#পুস্তকালোচনা — #ছায়াসপ্তক — #কর্ণ_শীল
বই = ছায়াসপ্তক
লেখক = কর্ণ শীল
প্রকাশক = boiChoi publiCation
পৃষ্ঠা সংখ্যা = ১২৮
মুদ্রিত মূল্য = ১৬৬ টাকা (প্রথম সংস্করণ)
———————————————————————————————————————
প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে, বইটি স্বয়ং লেখকের কাছে উপহার হিসেবে পাওয়া।
১) আবার ফিরব আমি (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত অপু-কাজল-এর প্যাস্টিশ) — কাজল তার বাবার সাথে এসেছে ইচ্ছামতীর কাছে যেখানে তাদের পুরোনো বাড়ি ছিলো। তারপরে তাদের কেমন অভিজ্ঞতা লাভ হয় সেই নিয়েই এই কাহিনীটি।
এই কাহিনীটিতে বেশ ছোট হলেও স্মৃতিমেদুর করে তোলে।
২) বাঘের মন্তর (তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত তারানাথ তান্ত্রিক-এর প্যাস্টিশ) — দক্ষিণবঙ্গের এক গ্রামে বাঘের হানা, এদিকে শিকারী জমিদারের উপর অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পায় তারানাথ। এরপরে কী হলো, এই অলৌকিক কাহিনীটিতে সেটাই বিবৃত।
এই কাহিনীটি ভালো আর এতে থাকা চমকটিও দুর্দান্ত।
৩) ভয়াল দেবতার মন্দির (সত্যজিৎ রায় রচিত শম্ভুচরণ বসু-এর ফ্যান ফিকশন) — তান্ত্রিক দানবিক এক শক্তি জেগে উঠে পৃথিবীতে নানা ধ্বংসাত্মক কাজ করে চলেছে, যাকে থামানো উপায় আছে তিব্বতের এক গুম্ফার পুঁথিতে। শম্ভুচরণের নাতি নিত্যশরণ রায়ের উপর এই কাজের ভার পড়েছে। এরপরে সেই ভয়ঙ্কর অপদেবতার সাথে কেমন লড়াই হলো, সেটা এখানে লেখা হয়েছে।
এই কাহিনীটির বিষয় ও লেখার ধরন সত্যজিৎ রায়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হলেও কাহিনীটি সুখপাঠ্য।
৪) কোকিলা (সত্যজিৎ রায় রচিত শম্ভুচরণ বসু-এর ফ্যান ফিকশন) — নষ্টচন্দ্রের রাতে শম্ভুচরণের দুই ছেলে এবং তাদের ঘরে মানুষ হওয়া রামখেলাওন চুরি করতে বেরিয়ে ঝামেলায় পড়ায় রামখেলাওনের ডাকে কোকিলা নামের একটি অলৌকিক শক্তি তাদের কীভাবে সাহায্য করলো এবং এই কোকিলার অতীত এই গল্পে জানানো হয়েছে।
এই কাহিনীটি লেখার কায়দা কিছুটা লীলা মজুমদারের লেখা ছোটগল্পের কথা মনে করায়।
৫) মহাভারতে ঘনাদা (প্রেমেন্দ্র মিত্র রচিত ঘনশ্যাম দাস-এর প্যাস্টিশ) — মহাভারতের যুগে চীন থেকে ভারতের দিকে পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার কাহিনী ঘনাদা জানিয়েছেন এখানে।
এখানে পারমাণবিক অস্ত্রের বৈজ্ঞানিক বর্ণনায় (ভরের ব্যস্তানুপাতিক বৃদ্ধি) ভুল হয়েছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখায় এই ধরনের ভুল কিন্তু থাকতো না। আর প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা মহাভারতে ঘনাদার যে কাহিনীগুলি আছে তার থেকে লিখনশৈলী কিছুটা ভিন্ন।
এরপরেও এটাকে প্যাস্টিশ হিসেবেই ধরা যায়! কারণ চরিত্রের আচরণ বা লেখনশৈলী ঘনাদার বাকি কাহিনীগুলিকেই অনুসরণ করেছে।
৬) ঈশ্বর ও সম্রাট (কথাসরিৎসাগর এবং সিংহাসন দ্বাত্রিংশিকায় উল্লিখিত রাজা বিক্রমাদিত্য ও বেতাল-এর ফ্যান ফিকশন) — শতরত্ন ভোপালে গিয়ে এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয় এবং ঈশ্বর তপাদার নামের এক ব্যক্তি তাকে রাজা বিক্রমাদিত্য বলে মনে করে। হঠাৎ বিক্রমাদিত্যের পুনর্জন্ম কেন হলো তা জানতে এই কাহিনীটি পড়তে হবে।
এই গল্পটি বেশ ভালো।
৭) ঝুটো নাকছাবি (তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত তারানাথ তান্ত্রিক-এর প্যাস্টিশ) — বাংলায় প্রবল বন্যার বর্ধমান জেলার পঞ্চপলাশি গ্রামে দুর্গাপুজো হওয়া একরকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে, সেই গ্রামের সুশীলচন্দ্র বসুর অনুরোধে তারানাথ তান্ত্রিক সেখানে গিয়ে পুজোর জোগাড় করতে থাকলেন। বোধনের আগেই দুর্গার নাকছাবি চুরির অভিযোগে গ্রামের নতুন আসা একজন ঢাকি ধরা পড়লো। এরপরে কী হলো সেটা নিয়ে এই গল্প।
অলৌকিকতার অভিনিবেশ থাকলেও এই গল্পটি মন খারাপ করে দেয়।
প্যাস্টিশ (Pastich) রচনার ক্ষেত্রে মূল লেখার রীতি এবং চরিত্রের আচরণ অনুকরণ করেই লিখতে হয় যাতে সেই লেখাটি ঐ কল্প জগতের একটি অংশ হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। অন্যদিকে, ফ্যান ফিকশন (Fan Fiction)-এ চরিত্রগুলির নাম একই থাকলেও রচনাশৈলী বা চরিত্রগুলোকে লেখক নিজের মতো বানিয়ে নিতেই পারেন। অর্থাৎ, সব প্যাস্টিশই ফ্যান ফিকশন কিন্তু সব ফ্যান ফিকশন প্যাস্টিশ নয়। তাই, প্যাস্টিশ লেখা একটি কঠিন কাজ হিসেবে ধরা যায়, কারণ এই ক্ষেত্রে মূল লেখকের লেখার ধরন এবং তার সৃষ্ট চরিত্রের ব্যবহার হুবহু ফুটিয়ে তুলতে হয়। ফলে লেখাটি ভালো হলে তার কৃতিত্ব সাধারণত যায় মূল লেখকের কাছে, আর খারাপ হলে যিনি প্যাস্টিশ লিখেছেন তার প্রতি পাঠকেরা বিরূপ হয়। এটি নতুন লেখকের কাছে অতটা বিপজ্জনক না হলেও যার কিছুটা অন্তত লেখক-পরিচিতি আছে, তার পক্ষে এই রকম লেখা একদিকে তার খ্যাতিতে নতুন কিছু যোগ করতে না পারার আশঙ্কা তৈরী করে; অন্যদিকে, লেখার মান একটু এদিক-ওদিক হলেই তার পাঠকদের চটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে বৈকি। কিন্তু কর্ণ শীল এই পরীক্ষায় নেমে তাতে উত্তীর্ণ হয়েছেন বলেই আমার মনে হয়েছে। কাজেই, বইটির নাম ছায়াসপ্তক রাখা সার্থক হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। অন্য পাঠকদের কেমন লাগবে সেটা জানার প্রতীক্ষায়।
বইটি নিয়ে একটা অনুযোগ এই যে, পড়ার আগে জানা মুশকিল যে কোন লেখাটি কীসের ছায়া অনুসারে লিখিত। এইটা পরবর্তী সংস্করণের অন্তত সূচিপত্রে উল্লেখ করলে ভালো। এছাড়া বইয়ের শুরুতে দুইটি ভূমিকা আছে যার প্রথমটি উদয়াদিত্য সোম এবং দ্বিতীয়টি ঋজু গাঙ্গুলি লিখিত। এই দুটির উল্লেখও সূচিপত্রে নেই।