দেশভাগ কোনো একটি বিশেষ প্রজন্মের অভিজ্ঞতা নয়। কোনো একটি বিশেষ বছরে দেশভাগ হয়েছে বটে কিন্তু তার অভিঘাত বহমান বছরের পর বছর ধরে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে। যে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনাই এইভাবে বহে যায় অভিঘাতে। এক প্রজন্ম হয়তো প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী। পরের প্রজন্মগুলি পরোক্ষে ভোগে। সামলেও নেয়। সেটাই সংঘর্ষের ইতিহাস। সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। নাটক, একটি সামাজিক মাধ্যম হিসেবে, এই প্রজন্মের লড়াইগুলি ধরে রাখে। উনিশশ’ নয় সালে বঙ্গ ভঙ্গ, উনিশশ’ উনচল্লিশ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, উনিশশ’ বিয়াল্লিশে আগস্ট আন্দোলন, উনিশশ’ ছেচল্লিশে নৌবিদ্রোহ, সাতচল্লিশে দেশভাগ। এই সমস্ত ঘটনার পারম্পর্য আছে। কোনো না কোনো ভাবে, এরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিচ্ছিন্ন বলে কিছু নেই। তাই দেশভাগের নাটক বলে পরিচিত যা কিছু আছে – দেশভাগ সম্পর্কিত নাটক অথবা অন্য সামাজিক নাটক, তার মধ্যেও ভারত-ভাগ মিশে থাকতে পারে। বা পারত।
দেশভাগের ব্যাপ্তি এতটাই যে বিস্তৃত এবং গভীর যে তাকে দু’ঘন্টা দেড়-ঘন্টার নাটকে বেঁধে ফেলা কঠিন কাজ।
উনিশশ’ ষাটে বিজন ভট্টাচার্য “গোত্রান্তর” লিখেছিলেন। “নবান্ন” এবং “দেবীগর্জন”-এর খ্যাতিতে এই নাটকটি খানিক চাপা পড়ে যায় বটে, কিন্তু দেশভাগ সম্পর্কিত নাটক হিসেবে “গোত্রান্তর” গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক বিরোধ, উদ্বাস্তু সমস্যা, গণ আন্দোলন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ – এই সব সমস্যাই ধরেছেন বিজন ভট্টাচার্য এ নাটকে। যদিও বৈবাহিক গোত্রান্তর প্রধান হয়ে উঠেছে শেষে, তবু পঞ্চায়েত, কৃষক ও কৃষি ঋণ – যা দেশভাগের সঙ্গে জড়িত, সেইসব বিষয়ও আছে।
উনিশশ’ সাতচল্লিশে দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন “বাস্তুভিটা”। কফিলদ্দি আর মুন্সীর কাহিনী। সাম্প্রদায়িকতা আর পুঁজিবাদ নিয়ে লিখেছিলেন “মশাল”। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আছে এই নাটকে – নোয়াখালি, ত্রিপুরা, ঢাকা, বরিশালের প্রেক্ষাপটে।
উনিশশ’ আটচল্লিশে রবীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত লিখেছিলেন “এই স্বাধীনতা”। দীপক, প্রমথ, কার্তিক, অবনী, প্রভাবতী, রাইমণিদের কাহিনী বাস্তুহারা জাতির ইতিহাস।
“জাতির সাধনার শেষ নাই। কখনো তা শেষ হয় না। মানব অভ্যুদয়ই কাম্য।” সেইসময়ে নাটকে উত্তরণের ভাষা এমনই ছিল।
উনিশশ’ পঁয়ষট্টি। বনফুল লিখলেন “আমরা”।
উনিশশ' তিপ্পান্নতে সলিল সেন লিখে ফেললেন তাঁর নাটক “নূতন ইহুদী”। মধ্যবিত্ত হিন্দু আর নম-শূদ্র কৃষক পরিবারের গল্প।
একটি অঙ্ক। ষোলোটি দৃশ্য। বলা যায় একাঙ্ক নাটক।
“নূতন ইহুদী” ইতিহাস তৈরি করল।
বাস্তুচ্যুত বাঙালি হিন্দু কখনোই দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি। পারা সম্ভব নয়। মুসলমান রাষ্ট্রে সংস্কৃত পাঠ নিষিদ্ধ হলে ব্রাহ্মণ মনমোহন চক্রবর্তী উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এলেন। অবশ্যই তিনি একটি রিপ্রেজেন্টেটিভ চরিত্র। উদ্বাস্তু হয়ে যাঁরা এদেশে এসেছেন, তাঁরা সকলেই সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবকদের অত্যাচারের কথা জানেন। প্রসঙ্গত মান্তোর “খোল দো” গল্পটি মনে পড়েই যায়। মনমোহন চক্রবর্তী, মাষ্টার মশাই থেকে জোগাড়ে ব্রাহ্মণে পরিণত হতে বাধ্য হন। দ্যুইখ্যা হয় চোর। ট্রামে কাটা পড়ে। পরী দেহব্যবসা শুরু করে। অন্নপূর্ণা মারা যান। বিনা চিকিৎসায় মারা যান পন্ডিত নিজেও। মনে হতেই পারে মেলোড্রামাটিক। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেনি তা তো নয়। প্রতিবাদী মুসলমান চরিত্র দিয়ে ব্যালান্স করেছেন। মির্জা, পণ্ডিতের চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করেন। গ্র্যাচুয়িটি পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টাও মির্জার। ইসলামের সমালোচনা তাঁর মুখে। “কথায় কথায় ইসলাম আর বেহেস্ত দেখাস মাইনসেরে, আর নিজেরা চাউল, চিনি, কেরাসিন চোরাই বাজারে বিক্রি করস”। সময় পাল্টেছে বলে বোধ হয় না। মির্জা যখন বলে, যে ফান্ডের টাকায় ইস্কুলের দোতলার বদলে ব্যক্তিবিশেষের বাড়ির দোতলা, তিনতলা ওঠে, তখন দেশভাগ ও পরবর্তী পঁচিশ বছরের করাপশন-চিত্র ধরা পড়ে। কিন্তু শেষ কথা ঐ একটাই। পণ্ডিতের মুখে।
“মোহইন্যারে!! তুই এটা কী ক’লি? দেশ কথাটা মোহ না রে। দেশ মাইনষের মনে জমির উপর দেওয়াল তুলছে। মনে যেন না তুলতে পারে”।
দেশভাগ মানে ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিক ঘটক মানে দেশভাগ। দলিল। প্রথম অভিনয় উনিশশ’ পঞ্চাশের জুলাইতে। ঐ একই বছরে নিকোলাই গোগোলের ছোটগল্প ‘অফিসার’ থেকে তৈরি হয়েছে নাটক ‘দ্য গভমেন্ট ইন্সপেক্টর’। দেশভাগ, ক্ষমতার হস্তান্তর, ক্ষমতায়ন, উদ্বাস্তু এবং ক্ষত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং শ্রেণীবৈষম্যের প্রেক্ষিতে “দলিল” নাটকের চরিত্র গাইছে, “হামার জানের গাঙ রে, হামার সোনার গাঙ রে, হামার পদ্মা গাঙ”। পদ্মা যাঁরা ছেড়ে এসেছেন, তাঁরা জানেন এই ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট। স্বর্ণ বলে, “এমন গান বাঁধো ঠাকুরপো, মনটা হুতাশে ভরৎ যায়”।
“সাহেব রাজার বাতে, স্বদেশীরে কাটে / হামরা এখন স্বরাজ হলাম”। নাট্যকার হরেন পন্ডিত বলছেন, “জানো না হে! আজই দেশবিভাগের খবরটা বেরোবে রেডিওতে”। স্বপ্ন আর স্বপ্পভঙ্গ ঋত্বিকের নাটকে। “বাংলারে কাটিছ কিন্তু দিলেরে কাটিবার জো নাই”। রূপাইকান্তি গ্রামের ক্ষেতু ঘোষ আর ফিরোজানানির কাহিনী। নিজের জমি খোঁজা মানুষ। যে ঋত্বিক বিশ্বাস করতেন, “আচ্ছা, নিজের জমির উপর না দাঁড়াইয়া কিছু করা যায় কী? কিছু সত্যিকারের গভীরতাকে ছোঁওয়া সম্ভব?”
সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলন, গণ আন্দোলনের আন্তরিকতা “দলিল” নাটকে। বাস্তুচ্যুত বাঙালি জানত না তার জমি কোথায়। তার পরিণতি কী।
পূর্ববাংলাতে তখন দুর্গাপূজা হয়। কিন্তু “ন্যাশনাল গার্ড ঘির্চাশ আছে পিত্যিমা” এই নাটক বলছে, “কোনো লোকে লাভ করার মতলবেই দেশভাগ আর দেশান্তরী করার ঢেউটা লাগছে”। হিন্দুদের মনে মুসলমান-বিদ্বেষ তৈরি করানো হচ্ছে।
“লাও বাঁধল্যাম। বাঁধে উঠল্যাম। পথটুকু পার হল্যাম। পথটা যেন ক্যামন ছোট্যা হয়্যা গ্যাছে। হামার ঘর। পূব্যা জানলাটা কেরা যেন খুল্যা রেখ্যা গিছিল। বেবাক বালি উড়্যা আস্যাছে পদ্মা থিকা। ...ই হ্যান সময়ে বাহার থিকা ভাস্যা আসে গান।
হামার মন মানে না, ই দু’টুকরা দেশ হামি মানি না” সাংবাদিক দেবু উদ্বাস্তুদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। চটকল, ধর্মঘট আর শস্তায় উদ্বাস্তু শ্রমিক-সংগ্রহ দ্যাখে। মনে বর্ম পরে চলতে হয় এখানে।
উনিশশ’ পাঁচে বঙ্গ-ভঙ্গ হয়েছিল। মামনুর রশিদের লেখা নাটক ‘ভঙ্গ বঙ্গ’। কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনের সময়। বেনাপুল, হরিদাসপুরের কথা। স্মাগলার রাজা আর যৌনকর্মী মালিনীর কাহিনী। দেশভাগের সঙ্গেই এসেছে কাঁটাতার। বর্ডার। স্মাগলিং। মেয়েরা দেহব্যবসাতে নেমেছে। এই কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে, ঘুরে বেড়াতে চায় এক আশ্চর্য মানুষ। যদি নদীকে, বাতাসকে দু’ভাগ করা না যায়, যদি পাখি সব আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারে, তবে মানুষ কেন পারে না? কেউ আটকাতে পারে না তাকে। সে চলে যায় সীমানা পার হয়ে। ইমিগ্রেশন আউট অব কন্ট্রোল। এইখানে যুক্ত হয় রক্তকরবীর রাজা, রঞ্জন, নন্দিনী। সেই আশ্চর্য মানুষ, নিয়মভাঙা মানুষ রক্তকরবী খুঁজছে।
গবেষকরা বলেন শ’খানেক নাটক আছে দেশভাগ সংক্রান্ত। মন্মথ রায়ের নাটক আছে। আছে কালোবাজারী আর মজুতদারদের নিয়ে শচীন সেনগুপ্তর নাটক “কালোটাকা”।
“মেঘে ঢাকা তারা” নাট্যরূপ পেয়েছে বারবার। প্রথম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায অভিনীত “মেঘে ঢাকা তারা” ইদানীং কালে ব্রাত্য বসুর পরিচালনায় মঞ্চে এসেছে। ইউটিউবেও দেখা যাবে এ নাটক। এই নাটকে, আমরা জানি, আছে মর্মান্তিক বেদনা। দেশভাগের যন্ত্রণা বহন করে আসা একটি রিপ্রেজেন্টেটিভ পরিবার, বড় মেয়ে নীতার বেঁচে থাকতে চাওয়ার আর্তনাদ। মেয়েদের অবস্থান্তর ঘটেছে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে। কিছু সংখ্যক শিক্ষিত মেয়ে বাইরের কাজ শুরু করেছেন। যৌনকর্মীর কাজে চলে গেছেন অনেক মেয়েরা। এটি সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়। থিয়েটার তাকে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এসেছে ভাষার বিবর্তন। ঘটি-বাঙাল সংস্কৃতির মেলবন্ধন। বহু বহু নাটকে তার প্রসার ঘটেছে। স্বর্ণকমল ভট্টাচার্যের “নোঙর ছেঁড়া নৌকা” মনে রাখতে হবে। যদিও তার চলচ্চিত্র রূপ “ছিন্নমূল” অধিকতর পরিচিত।
দেশভাগের প্রসঙ্গ আসবে, আর সাদাত মান্তো আসবেন না, ইসমত চুগতাই আসবেন না, এটা হয় না। মান্তোর বেশ কিছু নাটক বাংলা নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করেছেন ঊষা গাঙ্গুলি। এত শক্তিশালী নাটক বাংলার সম্পদ। ভীষ্ম সাহনির “তমস” অভিনয় করে চলেছেন গোবরডাঙার শিল্পায়ন। দেশভাগ শুধু পূর্ব-পাকিস্তান নয়। পশ্চিম-পাকিস্তান ও পাঞ্জাব দেশভাগের অন্যতম দিক। দেশভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে আরও অনেক নাটক হওয়া দরকার ছিল। দেশভাগের অভিঘাত চলছে এখনও। এক প্রজন্ম অন্য প্রজন্মের কাছে শুনে আসছে সীমান্ত পারাপারের কাহিনী। সাম্প্রতিক কালে বহরমপুর রঙ্গাশ্রম তাঁদের “আমার মুখের আঁচলখানি” নাটকটিতে দেশভাগের বিষয়টি আবার তুলে ধরেছেন। মহেশ দাত্তানির “হোয়ার ডিড আই লিভ মাই পর্দা” নাটকটিকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। মূলচরিত্র এক বয়স্কা অভিনেত্রী নাজিয়া। গেঁটে-বাত ও মাঝেমাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নাজিয়া খুঁজে চলেন শকুন্তলার ভূমিকায় অভিনয় করার অভিনেত্রীকে। শকুন্তলার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আসে অতীত।
এই কথাটাই বলার, যে দেশভাগ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
তার ফলাফল আজও ঘটমান। নাটক সেই প্রবাহকে মঞ্চস্থ করবে, এটাই কাম্য।
ছবিতে -
নাটক: আমার মুখের আঁচলখানি।
স্থান: বহরমপুর রঙ্গাশ্রম।
পরিচালক: সন্দীপ ভট্টাচার্য।