(গল্পটি এখানেই শেষ।)
এই ছোট গল্পে একাধিক theme এসেছে যেগুলো নিজেই এক একটি আলাদা বিষয় হিসেবে আলোচনার দাবী রাখে। যেমন —
১) মানুষের জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) -এর ব্যবহার করে কাহিনী রচনা করা।
২) লেখকের নিজের কোনো ইচ্ছা না রেখে শুধু পাঠকের চাহিদা অনুযায়ীই গল্প তৈরী করা। (সাম্প্রতিককালে প্রতিলিপি বা Wattpad জাতীয় জায়গায় লেখালেখি অনেকটাই পাঠকের feedback দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার জায়গা রাখে। ফেসবুকেও লাইক, কমেন্ট, শেয়ার দ্বারা লেখার বিষয় বা ধরণ প্রভাবিত হতে পারে। রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের লেখা "বটেশ্বরের অবদান" গল্পেও একই ঘটনা দেখেছি তার বহু আগেই, যদিও গল্পটি হাস্যরসাত্মক ছিল।)
৩) লেখার মাধ্যমে পাঠকের কাছে সামাজিক বার্তা পাঠিয়ে তার চিন্তাকে প্রভাবিত করা। (আজকের Post-truth যুগে যার উদাহরণ আমরা বিভিন্ন fake news-এর মাধ্যমে বার বার দেখি যেখানে বিজ্ঞানের জায়গায় অপবিজ্ঞান এবং ছদ্মবিজ্ঞানের প্রচার অথবা ইতিহাসের জায়গায় fictionalized alternative fiction-এর প্রচার।)
৪) জোর করে নিজেকে পক্ষপাতহীন প্রমাণ করতে গিয়ে মানুষের পক্ষপাতদুষ্ট কাজ করা। (ধর্মীয় বা জাতিগত বিদ্বেষজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে এর উদাহরণ মাঝেমাঝেই দেখা যায়, যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে "BlackLivesMatters" স্লোগানের বিপরীতে "AllLiveMatters"-এর প্রচার।)
কোনো কোনো পাঠক আবার গল্পে সায়াকা মুরাটার জবাব দেওয়ার ঘটনাটির সাথে সীতার অগ্নিপরীক্ষার মিলও পেতে পারেন।
তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে খোলাখুলি ভাবে মুসলিম, কৃষ্ণাঙ্গ বা এলজিবিটি চরিত্রদের negative shade-এ দেখানোর কথা লিখে লেখক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী বেশ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, কারণ এখানে স্বয়ং লেখকের বিরুদ্ধেই পক্ষপাতের অভিযোগ আসতে পারে!
এই লেখাটি বোধহয় খুব বেশী সংখ্যক মানুষের নজরে আসেনি, নাহলে অহেতুক বিতর্ক তৈরী হতে বেশী সময় লাগত না।
এছাড়া জানি না যে লেখক সচেতনভাবে এই প্রয়োগটি করেছেন কি না। কিন্তু গল্পে যখন প্রকাশনার প্রধান জানায় যে লেখিকা পক্ষপাতী নন, তখন থাকা এক সাংবাদিক পল বলে - "সেটা রক্তমাংসের লেখিকা হলে আমি মেনে নিতে পারতাম।"; অর্থাৎ চরিত্রটি ধরে নিয়েছে যে মানুষ হলে সে পক্ষপাতহীন হতে পারে কিন্তু যন্ত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পক্ষপাতদুষ্ট হতেও পারে — এই ধারণাটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি একটি পক্ষপাত কারণ মানুষ নিজেই সবসময়ে যে পক্ষপাতশূণ্য আচরণ করতে পারে এমনটা নয়। অর্থাৎ পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ যে আনছে এবং তার বিচার করতে চাইছে, সে নিজেই নিরপেক্ষ নয়। এই বিষয়টি আমার বেশ ভালো লেগেছে।
তবে, কিছু বিষয়ের পরিবর্তন হলে গল্পটি আরো ভালো হতো বলে আমার মনে হয়েছে।
১) কাহিনীতে একটি বইয়ের বিক্রির জায়গায় একাধিক বইয়ের বিক্রির ফলাফল হিসেবে মানুষের আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে দেখালে আরো বেশী বাস্তবসম্মত হতো। যদিও লেখক বই বিক্রির সংখ্যা যথেষ্ট দেখিয়েছেন, কিন্তু শুধুমাত্র একটি বইয়ে থাকা একটি উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে কোনো লেখককে পক্ষপাতদুষ্ট বলা কঠিন, একাধিক বইয়ে বার বার ঐ জিনিসটির উল্লেখ হয়েছে দেখালে আরো বিশ্বাসযোগ্য হতো।
২) ‘আচ্ছা কেসলার সিনড্রোম কী?’ — এই প্রশ্নটি সাংবাদিকদের কেউ না করে যদি গল্পে উল্লিখিত ফ্যানক্লাবের কেউ করত তাহলে আরো ভালো হত। কারণ গল্পে ফ্যানক্লাবের সদস্যদের ভূমিকা খুব একটা দেখা যায় না, আর কল্পবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের জ্ঞান গড়পড়তা ফ্যানদের থেকে বেশী হওয়ার কথা।
এছাড়া সাংবাদিকদের দ্বারা ঝামেলা দেখানোর জায়গায় সাংবাদিকদের সাথে ফ্যানক্লাবের সদস্যদের ঝামেলা দেখলে গল্পে তাদের অবদান থাকত, যেটা বর্তমান কাহিনিতে যৎসামান্য।
৩) গল্পে বায়াস দেখানোর ক্ষেত্রে সংঘাত বা সঙ্কটটি অনেক কম লেগেছে, যেখানে এক পক্ষের অনুকূলে ৯৮ বা ৯৯ বা ৯৩ শতাংশের বেশী তথ্য আসছে, সেখানে সাধারণ মানুষও সেই পক্ষের অনুকূলে যাবে।
কিন্তু ধরা যাক, ৫০ কোটি মানুষের মধ্যে দুটি পক্ষের পার্থক্য মাত্র দুই জনের কম বেশী, অর্থাৎ এক পক্ষের ২৫ কোটি ২ জন মানুষ আছে। গল্প অনুযায়ী, এই ক্ষেত্রেও যন্ত্র স্বাভাবিকভাবেই সংখ্যাগুরুর পক্ষে যাবে কিন্তু যেখানে ২/৫০০০০০০০০ অর্থাৎ ০.০০০০০০৪ শতাংশ পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে সেখানে মানুষের মন যথেষ্ট দোনামনায় পড়বে এবং দুটি মতবাদের সমর্থকের সংখ্যা অত্যন্ত কাছাকাছি হওয়ায় মানুষ একটা balance করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যাতে দুই পক্ষই খুশি থাকে।
৪) গল্পটি যেহেতু কল্পবিজ্ঞানের তাই মুসলিম ধর্মের জায়গায় কোনো কাল্পনিক ধর্ম অথবা কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গের জায়গায় গায়ের কোনো কাল্পনিক বর্ণের মানুষ ব্যবহার করে গল্পটি বললে হয়তো আরো ভালো হত। যদিও লেখক এখানে বাস্তব থেকে উপাদান তুলে এনেছেন হয়ত বার্তাটি সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তবে আমার মনে হয়েছে কল্পনার পরিমাণ আর একটু বেশী হলেও গল্পের মর্ম অনেকেই অনুধাবন করতে পারতেন।
এই ক্ষেত্রে অহেতুক বিতর্কের সম্ভবনা থেকেই যায়।
এখানে আমিও একটু পক্ষপাত দেখাচ্ছি, কল্পবিজ্ঞান না হয়ে সাধারণ সামাজিক গল্প হলে হয়ত এমন লিখতাম না!
৫) গল্পে পল চরিত্রটি "বায়াস" বলতে যেটা উল্লেখ করেছে সেটা কিছুটা ক্ষেত্রে ক্রেতার উপর নির্ভরশীল যেটা প্রকৃতপক্ষে প্রস্তুতকারকের নিজের পক্ষপাতদুষ্টতা নয়।
যেমন ধরুন — শতকরা হিসেবে সাড়ে ছয় ফুটের কম উচ্চতার মানুষেরা ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু, এবার এই জনসংখ্যা উপর ভিত্তি করে বাস বা মিনিবাসের design করলে সেটা ঐ উচ্চতার থেকে বেশী লম্বা লোকদের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করবে, কিন্তু অন্যদিকে বেশী লম্বা লোকদের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করলে বাসের আকার-আয়তন বেড়ে যাবে ফলে পরিবহনের খরচও বেড়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে অল্প কিছু মানুষের সমস্যা হতে পারে ধরেই বহুসংখ্যক মানুষের চাহিদা মেটানোর বাস্তববাদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এটার মানে এই নয় যে বাস যারা বানাচ্ছেন তাদের সাথে লম্বা মানুষের কোনো ঝামেলা আছে।
এটাকে "necessary evil" বলা যেতেও পারে।
সবমিলিয়ে, নিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে জোর করে (তথ্য অগ্রাহ্য করে) নিজেকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে যাওয়াটা যে আসলে পক্ষপাতিত্ব করা, সেটা এই কাহিনিতে দেখানো হয়েছে। বাকি পাঠকদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
(পুনশ্চ — এই গল্পে অ্যাসিমভের তিনটি আইনের ব্যতয় ঘটেছে, আগ্রহী পাঠক একটু খুঁটিয়ে দেখলে ধরতে পারবেন। যদিও কাহিনীর সাথে এর বিশেষ সম্পর্ক নেই।)