আজকে এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি যেটা সাহিত্যের শিল্প হিসেবে অনেকের কাছেই পদবাচ্য হয়ে ওঠেনি (যা নিয়ে স্বয়ং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ক্ষোভপ্রকাশ করে গেছেন)। সেটি হলো Detective Fiction বা গোয়েন্দা কাহিনী। এই গোয়েন্দা কাহিনীর বিষয়ে, বিশেষত তার ইতিহাস নিয়ে আরো ভালোভাবে জানতে সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত প্রলয় বসু লিখিত "গোয়েন্দা রহস্যের সন্ধানে" বইটি পড়ে দেখতে পারেন (প্রচার করছি না, আর এর জন্য টাকাও পাই নি!)। এছাড়া সুকুমার সেনের ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি বইটাও আছে, যদিও আমার সেটা অতটা ভালো লাগেনি।
কারণ, আমার আলোচনার বিষয়বস্তু একটু ভিন্ন, যেটি হলো — গোয়েন্দা কাহিনী এবং গোয়েন্দাকে কেমন করে চিনবেন। বলা যেতে পারে যে, গোয়েন্দা কাহিনীগুলি একটি ধাঁধার মতো, যেখানে অপরাধী এই ধাঁধাটি তৈরী করে আর গোয়েন্দা তার উত্তর খুঁজতে থাকেন। কিন্তু একসময় যখন জনপ্রিয়তার জন্য সবাই মিলে নানারকম কাহিনী লিখে সেগুলিকে গোয়েন্দা কাহিনী হিসেবে দাবী করতে শুরু করলেন (সাম্প্রতিক কালে তন্ত্র নিয়ে বাংলা সাহিত্য একই অবস্থা তৈরী হয়েছে), তখন এর ধারাকে সঠিক পথে রাখার জন্য গোয়েন্দা গল্পের কিছু নিয়ম সাহিত্য সমালোচকরা এবং স্বয়ং লেখকরা ঠিক করতে থাকলেন যাতে কোনটি গোয়েন্দা কাহিনী আর কোনটি তা নয় — এই পার্থক্যটা বোঝা যায়, যার সাথে রহস্যভেদ করার জন্য কাহিনীর গোয়েন্দার সমান সুযোগ পাঠক নিজে পায়। এই নিয়মগুলোর লেখার ক্ষেত্রে তিনজনের নাম করতেই হয় - উইলার্ড হান্টিংটন রাইট (Willard Huntington Wright [S.S. Van Dine ছদ্মনামে]), রোনাল্ডো নক্স (Ronald Knox), রেইমন্ড চান্ডলার (Raymond Chandler)। প্রথম জন কুড়িটি, দ্বিতীয় জন দশটি এবং তৃতীয় জন পঁচিশটি নিয়ম বা শর্ত মেনে চলার কথা বলে গেছেন। সেগুলো এইরকম --
–––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––
অ) গোয়েন্দার ও সত্যসন্ধানের বৈশিষ্ট্য ————
১) রহস্য গল্পের নায়ক হলো গোয়েন্দা। সবকিছু তাঁর ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। কাহিনীতে তার ব্যক্তিত্ব বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না থাকলে পাঠক হিসেবে আপনার কাছে খুব অল্প উপাদান থাকে।
২) গোয়েন্দা উপন্যাসটির অবশ্যই একটি গোয়েন্দা থাকতে হবে এবং একটি গোয়েন্দা ততক্ষণ অবধি গোয়েন্দা হয় না যতক্ষণ না সে সূত্র খুঁজে পায়। গোয়েন্দা যদি একটি ক্ষেত্রেও কোনো সূত্র ছাড়াই ধাপ পেরিয়ে সমাধানে পৌঁছে যায়, তাহলে সে গোয়েন্দা নয়।
৩) গোয়েন্দা কাহিনীতে কেবল একটিই গোয়েন্দা থাকবে যে সূত্র খুঁজে বেড়াবে, যদিও তার এক বা একাধিক সহকারী থাকতে পারে। কিন্তু মূল কাজ করবে গোয়েন্দা নিজেই। কারণ, মাথায় রাখা দরকার যে একাধিক জন মিলে একটি ধাঁধার সমাধান করলে আসল কৃতিত্ব কার সেটা নিয়ে পাঠকের মনে সন্দেহ তৈরী হবে এবং এতে গোয়েন্দা চরিত্রটির মূল্য পাঠকের কাছে কমে যাবে।
৪) যুক্তি দিয়ে পাওয়া সিদ্ধান্ত (যাদের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্ক থাকবে) থেকেই গোয়েন্দাকে অপরাধীকে শনাক্ত করতে হবে; কোনো কাকতলীয় ঘটনা, দুর্ঘটনা অথবা অকারণ উদ্দেশ্যহীন স্বীকারোক্তি ছাড়াই। বিশেষত এইসব কায়দার মাধ্যমে পাঠককে বুনো-হাঁসের পিছনে দৌড়াতে বাধ্য করার পরে যখন সে স্বভাবতই ব্যর্থ হয়, তখন তাকে সমাধান বলে দিয়ে এটা দেখানো যে, ধাঁধার উত্তর প্রথম থেকেই লেখকের হাতের কাছেই ছিলো; পাঠকের কাছে এই ধরনের লেখক ভাঁড়ের থেকে বেশী কিছু নন।
৫) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া গোয়েন্দার পক্ষে কোনো অনুমান করা উচিৎ নয় যেটি ঘটনাচক্রে সঠিক প্রমাণিত হবে।
৬) গোয়েন্দা যদি প্রশিক্ষিত পুলিশ হয় তবে তাকে অবশ্যই তেমনই আচরণ করতে হবে এবং সেই মানসিক ও শারীরিক অবস্থার অধিকারী হতে হবে যা কাজের জন্য লাগে। তিনি যদি কোনও বেসরকারী তদন্তকারী বা অপেশাদার হন তবে পুলিশের কর্মপদ্ধতি এবং আইন সম্পর্কে তাকে অন্তত ততটা জানতে হবে যাতে তিনি পরিহাসের পাত্র না হয়ে যান।
৭) গোয়েন্দার প্রেম করা যাবে না। কারণ গোয়েন্দা গল্পের লক্ষ্য হলো অপরাধের সমাধান করে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা, প্রেমিক ও প্রেমিকার মিলন বা বিচ্ছেদ ঘটানো নয়।
গোয়েন্দার কোনো চরিত্র প্রতি প্রেমের আগ্রহ তৈরী হলে তা সর্বদাই একটি রহস্য গল্পকে দুর্বল করে দেয়। কারণ এটি এক ধরণের উদ্বেগ তৈরী করে যা সমস্যা সমাধানের জন্য গোয়েন্দা যে কঠিন লড়াই করে তার পরিপূরক নয়, বরং বিরোধী। যে ধরণের প্রেমের উপাদান কাজে দেয় তা হলো যেটি মূল অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে গোয়েন্দার জন্য সমস্যাটি জটিল করে তোলে, কিন্তু এরই সাথে পাঠকের মনে হবে যে এই প্রেমটি স্থায়ী হবে না। একজন সত্যিকারের ভাল গোয়েন্দা কখনও বিয়ে করবে না, কারণ সেটা হলে সে তার নির্লিপ্ততাটি হারাবে যেটা তার গুণের অংশ।
অর্থাৎ সোজা কথায়, গোয়েন্দার সমস্ত মনোযোগ থাকবে সমস্যা সমাধানের প্রতি, কাহিনীর সাথে সম্পর্কহীন বিষয়ে নয়।
৮) বিভিন্ন পত্রিকায় ও চলচ্চিত্রের গোয়েন্দা কাহিনীতে নারী চরিত্র যোগ করে প্রেম দেখানো হলেও সেগুলো কাহিনীগুলিকে শৈল্পিক করে তোলে না। কারণ, তাদের লক্ষ্য শিল্প নির্মাণ নয়, বরং পাঠক হিসেবে মহিলাদের আকৃষ্ট করা। শিল্প হিসাবে তারা কোনও ধরণের লেখায় আগ্রহী নয়।
৯) গোয়েন্দা সোজা কথা ঘুরিয়ে বললে সেটা তার বুদ্ধিকে প্রতিষ্ঠা দেয় না।
১০) গোয়েন্দা নিজেই অপরাধটি করে তার তদন্ত করলে চলবে না। কারণ, সংজ্ঞা এবং ঐতিহ্য অনুসারে গোয়েন্দা হলেন সত্যের সন্ধানকারী। সে প্রথম থেকেই সত্যিটা জেনে বসে থাকলে সে সত্যসন্ধানী হতে পারে না। রহস্য সমাধানের শুরুতে গোয়েন্দা ও পাঠক যে একই জায়গায় আছে এটার নিশ্চয়তা রহস্য কাহিনীতে পরোক্ষে বোঝানোই হয়।
১১) গোয়েন্দা উত্তম পুরুষে কাহিনী বর্ণনা করলেও সেটির বিরুদ্ধে নিগূঢ় প্রতারণার অভিযোগ আসতে পারে, কারণ সেটি অকপটতার ভানের সাথেই গোয়েন্দার সঠিক যুক্তিসম্মত চিন্তা-প্রক্রিয়াটিকে লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা রাখে, বিশেষত যখন সেটি গোয়েন্দার চিন্তাভাবনা এবং কাজের স্পষ্ট বিবরণ দিয়ে যায়। কাহিনীটি গোয়েন্দা যতই অকপটে বলে চলুক না কেন, একটা সময় আসে যেখানে সে সূত্রগুলি থেকে চিন্তা করে কোনো সিদ্ধান্তে আসে যেটা সে কাহিনীর শেষে বাকি চরিত্রদের কাছে ফাঁস করার আগে পাঠককে জানায় না। আর আগে জানিয়ে দিলে পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা প্রবল।
১২) গোয়েন্দার সহকারী বা সঙ্গীটি কাহিনীটি বিবৃত করলে তার মনের সমস্ত চিন্তা পাঠকদের অবশ্যই জানাবে। গড়পড়তা পাঠকের তুলনায় তার বুদ্ধি অবশ্যই কম হবে, কিন্তু সেই পার্থক্যটা খুবই অল্প হবে।
এটা সাধারণ পাঠককে একটা স্বস্তি দেবে যে আমি গোয়েন্দা থেকে কম বুদ্ধিমান হলেও তার সহকারীর থেকে অন্তত বেশী বুদ্ধিমান, কিন্তু তাই বলে সহকারীটিকে অত্যন্ত বোকা দেখালে পাঠকের মনে এগিয়ে থাকার সেই আনন্দটা আসবে না।
আ) অপরাধী ও অপরাধের বৈশিষ্ট্য ————
১) মোটামুটিভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো চরিত্র যার সাথে পাঠক সুপরিচিত এবং যাকে নিয়ে পাঠকের আগ্রহ আছে, তেমন কাউকে অপরাধী হয়ে উঠতে হবে।
২) অপরাধীর উল্লেখ গল্পটির প্রথম দিকেই করতে হবে, কিন্তু এমন কেউ হলে চলবে না যার মনের চলতে থাকা ঘটনাগুলি সম্পর্কে পাঠক ওয়াকিবহাল।
অপরিচিত রহস্যময় কোনো ব্যক্তি যার অস্তিত্ব কাহিনীর শুরু থেকে পাঠকের আন্দাজ করার কোনো উপায়ই ছিলো না, এমন চরিত্রকে অপরাধী হিসেবে দেখালে কাহিনীর উদ্দেশ্যটাই মাটি হয়ে যায়। এটি বলাই সঠিকতর হবে যে, রহস্যের আবহে একটি চরিত্রকে লোকানো উচিৎ নয় যাকে অপরাধী হিসেবে পরে দেখা যাবে।
৩) ঘরের চাকরের মতো কাউকে অপরাধী হিসেবে নির্বাচন করা যাবে না। সেটি হলে এটি খুবই সহজ সমাধান হবে। অপরাধী এমন হবে যে সাধারণত সন্দেহের মধ্যে আসে না।
৪) এমন কোন চরিত্রকে অপরাধী বানানো যাবে না যার চেহারা দেখলেই অপরাধী বলে মনে হবে ("No Chinaman" rule)।
৫) কোনও অপরাধী ছদ্মবেশ নিয়ে (এমনকি গোয়েন্দা হিসাবেও) গল্পের অন্যান্য চরিত্রদের সহ পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে। তবে কোনো চরিত্র ছদ্মবেশ নিলে তার এই ক্ষমতার কথা আগেই উল্লেখ করতে হবে, সোজাসুজি সমাধানের সময়ে নয়।
৬) অপরাধী কখনোই পাগল হবে না অথবা কেউ পাগল হয়ে অপরাধ ঘটাবে না। আইনী অর্থে অপরাধ না করলে অপরাধী অপরাধীই নয়।
৭) অপরাধ যতগুলিই হোক, কেবলমাত্র একজন মূল অপরাধী থাকবে। তার ছোটখাটো সহায়ক বা সহকারী অপরাধী থাকতে পারে, কিন্তু মূল অপরাধী যেন একজনই হয়। নাহলে এক্ষেত্রেও একাধিক গোয়েন্দা থাকার মতো সমস্যা দেখা দেবে।
৮) গোপন সমিতি বা চক্রের মতো কোনো জিনিস গোয়েন্দা কাহিনীতে থাকবে না। কোনো অপরাধী যাই করুক সেটা যেন তার নিজস্ব দক্ষতায় করে, কোনো সংগঠনের সাহায্যে করলে কাহিনীতে অপরাধীর গুরুত্ব কমে গিয়ে সংগঠনটি গুরুত্ব বেড়ে যায়।
৯) একজন পেশাদার অপরাধী কোনো গোয়েন্দা গল্পের অপরাধ সংঘটিত করবে না। সিঁধেল চোর বা ডাকাতদের দ্বারা অপরাধগুলি হ'ল পুলিশ বিভাগের তদন্তের কাহিনীর আওতায় পড়ে, প্রতিভাবান অপেশাদার গোয়েন্দাদের কাহিনীর এলাকায় নয়।
১০) একটি গোয়েন্দা গল্পের একটি অপরাধ শেষ পর্যন্ত কখনই কোনো দুর্ঘটনা বা গল্পের কোন খুন আত্মহত্যা হিসাবে প্রকাশ পাবে না। একটি গোয়েন্দা কাহিনীতে এইরকম ভাবে পবর্তের মূষিকপ্রসব করার অর্থ হলো বিশ্বাসী ও দয়ালু পাঠককে প্রবঞ্চনা করা।
ই) কাহিনীর বৈশিষ্ট্য ————
১) কাহিনীটির অপরাধ এবং তার সমাধানটি অবশ্যই প্রত্যয়যোগ্যভাবে উদ্দেশ্যমূলক হবে। এটিকে অবশ্যই সম্ভাবনীয় পরিস্থিতিতে বিশ্বাসযোগ্য লোকদের সম্ভাবনীয় কর্মের সমন্বয়ে গঠিত হতে হবে। এটি মনে রাখা উচিত যে বিশ্বাসযোগ্যতা মূলত শৈলীর বিষয়।
২) কাহিনীটি অবশ্যই অপরাধ এবং সনাক্তকরণের পদ্ধতিগুলির বিষয়ে প্রযুক্তিগতভাবে সাবলীল হতে হবে।
৩) রহস্য সমাধানের জন্য পাঠকের অবশ্যই গোয়েন্দাদের সমান সুযোগ থাকতে হবে। গোয়েন্দা যা যা সূত্র পাবে সেই সমস্ত সূত্র (Clue) অবশ্যই স্পষ্টভাবে ও বিশদেপাঠকদের কাছে প্রকাশ করতে হবে।
কাহিনীটি অবশ্যই পাঠকের সাথে সৎ হবে। যেকোনো লেখকই সূত্র গোপন করে রহস্য তৈরী করতে পারে, কিন্তু প্রকৃত লেখকের মুন্সিয়ানা সেখানেই, যেখানে পাঠকের সামনে সূত্র দেওয়ার পরেও পাঠক সমস্যাটির সমাধান করতে পারে না।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি গোপন করা উচিত তো নয়ই, তার সাথেই তাদের উপর ভুলভাবে জোর দিয়ে বা তথ্যবিকৃত করে পাঠককে বোকা বানানো উচিৎ নয়। সমস্ত ভাল রহস্যকাহিনীর মূল তত্ত্বটি হলো যে, সমস্যা সমাধান করার মতো উপকরণগুলি গল্পের খুব পরের দিকে নয় এমন কোনো পর্যায়ে পাঠকের কাছেই ছিলো। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা দরকার যে ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা করার জন্য যদি বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রয়োজন হয় যেটা পাঠকের কাছে যদি না থাকে, তাহলে তার পক্ষে সমাধান করাও সম্ভব নয়।
বোধহয়, এই থেকেই অস্টিন ফ্রিম্যান (Austin Freeman) বিপরীতমুখী গোয়েন্দা গল্প (inverted detective story) - এর তৈরী করেন, যেখানে পাঠক প্রথম থেকেই সমাধানটি জানেন এবং গোয়েন্দাকে সেই দিকে ধাপে ধাপে এগোতে দেখে (Howcatchem) পরিতোষ লাভ করেন।
৪) অপরাধী নিজে গোয়েন্দা তথা কাহিনীর বাকি চরিত্রদের সাথে যেসব কৌশল বা প্রতারণা করছে সেগুলো বাদে আর কিছু কৌশল বা প্রতারণা ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠকের সাথে করা যাবে না।
৫) উত্তম পুরুষে কাহিনী বলা হলে সেক্ষেত্রেও সেই ব্যক্তির অপরাধী হওয়া অনুচিত। কারণ, যিনি কাহিনীটি বলছেন তিনি সত্য জেনেও চেপে থাকলে বা না জানার ভান করলে, সেটা পাঠকদের ঠকানো।
৬) একটি গোয়েন্দা উপন্যাসে বর্ণনামূলক দীর্ঘ অংশ থাকবে না, মূল কাহিনীর বাইরে থাকা সংযুক্ত কাহিনী নিয়ে সময় ব্যয় করা উচিত নয়, যে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি একবার স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে সেগুলো নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারের দরকার নেই, গল্পের আবহাওয়া বা পরিবেশ নিয়ে তন্ময় হওয়া চলবে না। অপরাধ ও তার অবরোহ প্রমাণের জগতে এইসব জিনিসগুলি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এগুলি গল্পের গতি আটকে দেয় এবং মূল লক্ষ্য থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। যেখানে গোয়েন্দা গল্পের মূল লক্ষ্য -
ক) সমস্যার বর্ণনা দেওয়া,
খ) সমস্যার বিশ্লেষণ করা,
গ) সফলভাবে একটি সিদ্ধান্তে আশা।
বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য জানিয়ে রাখা যায় যে, উপন্যাসটি যাতে আপাতভাবে সত্য বলে মনে হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় বিবরণ এবং চরিত্রগুলির বর্ণন উপস্থিত থাকবে।
৭) কাহিনীটির চরিত্র, বিন্যাস এবং পরিবেশ অবশ্যই বাস্তবসম্মত হতে হবে। এটি অবশ্যই বাস্তব বিশ্বের সত্যিকারের লোকদের সম্পর্কে হবে। পাঠক যে গল্পটি বার বার পড়ে এবং যে গল্পটিকে শুধু চোখ বুলিয়ে উপর উপর চলে যায়, তাদের মধ্যে এই বাস্তবতাই পার্থক্য গড়ে দেয়।
৮) রহস্য উপাদানটি বাদ দিলেও এটির একটি কাহিনী হিসেবে মান থাকতে হবে, অর্থাৎ তদন্তের অংশটি নিজেই আলাদাভাবে পড়ার যোগ্য হবে।
৯) রহস্যের পরিবেশ তৈরীর জন্য কাহিনীতে কোনো একরকমের উদ্বেগ তৈরী করতেই হবে, এমনকি সেটা বৌদ্ধিক হলেও চলবে। তার মনে এই নয় যে ভয়াবহ বিপদ এবং বিশেষত গোয়েন্দার নিজের ব্যক্তিগত জীবনের উপরে প্রাণঘাতী বিপদ চলে আসবে। একাধিক কাহিনীসূত্র (Plot) থাকা গল্পও নিরস হয়ে যেতে পারে, অতিরিক্ত অভিঘাত প্রয়োগে পাঠকের মন অভিঘাতের প্রতি অসাড়ও হতে পারে। তবে শারীরিক, নৈতিক বা অনুভূতিগত দিক থেকে কোনো দ্বন্দ্ব থাকতে হবে এবং বিপদের কিছু একটা উপাদান থাকতেই হবে।
১০) এতে অবশ্যই রঙ, উত্তোলন এবং যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে গতি থাকতে হবে। কাহিনীর শৈলী নিস্তেজ হলে সেটার ক্ষতিপূরণ দিতে প্রচুর পরিমাণে প্রযুক্তিগত ধূর্তামি করতে হয়।
১১) কাহিনীতে বাড়ির মধ্যে একটির বেশী গোপন ঘর বা গোপন রাস্তা রাখা যাবে না (যদি না সেই জায়গাটিই এমন ধরনের হয়)।
১২) যখন দরকার হবে তখন সহজে ব্যাখ্যা করার জন্য কাহিনীতে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় সরলতা থাকতে হবে। রহস্যের আদর্শ যবনিকা উত্তোলন সেটাই যেখানে চকিতে সমস্ত কিছু প্রকাশ পাবে। ব্যাখ্যা অতি সংক্ষিপ্ত হওয়ার দরকার নেই এবং প্রায়শই এটি সংক্ষিপ্তও হতে পারে না। কিন্তু এটি অবশ্যই নিজেই আকর্ষণীয় হবে এবং পাঠক শুনতে আগ্রহী এমন কিছু হতে হবে, সমাধান দিতে গিয়ে গল্পের জটিল কাহিনীসূত্রকে নায্য প্রমাণ করতে নতুন চরিত্র যোগ করে আরেকটি কাহিনী শুরু করা যাবে না।
১৩) এটি অবশ্যই যুক্তিপরায়ণ বুদ্ধিমান পাঠককে হতবাক করতে হবে। তাই, পাঠক সম্পূর্ণ সমাধানটি অনুমান করতে পারবে না বা যুক্তিসহ প্রমাণ দিতে পারবে না। তবে বিভিন্ন বৌদ্ধিক ক্ষমতার পাঠক থাকায় কেউ কেউ অত্যন্ত জটিল রহস্যেরও সমাধান করতে পারবে, অন্যদিকে কেউ আবার সহজতম সমস্যাটিরও সমাধান চোখের সামনে রাখা থাকলেও দেখতে পাবে না। তাই, গল্পের অন্তত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকবে যা চিন্তাশীল পাঠককেও হার মানাবে।
১৪) সমাধান প্রকাশ করা হলে সেটি অনিবার্যরূপে দেখা যাবে যেন সেটি ছাড়া আর কোনও সমাধান সম্ভবই ছিলো না। সমস্যার সমাধান সর্বদা অবশ্যই স্পষ্ট হবে, তবে পাঠককে তা দেখার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধিমান হতে হবে। অর্থাৎ, ধাঁধার সমাধান বা অপরাধের ব্যাখ্যাটি দেওয়ার পরে পাঠক যদি কাহিনীটি আবার পড়ে, তবে সে যেন দেখতে পায় যে, সমস্ত সূত্র সত্যই অপরাধীর দিকে ইঙ্গিত করেছিল এবং সমাধানটি যেন তার চোখের সামনেই ছিলো এবং সে যদি গোয়েন্দার মতো চালাক হতো তবে তিনি চূড়ান্ত অধ্যায়ে না গিয়েই রহস্যটি নিজেই সমাধান করতে পারতো। বুদ্ধিমান পাঠক যে প্রায়শই এভাবেই সমস্যার সমাধান করে তা না বললেও বোঝা যায়।
পাঠককে শুধু বোকা বানানো তার বুদ্ধিকে টপকে যাওয়াই যথেষ্ট নয়; কাহিনীটি পড়ে তার অবশ্যই অনুভব হবে যে তার সমাধানটি করা উচিৎ ছিলো এবং সম্মানজনক ভাবে, তাকে কোনো ছলনা না করেই তার বুদ্ধিকে অতিক্রম করা হয়েছে।
১৫) অপরাধের পদ্ধতি অবশ্যই যৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি মেনেই হতে হবে। কল্পবিজ্ঞান বা অলৌকিক পদ্ধতিতে অপরাধ করা চলবে না।
১৬) একইভাবে, অপরাধ শনাক্ত করার উপায়গুলি এবং সমাধানটি অবশ্যই যৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি মেনেই হতে হবে। এখানেও, কল্পবিজ্ঞান বা অলৌকিক পদ্ধতিতে সমাধান করা চলবে না।
দৈবিক বা ভৌতিক অর্থাৎ সমস্ত অলৌকিকতাকে কারণ হিসেবে অস্বীকার করতে হবে।
১৭) এখন অবধি আবিষ্কার হয়নি এমন কোন বিষ ব্যবহার করা যাবে না, বা এমন কোনও সরঞ্জাম থাকবে না যেটি জন্য শেষে একটি বিজ্ঞানসম্মত দীর্ঘ ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
মাথায় রাখতে হবে যে, এটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো প্রবন্ধ বা কল্পবিজ্ঞানের কোনো কাহিনী নয়, বরং রহস্য কাহিনী। তাই মূল লক্ষ্য সর্বদা রহস্য তৈরীর দিকে থাকবে, অন্য কোনো দিকে নয়।
১৮) কাহিনীর মধ্যে একসাথে সমস্ত কিছু করার চেষ্টা করা অনুচিত। এটি যদি সাধারণ যুক্তিসঙ্গত পরিবেশে হওয়া একটি ধাঁধার গল্প হয়, তাহলে একসঙ্গে এটি উগ্র দুঃসাহসিক অভিযান অথবা প্রগাঢ় প্রেমকাহিনী হতে পারে না।
১৯) একটি সাধারণ রহস্যকে গোপন করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো অন্য রহস্যের পিছনে সেটিকে লোকানো। এটি সাহিত্যিক হাতসাফাইয়ের খেলা। আপনি সঙ্কেত লুকিয়ে বা নকল চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য যোগ করে পাঠককে বোকা বানাবেন না, বরং তাকে বোকা বানাবেন ভুল সমস্যার সমাধান করতে বাধ্য করে।
২০) একটি গোয়েন্দা উপন্যাসে একটি মৃতদেহ থাকতেই হবে এবং হত্যার থেকে ছোট কোনো অপরাধ একটি পঞ্চাশহাজার শব্দের কাহিনীতে পাঠকের মনোযোগ বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।
২১) "কেউই মৃতদেহকে পাত্তা দেয় না।" - এটা বলা হয়ে থাকে। এই দাবীটি ভুল। এটি বলার অর্থ একটি মূল্যবান উপাদান উপেক্ষা করা। অচেনা কোনো ব্যক্তির মৃত্যু থেকে গল্পের চরিত্রদের সাথে সম্পর্ক থাকা ব্যক্তির মৃত্যু অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
২২) একটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত রহস্য কাহিনী ভালো রহস্য উপন্যাস হয় না। কারণ, পরবর্তী অধ্যায়টি একসাথে না পড়ার উপর আগের অধ্যায়ের "উপসংহার"-টি নির্ভরশীল। উপন্যাস আকারে এই "উপসংহার"-গুলি একটি মিথ্যা উদ্বেগ তৈরী করে যা বিরক্তিকর।
২৩) গোয়েন্দা গল্পের সমস্ত অপরাধের উদ্দেশ্যগুলি ব্যক্তিগত হওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ - আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এবং যুদ্ধের রাজনীতি নিয়ে কল্পকাহিনিগুলি একটি পৃথক বিভাগের অন্তর্গত, যেটি গুপ্তচর-বিভাগীয় কাহিনী বলে খ্যাত। তবে এটা বলাই যায় যে, একটি খুনের গল্পে পাঠককে স্বাচ্ছন্দ্যময় রাখতে হবে অর্থাৎ এটি অবশ্যই পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাগুলির সাথে মিলে যাবে এবং তার নিজের অবদমিত বাসনা এবং আবেগের জন্য একটি কোনো নির্গমনপথ খুলে দেবে।
২৪) এখানে কয়েকটি কয়েকটি কাহিনী-কৌশলের নাম তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে যা কোনও আত্মসম্মানযুক্ত গোয়েন্দা-গল্প লেখক এখন নিজেরাই ব্যবহার করতে চাইবেন না। এগুলো প্রায়শই ব্যবহৃত হয়েছে এবং অপরাধমূলক সাহিত্যপ্রেমীদের পরিচিত। এগুলি ব্যবহার করা হলো লেখকের দক্ষতাহীনতা এবং মৌলিকত্বের অভাবের স্বীকারোক্তি।
(ক) অপরাধের ঘটনাস্থলে থাকা সিগারেটের পিছনের অংশের সাথে কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তি যে বিশেষ মার্কা দেওয়া সিগারেট খান, তাদের তুলনা করে অপরাধীর পরিচয় নির্ধারণ করা।
(খ) ভূত ডেকে অপরাধীকে ভয় দেখিয়ে স্বীকার করতে বাধ্য করা।
(গ) নকল আঙুলের ছাপ।
(ঘ) নকল মূর্তি দিয়ে কোনও মানুষ বুঝিয়ে অ্যালিবাই তৈরী করা।
(ঙ) কুকুরটি যে ডাকে না তা বলে দিয়ে অনুপ্রবেশকারীটি যে পরিচিত সেটি জানানো।
(চ) যমজ বা প্রায় একই রকম দেখতে ব্যক্তির কে শেষে গিয়ে হঠাৎ অপরাধের সমাধান বা তার অংশ হিসেবে হাজির করা।
(ছ) হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ এবং অজ্ঞানকারী তরল ব্যবহার করা।
(জ) পুলিশের প্রকৃতপক্ষে প্রবেশের পরে একটি বন্ধ ঘরে হত্যা ঘটানো।
(ঝ) দোষী কি না জানতে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর সন্দেহভাজনদের দিয়ে চটজলদি বলিয়ে সেই উত্তর থেকে পাওয়া শব্দের সাথে অপরাধের সম্পর্কের ভিত্তিতে অপরাধী নির্বাচন।
(ঞ) সাইফার বা সাঙ্কেতিক চিঠি, যেটি শেষে গোয়েন্দা প্রকাশ করে।
২৫) নিখুঁত গোয়েন্দা গল্প লেখা যায় না। নিখুঁত সমস্যাটি বিকশিত করতে পারে এমন মননটি লেখার শৈল্পিক কাজ তৈরি করতে পারে না। এছাড়া, পাঠকের মনোভাবও এর জন্য দায়ী। পাঠকরা অনেক ধরণের এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির হন। কেউ ধাঁধার সমাধান করতে আগ্রহী থাকেন, কেউ অপরাধের মধ্যে উত্তেজনার উপাদান খোঁজে, কেউ আবার চরিত্র চিত্রণ নিয়েই ভাবে। কাজেই, এই সমস্ত পাঠককে একসাথে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করা অসম্ভব।
–––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––––
আপাতত এই নিয়মগুলি নিয়ে নিজস্ব মতামত দিন। কারণসহ জানান যে কোনটি মেনে চলাই ভালো আর কোনটি মেনে চলাই মুশকিল।
আর এই নিয়মগুলির ভিত্তিতে আপনার প্রিয় গোয়েন্দা অথবা গোয়েন্দা কাহিনী কতগুলি নিয়ম মেনেছে আর কতগুলি ভেঙেছে সেটাও দেখুন।
পরবর্তী অংশে সেইমত আলোচনা করা যাবে
আপাতত ভাসিয়ে দিয়ে যাই। এটা মনে হয় মলাটে পড়েছি।
খুবই ভালো লাগছে। এই নিয়ে আমি আগে পড়িনি। ইন্টারেস্টিং আলোচনা। যে নিয়মগুলো দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে 'গোয়েন্দার বৈশিষ্ট্য'র ৬ নম্বর আর 'অপরাধীর বৈশিষ্ট্য'র ৯ নম্বরের সাথে আমি খুবই একমত। আমি দুনিয়ার সব গোয়েন্দা গল্প পড়ে ফেলেছি তা নয়, কিন্তু খুব কমও পড়িনি। বেশির ভাগ গল্পেই দেখেছি গোয়েন্দা পুলিশকে একেবারে নস্যাত করে দিয়ে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নিচ্ছেন। বুদ্ধির দিক থেকে তিনি এগিয়ে থাকতেই পারেন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পুলিশকে বাদ দিয়ে খুন-জখম, বড় চুরি রাহাজানির কেসে এগোনো এক রকম অসম্ভব। পুলিশ সব্বার আগে ওখানে গিয়ে হাজির হয়, তাদের পদ্ধতি অত্যন্ত বিশদ, এবং পুলিশফাইলের তথ্য অ-পুলিশ গোয়েন্দার পক্ষে অ্যাভেইল করাও নেক্স্ট টু ইম্পসিবল ব্যপার। বাস্তবে। কাজেই পুলিশকে কলা দেখিয়ে তাদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া সূত্র ধরে গোয়েন্দা বাজিমাত করলেন এটা গল্পের গোয়েন্দা গাছে ওঠার মত একটা ব্যাপার। এখন লেখক বলতেই পারেন পোয়েটিক লাইসেন্স বলে একটা ব্যপার আছে। সে নিশ্চয়ই আছে। তবে আমার মনে হয় গোয়েন্দা পুলিশের সাথে সদ্ভাব রেখে একবার দেখতে পারেন।
লেখা চলতে থাকুক, পরের পর্বের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করবো।