#পুস্তকালোচনা -- #তোপসের_নোটবুক -- #কৌশিক_মজুমদার
বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের সেরা আখ্যানটি নিয়ে আজকে আবার এলাম। বইটিতে আর কী কী পেলাম চলুন ক্রমে ক্রমে দেখতে থাকি ---
১১) এই কাহিনী অনুযায়ী নবকৃষ্ণ মিত্রের সবমিলিয়ে তিনজন ছেলে - বড় ছেলে হরেকৃষ্ণ, মেজ ছেলে জয়কৃষ্ণ (অর্থাৎ ফেলুদার বাবা), ছোট ছেলে বিনয়কৃষ্ণ (অর্থাৎ তোপসের বাবা)।
কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের লেখা "রয়েল বেঙ্গল রহস্য" নামক কাহিনীতে জানানো হচ্ছে যে, এই তিন জনের বাইরেও তোপসের বাবার এক দাদা ছিলেন যিনি তেইশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়ে পশ্চিমে চলে যান এবং তারপরে আর ফেরেননি।
অর্থাৎ, ফেলুদার বংশের ব্যাপারে বর্তমান লেখক সত্যজিতের থেকেও বেশী জানেন!
১২) নোটবুক থেকে আরো জানা যায় যে, হরেকৃষ্ণের তিন বছর বয়সে তারা ঢাকায় আসেন, সেখানে দুই বছর থাকার পর ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ ই এপ্রিল জয়কৃষ্ণের জন্য হয়। তাই হরেকৃষ্ণের জন্ম (১৯১৯-২-৩) = ১৯১৪ অথবা বড়জোর ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দ হওয়া উচিৎ।
এদিকে আবার সেই একই নোটবুক অনুযায়ী, নবকৃষ্ণের বিয়ের (১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে) কয়েকবছরের মধ্যে হরেকৃষ্ণের জন্ম হয়।
কয়েকবছর বলতে যে ২৮/২৯ বছর (১৮৮৫ থেকে ১৯১৩/১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দ) বোঝানো হয় সেটি এই বইটি না পড়লে জানতেই পারতাম না!
১৩) নোটবুকের কাহিনী অনুযায়ী, নবকৃষ্ণ মিত্রের প্রথম ছেলে হরেকৃষ্ণ ও বিনয়কৃষ্ণ মিত্রের (তোপসের বাবা) মধ্যে বয়সের ফারাক ১৫-১৬ বছরের (১৯১৯/১৯১৪ থেকে ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দ)।
কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের লেখা "রয়েল বেঙ্গল রহস্য" নামের কাহিনীতে জানানো হচ্ছে যে, তোপসের বাবার সাথে তোপসের বাবার বড় ভাইয়ের প্রায় পঁচিশ বছরের বয়সের তফাৎ।
কাজেই, ফেলুদার ব্যাপারে বর্তমান লেখকের জ্ঞান সত্যজিতের জ্ঞানকে আবার টপকে গেছে!
১৪) নোটবুকের কাহিনী অনুযায়ী লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ২৯ শ্রাবণ ১৩৪১ বঙ্গাব্দ অথবা ১৩ ই আগস্ট ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে হয়।
"টিনটোরেটোর যীশু" কাহিনী অনুযায়ী লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন ২৯ শে শ্রাবণ এবং "এবার কান্ড কেদারনাথ" কাহিনীতে স্বয়ং লালমোহনবাবুর বক্তব্য অনুযায়ী তার জন্ম ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে।
অর্থাৎ সত্যজিতের কাহিনী অনুযায়ী লালমোহন গাঙ্গুলির জন্ম ২৯ শ্রাবণ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ অথবা ১৩ ই আগস্ট ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে হয়।
লেখকের জ্ঞান বার বার সত্যজিতের জ্ঞানকে পরাস্ত করছে। এইজন্যই তো এই নোটবুকটি পড়া দরকার!
১৫) এই নোটবুকের ষষ্ঠ অধ্যায়ের কাহিনী অনুযায়ী ফেলুদার জন্ম ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে মাসে।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত "ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি" কাহিনীতে ফেলুদার বয়স ২৭ বছর বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত "সোনার কেল্লা" কাহিনীতে পুজোর সময় কাটি-পতঙ্গ্ নামক সিনেমার গান বাজার উল্লেখ আছে যেটি বাস্তবে সেই বছরের জানুয়ারি মাসে বেরিয়েছিলো। এছাড়া "টিনটোরেটোর যীশু" নামক কাহিনীর মধ্যেই ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দের উল্লেখ আছে যেটি বাস্তবে ১৯৮২ খ্রীষ্টাব্দেই প্রকাশিত হয়। কাজেই কাহিনীতে আলাদা করে উল্লেখ না থাকলে ধরে নেওয়া যায় যে, কাহিনীর সময় এবং বাস্তবের সময় একই।
ফলে ফেলুদার জন্ম (১৯৬৫ - ২৭) = ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে হওয়ার কথা।
লেখকের জ্ঞানের কাছে হারতে হারতে সত্যজিৎ রায় এই বইটি পড়লে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন!
১৬) এই নোটবুকের কাহিনী মোতাবেক লালমোহন বাবুর পাড়ায় বন্ধু বলতে পুলক চ্যাটার্জি এবং সোমেশ্বর হাজরা উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু সত্যজিতের কাহিনীতে লালমোহনবাবুর পাড়াতুতো প্রতিবেশীর নাম পুলক ঘোষাল।
আবার সত্যজিৎ পরাজিত, পুলকিত হওয়ার মতো ব্যাপার!
১৭) এখানে শিশু/ অল্পবয়সী লালুর অর্থাৎ লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের গড়পারে হওয়া "ভূশন্ডির মাঠ" নামক নাটকে "নদেরচাঁদ মল্লিক"-চরিত্রে প্রথম অভিনয়ের কথা উল্লেখ আছে।
কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের লেখা "দার্জিলিং জমজমাট" কাহিনীতে উল্লেখ আছে যে "ভূশন্ডির মাঠ" নামক নাটকে উপরোক্ত চরিত্র হিসেবে লালমোহনবাবুর প্রথম অভিনয় ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে গড়পারে ফ্রেন্ডস ক্লাবে অর্থাৎ তখন তার বয়স ৩৪ বছরের কাছাকাছি।
এই নোটবুকটি না পড়লে জানতেই পারতাম না যে লালমোহন ৩৪ বছর বয়স অবধি শিশু ছিলেন অথবা স্কুলে পড়তেন।
১৮) এই নোটবুকের অষ্টম অধ্যায় অনুযায়ী ফেলুদা বা প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের জন্ম আশ্বিনের পাঁচই তারিখে।
কিন্তু বাংলা পাঁজি অনুযায়ী ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দ তারিখে পাঁচই আশ্বিন ছিলো, ১৯৩৯ নভেম্বর মাসে নয়।
কাজেই লেখক এখানে সত্যজিৎকে বারবার হারানোর পরে নিজেই নিজেকে Overtrump করেছেন!
১৯) এই নোটবুকের অষ্টম অধ্যায় অনুযায়ী ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিনের পাঁচই তারিখটি পূর্ণিমা ছিলো।
কিন্তু পুরোনো পাঁজি থেকে দেখা যায় যে সেটি শুক্লপক্ষের নবমী ছিলো।
বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকায় ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করতে না পারুক কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু একজন করতে পারেন এটা বোঝা গেলো!
২০) এই কাহিনী অনুযায়ী জয়কৃষ্ণ মিত্রের মৃত্যু ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে হয়।
কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের লেখা "রয়েল বেঙ্গল রহস্য" কাহিনীটি অনুযায়ী জয়কৃষ্ণের মৃত্যুর সময় ফেলুদার বয়স মাত্র নয় বছর, কাজেই ১৯৩৮-এ জন্মানো ফেলুদার বাবার মৃত্যু ১৯৪৭-এ হওয়ার কথা।
সত্যজিৎ তার নিজের সৃষ্ট চরিত্রের ব্যাপারেই যে কতগুলো ভুল তথ্য দিয়ে গেছেন তার খোঁজ এই বইটি না পড়লে পাওয়াই যেত না!
–––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––
নোটবুকের কাহিনী নিয়ে এইভাবে আলোচনা আরো অনেকটাই চালিয়ে যাওয়া যায় কারণ ২৭-টি অধ্যায়ের মধ্যে মাত্র আটটি অধ্যায় নিয়ে আলোচনা করেছি, এখনো অনেক বাকি। বিশেষত ফেলুদার কিছু কাহিনী, যেগুলোর নাম সত্যজিৎ উল্লেখ করলেও ঘটনার বিবরণ দেননি এবং "তোপসের নোটবুক"-এ তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে।