার চেষ্টা করেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, গোটা পৃথিবীতে অবিশ্বাসী মানুষের অনুপাত মোটামুটি সাড়ে সাত (৭.৫) থেকে সাড়ে এগারো (১১.৫) শতাংশের মধ্যে হতে পারে। ফলত, ২০০২ এবং তার আগের হিসেবগুলো নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকছে।
পরবর্তী তিন বছরের তথ্য যে উইকিপিডিয়াতে পেয়েছেন, এ কথা আপনি আপনার মূল লেখায় বলেছেন, তবুও তথ্যের উৎস চেয়েছিলাম। তার কারণ হচ্ছে, উইকিপিডিয়াতে বহু জায়গায় নাস্তিকতা ও তার সমীক্ষার কথা উঠেছে, তার মধ্যে ঠিক কোনটার কথা আপনি বলছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে, আপনি সম্ভবত উইকি-র 'ডেমোগ্রাফিক্স অফ অ্যাথেইজম' শীর্ষক প্রবন্ধটির প্রথমাংশের কথাই বলতে চাইছিলেন। যদি তাইই হয়, তাহলে বলব, ওই প্রবন্ধের ওই প্রাসঙ্গিক বাক্যটিতে যে তিনটি সূত্র দেওয়া আছে সেগুলো একটু ভাল করে পড়ে নিলে আপনার হতাশা ও আশঙ্কা হয়ত কিছু কম হতে পারত। কেন, একটু বলি। আসলে, বিভিন্ন সমীক্ষায় অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু এবং স্থান-কাল-পাত্রে কিছু না কিছু সূক্ষ্ম তফাত হয়ই, ফলে অপ্রত্যাশিত ওঠানামা চলে আসে ফলাফলেও। যেমন, কেউ নাস্তিক কিনা বোঝার জন্য কোন কোন প্রশ্ন করা হচ্ছে তাতে হয়ত ফলাফল কিছু আলাদা হয়ে যেতে পারে, বা ভারত বা চিন-এর মত বেশি লোকসংখ্যাওয়ালা একটি বা দুটি দেশ সমীক্ষায় যুক্ত হলে বা বাদ পড়লেই মোদ্দা ফলাফলে অনেকটা তফাত হয়ে যেতে পারে। সেইজন্যে, 'অ্যাথেইস্ট' বা 'নাস্তিক' বর্গটির চেয়েও আজকাল বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে 'নন রিলিজিয়াস' বা 'ধর্মমুক্ত' বর্গটি। কঠোর নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী, যিনি নিজেকে নাস্তিক বলেন না কিন্তু কোনও ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মে যোগও দেন না এই ধরনের লোকজন --- এদের সকলকে মিলিয়ে তৈরি এক বৃহত্তর বর্গ এই 'নন রিলিজিয়াস'। এই বর্গটির মধ্যে দিয়ে ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অনেক বেশি প্রকাশ পায়, এটা আজ অনেকে মনে করেন। এভাবে যদি দেখেন, তাহলে এই একই সমীক্ষাগুলোর অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরুন, সেক্ষেত্রে ২০১২ সালের হিসেব দাঁড়াবে ৩৬ (২৩+১৩), ২০১৫ সালের হিসেব দাঁড়াবে ৩৩ (২২+১১), এবং ২০১৭ সালের হিসেব দাঁড়াবে ৩৪ (২৫+৯)। পাঁচ বছরের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসে বিরাট কিছু তফাত হবার কথা ছিল না, এবং হয়ওনি, কিন্তু ২০০৭ সালের সঙ্গে তফাতটা খুব পরিষ্কারভাবেই দৃশ্যমান (ওপরে দেখুন)। এখানে আরও বলে রাখি, উইন গ্যালাপ-এর মত নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা-উদ্যোগ আরও আছে, যেমন 'পিউ ফোরাম', 'ডব্লু ভি এস' (ওয়ার্ল্ড ভ্যালু সার্ভে) --- এবং এদের করা সমীক্ষাগুলোর ফলাফলও উইন-গ্যালাপ-এর ফলাফলের চেয়ে খুব বেশি আলাদা নয়। এমন কি, ২০১৭ সালের পরেও আরও সম্প্রতি একাধিক সমীক্ষা হয়েছে, এবং সেখানেও ফলাফল পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
সবশেষে বলি, এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনও সুযোগ রাখতে চাইনা। পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন, আপনার লেখাটি যুক্তিবাদ নাস্তিকতা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার পক্ষে বলেই মনে করি, এবং আমি নিজে এ অবস্থানের আন্তরিক সমর্থকও। আমার বক্তব্য শুধু এই যে, মৌলবাদী তাণ্ডবের আড়ালে ঐতিহাসিক প্রগতির মোদ্দা শক্তিগুলো বোধহয় মোটের ওপর প্রত্যাশামতই কাজ করছে, এবং হতাশাগ্রস্ত হবার কারণ নেই আমাদের।
অবশ্য তার মানে এও নয় যে, দুশ্চিন্তা করার মত কিছুই নেই। সারা পৃথিবীতেই গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর মৌলবাদী আক্রমণ যেভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তাতে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা কঠিন তো বটেই। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অবস্থা যে খুবই খারাপ, তাতে সন্দেহ নেই।
শেষতক আমার মোদ্দা কথাটা এই যে, মৌলবাদী জঙ্গিপনা ও ধর্মান্ধ হিংস্রতার যে চিত্র আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি তা অবশ্যই বাস্তব এবং গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা এক আংশিক ও স্বল্পমেয়াদি প্রবণতা। এ প্রবণতা সম্ভবত আমাদের বৈশ্বিক ইতিহাসের কোনও সামগ্রিক, দীর্ঘমেয়াদি ও নিষ্পত্তিমূলক গতিপ্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করেনা।