এবার আমার পিসিমাদের কথা।
দুর্গোপূজো শেষ, বিজয়াদশমীর বিসর্জন সবে শুরু। বিকেল পাঁচটা নাগাদ অন্ধকার ঘনিয়ে আসার সময় দূর থেকে কোথাও অবাঙালী পাড়ায় রাবণ জ্বলছে, বাজি পুড়ছে। তার দূরাগত গুরুগুরু ধ্বনি মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ঘড়ি ধরে দরজায় কড়া নড়ে উঠত। বাচ্চারা টের পেতাম ঢাকুরিয়া থেকে দুই জোড়া পিসিমা-পিসেমশায়রা এসেছেন! যাঁদের পদবি ছিল মজুমদার, বাঙাল উচ্চারণে মন্দার!দরজা খুলতেই ধোপদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবি পরা বিপুলবপু পিসেমশায়ের হাঁকডাক ও হাসিতে বাড়ি সরগরম। পাড়াপড়শিরাও টের পেত।
বাচ্চারা খুশি, এবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবে থরে থরে দুধের লাড়ু যা তৈরি হয়েছে বিশাল পিতলের কড়াইয়ে পালা করে মা-কাকিমা-ঠাকুমাদের হাতের নাড়ায় দুধ শুকিয়ে খোয়া ক্ষীর বানিয়ে এবং পাথরের খাদায় (বাটিতে) নরুণ দিয়ে সজত্নে ফুল পাখি মাছ তোলা ছাঁচে চেপে চেপে। এ নাকি ময়মনসিং জেলার বিশিষ্ট মিষ্টি! যা হারিয়ে গেল আমার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে । আর থাকবে নারকোল নাড়ু ও তক্তি(বরফি)।
ষাট বছর পেরিয়ে গেছে।
আজ আমাদের সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। এখন আমরা ভাই-ভাই ঠাঁই ঠাঁই। একে অন্যের বাড়ি যাবার আগে দস্তুরমত ফোন করে অ্যাপো নিয়ে তবে দেখা করি, সবাই ব্যস্ত যে! আগে যেমন বিনা খবরে যে যার বাড়িতে যেতুম, সেই অধিকারবোধটাই হারিয়ে গেছে বোধহয়।
আমাদের পিসতুতো দাদাদের ডাক নাম ছিল ময়না ও বুলবুল। দাদু সতীশচন্দ্র মুখ বেঁকিয়ে বললেন – পক্ষীর নামে মাইনষের নাম? এতে মাইনষের অসম্মান হয়। আমি আমার ছেলেমেয়েদের কত সুন্দর নাম রাখছি। সলিলকুমার, বিজন, বিনয়, শৈবাল ---, আর শিশিরকণা, নীহারকণা, সবিতা, মনীষা।
কথাটা আমার মনে ধরল। কিন্তু ছোটপিসি মুখ ঝামরে উঠল—হ্যাঁঃ, সে তো ভাল নাম। তোমাদের রাখা ডাকনামগুলো আরও অখাদ্য। দাদাদের নাম কী করে বীণা, মীরা, মণি এইসব রাখলে?
দাদু রণে ভঙ্গ দিয়ে ইসলামপুরি কাঁসার জামবাটি ভরে দেওয়া গরম দুধ ও রুটি খাওয়ায় মন দিলেন।
বড়পিসিমা ও পিসেমশায়ের পরিবার আমাদের অভিন্ন অঙ্গ , তিনটে ঘরের একটায় দুটো তক্তপোষ ও মেজেতে বিছানা করে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ওঁদের সংসার। আমার থেকে ছ’বছরের বড় দাদা পড়ে ক্লাস এইটে। আমাকে পড়ায় পাড়ার লাইব্রেরি বা বন্ধুদের থেকে ধার করে আনা স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজ ও বাজপাখি সিরিজের রোমহর্ষক ডিটেক্টিভ উপন্যাস। পাতলা পাতলা ছোট সাইজের পেপারব্যাক, দাম চার আনা। কভারের ছবি থেকে চোখ ফেরানো দায়।
একটার কভারে আঁকা—টেবিলে মুখ থুবড়ে একজন সুবেশ ভদ্রলোক, মুখ থেকে রক্তের ধারা বেরিয়ে টেবিলে জমাট বেঁধেছে। আর কালো ফেল্ট হ্যাট, ওভারকোট পরা এক মূর্তির হাতের পিস্তল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
বইগুলোর নাম এ’রকমঃ জীবন-মৃত্যু, বিকেল ছ’টার শো’তে, নীল সমুদ্রে বাজপাখি।
আমি জানলাম কোলকাতায় রসা রোড, বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিট, হ্যারিসন রোড, পার্ক স্ট্রিট ও ক্যামাক স্ট্রিট নামের রাস্তা আছে। আরও জানলাম দীপক চ্যাটার্জি বলে এক গোয়েন্দা আছেন, তিনি ও তাঁর সহকারী রতনলাল যে কোন রহস্য ভেদ করতে পারেন। কোন গুন্ডা তাঁদের সঙ্গে পেরে ওঠে না। এরপর এল শশধর দত্তের মোহন সিরিজ—দস্যু মোহন, মোহন ও রমা, আবার মোহন, রমাহারা মোহন। এগুলোর দাম একটাকা করে।
তারপরে এল সুন্দরবনের আর্জান সর্দার, ভোম্বল সর্দার, শুকতারা ও কালো ভ্রমর।
আমি আর থই পাই নে, অন্য এক দুনিয়ায় পৌঁছে যাই। পিসেমশায় অসুস্থ, অফিস ফেরত বাড়ি এসে ছানা খান, বেদানা খান। কিন্তু অনেক সময় শুয়ে বসে কাটান। আমাকে ডেকে একদিন বীজমন্ত্র দিলেন।
বড় হয়ে দূরে দূরে চাকরি করবি, মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবি। তখন দেখবি কত খাতির। আর যদি এইখানেই আঠা হয়ে থাকিস, তোর মূল্য যাবে কমে। তুই রঞ্জন থেকে হবি ‘রঞ্জইন্যা’! রোজ ফাইফরমাইশ খাটতে হবে।
বড়পিসিমা আমার মায়ের বাড়া। অনায়াস অধিকারে গাল টিপে ধরে মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে চুরি করে মুখে পোরা গুড়ের ড্যালা নর্দমায় ফেলে দেন! ওরে , কৃমি হইব যে, দাঁতে পোকা অইব। আমি চোখের জলে মার সামনে বলি-- কথা দিলাম, বড় হয়ে চাকরি করার সময় প্রথম মাসের মাইনে থেকে এক সের গুড় কিনব, আর কিনব মোহন সিরিজের চল্লিশটা বই। দেইখ্যা নিও।
মা হেসে ফেলে।
কিন্তু কেউ কথা রাখে নি, আমিও না।
মেজপিসে থাকতেন জামসেদপুরের স্ট্রেট মাইল রোডে; তাঁর বাড়িতে ছিল সবার জন্যে অবারিত দ্বার। বাবা-কাকারা বেকার হলেই চাকরি খুঁজতে গিয়ে উঠত মেজদাদাবাবুর বাড়িতে। একান্নবর্তী পরিবারে কুড়ি জনের হেঁসেল ঠেলে ঘরের বৌয়ের, যেমন আমার মায়ের, শরীর খারাপ হলে ফণিডাক্তার বললেন জলবায়ু বদলানো দরকার। কোথায় যাওয়া যায়? মোল্লার দৌড় মসজিদ, সেই জামশেদপুর। এক কাকা বর্ণনা করলেন—মেজদাদাবাবুর বাড়ি হল নন্দনকানন। সেখানের বাগানের গাছে গাছে বুলবুলি দোয়েল শিস দেয়, টিয়ের ঝাঁক উড়ে বেড়ায়, বাগানের পেয়ারা আর পেঁপের স্বাদ?
ওদের একমাত্র ছেলে, আমাদের দাদামণি, কোলকাতায় এল মামাবাড়িতে থেকে ইন্টারমিডিয়েট পড়বে বলে। দাদামণি নিপাট ভালমানুষ, কিন্তু আমাদের বাড়ির হিসেবে বেশ শৌখিন মেজাজের। পড়ায় বিশেষ মন নেই। মন পড়ে থাকে ‘মুঘল- এ-আজম’ ফিল্মে পৃথ্বীরাজ কাপুরের আকবর বাদশার অভিনয়ে। বাড়িতে নকল করে দেখায়—‘ লে যাও ফাটক মেঁ’।
বাড়ির সামনে ধাঙড়বাজারের তিনদিবসের রাতভোর ক্ল্যাসিক্যাল প্রোগ্রামে উনি সিজন টিকিট কেটে হাজির। আমাদের সে সামর্থ নেই। ঘর থেকেই মাঝরাতে ঘুমচোখে শুনতে পাই কত্থক নর্তকীর নূপুরনিক্কণ, তবলায় ধা -ধা-তেরেকেটে, থুন-না, কত্তা ধাগে! আর কখনও সেতারের মীড় ও দ্রুতলয়ে ঝালা।
মামিমারা পরের দিন খাবার বেড়ে দেবার সময় মুখ টিপে নিরীহ স্বরে জিগাইলেন—কী গো ভাইগ্না, কাইল রসুনকুমারীর নাইচ দেখতে গেছলা?
--কী যে কন মাইমা! রসুন না, রওশনকুমারী। দারুণ কত্থক নাচে। আর সঙ্গে বনারস ঘরানার পন্ডিত সামতাপ্রসাদের তবলা! স্বর্গীয় জিনিস।
কথা ছড়িয়ে গেল। বাড়ির কর্তা দাদু সতীশচন্দ্র ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন লেখাপড়া ছেড়ে সারারাত এইসব যাত্রাপালা শুনে কার কী উদ্ধার হচ্ছে?
--দাদু, সামতাপ্রসাদ যখন তবলায় চাঁটি মারে—
দাদু হতাশ হয়ে পরের দিনই চিঠি লিখে মেজজামাইকে বললেন—ছেলেকে জামশেদপুরে ফেরত নিয়ে যাও, এখানে বখে যাচ্ছে।
দাদামণির কলেজ আর হয় নি। কিন্তু ওঁর ছোট ছেলে এখন প্রফেশনাল তবলাবাজিয়ে, এটাই ওর সংসারযাত্রার সম্বল।
তবে ক্লাসিক্যাল সংগীতের রসগ্রহণে অক্ষম সতীশচন্দ্র নিজের ছেলেকে বললেন—যম-জামাই-ভাগনা, তিন নয় আপনা।
আমাকে শেখালেন—ভাগিনা গো ভাগিনা, তোমার বাপের ডরে হাগি না।
৭) আমাদের ফ্ল্যাটের গৌরবময় ঐতিহ্য, আরশিনগরের পড়শিরা, এবং ভো-কাট্টা:
সার্কাস মার্কেট প্লেস ও কড়েয়া রোডের সংযোগস্থলে, মানে সমকোণের জোড়ে, আয়তক্ষেত্রের মত দোতলা ফ্ল্যাটবাড়িটি, মাঝখানে চতুষ্কোণ খোলা জায়গা—যেন কোন গাঁয়ের আটচালা বাড়ির ভেতরের খোলা আঙিনা। আয়তক্ষেত্রের দুই দীর্ঘবাহুর মাঝখান দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি, দু’দিকের ফ্ল্যাটগুলোকে দুপাশে ঠেলে দিয়ে সোজা ছাদে উঠে গেছে। দরজায় সবুজ রঙ, জানলার কপাট ও খড়খড়ি সবুজ রঙের, আর বারান্দার সিমেন্টের রেলিং ও উপরের জাফরিতে লতাপাতার নকশা।
মা-কাকিমাদের খোশগল্পের মাঝে কানে আসে –এই বাড়ি চল্লিশ বছর আগে মুসলমানে বানাইছিল, তাই এইরকম। একদিন ছোটকাকা বললেন যে আমাদের অংশের ফ্ল্যাটটিতে আগে থাকত একজন স্মাগলার—নাম শাহাজাদা। সে পরে পার্কসার্কাসের পাঁচমাথার মোড়ে ইয়াসমিন কোর্টের বাড়িটিতে পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে মারা যায়।
হাচা কইতাছ? (সত্যি বলছ তো?)
আরে আউয়াখানা! এই যে বাইরের ঘরে ছুট কালা টেবিল, যার উপরে ওষুধের শিশি আর টাইমপিস ঘড়ি থাকে –হেইডা ছিল শাহজাদার, ছাইড়্যা গেছে।
পুলিশের ভয়ে?
দূর-অ ব্যাডা আহাম্মক!
তিন দশক পরের ঘটনা। সামনের বাড়ির একতলার প্রাক্তন ভাড়াটে মন্টি ওরফে শ্রীসুনৃত মল্লিকের স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি আর্টিকল বেরোল যার থেকে জানলাম যে আমাদের এই ফ্ল্যাটগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নামকরা গণিকালয় ছিল। কড়েয়া রোড ও গুরুসদয় দত্ত রোডের কোনায় ছিল ফৌজি ছাউনি। সেখান থেকে শনিবার শনিবার একজন কোয়ার্টার মাস্টারের নেতৃত্বে টমির দল লেফট রাইট করে হাজির হত রাস্তার উপরে। শিস দিত আর মুখে চড়া রংমাখা মেয়েরা বারান্দার রেলিং থেকে হাসিমুখে উপরে আসার ইশারা করত, দরদাম হত। সত্যি, আমাদের বাড়ির কী মহান ঐতিহ্য!
মজার ব্যাপার, এই কথাগুলো ক্যানাডার মন্ট্রিল শহরের কোন সান্ধ্যকালীন পাবে এক বুড়ো প্রাক্তন আইরিশম্যান কোলকাতার বাঙালি শুনে মন্টিকে বিয়ার খাইয়ে পার্কসার্কাস নিয়ে নিজের নস্টালজিয়া শোনানোর ফাঁকে বলেছিলেন।
মন্টি কানাডা গেছল ব্রাহ্মসমাজের আচার্য হওয়ার ট্রেনিং নিতে! কী দিনকাল দেবেন ঠাকুরের ঐতিহ্যের! অবশ্যি মাঝখানে প্রাচ্যবিদ্যার পড়াশুনো করতে আমাদেরও জর্মনী ছুটতে হত।
পড়শিরা
তবে আমাদের আরেক দিকের ফ্ল্যাটে থাকতেন ঢাকা হইতে আগত এক হিন্দু বাঙালী পরিবার। ওদের সিঁড়িটি ছিল আয়তক্ষেত্রের ক্ষুদ্রবাহুর দিকে। ফলে ওদের সঙ্গে আম্মাদের দেখা সাক্ষাৎ হত ছাদে উঠলে। ওরা খুব ভাল ঘুড়ি ওড়াতেন। একভাই, ধরা যাক তাঁর নাম বাসব বা বাসুদা, কখনও হাসতেন না। ঘুড়ির প্যাঁচ খেলতেন ঢিল দিয়ে নয়, নিচের থেকে টেনে। আগে সুতো ছেড়ে ঘুড়ি তুলতেন দূর আকাশে, চিলওড়া উঁচুতে; তারপর দ্রুত হাতে আকাশে প্রায় হলিউডি সিনেমার প্লেনের ফাইটের মত নানান গোঁত্তা, নানান ক্যারদানির পর সেই ঘুড়ি নির্মম ভাবে আকাশের সীমানায় একের পর এক অনুপ্রবেশকারী ঘুড়িদের ডগ ফাইটে ধ্বংস করত। সেই সময় তাঁর দাঁতের ফাঁকে জ্বলত বিড়ি আর চোয়ালের হাড় শক্ত হয়ে উঠত।
কিছুদিন বাসুদাকে ছাদে দেখি না। শুনলাম কোন পাড়ায় মারামারি করে ফিরেছে, গায়ে বাইশটা ছুরির ঘা নিয়ে , চিকিৎসা চলছে। আমরা অবাক হলাম।
দু’বছর পরে দেখি উনি রোজ ছাতে উঠে ঘুড়ি ওড়ান। পরনে লুঙি আর চোখে নীলরঙা রোদচশমা। কাকাদের মুখে শুনলাম একসপ্তাহ আগে ধর্মতলায় ওয়াছেল মোল্লার বিখ্যাত কাপড়ের দোকানে ডাকাতি হয়ে গেছে। ওরা এসেছিল ফিটন গাড়ি করে, পিস্তল নিয়ে । কোন হতাহতের খবর নেই। কেউ ধরা পড়েনি।
শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নুয়ে পড়ল।
সেদিকেই থাকতেন এক বয়স্ক মহিলা, তাঁর চোপা আর সব ব্যাপারে নাক গলানো দেখে সবাই নাম দিয়েছিল ‘দজ্জাইল্যা বুড়ি’। কিন্তু তাঁর অসমবয়সী প্রতিদ্বন্দ্বী গোকুলে বেড়ে উঠছিল। উল্টোদিকের গুপ্তদের বাড়ির ঝর্ণা। ডানপিটে মেয়েটি ছাদে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলত মার্বেল( সাইপার-গাইপার), লাট্টু (লেত্তি-হাতলেত্তি-ইয়ো ইয়ো)-- সব । জানত মার্বেল খেলার সব কোড শব্দগুলো। আমি ওকে দেখলেই ক্লাস থ্রি’র পাঠ্যবই থেকে নতুন শেখা কবিতা আওড়াতাম—
‘ঝর্ণা, ঝর্ণা, সুন্দরী ঝর্ণা, তরলিত চন্দ্রিকা চন্দনবর্ণা’।
ও হেসে গড়িয়ে পড়ত।
কোথায় শিখেছিস রে? আরেকবার শোনা দেখি।
কিন্তু সময়ের সাথে আমরা উঁচু ক্লাসে উঠলাম। ছাদে গিয়ে পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলাধুলোর দিন গেল। আর চোখে পড়ল না যে আমাদের খেলার সাথী বাচ্চামেয়েটি কখন যেন প্রকৃতির নিয়মে সত্যি সত্যিই ‘তরলিত চন্দ্রিকা’ হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ একদিন ভরদুপুরে খাওয়ার সময় ওপাশের চিলচিৎকারে সবাই তটস্থ। ভীড় জমেছে মুখোমুখি সব ফ্ল্যাটের বারান্দায় আর জানালায়। অবশ্যই মহিলা ও বাচ্চাদের, পুরুষেরা সবাই কাজে বেরিয়েছেন।
খানিকক্ষণ পরে যা বুঝলাম—সেই ‘দজ্জাইল্যা বুড়ি’ বাড়ন্ত বয়সের ঝর্ণার চালচলন ইত্যাদি নিয়ে কিছু মন্তব্য করায় এবং গার্জেনি ফলানোর চেষ্টায় ঝর্ণা এই বলে গ্যামাস্কিন ছিটিয়েছে যে বুড়ির তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, গেছে বসন্তের দিন, তাই হিংসেয় অকথা-কুকথা বলছে।
মহিলারা মুচকি হেসে বল্লেন—বোঝ ঠ্যালা!
এর একদশক পরে ছত্তিশগড় থেকে কোলকাতার বাড়িতে বেড়াতে এসে ছাদে পায়চারি করছি; ভাদ্রমাসের বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে বাহারি রামধনু উঠেছে। ওপাশের ছাদে দেখছি ছাদে উঠেছে ঝর্ণার ছোট ভাই, গোঁফ গজিয়েছে আর চোখে উঠেছে চশমা। দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছি, আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। কোথা থেকে একটা সংকোচের কুয়াশা আমাদের মাঝখানে ঘন হচ্ছে। এমন সময় ছাদে এল ঝর্ণা। ওর সিঁথিতে সিঁদূর, কোলে একটি বাচ্চা। একবার চোখে চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল—এ্যাই, তুই রঞ্জন না? আমাদের চিনতে পারছিস না? কী রে, ছোটবেলায় এই ছাদে আমাদের সঙ্গে খেলাধূলো করে বড় হয়েছিস, এখন কথা বলতে লজ্জা করছে? এমন ন্যাকামি কবে শিখলি?
হায়, সবাই যদি এমন সহজ সাবলীল হত, তাহলে জীবন হয়ত এত জটিল, এত জট-পাকানো হত না।
ঝর্ণাদের লাইনে তিনটে পরিবার। একপাশে ওরা, মানে গুপ্ত পরিবার। ওর কাকা ছাদের চিলেকোঠায় কবরেজি বড়ি বানিয়ে শুকিয়ে জাতিগত পেশা খানিকটা ধরে রেখেছিলেন। ওদের গায়ে লাগা ফ্ল্যাটে একটি ঘর নিয়ে কয়েক বছর ছিলেন ওঁদের ভাগ্নে দাশগুপ্ত পরিবার। তাঁদের একমাত্র ছেলে দীপুদা বা প্রদীপ ছিল আমার গুরু। আমার থেকে তিনবছরের বড়। অর্থাত গুরুধরা আমার ছোটবেলার অভ্যেস।
ক্লাস এইটের নতুন ইতিহাস বই নিয়ে আমাকে বললঃ বোকা—দার ছবি দেখবি?
পাঠ্যবইয়ে গালাগাল?যাঃ, এ’রকম হতে পারে না। ও রেনেসাঁর চ্যাপ্টারের পাতা খুলল। দেখি, ডেকামেরন রচয়িতা বোকাচ্চিও’র ছবি। আমার গুরুভক্তির ভিত পাকা হল ।
বহুবছর পরে সদ্য কলেজে ঢুকেছি, রোজ কফিহাউসে আড্ডা মারতে যাই। আর দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এর সিঁড়িতে গরম গরম বাম রাজনীতির বক্তৃতা শুনি। দেখি দীপুদা। জানলাম ও সিপি আইয়ের ছাত্র ফেডারেশনের সমর্থক। কেন?
আরে আমাদের পার্কসার্কাসের কমলেশ্বর ওরফে ভাইয়া এখন কোলকাতা ইউনিভার্সিটির জেনারেল সেক্রেটারি।
তাতে তোমার কী, ওরা রিভিশনিস্ট। রাশিয়ার পা চাটা।
আ মোলো যা! ওসব কচকচিতে আমার কোন আগ্রহ নেই। সবাই কারো না কারো পা-চাটা; হয় আম্রিকার, নয় রাশিয়ার, নইলে চিনের। ভাইয়া চিরকুটে সাইন করলে ইউনি’র ক্যান্টিনে আমাদের পয়সা লাগে না, ব্যস।
আর অতিবাম নকশালরা?
ওরে বাবা! শোন তা’লে। সেদিন বেশ কিছু নতুন নকশাল ভাইয়াকে ঠ্যাঙাতে এসেছিল। আমি বেগতিক দেখে মারামারির মধ্যে ওকে টানতে টানতে একটা ছোট স্টোরমত ঘরে ঢুকিয়ে ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিলাম। তারপর দেখি দুটো ছেলে জানলা দিয়ে একটা বাঁশ ঢুকিয়ে আম্মাদের খোঁচাতে চাইছে!
ক’দিন পরে ক্লাসের শেষে একটা রোগাপ্যাঙলা চশমাপরা ছেলে এসে আমাকে বলল—তুমিই না? খোমা চিনে রেখেছি। এবার খেলা দেখবে।
তা ওই সব ভপকিতে তুমি ভয় পেয়ে গেলে?
পাব না? (গলা নামিয়ে ফিসফিস করে) বুঝলি, ওর জামার নীচে গেঞ্জি ছিল না। কী ভয়ানক!
অনেকদিন পরে ছত্তিশগড়ে বসে দেশ পত্রিকার পাতায় দেখি গুরুর ছবি। উনি কবি সুনীল গাঙ্গুলির ‘বুধসন্ধ্যা’ সমিতির সম্পাদক, এবং মাঝে মাঝে সুনীলের লেখা নাটকের অভিনয়ে পরিচালনা করছেন।
গুরু আমার জাতে উঠেছেন! গর্বে আমার ছাতি ছাপ্পান্ন ইঞ্চি হয়ে গেল।
এই উচ্চারণ নিয়ে -
আমাদের বাড়ি একজন আসতেন হইন্যা বাগচি। দাদু বলল হইন্যা আইসে চা চু দেও ওরে। বা দিদা বলল যাছে চা দিয়ায়। হইন্যারে আগে দিবি৷ ইত্যাদি। তো আমি তাঁকে হইন্যামামা বলেই চিনতাম।
অনেকটা বড়৷ হয়ে জানলাম তাঁর নাম হরিনারায়ণ বাগচি।
তুমি যে বুলবুল আর ময়না নামের দুইভাইয়ের কথা লিখেছো, মজুমদার। তাদের বাড়ি কি ঝিল রোডে?
শিগগীর জানাও
তুমি যে বুলবুল আর ময়না নামের দুইভাইয়ের কথা লিখেছো, মজুমদার। তাদের বাড়ি কি ঝিল রোডে?
শিগগীর জানাও
কি অপূর্ব স্মৃতিকথা! যেন ধূসর হয়ে আসা ফ্রেমে বাঁধাই সাদাকালো ফ্যামিলি ফটো!
আরও লিখুন।
"বাচ্চারা খুশি, এবার রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবে থরে থরে দুধের লাড়ু যা তৈরি হয়েছে বিশাল পিতলের কড়াইয়ে পালা করে মা-কাকিমা-ঠাকুমাদের হাতের নাড়ায় দুধ শুকিয়ে খোয়া ক্ষীর বানিয়ে এবং পাথরের খাদায় (বাটিতে) নরুণ দিয়ে সজত্নে ফুল পাখি মাছ তোলা ছাঁচে চেপে চেপে। এ নাকি ময়মনসিং জেলার বিশিষ্ট মিষ্টি! যা হারিয়ে গেল আমার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে । "
যদি ভুল করে না থাকি, এটি বোধহয় ঠিক নাড়ু নয়, ক্ষীরের সন্দেশ, এখনো খুব বিখ্যাত। শেষ রেসিপিটা দেখুন :
ম,
আজকে যোগযোগ নেই। সম্ভবতঃ তাই । পারুল পিসি ও শিশির পিসের ছেলে। ওরা বেশ ফর্সা ছিল। আমাদের মত কালোকোলো নয়। বয়সে অনেক বড়। ওদের মাসতুতো ভাই আমাদের ঝুনুপিসির ছেলে সাধনদা জার্মানিতে পড়তে যায় সেই ষাটের দশকের গোড়ায়। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি। পার্কসার্কাসে ধাঙড়বাজারের সামনে দোতলা বললে হয়ত মনে পড়তে পারে। আমার মেজকাকা র(যোধপুর পার্ক),উষা কারখানায় কাজ করতেন, সঙ্গে ওঁদের কিঞ্চিৎ যোগাযোগ ছিল।
বিপ্লব,
আমাদের বলা হত ময়মসিং ের উচ্চারণে দুধের লাড়ু। অনেকক্ষণ ধরে পিতলের কড়াইয়ে হাত ব্যথা হওয়া অব্দি নেড়ে নেড়ে শুকিয়ে ক্ষীর করে তারপর ওই পাথরের বাটির ছাঁচে চেপে। আজকে বোধহয় সন্দেশই বলা হবে।
বুলবুল আর ময়না - এই দুজন সম্পর্কে আমার দাদু হন।ওরা আমার ঠাকুমার মামাতো ভাই।বড়-দিদা মানে ওদের মা কিছু বছর হলো ( আমার ছেলেকে দেখে- ৫ম প্রজন্ম) গত হয়েছেন।এমনকি তখন কোলকাতায় থাকায় আমি সেসময়ও ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম।এছাড়া নিমতা,জামসেদপুর আর এমনকি জারুইতলা কানেকশান পেয়ে আর তো সন্দেহই নেই।তুমি লতায় পাতায় আমার আত্মীয় হও:-)
মরেছে।
মিঠু, তাহলে আমিও তোমার দাদু। আর বড় দিদা হলেন আমার পারুল পিসি, ওনার আরেক বোন কাছাকাছি থাকতেন ঝুনু পিসি, যাঁর ছেলের নাম সাধন, তোমার আরেক মামা।
আর তোমার ঠাকুমার নাম আর পদবি জানাবে? পারুল পিসি আমার দাদু ও ঠাকুমাকে ডাকতেন ঠাকুরমামা ও ঠাকুরমামি। তোমাদের পদবি কি? কাছাকাছি এক সিংহ পরিবার ওদের জান? তোমাদের অরিজিনাল গ্রামের নাম জান?
এদিকে দময়ন্তীও কিন্তু কোন একদিকে? কারণ জঙ্গলবাড়ির কারকুন পরিবার আমাদের আত্মীয়। আবার সতীশ কারকুন অন্নদা কারকুন আমার দাদুর ভাগ্নে ।ওঁরা আবার দময়ন্তীর মায়ের দিক থেকে--! উফ মাথা ঘুরছে।ঃ)))
ভালো লাগছে এই সিরিজটা। খুব ঝরঝরে লেখা। চোখের সামনে সুন্দর ছবি ফুটে উঠছে।
আমার ঠাকুমার নাম শেফালিকা ওরফে শেফালি রায়। ঠাকুমার বাবার নাম নগেন্দ্রনাথ আর মায়ের নাম লাবণ্যলতা রায়।
আর একদা জারুইতলা নিবাসী আমার ঠাকুরদার বাবার নাম পন্ডিত হরচন্দ্র রায়।
রঞ্জন্দা,
অন্নদাচরণ কারকুন সম্ভবত দাদুদের প্রতিবেশী ছিলেন আত্মীয় নয়। ওঁর লেখা পাতলা বইটা বারেবারে ঘুরেফিরে পড়তেন সম্ভবত জঙ্গলবাড়ির গন্ধ স্মৃতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। বইটা বহুকালইয়ার মামাবাড়িতে নেই ফলে আমার কোনদিন পড়ার সুযোগ হয় নি।
দাদুর বাবা মানে আমার মায়ের ঠাকুর্দার নাম ছিল যোগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী।
দ
এই দেখ, তাহলে তোমরা ব্রাহ্মণ। আসলে তালুকদার হোল ল্যান্ড টাইটেল, রায়ও তাই। তবে কারকুন এবং আমরা কায়স্থ।
ম,
শেফালি রায় নামটা শোনা। আমার মা চলে গেছেন। তবে আমার ছোটকা মানে চিন্টুবাবুর বাবাকে জিগ্যেস করা যেতে পারে। আইজ বিকালে জিগাইয়া দেহি।
রঞ্জনদা,
হা হা হাহা হ্যাঁ। তালুকদার বাবার দিকের, আসল পদবী বাগচি। ঔরঙ্গ্জেবের থেকে কি একটা পাট্টা না সনদ কিসব পেয়েছিল পাবনায়। আমার ঠাকুর্দা অবশ্য কলকাতায় চাকরি করার সুবাদে কিছুই পাননি। সিজনস অব বিট্রেয়ালে আছে মোটামুটি বাড়িতে শোনা গল্পটা।
হেহে একবার সেই নাস্তিক্য, অ্যান্টি -ব্রাহ্মণ ইত্যাদি নিয়ে গুরুতে তর্ক হচ্ছে। তো তখন কেডি বলে যিনি লিখতেন, কালীঘাটের উনি আমাকে বলেছিলীন যেযারা নিজেরা ব্রাহ্মণ হয় না তাদের অমনি রাগ থাকে। :-)))
ভগ্যিস তালুকদার দিয়ে কিছু বোঝা যায় না।
কেডি
মানে কাবলিদা? এমনিতে নিপাট ভালমানুষ, ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে জেনেছি। কিন্তু অনেকগুলো পূর্বাগ্রহ আছে। আগের জেনারেশনের মত।
কেডি
মানে কাবলিদা? এমনিতে নিপাট ভালমানুষ, ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে জেনেছি। কিন্তু অনেকগুলো পূর্বাগ্রহ আছে। আগের জেনারেশনের মত।
হ্যাঁ। :-))
ঐ নাস্তিক্য ব্রাহ্মণত্ব ইত্যাদি ভাল লিটমাস পেপার।
যাগগে বাদ দেন।
কলকাতার একটা দুর্দান্ত টেম্পোরাল ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করছেন আপনি; এবং আখ্যানের প্রবহমানতা ধরে রেখেও envy করার মতো detailing করেছেন। খুউব ভালো লাগছে পড়তে।
আপনি হুতোমের একমাত্র উত্তরসুরি ।