মায়েরা ডাকে (পর্ব দুই)
দিনগুলি কুড়োতে
কত কি তো হারালো।
সেই রবিবার বি টি রোড ধরে, ডানলপ ফেলে, সুখচর গীর্জার পাশ দিয়ে গেলাম বড়মামার বাড়ি। মা হারমোনিয়ামটা দেখে উচ্ছল হয়ে ওঠে। নিজের মনে নানা স্কেলে হরেক রকম সারেগামা বাজাতে থাকে। দেখে অবাক হয়ে যাই। মা শিখল কোথায়? আমাদের বাড়িতে তো হারমোনিয়াম নেই।
- মা, তুমি গান জানো, আমাকে তো কোনদিন বলোনি।
- গান জানিনা তো।
- তাহলে বাজাচ্ছো কি করে?
- আমার মায়ের কাছে শিখেছি। শুরু করেছিলাম। তারপর আর হলনা।
- হলনা কেন?
- হারমোনিয়াম টা হারিয়ে গেল।
- কিকরে?
- সে অনেক কথা, পরে বলব।
ছোটো করে একটা ধাক্কা লাগল মনে। লাবণ্যর হারমোনিয়াম হারিয়ে গিয়েছিল? কি এমন কথা আছে, মা বুকে চেপে আছে?
লাবণ্যর হারমোনিয়াম
কখনো অবসর পেলে, মা আমাকে খালিগলায় গান শেখাতো, যে গানগুলো লাবণ্যর কাছে শিখেছিল, যেগুলো দিদার প্রিয় গান। দু একটা বলি, তুমি কেমন করে গান করো যে গুণী, কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো। এছাড়া মেঘের কোলে, আজ ধানের ক্ষেতে, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা - এগুলো তো ছিলই।
গরমের ছুটির দুপুরে ন্যাশনাল চ্যানেলে ছোটদের অনুষ্ঠান শুরু হল। আর সকাল এগারোটায় কলকাতা দূরদর্শনের ছুটি ছুটি। যেদিন জিনিস বানানো শেখানো হত, খবরের কাগজ নিয়ে বসে যেতাম। কাগজ মুড়ে ওরিগ্যামি, শ্যাম্পুর শিশি দিয়ে পুতুল, এরকম কতো। ইস্কুলেও ওয়ার্ক এডুকেশনের প্রদর্শনীর সময়ে পুতুল বানানোর যজ্ঞ বসে যেত। সেই থেকে জিনিস বানানোর নেশা চেপে বসল। মা দেখে আর হাসে, বলে
- জানিস, আমার মায়ের ও এমন নেশা ছিল। মাছের আঁশগুলো কত কান্ড করে হাঁস বানাতো, আরও কত কিছু। সব মনে নেই। তখন তো আর পাত্তা দিতাম না। এখন ভাবি, মায়ের হাতের কয়েকটা জিনিস ও যদি রাখতে পারতাম। কিন্তু কি সব হয়ে গেল, সব হারিয়ে গেল।
- হারমোনিয়ামটা তো হারিয়ে গেছিল। জিনিসগুলো হারালো কেন? আমি বেশ দেখতাম।
- এই যে তুই বানাচ্ছিস, আমি দেখছি। তুই তো আমার মা।
- ধুর, মায়েরটা দেখবে, মেয়েরটা দেখবে, সব দেখা শুধু তোমার ভাগে। আমি দেখবোটা কি?
- কত বয়স হল রে তোর, সব দেখবি? অপেক্ষা কর। জীবন কত কিছু দেখাবে তোকে, আমি দেখতে পাবোনা।
- আমি দেখবো, আর তুমি দেখতে পাবেনা, সেটা হয়?
- আমি কি চিরদিন থাকব পাগলি? আমার মা কি এখন আছে?
- তুমি থাকবে। আমি ধরে রাখব।
- জানিস, আমি এসব হাতের কাজ এতো পারিনা। ভাল্লাগেনা। মা বলতো, কিছু সৃজন করা ভালো রে খুকু। যার হাত সৃজন করেনা, সে বাঁধা গতে চলা, বোকা হাতের মানুষ। আমি পারিনি। কিন্তু তুই যখন পারছিস, লেখাপড়া বাঁচিয়ে যা প্রাণে চায় কর।
- আচ্ছা মা, মাসিমণি যে এত সুন্দর রথ সাজিয়ে দেয়, ঝুলন করে, এটাও কি সৃজন?
- অবশ্যই।
- আর ছোটোমামা যে যাত্রা করে। সেটাও সৃজন?
- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই চরিত্র কে ফুটিয়ে তোলাও সৃজন। তোর দাদুও অভিনয় করত সিনেমায়, থিয়েটারে।
- তাই নাকি?
- হ্যাঁ, আমার আর ছোড়দার দুজনেরই গলায় সুর ছিল, মায়ের কাছে শিখতাম। আর হলনা। ছোড়দা এখন মঞ্চে ওর ঐ না পাওয়া গুলো পুষিয়ে নেয়।
বাড়িতে সোভিয়েত নারী পত্রিকা আসত, মোম মোম পাতা, পাতায় পাতায় উজ্জ্বল রঙিন ছবি। সেখানে এক ধারাবাহিক পড়তে পড়তে মাকে বলে দিলাম, আজ থেকে তুমি ইভদোকিয়া আর আমি নাতালিয়া। মা মেনে নিল। ইস্কুলের লাইব্রেরিতে পেলাম ম্যাক্সিম গোর্কির "মা", সহজ বাংলা অনুবাদ। তারপরই নতুন ঘোষণা করে দিলাম,
- মা! এবার থেকে মা নয়, তোমাকে নেনকো বলে ডাকব।
- আবার বই পড়ে ডাক বদলাচ্ছিস?
- ডা, মানে হ্যাঁ।
বাড়িতে বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে অনেক গুলো ডিক্শনারী ছিল। সেখান থেকে এ টি দেবের ইংরেজি থেকে বাংলা ডিকশনারির শেষে দেখলাম গ্রিক আর রুশ বর্ণমালা রয়েছে। ব্যাস আর আমায় পায় কে? দিনরাত নতুন বর্ণমালা মকশো চলল রাফ খাতায়। প্রগতি প্রকাশনের রুশ গল্পের বাংলা অনুবাদ যত আছে, সব নিয়ে খাটে ছড়িয়ে বসলাম। মলাটের পরের পাতায় বাংলার নিচে ছোট ছোট করে রুশ ভাষাতেও লেখা থাকত। উভচর মানুষ বইটার লেখক আলেকজান্ডার বেলায়েভ। রুশ বর্ণমালা মিলিয়ে দেখলাম, লেখা আছে, এ বেলায়েভ। বাংলায় মস্কোর নিচে যা লেখা আছে, তা বাংলা মতে উচ্চারণ করলে দাঁড়ায় মস্কভা - মানে মস্কো। হায় কপাল! ইস্কুলের ভূগোল বইতে লেখা আছে, মস্কো শহর মস্কোভা নদীর ধারে। ভুল, এ যা দেখছি, তাতে মস্কো শহর মস্কো নদীর ধারে। দৌড়োলাম, মাকে এই নতুন আবিষ্কার জানানোর জন্য। মা শুনে বেশ অবাক হল।
- বাবা! পড়ে ফেললি তুই।
- তুই যেমন রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস, আমার মাও এভাবে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করত।
- তাই নাকি, বলো বলো গল্পটা।
- এই হল রে! আমার এখন অনেক খাতা দেখা বাকি পড়ে রয়েছে।
- না মা, এরকম আধখানা কথা বললে হয়না। সবসময় পরে পরে করলে, আমার তো জানা হচ্ছেনা। বলো শিগগির। প্রথমে বলো, দিদা কেন ইংরেজি শিখতে চাইতো। কারণটা কি?
- তুই কেন রাশিয়ান শেখার চেষ্টা চালাচ্ছিস?
- সিম্পল। কিছু শিখলে ভালো লাগে।
- আমার মায়ের ও তাই। সবসময়ে প্রয়োজন থাকবে সেটা কেন?
- আচ্ছা, মানলাম। বাকিটা বলো।
- ছোটবেলায় বড়দা, ছোড়দা ইস্কুলে যেত। আমাকে কেউ ভর্তি করতনা। একদিন সেনবাড়িতে খেলছিলাম। দাঁতিদার বৌ ফুল বৌদি বললেন, সবসময় খেলা! বাবাকে বলে দেব, এবারে ইস্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই ধমক খেয়ে বাবা আমায় নিবেদিতায় ভর্তি করে দিল। কিন্তু ছোট ছিলাম, কেউ কিছু বলতোও না। বছরের শেষে অঙ্ক পরীক্ষায় দেখলাম, প্রশ্নে কত কিছু লেখা। কে করে ওসব! যা খুশি অঙ্ক বসিয়ে দিলাম। যোগ বিয়োগ কিছুই করলাম না। ব্যাস ক্লাস ওয়ানে ফেল করে গেলাম। বাবা গেল বলতে, যাতে ক্লাসে তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু ইন্দিরাদি খাতা দেখিয়ে বললেন, দেখুন লিখতে দিয়েছি ডুমুর, লিখেছে গুমুর। একটাও অঙ্ক করেনি। বড় গীতাদি মানে তোদের ত্যাগপ্রাণাজী বললেন, থাক একবছর। ওর ভালোই হবে। তখন উনি ব্রহ্মচারিণী ছিলেন, সন্ন্যাসিনী হননি।
আমি হা হা করে হাসি।
- মা, তোমার এত প্রাইজ। ক্লাস ওয়ানে ফেল? ওটা ফেল করার মতো কোন ক্লাস হল?
- তার পর সংসারে কাজের ফাঁকে ফাঁকে, মা আমার পড়া দেখাশোনা করা শুরু করল। আমিও টকটক করে ক্লাসে উঠতে লাগলাম। কিন্তু যখনই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত, দেখতাম, ছোটো একটা আলো জ্বালিয়ে মা আমার ইস্কুলের ইংরেজি বই পড়ছে আর ট্রান্সলেশন করছে। যখন আটকে যেত, তখন খুকু খুকু করে ডেকে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিত। কোনো শব্দের মানে জিজ্ঞেস করতো।
- তুমি কি করতে?
- ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বলে দিতাম।
- কিন্তু তুমি তো তখন ছোটো মা। সবকিছু ঠিকঠাক বলতে পারতে?
- না, সব তো পারতাম না। তাই মা সেগুলো নিজের মতো করে লিখতো, তারপর সংশোধনের জন্য ইনল্যান্ড লেটারে ছোট্ট ছোট্ট হাতের লেখায় সব ধরিয়ে রাঁচিতে আমার বড়মামার কাছে পাঠিয়ে দিত। বড়মামা আবার ইংরেজি শুধরে, ব্যাখ্যা লিখে পাঠিয়ে দিত।
- কি বলছো মা! রাঁচি থেকে চিঠি যাওয়া আসা - সে তো অনেক সময়ের ব্যাপার। বাড়িতে কেউ ছিলনা, যে একটু বলে দিতে পারে?
- কেউ জানতো নাকি? বাড়ির বৌ, কেউ যদি ছোটো বড় কথা বলে দেয়। মানে লাগবে। খুব অভিমানী ছিল তো।
মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যাই। মা যা বলছে, তার অর্থ হল বেশি লেখাপড়া শেখা হয়নি বলে আক্ষেপ ছিল লাবণ্যর। বাড়ির লোক, স্বামীকে গোপন করে, বড় মেয়ে, আর প্রবাসী ভাইয়ের সাহায্যে লেখাপড়া শেখার প্রাণান্তকর চেষ্টাটা বুঝলাম। কিন্তু স্বামীকে গোপন করা কেন? দাদু জানতে পারলে কি পড়া বন্ধ হয়ে যেত? মায়ের কাছে প্রশ্নটা উথ্থাপন করলাম। মা ধীরে ধীরে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগল।
- আমাদের বইয়ের আলমারিতে দুটো খুব পুরোনো বই দেখেছিস, নীল আর সবুজ মলাট, ওপরে সোনার জলে নাম লেখা?
- দেখেছি, পূজার ফুল, কবিতার বই, আর বোঝবার ভুল, উপন্যাস। লেখিকা কুমুদিনী বসু।
- হ্যাঁ, আমার ঠাকুমার লেখা। আরও অনেক বই ছিল। গ্রহের ফেরে সব উইয়ে কেটেছে। রক্ষা করতে পারিনি। ঠাকুমা ইংরেজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। খুব ব্যস্ত থাকতেন, সংসার দেখতে পারতেন না। তিনি ঐ যুগের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। আমার বাবা খুব কান পাতলা লোক ছিল। মা ঘর দুয়ার দেখতে পারেনা, সব ঠাকুর চাকরের ওপর নির্ভর। তাই আমার বাবার তার মায়ের ওপরে রাগ ছিল। আত্মীয় স্বজন হয়তো কিছু বুঝিয়ে ছিল। মায়ের ওপর রাগ করে বাবা ম্যাট্রিক পরীক্ষাটাও দেয়নি। পরে বড় হয়ে বাবা বিলিতি স্যাক্সবি কোম্পানিতে চাকরি পায়। অনেক টাকা রোজগার করত। আর পুরোটাই ওড়াত। ঠকেও যেত। বেলা করে বাজারে গিয়ে, শুকনো শাক, বরফের মাছ কাঁড়ি দাম দিয়ে, টাটকা বলে কিনে আনত। মা আবার লুকিয়ে, পরিচারক কাউকে বাজারে পাঠাত। এবেলার লুচি ওবেলা কেউ খাবেনা বলে ফেলে দেওয়া হত। সন্ধ্যে হলেই বাড়িতে তাস খেলার আসর বসত। কেটলি কেটলি চা আর থালা থালা জলখাবার উড়ে যেত। বাবা ব্রিজ খেলত। নিউ মার্কেটের নামী দোকান থেকে দর্জি আসত জামাকাপড় আর সুটের মাপ নিতে। জুতোও অর্ডারি বানানো হত। তার ওপর অভিনয়ের নেশা। থিয়েটারের মহলা চলত। বাবা একবার মঞ্চে রামকৃষ্ণ চরিত্রও করেছিল, আর কয়েকটা সিনেমাতেও অভিনয় করেছে।
- খরুচে দাদু রামকৃষ্ণ? হবে বা, টাকা মাটি, মাটি টাকা! তা সিনেমাগুলো কি?
- বড় চরিত্র পশুপতি চ্যাটার্জির ষোড়শীতে। ছবি বিশ্বাস ছিলেন। ১৯৫৪ তে মুক্তি পেয়েছিল। অন্য গুলো ছোটখাটো রোল, অত মনে নেই। যাই হোক। বাবা মানুষ হিসেবে খুব যে খারাপ ছিল, তা নয়। কোনো ম - কারের নেশা ছিলনা। হাসলে বাড়ি কাঁপিয়ে হা হা করে হাসত। কিন্তু, ভীষণ বদরাগী। চন্ডাল রাগ। একবার আমার এক দাদাকে দোতলার বারান্দা দিয়ে ফেলে দিতে গিয়েছিল। অন্য লোকে কোনোক্রমে বাঁচায়। মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ঐ দাদার হার্টে ফুটো ছিল। তখন তো তেমন চিকিৎসা ছিলনা, যত্নে রাখতে হত। কিন্তু রাগলে বাবার জ্ঞান থাকতোনা। পরে ঐ দাদা মারা যায়। যদি কোনো বিষয়ে বাবা জেদ ধরে বসত, তবে কোনো উপায়েই তাকে ফেরানো যেতনা। কারোর কথা শুনতোনা। যদি একবার পড়তে বারণ করে দেয়, আর পড়া হবেনা। তাই মা ভয় পেত। লুকিয়ে পড়াশোনা করত।
- নিকুচি করেছে দাদুভাইয়ের রাগের। দিদা রাগ করতোনা?
- মা ছিল খুব ঠান্ডা ধৈর্যশীল মানুষ। সবদিক সামাল দেবার চেষ্টা করতো। এক দুবার মাকে রেগে যেতে দেখেছি।
- বাপরে বাপ! কিন্তু এযে ভয়ে ভয়ে বাঁচা। ভারি জ্বালা ছিল তো লাবণ্যর!
- এই ! দিদার নাম ধরছিস।
- তাতে কি? আমিই তো লাবণ্য, আবার ফিরে এসেছি, তোমার কাছে।
- জানিস, আমার বাবার এই উড়নচন্ডীপনা আর বিলিতি জিনিসের ওপর আসক্তির জন্য ঠাকুমা শেষ বয়সে ছেলের মুখ দেখতেন না। ছুঁতে দিতেন না, প্রণাম নিতেন না। ঠাকুমার আয়া, চিকিৎসা, সব কিছুর খরচ দিতেন, আমার বড় পিসেমশাই শ্রীশ চন্দ্র সেন বা ভুতি বাবু।
- মা, তুমি তোমার ঠাকুমাকে দেখেছ?
- না রে মা। ছোড়দা জন্মানোর আগে বা পরে তিনি মারা যান। আমি দেখিনি। মায়ের কাছে সব শুনেছি।
- মা, তোমার ঠাকুমার খুব তেজ ছিল, তাই না?
- হ্যাঁ। মায়ের ও ছিল। কিন্তু অন্যরকম। একটা শান্ত গাম্ভীর্য। মাও তো কম বড়বাড়ির মেয়ে ছিলনা। আর জি করের ছোটো ভায়ের নাতনি, খানাকুলের ঘোষবংশের মেয়ে। খুব মানী ছিল।
- এত বড়ো বংশের মেয়ে সব। বড় ঘরের বৌ! গয়না ছিলনা মা? বন্ধুরা সব গল্প করে, ঠাকুমার বালা, দিদার বিছে হার। তোমার তো কিছু নেই। তোমাকে দেয়নি।
- সব গেছে, দেবে কিকরে?
- প্রথমে বললে হারমোনিয়াম গেছে, তারপর বললে, দিদার হাতের কাজগুলো গেছে। এখন বলছ গয়না গাঁটি গেছে। কিকরে গেল সেটা তো বলো।
- আজ কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গেল মা, আবার একদিন হবে। মেলা কাজ পড়ে আছে।
তখন যে কোনো উপলক্ষে আত্মীয় স্বজন মিলে সিনেমা দেখতে যাবার চল ছিল। আমরা একবার দেখতে গিয়েছিলাম তপন সিংহের হারমোনিয়াম। একটা হারমোনিয়াম হাত ফেরতা হয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে, আর গল্প ও বদলে যাচ্ছে। ছবি দেখে মা আর ছোটোমামা, দুজনের চোখে জল। হল থেকে বেরিয়ে মামাকে ধরি,
- মামা, কাঁদছিলে কেন গো? কত হাসির সিন ছিল।
- ও কিছু না। আমাদেরও হারমোনিয়াম ছিল। হারিয়ে গেল। আবার যদি পেতাম।
- যা গেছে, তা গেছে। আবার কিনতে পারতে।
- বাবা আর কিনলোনা। খামখেয়াল। মা গুমরে মরতো। আমার গান শেখা হলনা। তোর মায়ের ও হলনা। খুব দামী বিলিতি কোম্পানির অর্গ্যান রিডের হারমোনিয়াম।
- ঐ হারমোনিয়ামটা কে কিনেছিল?
- বিয়ের পরে, মায়ের গানের শখ দেখে বাবা কিনেছিল, মানে ঠাকুমা তখন বেঁচে ছিল তো। খুব তেজীয়ান মহিলা। মায়ের জন্য হারমোনিয়াম কিনিয়েছিল ছেলেকে দিয়ে।
(মস্তিষ্কের অদৃশ্য ডায়েরিতে নোট করি নতুন তথ্য। কুমুদিনী পুত্রবধূ লাবণ্যর জন্য দামী হারমোনিয়াম কিনিয়েছিলেন।)
- তারপর?
- ঐ হারমোনিয়াম মায়ের শান্তির জায়গা ছিল। কাজ শেষ করে নিয়ে বসত। রবিঠাকুরের গান গাইত।
- হারালো কি করে?
- বাবা অভিনয় করতো। সেনবাড়িতে হৈ হৈ ক্লাব ছিল। এন্টালিতে থ্যাটাব্যাটা ক্লাব ছিল। দিনরাত নাটক, থিয়েটারের মহলা চলত। ঐসব করতে গিয়েই বাবা কাউকে দিয়েছিল, কাকে আমরা জানিনা। আর ফেরত পাওয়া গেলনা। তারপর সব গোলমাল হয়ে গেল। আমরা খুব গরীব হয়ে গেলাম। ভাত জোটানোর লড়াই করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলাম। মা চলে গেল। হারমোনিয়াম মরীচিকা হয়ে গেল।
এটুকু আলোচনা হচ্ছিল হাতিবাগানের ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে। তারপর বাস এসে গেল। যে যার বাড়ি চলে গেলাম। হারমোনিয়াম রহস্যটা উদ্ঘাটন হল বটে, কিন্তু নতুন জট পড়ল। মায়েরা গরীব হয়ে গেল কি করে? লাবণ্যর হারমোনিয়াম নিয়েও একটা ছায়াছবি হতে পারত মনে হয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।