মায়েরা ডাকে (পর্ব চার)
সোনার কাঠি রুপোর কাঠি
মা বোধহয় ভেবেছিল, এই যে বড়মামা এত হৈ হৈ করে, আমায় ছুরি দিয়ে সব্জি কাটা শেখায়, আর বড়মামা এলেই আমি ছিনেজোঁক হয়ে বসি, ফায়ার ব্রিগেডের রোমহর্ষক সব গল্প শুনব বলে - সেই মামা সৎ শুনে আমার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে। অথবা লাবণ্য, দাদুর ঘর ছেড়ে উদ্বাস্তু কলোনিতে গিয়েছিলেন শুনে আমি শ্রদ্ধা হারাব। তাই কথাগুলো বলতে চাইতোনা। কিন্তু মা সেই সীতার কাল থেকে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েটা উদ্বাস্তু নয়? মা তুমি ন হন্যতে পড়োনি। আমি ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে এনেছিলাম। পড়লে বুঝতে ঐ বইতে মৈত্রেয়ী দেবী কিভাবে নতুন যুগ আর মুক্ত চিন্তাকে কুর্নিশ করেছেন। মা বি এ পাশ করেছিল বিয়ের পরে, কিন্তু আরও পড়া হলনা বলে হাহুতাশ করত। মাকে সান্ত্বনা দিতাম। এই লকডাউনে সব ফাঁকা হয়ে যাবার পরে মায়ের স্মৃতিগুলো বড় বেশি ভিড় করে আসে আজকাল। যে প্রশ্নগুলো ভুলে গিয়েছিলাম সেগুলো আবার ফিরে আসে। লাবণ্যর হারমোনিয়ামটা কোথায় গেল? লাবণ্যর উলবোনার বইটা কোথায় গেল? মেয়েদের ঠিকানা বদলায়, তাই সব গুছিয়ে রাখা যায়না। আচ্ছা, লাবণ্যর রুপোর সিঁদুর কাঠি দিয়ে মা চিরকাল সিঁদুর পরত। উল্টো দিকে টিপের গোলটা সিঁদুরে ডুবিয়ে টিপ পরত। একটু খানি নাকে ঝরে পড়ত। আমার বিয়েতে ঐ সিঁদুর কাঠি মা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরে বাড়ি বদল করতে গিয়ে ঐ সিঁদুর কাঠিটা হারিয়ে গেছে। তাহলে কি লাবণ্যর কোনো কিছুই আমার কাছে রইলনা? বুক ঠেলে কান্না আসে। কিন্তু চোখটা শুকনো রাখতে হয়। কান্নার কারণ জানলে বাড়িতে সকলে হয়তো হাসবে। লকডাউন একটু শিথিল হতেই পাগল হয়ে রুপোর দোকানে দোকানে ঘুরি।
- দাদা আমি একটা রুপোর সিঁদুর কাঠি করাব।
- অনেক আছে, নিন না, কোনটা নেবেন।
- এরকম এতো হাল্কা নয়। আমি ছবি এঁকে দেব। সেই রকম বানিয়ে দিতে হবে।
- সম্ভব নয়।
- কেন সম্ভব নয়?
- আপনি ক্ষেপেছেন দিদি? একটা সিঁদুর কাঠি অর্ডার নিয়ে কোনো কারিগর করতে চাইবেনা। সেই সময়ে ওর একশোটা ছাঁচে ঢালা বানানো হয়ে যাবে। কেউ যদি করেও, সে এত মজুরি চাইবে, আপনার পোষাবে না।
- পোষাবে, দেখুন না যদি হয়।
- যা হবেনা, তা কিকরে আশ্বাস দিই দিদি। আপনি অন্য কোথাও দেখুন।
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ঘুরে মরি। বাড়িতে সবাই জিজ্ঞেস করে, কোথায় গিয়েছিলে? কিছু বলতে পারিনা। কর্তা বলেন, দেখছ একটা অতিমারী চলছে। ল্যাপটপে বসে ছাত্রছাত্রীদের বড় বড় কথা বলছ, আর নিজে ঘুরে বেড়াচ্ছ? ডিসগাস্টিং। উত্তর নেই আমার। পূর্ণ থাকলে মন সব ছেড়ে দিতে পারে, উদার হয়, আর শূন্য হয়ে গেলে আঁকড়াতে চায়। রাতে ঘুম আসেনা, এপাশ ওপাশ করি। ছেঁড়া তন্দ্রায় আবার স্বপ্ন দেখি। একটা সোনার সিঁদুর কাঠি পালকের মতো ভেসে চলেছে, তার পিছনে ভেসে যায় মায়ের প্রাইজের বইগুলো। তন্দ্রা কেটে যায়। অন্ধকারে ধড়মড় করে উঠে বসি। হঠাৎ মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন আসে। আচ্ছা! মায়েরা যখন অশোক নগর গেল, তখন এবাড়িতে সব পড়ে রইল। কিন্তু প্রথম শ্রেণী থেকে মায়ের প্রাইজের বইগুলো থেকে গেল কি করে? মার নিশ্চয়ই পেটে খিদের জ্বালা নিয়ে ওসব মনে ছিলনা। তার মানে লাবণ্যই হাজার ঝড়ে ওগুলো বাঁচিয়ে রেখেছিল। ঐ বইগুলো মা আর দিদা দুজনের স্মৃতি। সবকিছু হারায়নি তবে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে আলো জ্বেলে মুখে ঘাড়ে জল দিই। ডিভানে মেয়ের হারমোনিয়ামটা পড়ে আছে আলগোছে। আমার বাবা নাতনির জন্য কিনে দিয়েছিল। বাবার এক পেশেন্টের বাজনার দোকান ছিল। তার কাছ থেকে কিনেছিল ভালো হারমোনিয়াম,তবে সেকেন্ড হ্যান্ড। আবার ঐ সোনার কাঠিটা উড়ে বেড়ায়। আরে এটাও তো হাত ঘোরা হারমোনিয়াম। আমার লাবণ্যর না হলেও অন্য কোনো লাবণ্যর ছোঁয়া আছে এতে। তার মানে সিনেমার মতো হারমোনিয়াম আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে সেই কবে, এতদিন বুঝতে পারিনি, অন্ধ হয়ে ছিলাম। দেয়ালে বাবার ছবিটা ঝোলে। বাবার তো মা ছিলনা। জ্ঞান হবার আগে মা মারা গেছে, বড়মামার মতো। কিন্তু বড়মামার লাবণ্য ছিল। ঠাকুরদাতো আর বিয়ে করেনি। তারপরে নিজেরই হাসি পেয়ে যায়। বড়মামা তো প্রথম সন্তান, আর বাবা সবচেয়ে ছোট। বাবার জন্য বৌদিরা মানে আমার জ্যাঠাইমারা ছিল। আর ভগবান সব তুল্যমূল্য করে দেন। ঐ জন্যই বাবার ছেলে নেই শুধু মেয়ে। ঠাকুমার নামটা জানি, হেমনলিনী। একটাই ছবি আছে। বাবার মামার বাড়ি যেতাম, আড়বালিয়ার পাশে শুকপুকুরিয়ায়। মা মরা ভাগ্নের আর তার পরিবারের খুবই আদর ছিল ওখানে। আচ্ছা ঠাকুমা স্থূল দেহে ছিলনা ঠিকই, তবে আদর যা পেলাম, সে তো হেমনলিনীর ভাগেরই। লকডাউনে বাবা মারা যাবার পর শুকপুকুরে যাই। আধখানা চাঁদের মতো সেই উঁচু লাল দালান আগে খোলা ছিল, এখন গ্রিল বসেছে। এমাথা, ওমাথা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে দালানে উঠি হাঁটুর ব্যথা ভুলে। এঘর ওঘর থেকে কাকা কাকিমারা বেরিয়ে আসে। অন্তরঙ্গ গল্পগাছা চলে, যেমনটা চলত বাবা মায়ের সাথে। যেন আমিই বার্তালাপ চালিয়েছি এতকাল, কয়েক দশকের অদর্শন কিছু নয়। কাকা কাকিমাদের আছে আজ আমিই দাদা বৌদি। বাবার বড়মামা একটা পারিবারিক রুপোর পকেট ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন বাবাকে। বাবা লেখাপড়ায় ভালো ছিল, জলপানি পেত। ডবল প্রমোশন পেয়েছিল পাঠশালায়। তেমন কোনো উপলক্ষে হবে হয়তো। সেই ঘড়ির রুপো দিয়ে বাবা একটা হার করে দিয়েছিল মাকে, সেটাতো আছে আমার কাছে। বলা যেতে পারে, ওটা হেমনলিনীর স্মৃতির একটা সূত্র। এতদিন তো এভাবে ভাবিনি। স্বপ্নে একটা সোনার কাঠি এসে কি যে করে দিল, বহু প্রজন্মের মায়েদের অনুভব করতে পারছি এখন। বংশলতিকাতে মেয়েদের নাম তো থাকেনা তেমন। যেন তাঁদের অস্তিত্বই নেই। কিন্তু বাবাদের মতোই তাঁরা আমাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছেন প্রবলভাবে।
কার চোখে কত জল কে বা তা মাপে
মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনীর বইগুলো আজকাল বার করে প্রায়ই পড়ি। আমারও এমন লিখতে ইচ্ছে করে। এও বিশ্বাস করি আমার মা কৃষ্ণা আর লাবণ্যর আরও বেশি লেখাপড়া হলনা - এই আক্ষেপটাই আমাকে এম এস সি, এম ফিল, পি এইচ ডি পার করিয়ে অধ্যাপিকা করেছে। হেমনলিনীর বাপের বাড়ির রুপোয় গড়া হারটা পরি। আয়নায় চোখ পড়ে যায়। দেখি আমার পিছনে দেওয়ালে কৃষ্ণা, গলায় হেমনলিনী, হাতে কুমুদিনী, আর আয়নায় লাবণ্য। সব শূন্যতা ঢেকে গিয়ে, নিজেকে ভীষণ পূর্ণ লাগে। কন্যার ডাক ভেসে আসে।
- কি বলছিস? তোর ক্লাস চলছে তো।
- আরে মিসের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে, কানেকশন কেটে গেছে। আজ আর ক্লাস হবেনা।
- হবেনা তুই জানিস? ওয়েট কর।
- হ্যাঁ রে বাবা, হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে মিস বলে দিয়েছে কাল নেবে। ওমা! একটু ছাদে চলনা।
- এখন? ঐ উঁচু ফ্ল্যাটের ছাদে, অন্ধকারে?
- মা, প্লিজ প্লিজ, মোবাইলে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ টনটন করছে।
- আচ্ছা চল।
আঁধার ছাতে চুল এলোমেলো করা হাওয়া দেয়। এখানে আকাশে আজ মেঘ কম। কৃষ্ণপক্ষের মৃদু চাঁদ আর অজস্র তারার মেলা। কন্যা হঠাৎ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমায়, ওপরে আঙ্গুল দেখিয়ে নতুন শেখা কবিতা বলে - দেখো মা -
হাওয়া বয় শনশন তারারা কাঁপে
হৃদয়ে কি জং ধরে পুরোনো খাপে
কি বললি বাবু! মনে হঠাৎ একটা ফুলঝুরি জ্বলে ওঠে। মেয়েকে আঁকড়ে ধরে ওর কাঁধে চিবুক রেখে আকাশে চোখ পেতে দিই। ওগো প্রেমেন বাবু আজ নতুন করে তোমার কথার মানে বুঝেছি আমি।
হাসিখেলা দুখমেলা স্মৃতির বাঁকে,
আঁখিতারা তারা জুড়ে মাকেই আঁকে।
হৃদপাতে সরোবর - হোথা মায়েরা থাকে।
সমাপ্ত
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।