বই = দ্য সেভেন বেসিক প্লট হ্যোয়াই উই টেল স্টোরিস (The seven basic plots why we tell stories)
লেখক = ক্রিস্টোফার বুকার (Christopher Booker)
পৃষ্ঠা সংখ্যা = ৭৩৬
মূল্য = ৯৫০ টাকা (২০১৯ খ্রীষ্টাব্দের Paperback সংস্করণ)
প্রথমে কয়েকটি চেনা কাহিনীর সারসংক্ষেপ দেখি।
1] একটি চরিত্র তার চেনা একজনকে ছদ্মবেশে শত্রু-শিবিরে পাঠালো যাতে তাদের নিজের লাভের জন্য ব্যবহার করা যায়। কিন্তু নিজের আসল পরিচয় গোপন রেখে দ্বিতীয় জন যখন শত্রু-শিবিরে যায়, তখন সে তাদের সাথে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে তাদের সমব্যাথী হয়ে যায় এমনকি তাদের একজনের সাথে প্রেমজ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় চরিত্রের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এতটা পড়ে যারা একটু বয়স্ক, তারা হয়তো ভাববেন যে এটি ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দের হিন্দি চলচ্চিত্র "নমক-হারাম"-এর কাহিনী।
যারা তাদের থেকে কম বয়সী তারা ভাববেন যে এটি ১৯৯৫ খ্রীষ্টাব্দের "Pocahontas" চলচ্চিত্রের কাহিনী।
আর যাদের বয়স তাদের থেকেও কম তারা এই কাহিনীটির সাথে ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দের "Avatar" চলচ্চিত্রের কাহিনীর মিল পাবেন।
(এবং এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, শেষ দুটি চলচ্চিত্রের কাহিনীর মধ্যে আরো বেশ কিছু মিল আছে।)
2] নায়ক খুনের মিথ্যা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে আটকে পড়ে। সেখানে সে কিছু নতুন বন্ধু ও শত্রু তৈরী করে। কারারক্ষক তার গুণের সুবিধা নিতে শুরু করে। ফলে সে নিয়মমত জেল থেকে মুক্তি পেতে গেলে কারারক্ষক নিজের অসুবিধার কথা ভেবে তাকে অনৈতিক ভাবে আটকাতে চায় এবং তার উপর অত্যাচার করে। কিন্তু নায়ক এবং তার বন্ধু জেল থেকে মুক্তিলাভ করে এবং কারারক্ষক তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করে।
- উপরের এই কাহিনীটি পড়ে অনেকেই হয়তো স্টিফেন কিং (Stephen King) - এর লেখা "Rita Hayworth and Shawshank Redemption" নভেলাটির কথা ভাববেন যেটি থেকে পরবর্তীকালে ১৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দে "Shawshank Redemption" নামে একটি চলচ্চিত্র প্রকাশ পায়। কিন্তু ২০০৮ খ্রীষ্টাব্দের "Death Race" নামক চলচ্চিত্র কাহিনীর ছকটিও এই রকমই।
প্রায় দেড় বছর আগের একটা কথোপকথন থেকে মনে প্রশ্ন জাগে যে সমস্ত কাহিনীর মূল কাঠামোর মধ্যে কোনো সাদৃশ্য আছে কি না এবং তাদের কোনো নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায় কিনা। এই বিষয়ে অনেকেই কাজ করেছেন এবং তাদের একজন হলেন ক্রিস্টোফার বুকার (Christopher Booker) যিনি সমস্ত কাহিনীগুলিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের কাহিনী বা তাদের রকমফের হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চৌত্রিশ বছর ধরে গবেষণা করার পরে ২০০৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি "The Seven Basic Plots why we tell stories" বইটি প্রকাশ করেন। সেই বই অনুযায়ী ছকগুলি দেখে নেওয়া যাক।
–––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––
(১) Overcoming the Monster / দানবদমন —
এই ক্ষেত্রে অশুভ শক্তির একটি ভয়ানক ও মারাত্মক রূপের সাথে নায়ক লড়াই করে ও তাকে হারায়। এই শক্তিটি নির্দয়ী, অহংকারী এবং আপাতদৃষ্টিতে সর্বশক্তিমান হলেও এর একটি দুর্বলতা দেখা যায়; যার জন্য এটাকে হারানো সম্ভব হয়। সাধারণত, কাহিনীটি যেভাবে উপস্থাপিত হয় তাতে সেটি লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একটি শেষ লড়াইয়ে পৌঁছায়। এইরকম গল্পগুলি এই পাঁচটি ধাপে এগোয়। -
১) প্রত্যাশাপর্যায় এবং 'ডাক' -- সাধারণত, অনেক দূর থেকেই দানব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে এটির ভয়ানক ক্ষমতার সম্পর্কে আমরা আভাসটুকুই পেয়ে থাকি, যদিও কিছু গল্পে শুরুতে এর বিধ্বংসী ক্ষমতার কিছু ঝলক আমরা দেখতেও পারি। আমরা ধীরে ধীরে এর ভয়ঙ্কর খ্যাতি সম্পর্কে জানতে পারি যে কীভাবে এটি কোনও সম্প্রদায়, রাজ্য, দেশ বা পুরো মানবজাতির বিপদের কারণ হয়ে উঠছে। এরপরে নায়ক তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি 'ডাক' অনুভব করে।
২) স্বপ্নপর্যায় -- যুদ্ধের আগমনের জন্য নায়ক প্রস্তুতি নেয় (যেমন - সে দানবের দিকে এগিয়ে যায়) এবং কিছুক্ষণের জন্য এটি বেশ ভালভাবে চলেছে বলেই মনে হয়। বিপদের পূর্ণ ক্ষমতা কিন্তু এখনও দেখা যায় না, কারণ আমরা এখনো একটি নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঘটনাটি দেখতে থাকি।
৩) হতাশাপর্যায় -- শেষ অবধি আমরা যখন দানবের মুখোমুখি হই তখন তাকে পূর্ণ শক্তিতে দেখি। এই সময়ে এসে হঠাৎ খেয়াল করি যে এই রকম অতিপ্রাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নায়ক ছোট এবং একা। এমনকি এমনও মনে হয় যে সে ঐ দানবের শক্তির বশীভূত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি সে অসহায় হয়ে দানবের খপ্পরে পড়তেও পারে। এই সময়ে আমাদের মনে হতে থাকে যে এই লড়াইয়ের কেবল একটি পরিণতি হতে পারে, সেটি হলো নায়কের পরাজয়।
৪) দুঃস্বপ্নপর্যায় -- একটি প্রচন্ড আতঙ্কের লড়াই শুরু হয় যেখানে মনে হয় যে পরিস্থিতি পুরোটাই দানবের অনুকূলেই আছে এবং এটাই নায়কের জন্য চূড়ান্ত অগ্নিপরীক্ষা। তবে গল্পের এই উচ্চতায় এসে যখন নায়ক প্রায় হেরেই গেছে বলে মনে হচ্ছিলো, ঠিক তখন একটি 'পরিবর্তন' আসে।
৫) মৃত্যুর হাত থেকে রোমাঞ্চকর অব্যাহতি ও দানবের মৃত্যু -- ঠিক এই সময়ে এসে দানবটি একটি আশ্চর্য প্রাণঘাতী আঘাতের মুখোমুখি হয়। এর অন্ধকার শক্তি নিপাতিত হয়। যে সম্প্রদায়টি এর কবলে পড়েছিল সেটি বিপদ মুক্ত হয়। সমস্যার মোকাবিলা করে নায়ক তার পূর্ণ মর্যাদায় আসীন হন এবং পুরষ্কার হিসেবে আসে কোনো অসাধারণ ধনসম্পত্তি বা 'রাজকুমারী' - র সাথে মিলন অথবা কোনো 'রাজ্য' - এর উত্তরাধিকার প্রাপ্তি।
(২) Rags to Riches / নির্ধন থেকে সম্পদশালী —
এখানে দেখা যায় যে, কোনো অল্পবয়সী, খ্যাতিহীন নায়ক বা নায়িকা তার দারিদ্র্য ও দুর্দশার থেকে ধীরে ধীরে ঘটনাক্রমে এক অসাধারণ জাঁকজমকপূর্ণ সুখের অবস্থানে পৌঁছায়। তবে তাদের এই অগ্রগতি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে হওয়ার সম্ভাবনা কমই। এই ধরনের গল্পগুলি সাধারণত এই পাঁচটি ধাপে এগোয়। -
১) প্রাথমিক অবস্থার দুর্দশা ও 'ডাক' -- প্রথমে তরুণ নায়ক বা নায়িকার সাথে তাদের প্রাথমিক অবস্থার সাথে আমাদের পরিচয় হয় যখন তারা সাদামাটা ও অসুখী থাকে। এটা সাধারণত তার বাসস্থানেই হয়ে থাকে। তাদের কাছে থাকা বিদ্বেষী 'অন্ধকার' চরিত্রের ছায়ায় তারা ঢাকা পড়ে যায়, যারা তাদের নিন্দা বা অপমান করে অবদমিত করতে থাকে। এটাই তাদের দুর্দশার সর্বাধিক সুস্পষ্ট কারণ হিসেবে দেখা যায়। এই পর্বটি শেষ হয় যখন আরো বৃহত্তর বিশ্বে যাওয়ার জন্য তাদের ডাক পড়ে বা তাদের পাঠানো হয়।
২) বাইরের জগতের সাথে বেরিয়ে প্রাথমিক সাফল্যলাভ -- এই পর্বটি নতুন অগ্নিপরীক্ষা দ্বারা চিহ্নিত করা যেতে পারে। নায়ক বা নায়িকা এখানে তার প্রথম ও সীমিত সাফল্যের মাধ্যমে পুরস্কৃত হয় এবং পরবর্তীকালে তার গৌরবময় নিয়তির কিছুটা পূর্বাভাস এখানে পাওয়া যেতে পারে। তারা তার 'রাজকন্যা' বা 'রাজপুত্র' - এর সাথে প্রথম মুখোমুখি হতে পারে। এমনকি তার 'অন্ধকার প্রতিদ্বন্দ্বী' - কে প্রতিযোগিতায় ছাড়িয়ে যেতে পারে, তবে কেবলমাত্র কিছু অসম্পূর্ণ পদ্ধতিতেই সেটা ঘটে হবে এবং সেটা থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে তারা এখনও তাদের সম্পূর্ণ পরিপূর্ণতার চূড়ান্ত অবস্থার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় নি।
৩) কেন্দ্রীয় সঙ্কট -- হঠাৎ করে সব গোলমাল হয়ে যায়। অন্ধকার চরিত্রগুলির দ্বারা বানানো সঙ্কট ফিরে আসে। বিশ্বের যে কোনও কিছুর চেয়ে তাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো, নায়ক বা নায়িকা তার থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আগের সীমিত জয়ের পরে এই বিপুল পরাজয়ে তাদের এতটাই শক্তিহীন দেখায় যে এটা তাদের কাহিনীর সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
৪) স্বাধীনতা ও চূড়ান্ত অগ্নিপরীক্ষা -- সঙ্কট থেকে বেরোনোর সাথে সাথে আমরা ধীরে ধীরে নায়ক বা নায়িকাকে নতুন আলোয় দেখতে পাই। সে নিজের মধ্যে একটি নতুন স্বাধীন শক্তির আবিষ্কার করতে থাকে যেটা তখনও অপূর্ণ। এই শক্তিটি বিকাশ লাভ করে পূর্ণতা পায় এবং শেষ পর্যন্ত এটিকে একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা অবশ্যই দিতে হয়, যেটি আবার সাধারণত কোনো শক্তিশালী দুষ্ট চরিত্রের সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে হয়। এই চরিত্রটি আবার নায়ক/ নায়িকার দুষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে তাদের এবং তাদের লক্ষ্যের মধ্যে বাধা হিসেবে থাকে; এবং এটি পুরো গল্পের তুঙ্গমুহূর্ত প্রতিষ্ঠা করে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই অর্থাৎ সমস্যাটি সফলভাবে মেটানোর পরেই এবং তার জীবনের উপরের থাকা সঙ্কট পুরোপুরি সরে যাওয়ার পরেই নায়ক/ নায়িকা চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পারে।
৫) চূড়ান্ত মিলন, সমাপ্তি এবং পরিপূর্ণতা লাভ -- সাধারণত 'রাজকুমারী' বা 'যুবরাজ' -এর সাথে প্রেমময় ও সম্পূর্ণ মিলন তাদের প্রাপ্ত পুরষ্কার হিসেবে দেখা যায়। তারা শেষ পর্যন্ত এক ধরণের 'রাজ্য' -এর উত্তরাধিকারীও হতে পারে যার প্রকৃতি কেমন হবে সেটা বিস্তারে নাও জানানো হতে পারে। তবে এই ইঙ্গিত দেওয়া থাকে যে তাদের বর্তমান সুপরিণত অবস্থায় তারা সেখানে বুদ্ধিমত্তার সাথে ভালোভাবে শাসন করবে। ফলে এই গল্পটি একটি এমন চিত্রাঙ্কন করে যেখানে তারা পরবর্তীকালে আজীবৎকাল সুখে - স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করবে।
(৩) The Quest / খোঁজ —
এখানে গল্পগুলিতে প্রত্যাশিতভাবেই নায়ক/ নায়িকা কিছুটা দূরের ও সর্ব-গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের টানে এগিয়ে যায়। তবে এই যাত্রাপথে সে কোনো পর্বে কিছুর দিকে বেশী ঝুঁকে পড়লেও আমরা সর্বদা বুঝতে পারি যে এগুলো মূল লক্ষ্যের তুলনায় গৌণ এবং তার লক্ষ্যপূরণ না হওয়া পর্যন্ত গল্পটি সন্তোষজনকভাবে শেষ হবে না। এই ধরনের গল্পগুলি সাধারণত এই পাঁচটি ধাপে প্রকাশ পায়। -
১) ডাক -- কোনও 'ধ্বংসের শহর' - এর থাকা নায়ক/নায়িকার জীবনযাত্রা দমনপীড়নের শিকার হয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে এবং সে বুঝতে পারে যে দীর্ঘ, কঠিন একটা ভ্রমণের পরেই সে বিষয়গুলি সংশোধন করতে পারবে। এই দূরবর্তী, জীবন বদলে দেওয়া লক্ষ্যের দিকে তার উদ্দেশ্য স্থির করতে তাকে অলৌকিক দিকনির্দেশ দেওয়া হয়।
২) যাত্রা -- নায়ক / নায়িকা এবং তার সঙ্গীরা প্রতিকূল অঞ্চল জুড়ে যাত্রা শুরু করে এবং যাত্রাপথে একের পর এক জীবনসংশয়কারী পরীক্ষার সম্মুখীন হতে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ভয়াবহ দানবকে কাটিয়ে ওঠা, বিভিন্ন প্রলোভন প্রতিরোধ; এবং দুটি মারাত্মক প্রাণঘাতী 'বিপরীত'-ধর্মী বিপদের থেকে সমান দূরত্ব বজায় রেখে মধ্যবর্তী অংশ দিয়ে ভ্রমণ। এগুলির প্রতিটি 'রোমাঞ্চকর পলায়ন' -এর সাথে শেষ হয় এবং প্রতিটি বিপদ আবার পরেই পর্যায়ক্রমে একটি সাময়িক বিরাম পর্ব আসে যেখানে তারা শক্তিসঞ্চয় করে নিজেদের গুছিয়ে নেয়। এই সাময়িক বিশ্রামপর্বে নায়ক ও তার সঙ্গীরা প্রায়শই 'জ্ঞানী বৃদ্ধ' বা 'সুন্দরী যুবতী মহিলা'-র কাছ থেকে আতিথেয়তা, সহায়তা বা পরামর্শ পায়। এই পর্যায়ে নায়ককে 'মৃত্যুলোকের মধ্য দিয়ে যাত্রা' অবধি করতে হতে পারে; যেখানে মৃত্যু যে ক্ষমতা দিয়ে জীবন থেকে তাকে আলাদা করে দিতে পারে, সে সাময়িকভাবে সেটাকে অতিক্রম করে এক তুরীয় অবস্থায় পৌঁছায় এবং এখানে সে তার অতীতের চৈতন্যের সাথে বা কোনো পূর্বপরিচিত ব্যক্তির আত্মার সংস্পর্শে আসে, যেটি তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করে।
৩) আগমন ও হতাশা -- নায়ক/নায়িকা এমন জায়গায় পৌঁছায় যেখান থেকে সে তার লক্ষ্যটি দেখতে পায়। তবে প্রকৃতপক্ষে সে তার গল্পের শেষে পৌঁছানোর থেকে অনেক দূরে রয়েছে, কারণ এখন সে তার নিজের এবং তার পুরষ্কারের মধ্যে নতুন এবং ভয়ানক বাধার সারি দেখতে পায়, এবং তার মূল লক্ষ্যটিকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত করতে গেলে এগুলো তাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে।
৪) চূড়ান্ত পরীক্ষা -- নায়ককে সত্যিকার অর্থেই তিনি পুরষ্কারের যোগ্য বলে প্রমাণ করতে শেষ সারির পরীক্ষা (প্রায়ই তিনটি পরীক্ষা থাকে) দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হয়। এটি একটি সর্বশেষ দুর্দান্ত যুদ্ধ বা অগ্নিপরীক্ষায় পৌঁছায় যা আগের সকল পরীক্ষার মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক।
৫) লক্ষ্য -- একটি অন্তিম 'মৃত্যু থেকে রোমাঞ্চকর অব্যাহতি লাভ' - এর ঘটনার পরে, রাজত্ব বা 'রাজকুমারী' বা জীবন বদলে দেবে এমন সম্পদ নায়ক অবশেষে জিতে নেয়; তার সাথে সে পুনর্জীবিত জীবনের নিশ্চয়তা লাভ করে যেটি অনির্দিষ্টকালের জন্য ভবিষ্যতে কাজে দেবে।
(৪) Voyage and Return / যাত্রা ও প্রত্যাবর্তন —
এখানে নায়ক বা নায়িকাকে হঠাৎ করে তাদের 'স্বাভাবিক' জগৎ থেকে একটি 'অস্বাভাবিক' জগতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং ঘটনাক্রমে শেষ পর্যন্ত যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই সে ফিরে আসে। এইরকম গল্পগুলি এই পাঁচটি ধাপে এগোয়। -
১) প্রত্যাশা পর্যায় এবং অন্য জগতে 'পতন' -- আমরা যখন প্রথম নায়ক / নায়িকার সাথে সাক্ষাৎ করি তখন তার এমন অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা বেশী যেখানে তার চেতনা একরকমভাবে সীমাবদ্ধ। সে তরুণ এবং সরল, কারণ জগৎসংসারের সাথে তার পরিচয় যৎসামান্য ফলে তার অভিজ্ঞতাও কম। ফলে, একটি নতুন অভিজ্ঞতা তাকে মানসিকভাবে উতলা করে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আবার, সে নিজে থেকে সক্রিয়ভাবে কৌতূহলীও হতে পারে, ফলে তার সাথে অপ্রত্যাশিত কোনও কিছুর হওয়ার জন্য সন্ধান করে যায় । সে ক্লান্ত, হতবুদ্ধি বা বেপরোয়াও হতে পারে। তবে যে কারণেই হোক না কেন, তারা তাদের পরিচিত ও সীমিত জীবনকে হঠাৎ করেই একটি অদ্ভুত জগতে খুঁজে পায়; যেটা তাদের পূর্বে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে একদম আলাদা।
২) প্রাথমিক মুগ্ধতা বা স্বপ্নের পর্যায় -- প্রথমে নতুন পৃথিবীর অন্বেষণকারী এই অভিযান ও অনুসন্ধান উৎফুল্লকর হতে পারে, কারণ এটি তার কাছে অপরিচিত জগৎ এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই জগৎটা তার ধাঁধার মতো লাগে। কিন্তু এখানে এসে এর পরিবেশটি তার কাছে কখনোই ঘরোয়া পরিবেশের মতো অনুভব জাগায় না।
৩) হতাশার পর্যায় -- ধীরে ধীরে এই দুঃসাহসিক অভিযানের মেজাজ হতাশা, অসুবিধা বা নিপীড়নের একটিতে পরিবর্তিত হয়। একটি ছায়ার অনুপ্রবেশ শুরু হয় যা ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।
৪) দুঃস্বপ্নের পর্যায় -- ছায়াটি এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে এটি নায়ক বা নায়িকার জীবন সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৫) রোমাঞ্চকর পলায়ন ও ফিরে আসা -- নায়ক বা নায়িকার উপরে আসা বিপদ যখন তার খুব কাছে চলে আসে, ঠিক তখন সে ঐ নতুন বিশ্ব থেকে পালিয়ে গিয়ে তার পুরোনো জগতে ফিরে আসে, যেখান সে যাত্রা শুরু করেছিল। এই মুহুর্তে পুরো অভিযানের মধ্য দিয়ে আসল প্রশ্ন উঠে আসে -
ক) সে কি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?
খ) পরিবর্তন হলে সে কতটা শিক্ষালাভ করেছে?
গ) সমস্তটাই কি 'শুধু একটি স্বপ্ন' ছিলো?
(৫) Comedy / মিলনান্তক —
মিলনাত্মক কাহিনীগুলির মধ্যে প্রচুর ভিন্নতা থাকায় এই গল্পগুলিকে অন্য কাহিনীগুলির মতো হবহু একইভাবে ছাঁদে ফেলা মুশকিল। তাও এদের সারবস্তু এইভাবে বলা যায়। -
১) ছলনায় আটকে থাকা -- এখানে একটি জগৎ দেখা যায় যেখানে মানুষ দ্বিধা - দ্বন্দ্ব, সংশয়, অনিশ্চয়তা এবং হতাশায় ভোগে যার ফলে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
২) জট পাকানো -- এই পর্যায়ে জটিল পরিস্থিতির চাপে সংশয়, হতাশা, পারস্পরিক সমস্যা বেড়ে চরমে পৌঁছায় এবং প্রধান চরিত্রগুলির কাছে এটা দুঃস্বপ্নের মতো প্রতিভাত হয়।
৩) সমস্যার সমাধান -- আগে যা বোঝা যায় নি সেগুলো সবার কাছে আশ্চর্যজনকভাবে নতুন আলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গিয়ে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি নাটকীয়ভাবে মিটে যায় ও সকল সমস্যার সমাধান ঘটে। ঐ জগতের সবাই সম্মিলিতভাবে একটি আনন্দের পরিবেশ লাভ করে।
(৬) Tragedy / বিয়োগান্তক —
এই গল্পগুলির প্রতিটিতে একজন নায়ক /নায়িকাকে কোনো খারাপ বা নিষিদ্ধ কাজের জন্য প্ররোচিত করা হয় বা সে নিজে সেটি করতে উদ্বুদ্ধ হয়। আমরা সাধারণ স্তরগুলি প্রকৃতপক্ষে নির্ধারণ করতে পারি যার মাধ্যমে এর ছকটি প্রকাশিত হয়। সেই পাঁচটি ধাপ হলো -
১) প্রত্যাশা পর্যায় -- নায়ক কোনভাবে অসম্পূর্ণ বা অপূর্ণ; কিছু একটা অস্বাভাবিক তৃপ্তির আশায় তার চিন্তাভাবনা ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। কিছু আকাঙ্ক্ষার বিষয় বা ক্রিয়াকলাপ নিজেই নিজেকে তার সামনে উপস্থাপন করে এবং তার শক্তিগুলি একটি কেন্দ্রবিন্দু খুঁজে পায়।
২) স্বপ্নপর্যায় -- সে কোনোভাবে তার কার্যক্রমের জন্য দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে এবং কিছু সময়ের জন্য বিষয়গুলি প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে নায়ক/নায়িকার পক্ষে যেতে থাকে। যে ইচ্ছা চরিতার্থ করার স্বপ্ন সে দেখেছিল তা সে লাভ করেছে এবং মনে হতে থাকে যে এই রকম কাজ করার পরেও সে 'নিস্তার পেয়ে যাচ্ছে'।
৩) হতাশার পর্যায় -- ঘটনাগুলি প্রায় অগোচরে থেকে নায়ক /নায়িকার বিপক্ষে যেতে থাকে। সে থামার কোনো অবকাশ পায় না। সে হতাশা অনুভব করতে শুরু করে এবং নিজের অবস্থান সুরক্ষিত করতে আরও 'খারাপ কাজ' করতে বাধ্য হতে পারে যা তাকে আরো সংশোধনাতীতভাবে তার কর্মকান্ডের পথেই আটকে রাখে। এই মুহূর্তে একটি 'অশরীরী চরিত্র' উপস্থিত হতেও পারে, যেটি তাকে কোনো দুর্জ্ঞেয়ভাবে ভয় দেখায়।
৪) দুঃস্বপ্নের পর্যায় -- বিষয়গুলি এখন নায়কের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গুরুতরভাবে পিছলে যায়। তার মধ্যে বিপদ ও হতাশার বোধ বাড়তে থাকে। বিরোধী শক্তি ও ভাগ্য ক্রমশ তার কাছে এসে তার পতন তরান্বিত করে।
৫) ধ্বংস বা মৃত্যুর ইচ্ছার পর্যায় -- তার আগের কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত বাহিনী দ্বারা অথবা হিংসতার কোনো চূড়ান্ত কার্যকলাপ দ্বারা নায়ক সর্বনাশ ডেকে আনে যা তার নিজের মৃত্যু (হত্যা বা আত্মহত্যা) ঘটায় এবং সে ধ্বংস হয়।
(৭) Rebirth / পুনরুজ্জীবন —
এই রকম গল্পের বুনিয়াদী ধারাগুলি এমন -
১) একজন তরুণ নায়ক বা নায়িকা অন্ধকার শক্তির ছায়ায় ঢাকা পড়ে।
২) কিছুক্ষণের জন্য সমস্ত কিছু যথাযথভাবে ও ঠিকঠাক চলছে বলে মনে হতে পারে, এমনকি বিপদ চলে গেছে বলেও মনে হতে পারে।
৩) কিন্তু ঘটনাক্রমে শেষ পর্যন্ত এটি আবার পূর্ণশক্তিতে ফেরত আসে এবং নায়ক বা নায়িকাকে জীবন্মৃত অবস্থায় আটকে দেয়।
৪) দীর্ঘ সময় লড়াই অব্যাহত থাকে এবং যখন মনে হয় যে অন্ধকার শক্তি সম্পূর্ণভাবে জয়ী হয়েছে।
৫) কিন্তু শেষে নিজে থেকে বা কোনো যুবতী বা যুবক বা শিশুর সাহায্যে নায়ক/নায়িকার আশ্চর্য উপায়ে মুক্তিলাভ হয় এবং অন্ধকার শক্তি হার মানে।
–––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––
আপাতত এই নিয়েই আলোচনা হোক। দেখা যাক আপনার পড়া কোন কোন কাহিনীতে এর মধ্যে কোন ধরনের ছকের উপস্থিতি আপনি খুঁজে পান।
উদাহরণ — মতি নন্দীর লেখা "অলৌকিক দিলু" এবং সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের লেখা "জিপুর যাওয়া-আসা"-এর কাহিনীর মধ্যে অনেকে মিল পেলেও প্রথমটির মূল কাহিনীসূত্রটি "খোঁজ" -এর উপর ভিত্তি করে লেখা এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেটি "যাত্রা এবং প্রত্যাবর্তন"-এর উপর ভিত্তি করে লেখা।
পরবর্তী পর্বে বইটিতে লেখা বাকি ধারণাগুলি নিয়ে আলোচনা করবো। বইটি যথেষ্ট দীর্ঘ হওয়ায় একটি পর্বে সমস্ত আলোচনাটি করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।