শীতকাল। ঝরা পাতার সময়। শুষ্ক পাতাগুলি কাঁপছে। খসে পড়ে উত্তুরে হাওয়ায়। বীজ সুপ্ত থাকে মাটির নীচে অসীম সম্ভাবনা বুকে চেপে ধরে থমকে। ভোরের কুয়াশা আনে জলকণা। তৃষ্ণার্ত বালিও ভিজে ওঠে। কুয়াশা এক যাদুকরী অস্তিত্ব। ফজরের কুয়াশা ঘন সন্নিবিষ্ট কিশোর প্রেম। বেলা বাড়ে। আলোর প্রকাশ ঘটে ধীরে ধীরে কুয়াশা মিলাতে থাকে। দিনের ঔদ্ধত্বঘোষে কুয়াশা বিলীন চরাচরে।
সুভাষদা, সুভাষ গাঙ্গুলিকে নিয়ে লিখতে গেলে এখন এই বয়সে এসে ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতি ধূসর পাণ্ডুলিপির মত ভেসে চলে যায়। এই তো সেদিন এপিডিআরের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সাক্ষাতকার নিতে গেছিলাম সুভাষদা-ভারতীদির ফ্ল্যাটে। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত উষ্ণ গলায় সাদর ডাক। সেদিনও সেই প্রথমদিনের মত খাদির পাঞ্জাবী আর বড় ফাদের পাজামা। সেই প্রথমদিনের মত কদমছাঁট চুল, নাঃ সেবার ছিলো একমাথা কালো এবার পাক ধরেছে তাতে। সেই একই রকম ছিপছিপে অবয়ব, কালো ফ্রেমের চশমা।
সুভাষদার কথা বলতে গেলে আরও তিনজন মনে ভিড় করে আসে – সঞ্জয়দা (মিত্র), দিলীপদা (চৌধুরী) আর ভারতীদি (গাঙ্গুলী)। এপিডিআরের শুরুর পাঁচ বছরের চার স্তম্ভ। এই যে ছোট্ট করে লেখা হয়ে গেলো “শুরুর পাঁচ বছর” কিছু বোঝা গেলো কি? সম্ভব নয়।
সেটা ছিলো ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬। পশ্চিম বাংলার এক নির্মম নৃশংস সময়। সমস্ত রকমের গণতন্ত্রের উপর বলাৎকার করেছে তৎকালীন শাসকদল নব কংগ্রেস। ১৯৭২এর নির্বাচনের প্রহসন আজ বহু-চর্চিত। শুধুমাত্র সিপিএম বা নকশাল হওয়ার কারণে খুন হয়েছে কয়েক হাজার প্রাণ। জেলে বান্দী রাজনৈতিক কর্মীদের উপর চলছে যথেচ্ছ অত্যাচার অ নানা বাহানায় গণহত্যা। কাশীপুর-বরানগরের সেই বীভৎস এক রাতে খুন হয়েছে কয়েক শত তারুণ। শাসক দলের ছাড়া অন্য যেকোনো রাজনৈতিক কাজের উপর প্রশাসনের শকুন তীক্ষ্ণ নজর ও প্রয়োজনে গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়া। সামান্য কলেজ পত্রিকায় অন্যরকম কিছু ছাপা হলে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ। সদ্য জেল ফেরত বাম রাজনৈতিক কর্মীদের চাপ দিয়ে শাসক দলে যোগ দিতে বাধ্য করা। কয়েক হাজার মানুষ বিরোধী রাজনীতির কারণে ঘরছাড়া। এমন একটা আবহে যে চারজন যুবক এগিয়ে এসেছিলো রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির দাবী তুলে দরজায় দরজায় ঘুরে কিছু প্রথিতযশা মানুষকে সে দাবীর সপক্ষে বুঝিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) তৈরি করে, সুভাষদা তাদেরই একজন।
সুভাষদা আমার প্রথমদিকের রাজনৈতিক জীবনের হাতে গোনা শিক্ষকদের একজন। আর কয়েকজনের মধ্যে দুজন অবশ্যই সঞ্জয়দা আর দিলীপদা। তখন গোপন রাজনীতি থেকে পথে নেমে রাজনীতিতে উত্তরণের দিন। প্রথম মিছিলে হাঁটা, প্রথম রাজনৈতিক বন্দীমুক্তর স্লোগান তোলার অন্যতম সাথী সুভাষদা। প্রথম স্ট্রিট কর্নারে বক্তৃতার শ্রোতাদের মধ্যে সুভাষদা।
জরুরী অবস্থার মধ্যে এপিডিআরের সংকলন "ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বরূপ" বইটিকে বুকে করে আগলানোর কৃতিত্বের একজন দাবীদার সুভাষদা।
১৯৭৭এ শিশু এপিডিআরকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে নিঃশব্দে সরে গেলেন সুভাষদা, সঞ্জয়দা, দিলীপদা। তারপর থেকে যোগাযোগ কম। দেখা হতো, হতোই বইমেলায়। দেখা হলেই সেই উষ্ণ গলা – কেমন আছো?
আসলে সুভাষদারা এমন এক ঘরানার মানুষ যারা ভীষণ দরকারি থেকে অনায়াসে কেউ না হয়ে যেতে পারেন।
এবারের বইমেলায় দেখা হবে না, এটুকুই।
কুয়াশা মিলিয়ে গেছে চিরতরে সেদিনের শীতের ভোরে আমায় জলসিঞ্চিত করে। সেটুকু পাথেয় নিয়ে পথ চলা। এবার তবে অপেক্ষা……