১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ ভারতের আবালবৃদ্ধবণিতার বড় আনন্দের দিন। নাকি ভুল বললাম। তামিলনাডু-কেরালা থেকে গুজরাট-রাজস্থান, হিমাচল-যুক্তপ্রদেশ থেকে বিহার-উড়িষ্যাবাসী আবালবৃদ্ধবণিতার বড় আনন্দের দিন। শুধু আনন্দ নাই পাঞ্জাবে, আনন্দ নাই বাংলায়, আনন্দ নাই অসমে।
সারা দেশ যখন জনগণমনঅধিনায়ক সুরে মাতোয়ারা, সারে জাঁহা সে আচ্ছা গাইছে দৃপ্ত উচ্চারণে আর তেরঙ্গা ঝান্ডা দুলিয়ে গাল ফুলিয়ে নারা তুলেছে বন্দে-মাতরম, তখন বাংলা অসম আর পাঞ্জাবের বুক চিরে উঠে আসছে অক্ষম ক্রোধের দীর্ঘশ্বাস, বিশ্বাসহীনতার কাছে পরিচয়ের হারানো অপমানিতের চিখ চিৎকার -
আমগো দ্যাশ ভাগ হৈয়া গেল
মোর দেখ ভাগ হৈ গ'ল
সাড্ডা দেস ভডিয়া গৈ
আজ সেই বিশ্বাসঘাতকাতার, সেই পিঠ পিছে ছুরি মারার, সেই চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে পড়া স্বপ্নযাপনের পঁচাত্তর বছর। কি বীভৎস মজা !
এমন দিনে চেতনে বার বার আছড়ে পড়ে গান তার সুর আর বাণী নিয়ে, যে শোনায় তার কন্ঠ, যে শোনে তার অন্তর গেয়ে ওঠে – যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক / আমি তোমায় ছাড়বোনা মা
দেশভাগ, বিশেষতঃ বাংলার, এমনি হঠাৎ হয়ে যায় নি। শুরু ১৯০৫এ লর্ড কার্জনের উদ্ধত খঞ্জর উদ্যত বঙ্গভঙ্গের নেশায়। ক্ষমতার চিরাচরিত বাহানা “প্রশাসনিক সুবিধা”র ঘোমটার আড়ালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঝটিকা কেন্দ্র বাংলাকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এই চক্রান্ত।
সেসময় বাংলার রাজনৈতিক আকাশে ধূমকেতুর মত উদয় হয়েছে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, ব্রতী নামের নানান সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী সংগঠন। তার সাথে চলছে স্বদেশী জাগরণ ও বয়কট আন্দোলন। সেই সব আন্দোলনের ধাতৃভূমি বাংলা। তাকে ভাগ করে আন্দোলনের তীব্রতা কমাতে চেয়েছিল বৃটিশ ঔপনিবেশীক শাসক। ফল হলো অভূতপূর্ব এক জনতার বিস্ফোরণ।
আগুন জ্বলে উঠলো বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন এক ঐতিহাসিক অবয়ব পেলো ১৬ অক্টোবর ১৯০৫। সুরেন বাঁড়ুজ্জ্যের ডাকে সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে অরন্ধন, কলকাতা জুড়ে হরতাল। স্বয়ং রবি ঠাকুর রাস্তায় নেমেছেন রাখী হাতে। হিন্দু-মুসলমান-ব্রাহ্ম-খ্রিস্টান সকলের হাতে রাখী বেঁধে শুরু রাখী বন্ধন উৎসব। গান বেঁধেছেন রবিবাবু –
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান॥
বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ--
পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক, পূর্ণ হউক হে ভগবান॥
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা--
সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান॥
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন--
এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান॥
গানের পর গান শরৎএর পেঁজা মেঘের মত ছেয়ে গেলো বাংলার আকাশ। গানে গানে পাগল বাঙ্গালী রাস্তায় মাঠে ঘাটে প্রান্তরে গেয়ে চলেছে -
সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালোবাসি / চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস / আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ……
ও আমার দেশের মাটি / তোমার পরে ঠেকাই মাথা / তোমাতে বিশ্বমায়ের আসন পাতা ……
আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে / ঘরের হয়ে পরের মতন / ভাই ছেড়ে ভাই ক'দিন থাকে ……
সঙ্গীতের ঝংকারে মেতে উঠছেন কান্তকবি রজনী। তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসছে আকুল করা ডাক –
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই / দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই
দেশের সন্তানদের হাঁক দিচ্ছেন কান্তকবি, জেগে ওঠার ডাক -
আমরা নেহাত গরীব, আমরা নেহাত ছোট / তবু আছি সাতকোটি ভাই,- জেগে ওঠ
মন্ত্রের মত উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর গান গ্রামে গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় –
তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে / তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে
গর্জে উঠছেন বাংলার চারণসিংহ কম্বুকন্ঠ মুকুন্দ দাস। গান বুকে নিয়ে কন্ঠের অগ্নিবীণার নাদে দাবানল জ্বালিয়ে দিচ্ছেন হাটে-মাঠে-ঘাটে -
বন্দে মাতরম বলে নাচরে সকলে / কৃপাণ লইয়া হাতে / দেখুক বিদেশী, হাস অট্টহাসি / কাঁপুক মেদিনী ভীম পদাঘাতে
ঘুমন্ত বাঙ্গালীকে জেগে ওঠার ডাক দিচ্ছেন মুকুন্দ –
বান এসেছে মরা গাঙ্গে / খুলতে হবে নাও / তোমরা এখনও ঘুমাও ……
প্রলয় নাচে নেচে ওঠেন মুকুন্দ নটরাজের রুদ্ররূপে –
ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে / মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে ……
এভাবেই বাঙ্গালী সেদিন ব্যর্থ করে দিয়েছিলো বঙ্গভঙ্গের হীণ প্রচেষ্টা।
১৯১১। যেবার আদুল পায়ে মোহনবাগান সবুট ইস্ট ইয়র্ককে ময়দানের লড়াইয়ে উড়িয়ে দিল, সেবারই বাংলা জোড়া প্রতিরোধের আগুনের সামনে অর্ধেক পৃথিবীর অধিশ্বর বৃটিশ রাজশক্তি মাথা নুইয়ে হার মানলো বাংলামায়ের পায়ের কাছে – রদ হলো বঙ্গভঙ্গ।
১৯৪৬এর ক্যাবিনেট মিশন। তারা ভারতের নেতাদের সাথে শলা করতে এসেছে কিভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। মিশনে অন্যদের সাথে আছেন স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং বড়লাট লর্ড ওয়াভেল। তাদের প্রস্তাব ছিল ভারতের বৃটিশ শাসিত প্রদেশগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা। একে বলা হলো গ্রুপিং সিস্টেম। গ্রুপ এ তে ছিলো যুক্তপ্রদেশ (আজকের উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড মিলিয়ে), মধ্যপ্রদেশ (আজকের মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগঢ় মিলিয়ে), বম্বে (আজকের মহারাষ্ট্র ও গুজরাট মিলিয়ে) বিহার, উড়িষ্যা ও মাদ্রাজ (আজকের তামিলনাডু, সীমান্ধ্র আর তেলেঙ্গানা মিলিয়ে)। গ্রুপ বি তে ছিলো, সিন্ধ, পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য আর বালুচিস্তান। গ্রুপ সি তে ছিলো বাংলা ও অসম।
দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের অধিকার বজায় রাখতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে।
এই ব্যবস্থা জিন্নার সমর্থন পায় ও মুসলিম লীগের কাউন্সিলও এই প্রস্তাবে সায় দেয়। জিন্না মনে করেছিলেন এতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থই রক্ষিত হবে। কিন্তু কংগ্রেস এই প্রস্তাবে আপত্তি করে। তারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য আর অসমকে এর বাইরে রাখতে চায়, কারন সে সময় এই দুটি রাজ্যেই কংগ্রেস সরকার ছিলো, গ্রুপিং-এর ফলে তা হারাতে হতো। স্বভাবিকভাবেই মুসলিম লীগ এতে রাজি হয় নি। যদিও এই প্রস্তাব ছিলো প্রকৃতপক্ষে ভারতকে অখন্ড রাখার শেষ চেষ্টা। একটা মধ্যবর্তিকালীন মন্ত্রীসভা তৈরী করার কথা হয়, যাতে ৫জন কংগ্রেস ৫জন মুসলিম লীগ ১জন শিখ ও ১জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রতিনিধি থাকবেন। পরে সেটি পাল্টে ৫জন কংগ্রেস ৫জন মুসলিম লীগ ১জন শিখ ১জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ১জন পার্সি প্রতিনিধি রাখার কথা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের চাপে ৪জন কংগ্রেস হিন্দু, ১জন কংগ্রেস মুসলমান, ১জন কংগ্রেস নিম্ন বর্ণের হিন্দু, ৪জন মুসলিম লীগ মুসলমান, ১জন মুসলিম লীগ নিম্ন বর্ণের হিন্দু, ১জন শিখ ১জন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ১জন পার্সি প্রতিনিধিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে কংগ্রেস-মুসলিম লিগ অনুপাত গিয়ে দাঁড়ায় ৬-৫এ, যা মুসলিম লীগের পক্ষে মানার কথাই নয়। এই সময়েই কংগ্রেস বিবৃতি দেয় যে তারা ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব মানতে বাধ্য নয়। ফলতঃ মুসলীম লীগ “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে” ঘোষনা করে ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ এ।
সেদিনটি ছিলো ঔপনিবেশিক ভারতের ঘৃণ্যতম লজ্জার দিন। এর আগে ঘটে গেছে বুড়িবালামের যুদ্ধ, চট্টল পাহাড়ের যুদ্ধ, হিজলী জেলের নৃশংস বন্দী হত্যা যতীন দাসের অনশনে মৃত্যু ও সবার উপরে জালিয়ানওয়ালাবাগ। কিন্তু সেসব ছিলো সাম্যাজ্যবাদী লুঠেরা শাসকের বিরুদ্ধে ভারতের বীর সন্তানদের লড়াই। তাতে আত্মত্যাগ ছিলো, বীরত্ব ছিলো, গর্ব ছিলো। কিন্তু ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ যা ঘটলো তা ঘেন্নার, লজ্জার। ভাইয়ের বুকে ভাই ছুরি বসালো। হাজার বছর পাশাপাশি থেকে সুখে-দুঃখে, সম্প্রীতি-বিবাদে, ভালোবাসা-অভিমানে, বিশ্বাস-অবিশ্বাসে যে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিলো কিছু স্বার্থপর, নির্বোধ নেতার প্ররোচনায় সেই বোঝাপড়া এক নিমেষে ধূলিস্যাৎ। হিন্দু-মুসলমান একে অন্যের রক্তপিপাসু দানবে পরিণত হলো।
ঠিক সেদিনই দেশভাগের মর্মান্তিক নিয়তি লেখা হয়ে গেলো এই উপমহাদেশের বুক চিরে।
এরপর ১৯৪৭এর ঔপনিবেশিক ধুর্ত চালে “স্বাধীনতা” ও দেশভাগ ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র।
বিলেত থেকে এলেন সিরিল রডক্লিফ সায়েব সাথে নয় নায়েব নিয়ে, সি সি বিশ্বাস, বি কে মুখার্জি, এ এস এম আক্রম, এস এ রহমান, এম সি মহাজন, টি সিং, ডি মহম্মদ, আর এম মুনীর।
না, দেশের মানুষের মতামত চায় নি কেউ। যাদের জীবন জীবিকা, যাপন, পরম্পরা, হাজার বছরের বসত উচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তাদের অনুমতির কোন জায়াগাই ছিলো না ক্ষমতার মদগর্বে মাতাল হবু শাসকের কাছে। ছেড়ে যাবার আগে সাম্যাজ্যবাদী লুঠেরার দল তাদের শেষ কামড়ের বিষ ঢেলে দিলো পাঞ্জাব আর বাংলা জুড়ে। ঘটে গেলো আজ অবধি সৌরমন্ডলের এই তৃতীয় গ্রহে মানুষের তৈরী প্রচন্ডতম বিভেদপ্রাচীর।
ইংরেজ কবি ডব্লিউ এইচ অডেন তার পার্টিশন কবিতায় রডক্লিফ সায়েবের উদ্দেশে লিখলেন –
Unbiased at least he was when he arrived on his mission,
Having never set eyes on the land he was called to partition
Between two peoples fanatically at odds,
With their different diets and incompatible gods.
Time,’ they had briefed him in London, is short. It’s too late
For mutual reconciliation or rational debate:
The only solution now lies in separation.
The Viceroy thinks, as you will see from his letter,
That the less you are seen in his company the better,
So we’ve arranged to provide you with other accommodation.
We can give you four judges, two Moslem and two Hindu,
To consult with, but the final decision must rest with you.’
Shut up in a lonely mansion, with police night and day
patrolling the gardens to keep the assassins away,
He got down to work, to the task of settling the fate
Of millions. The maps at his disposal were out of date
And the Census Returns almost certainly incorrect,
But there was no time to check them, no time to inspect
Contested areas. The weather was frightfully hot,
And a bout of dysentery kept him constantly on the trot,
But in seven weeks it was done, the frontiers decided,
A continent for better or worse divided.
The next day he sailed for England, where he could quickly forget
The case, as a good lawyer must. Return he would not,
Afraid, as he told his Club, that he might get shot.
দেশভাগ হয়ে গেলো। লক্ষ মানুষের ঘরবসত পরিচয় হারানোর হাহাকার নিয়ে দেশভাগ হয়ে গেলো। যার যার রাজত্বে মসনদে বসলেন শাহেনশা-রা। গোলাপ ও আতরের গন্ধে চাপা দেবার চেষ্টা হলো ট্রেন ভর্তি লাশ, দেশ ভর্তি উদ্বাস্তু, কান্না আর পরিচয়হীনতার অপমান।
তাদের কথা গান হয়ে উঠে এলো।
ফরিদপুর থেকে আগত সুরেন্দ্র নাথ সরকার উদ্বাস্তুদের নিদারুণ দুর্ভোগ নিয়ে গান বাঁধলেন -
আমরা যারা বাস্তুহারা, একেবারেই সর্বহারা
তাদের অন্নচিন্তা চমৎকার।
তারা কেউ ঝোপে-জঙ্গলে, কেউ বা তাঁবুর তলে
কেহ প’ড়ে তালবেতালে, আছে আজ নৈনিতালে।
কেহ বা দুটো অন্নের জন্য রয়েছে দণ্ডকারণ্যে,
কেহ বা বিনা খুনে গিয়েছে আন্দামানে…।
এমন সোনার বাংলা দেশে,
মানুষ বেড়ায় ভেসে ভেসে,
হলাম বাস্তুহারা সর্বহারা—
কার কলমের এক খোঁচায়।
আমরা ক্যাম্পে শুয়ে আজো মাঠে,
আর কত দিন জীবন কাটে,
দেখে মোদের দুঃখ কষ্ট—
শেয়াল কুকুর লজ্জা পায়।
বরিশাল থেকে আগত নকুলেশ্বর সরকার। তাঁর রচিত অসংখ্য গানের মধ্যে একটি ছিল -
আছি বাস্তুহারা হিন্দু যারা, হবে মোদের বাস্তু গড়তে,
আবার হবে দাঁড়াতে — পথের কাঁটা সরাতে।
হ্যাঁ, সব হারিয়েও গড়ে তোলার জেদ তাদের ছাড়েনি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে মূর্ত হয় সেই জেদ -
বাঁচবো বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো রে বাঁচবো / ভাঙ্গা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো
বিভেদ গাঙ্গের বাঁধবো দুকুল / বাঁধবো আবার মিলনের পুল / যতো বাস্তুহারা সর্বহারা সুখের গৃহ গড়বো
ঘুচবে দেশের অন্ধকার / আসবেরে প্রাণের জোয়ার / (আমরা) সবাই মিলে তালে তালে আনন্দের গান গাইবো
গোলায় গোলায় উঠবে ধান / গলায় গলায় উঠবে গান / যত মায়ের বুকে শিশুর মুখে হাসির ঝলক আনবো
দীন দুঃখী অভাগার দল / মোছরে এবার চোখের জল / এলো নিখিল বিশ্বে যতো নিঃস্বের মহামুক্তির পর্ব
হবিগঞ্জের ডানা ভাঙ্গা জালালী কইতরের গান গেয়ে ওঠেন হেমাঙ্গ কবিয়াল -
হবিগঞ্জের জালালী কইতর, সুনামগঞ্জের কুড়া / সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর / ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি
হাওরের পানি নাইরে হেথায় নাইরে তাজা মাছ / বিলের বুকে ডানা মেইলা নাইরে হিজল গাছ
তবু নিদহারা নগরের পথে রাইতের দুপুরে / মরমিয়া ভাটিয়ালী আমার গালায় ঝরে
এই সুরে আছেরে বন্ধু অশত্থ বটের ছায়া / এই সুরে বিছাইয়াদেরে শীতল পাটির মায়া
এইনা সুরের পালের দোলায় খুশির হাওয়া বয় / এই সুরের দৌলতে আমি জগৎ করলাম জয় ।
হবিগঞ্জের জালালী কইতর সুনামগঞ্জের কুড়া / সুরমা নদীর গাংচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া
শূন্যে দিলাম উড়া রে ভাই যাইতে চান্দের চর / ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কইলকাত্তার উপর,
তোমরা আমায় চিননি
পদ্মার গহীণ গাঙ আর ধুধু চর ডাক দেয় উদ্বাস্তু কলোনীর ছ্যাঁচা বেড়া আর খাপলার চালের ফাঁকে ফাঁকে। হেমাঙ্গ ফুকরে ওঠেন -
পদ্মা কও কও আমারে / (আইজ) মন বাঁশুরী কাইন্দা মরে তোমার বালুচরে
পদ্মারে
তুমি আমার ভালোবাসা তুমি আমার স্বপ্নের আশা / কে বলেরে কীর্তিনাশা কুলভাঙ্গা তরে
ও যে জন ভাংলো কুল ভাঙ্গলো বাসারে / সর্বনাশা চিন নিলা তারে
পদ্মারে –
পরাণ মাঝি হাল ধরিত হুসেন মাঝে গুণ টানিত / ভাটীয়লী সুর নাচিত ঢেউয়ের নুপুরে
কতো চাইন্দের বাতি জ্বলতো জলেরে / রাইতের নিঝঝুম আন্ধারে
পদ্মারে –
কোন বিভেদের বালুচরে তোর ময়ুরপঙ্খী ভাঙ্গলো ওরে / কোন কালসাপে দংশিল তোর সুজন নাইয়ারে
আজ ভেলায় ভাসে বেহুলা বাংলারে / বধূর বিষের জ্বালা অন্তরে
বেহুলার রূপকল্প বার বার ফিরে আসে হেমাঙ্গের গানে -
বেহুলার ভেলায় যায় ভেসে যায় অভাগী বাংলা মা / ভাসানের ঢাকে ছেয়েছে আকাশ ভাসমান প্রতিমা
মিথ্যা তোমার প্রগতি বন্ধু মিথ্যা জ্জানের গরিমা / অভাগী বাংলা মা
ঘরে ঘরে আজ নিভেছে বাতি / ফিরে এল ওগো একি কালরাতি
শষ্য শ্যামলা প্রান্তরে কালো মৃত্যু পরিক্রমা / অভাগী বাংলা মা
কল্পনাতীত একি দুর্গতি / পরিকল্পনার একি পরিণতি
যে বাঁধ ভেঙ্গেছে মানুষের দোষে তার কি আছে ক্ষমা / অভাগী বাংলা মা
এ দুঃখের কিবা পরিমাপ / কারে তুমি বন্ধু কর অভিশাপ
এ আমার এ তোমার পাপ ভুলেছি জনশক্তির মহিমা / অভাগী বাংলা মা
ভাঙ্গা বাংলার আর এক মাটির কবিয়াল নিবারণ পন্ডিত গান বাঁধেন -
মূর্খ গীদাল হামরগুলা ভাওয়াইয়া গান গাই / হাল বাড়ির কামাই সারি দুতারা ডাঙ্গাই
সুখদুঃখের কথা যেলায় মনত পড়িল / চটকা সুরে দুতারা ডাডাং বাজিয়ারে উঠিল
স্বাধীন হইনু ঘর হারাইনু নাই আর ভিটা মাটি / পরার ভুইয়ত ঘর বান্ধিয়া পরার ভুইয়ত খাটি
দিনমনে সেই আড়াই টাকা মজুরী পাইয়া / মাইয়া ছাওয়ায় রুটি চাবাই আন্ধ্যারত বসিয়া
তাই যখন ওপার বাংলার মানুষ ১৯৭১এর মুক্তিতে গেয়ে ওঠেন -
এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়
এ আমার দেশ এ আমার দেশ
আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সংকটে
তখন অন্য কোথা অন্য কোনখানে বুঢ়া লুইতের কবিয়াল হাহাকার করেন -
গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা / আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা
আইজ সেই পোড়াকপাইল্যা স্বাধীনতার, সেই কইলজা ফাডা দ্যাশভাগের পঁচাত্তর বছর। দ্যাশে কি বীভৎস মজা
কোথায় পেলাম –
১) মিলনসাগর - মুকুন্দদাস
২) বাঙালনামা
৩) বাংলার ফকির বাউল - ফেসবুক পেজ
৪) মিলনসাগর - নিবারণ পণ্ডিত
৫) মিলনসাগর - হেমাঙ্গ বিশ্বাস
শুধু নেহেরু প্যাটেল নয়, গান্ধীকে ক্রমাগত দেশভাগ, বিশেষতঃ বাংলাভাগের জন্য ঝোলাঝুলি করেছেন কলকাতার মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের হয়ে ঘণশ্যাম বিড়লা নিজেই
লেখাতে যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিলচোখের সামনে দেশভাগের দিনগুলো৷
দেশভাগ নিয়ে ওপার বাংলার মুসলিম কবিয়াল, গায়ক-দের কোন গান সংগ্রহে আছে, কল্লোল দা?
আছে অরণ্য।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম।
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম।
বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম
কে হবে মেম্বার,
কে বা সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
করি যে ভাবনা
সেই দিন আর পাব নাহ
ছিল বাসনা সুখি হইতাম
দিন হইতে দিন
আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….
শাহ আব্দুল করিম
কিন্তু আর বিশেষ কোন গান পাই নি। এই গানটি লেখায় রাখিনি, কারন আমি উদ্বাস্তু মানুষদের গান নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। এ গান দেশভাগের পর ওপার বাংলায় লেখা। এপার থেকে যে মুসলমান মানুষেরা ওপারে গেছেন, অধিকাংশই স্বেচ্ছায়। তাদের সাথে যাদের যেতে হয়েছে অনিচ্ছায়, তাদের কথা আছে আগুনপাখীতে। কিন্তু বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু বাঙ্গালী মুসলমান মানুষের গান আমি অনেক খুঁজেও পাইনি।
আমার করা নেহেরু-প্যাটেল-বিড়লা নিয়ে মন্তব্য এই লেখার জন্য নয়। এখানে ভুলবশ্তঃ পোস্ট হয়ে গেছে।
"Hindus and Muslims were sons of the same soil of India; they were brothers who therefore must strive to keep India free and united." - M K Gandhi
--
ধন্যবাদ কল্লোল-দা। শাহ করিমের এই গানটা পরিচিত। বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু বাঙ্গালী মুসলমান সংখ্যায় অনেক কম ছিল, হিন্দু উদ্বাস্তুর তুলনায়, সেটাও ঠিক
শুধু তখন-তখনই মানে ১৯৪৭য়েই নয়, এমন বহু মানুষকে জানি যাঁরা প্রথমে মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন। পরে নিতান্ত নিরুপায় হয়ে ষাটের দশকে বা তারও পরে ভিটেমাটি ত্যাগ করেন।
আশিষ ব্যানার্জিকে বলছি। এখানে হয়। দেশভাগ সংক্রান্ত ইন্দ্রনীলের লেখায় মন্তব্য করুন। সেখানে তর্ক করা যাবে। এখানে আমার পোস্টটি ভুলবশতঃ হয়ে গেছে। তার জন্য দুঃখিত। বক্তব্যের জন্য নয়।
অরণ্য বাঙ্গালীর পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ দুইবার হয়েছে বড় করে। প্রথমবার ১৯৪৬-৪৭এ পরেরবার ১৯৭০-৭১এ। কিন্তু এখন এবং ১৯৪৭পরবর্তি সমস্ত সময় জূড়ে এই চলে আসার স্রোত থামেনি একবারও। ১৯৭১এ ভহু বাঙ্গালী মুসলমানও চলে এসেছিলেন। তাদের অনেকেই আমার বাসার আসে পাশেও থাকতেন। তাদের একজন কবি আল মাহমুদ।
হ্যাঁ,একথা ঠিক পশ্চিম থেকে পূবে উদ্বাস্তু হয়ে চলে যাওয়া মুসলমান মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। কারন প্রথম ধাক্কায় যারা ভুগেছিলেন তারা মূলতঃ মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত শ্রেণী। এপারে মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি ১৯৪৭এর সময় খুবই সংখ্যাল্প ছিলো। তাদের বেশীরভাগই ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তারা তো অপশন পেয়েছিলেন যেমন পূর্ব বাংলার হিন্দু সরকারী কর্মচারীরাও পেয়েছিলেন। এপারের মুসলমান উচ্চবিত্তরা সময় পেয়েছিলেন গুছিয়ে নেওয়ার। অনেকেই কংগ্রেসের সাথে সংযোগ রেখে চলতেন। যাদের যাবার ছিলো তারা অনেকেই সম্পত্তি অদল-বদল করে নিয়ে গেছেন। এই বাংলায় তাদের উপর দেশ ছাড়ার চাপ তেমন প্রবল ছিলো না। গরীব ও সাধারণ মুসলমান কি নিম্নবর্ণের হিন্দু ১৯৪৭এ ততো উদ্বাস্তু হন নি।