এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ভ্রমণ

  • গন্তব্য চড়িদা - ৩

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ভ্রমণ | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ৩৭২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • আমরা শুনলাম আজকাল হোটেলের সঙ্গে ছৌনাচের দলের যোগাযোগ থাকে। পর্যটকদের দল উৎসাহী হলে ছৌশিল্পীরা সাম্মানিকের বিনিময়ে নাচ দেখিয়ে যান। আগে নিয়ম ছিল অন‍্যরকম। ছৌ শিল্পীরা সারা চৈত্র মাস ধরে অনুশীলন করতেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে সারা বৈশাখ মাস ও জ্যৈষ্ঠ মাসের তেরো তারিখে অনুষ্ঠিত রহিন উৎসব পর্যন্ত ছৌ নাচ নাচা হত।পুরো পুরুলিয়া জেলায় চৈত্র মাসে শিবের গাজনে ছৌ নাচের আসর ছিল প্রধান আকর্ষণ। ছৌনাচের মূল রস হল বীর রস ও রুদ্র রস। উৎসবে, পরবে গ্রামের মানুষ খোলা মাঠে গোল হয়ে বসে, বীররসে জারিত নৃত‍্যের মাধ‍্যমে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন উপভোগ করে।তবে শহরে আয়োজিত হলে সাধারণত মঞ্চ বেঁধেই ছৌ নাচ দেখানো হয়। আজকাল পেটের দায়ে শুধু পরবে নাচ করা উঠে গেছে। সম্বৎসরই চলছে দর্শক মনোরঞ্জন। আমরা আমাদের হোটেলের ম‍্যানেজারের কাছে খোঁজখবর নিলাম সামনাসামনি ছৌনাচ উপভোগের কোন সুযোগ পাওয়া যেতে পারে কিনা। ম‍্যানেজার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানালেন, অবশ‍্যই ছৌনাচের আয়োজন সন্ধেবেলা করা যেতে পারে, একঘন্টার মহিষাসুর মর্দিনী পালার সম্মান দক্ষিণা বেশ কয়েক হাজার টাকা। টাকাটা যেহেতু ছাত্রছাত্রীদের, আমরা অনুরোধ করেছিলাম একটু কমসম করা যায় কিনা। হোটেল মালিক নিজ এসে জানালেন, যে দলটি আসে, তার কুড়িজন সদস্য। তাদের টিফিন খরচ উনি পকেট থেকেই দেন, কারণ পুরুলিয়ার এই সংস্কৃতি বাইরে ছড়িয়ে পড়ুক, এটাই তাঁর মনোবাসনা। গাড়িভাড়া দিয়ে এই সামান্য টাকায় সদস্যদের পঞ্চাশ একশ টাকা হয়তো ভাগে পড়ে। তাই টাকা কোনমতেই কমানো যাবেনা। পরিস্থিতি বুঝে আমরা ঐ টাকাতেই রাজি হলাম। যে সন্ধেয় নাচ হবার কথা, সেদিন সারাদিন আমরা ঘুরে বেড়ালাম প্রথমে জয়চন্ডী পাহাড়, তারপর রঘুনাথপুরের তসর থান বোনার জন্য বিখ্যাত তাঁতীপাড়া। এরপর গড় পঞ্চকোটে লাঞ্চ। তারপর একটুও না থেমে সোজা বরুন্তির বাঁধের জলে অপরূপ সূর্যাস্ত। যাবার সময়ে পুরুলিয়া শহরে ঢুকিনি। বাইপাস হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে পুরুলিয়া শহর দেখতে দেখতে, সাহেব বাঁধের চারপাশে এক চক্কর দিয়ে এলাম। আর কিমাশ্চর্যম, পুরুলিয়ার রাস্তায় খানাখন্দ কিচ্ছুটি নেই, কোন ময়দানবের হাতের ছোঁয়ায় রাস্তা একেবারে মাখন মসৃণ, রাস্তার মেঝেতে হলুদ আর ধারে ধারে কমলা ইন্ডিকেটর, নানারকম সাইনবোর্ড, দিক নির্দেশ। আসলে এমন অভ‍্যেস নেই তো, পশ্চিমবঙ্গের এমন মারকাটারি হাল দেখলে অবাকও লাগে আর খুব আনন্দও হয়। সকাল আটটায় বেরিয়ে রাত আটটায় বুক ভরা অক্সিজেন নিয়ে যখন হোটেলে ফিরলাম, তখনও সকলে এনার্জিতে টগবগ করছে। হোটেলে ফিরে দেখি ছৌনাচের দলটি প্রস্তুত হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।হোটেলের দুটি বিল্ডিংয়ের মধ‍্যে শান বাঁধানো উঠোন। তার ডানদিকের ধারে বসল বাজনদারের দল। মূল গায়ক দেখলাম অন্ধ। বাঁদিকে হোটেলে ঢোকার চওড়া টাইলড করিডোর। বেশ কিছুক্ষণ রিদমিক বাজনার কনসার্টের পর সেই করিডোরের দিক থেকে ছুটে এসে উঠোনে পরপর ডিগবাজি দিয়ে ছৌনাচের কুশীলবেরা নাচ শুরু করলেন।প্রথমেই হল গণেশ বন্দনার সঙ্গে গণেশের নৃত্য। গণেশের পর দেবসেনাপতি কার্তিক নৃত‍্য সহযোগে দর্শকদের সঙ্গে পরিচয় করলেন। মাঝে আবার প্রজাপতি ব্রহ্মা এসে মহিষাসুরকে বর দিয়ে অমিত শক্তির অধিকারী করে তুললেন।তারপরেই ছ ছটি ভীষণ দর্শন সবুজ রঙের ঝলমলে অসুর মধ‍্যমণি মহিষাসুরকে ঘিরে ঘিরে  আমাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে নাচতে লাগল। দেবসেনাপতি কার্তিকের সঙ্গে তাদের ভয়ানক যুদ্ধ হতে লাগল। এক ফাঁকে কার্তিকের বাহন ময়ূরও সোলো ডান্স দেখিয়ে গেল।  না কোন জিমন‍্যাসটিকস ম‍্যাট, না বালি না নরম মাটি। দেবতা আর অসুর পাল্লা দিয়ে শান বাঁধানো উঠোনের ওপর একটা দুটো তিনটে চারটে ভল্ট দিতে লাগল, কাকে ছেড়ে কার দিকে দেখি। ছৌনাচের দলপতিই মহিষাসুর। লাউড মিউজিক আর সপ্তম সুরে গানের সঙ্গে ধুয়ো ধরা গাইয়ের দল মুখে থাবড়া দিয়ে দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে হা-বা-বা-বা রব তুলল। সেই সুরকম্পনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মহিষাসুরের কাঁধ হাত বুক পেট কম্পিত হতে লাগল। লক্ষ্মী সরস্বতীও যুদ্ধে যোগ দিলেন। কিন্তু মহিষাসুর কে থামাবে কে? সে তো জিতেই চলেছে। আসলে ছৌ নাচে মুখে মুখোশ থাকার ফলে মুখের অভিব্যক্তি প্রতিফলিত হয় না। তাই শিল্পী অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কম্পন ও সঙ্কোচন - প্রসারণের মধ্য দিয়ে চরিত্রের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে থাকেন। ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য ছৌ নাচের অঙ্গসঞ্চালনকে
    ১। মস্তক সঞ্চালন, 
    ২। স্কন্ধ সঞ্চালন, 
    ৩। বক্ষ সঞ্চালন, 
    ৪। উল্লম্ফন এবং 
    ৫। পদক্ষেপ এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেছেন। 
    বাজনার তালে হাত ও পায়ের সঞ্চালনকে বলে চাল। ছৌ নাচে মুখোশ ও চরিত্র অনুযায়ী দেবচাল, বীরচাল, রাক্ষসচাল, পশুচাল প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের চাল রয়েছে। চালগুলি আবার নানা ভাগে বিভক্ত - যেমন ডেগা, ফন্দি, উড়ামালট, উলফা, বাঁহি মলকা, মাটি দলখা ইত‍্যাদি। যাই হোক এসব থিয়োরির কথা ভুলে আমরা তখন যুদ্ধ দেখতে ব‍্যাস্ত। শেষে চারপেয়ে বিশাল সিংহ এসে হাজির হল। বিশাল না হয়ে উপায় কী? ভিতরে দু দুটো প্রমাণ মাপের মানুষ। দেবতা, অসুর উভয়ের হাতেই অস্ত্র ছিল।ছোট পরিসরের মধ্যে অতজন শিল্পী কবজির মোচড়ে এমনভাবে তলোয়ার বনবন করে ঘোরাচ্ছেন দেখে তাজ্জব হতে হয়। শেষে যখন করিডোরের মুখে লাল বেনারসি পরা দুর্গাঠাকুরকে দেখা গেল, ততক্ষণে একটা যেকোনো মুখোশ আর অস্ত্র পেলেই আমরা যে কোন একটা চরিত্রে যুদ্ধে নেমে পড়ি এমন অবস্থা। মনে মনে সারা জীবন ধরে কে না যুদ্ধ করে? একবার হারেরেরে করে নেমে পড়ে মনে পুষে রাখা শত্রুকে কচুকাটা করতে পারলে বেশ হত। একঘন্টা ধরে নাকের ডগায় লাইভ যুদ্ধ সহ‍্য করা কি চাট্টিখানি কথা! যা হোক, শেষে এক ভয়ানক যুদ্ধের মাধ‍্যমে মহিষাসুর অক্কা পেল। মা দুর্গা ব‍্যালান্স করে সেই বিশাল সিংহের পিঠে উঠে পড়লেন, আর অমনি তাঁর ঝলমলে ছেলেমেয়েরা আর তাঁদের বাহনরা পজিশন নিল। আমার ছেলেমেয়েরা থুড়ি ছাত্রছাত্রীরাও হৈ হৈ করে উঠোনে নেমে পড়ল। ওরা মনে হয় এতক্ষণ আমার ভয়েই চুপ করে চেয়ারে বসেছিল। আমারও যে যুদ্ধে নামার ইচ্ছে ছিল, সে আর ওদের মুখ ফুটে কেমন করে বলি! যদি ওরা সাহস করে নামত, তাহলে আমার পক্ষেও একী, কী করছ তোমরা বুলি তুলে যুদ্ধে নামা সম্ভব হত। যাকগে, হলনা যখন, ভেবে লাভ নেই। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ | ৩৭২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন