এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • হারিয়ে যাওয়া কোলকাতার গল্পঃ পর্ব ৭

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৮ জুন ২০২১ | ২৯৪৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬
    দাদু আমাকে বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নিজে মুখে মুখে শেখাতে লাগলেনঃ

    “তিরিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর,
    সেইরূপ এপ্রিল, জুন আর নভেম্বর।
    আটাশ দিনেতে সবে ফেব্রুয়ারি ধরে,
    বাড়ে তার একদিন চারিবর্ষ পরে।
    আর আর মাস যত একত্রিশ দিনে,
    জানিবে ইংরেজি মাস এই মতে গণে”।

    পাশের বাড়িতে বুবুলের সঙ্গে খেলার সময় বেশ ঘ্যাম নিয়ে ছড়াটা শোনালাম। ও হাসল; ও সাউথ পয়েন্ট বলে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তারপর বলল, ‘এটা শোনঃ

    “থার্টি ডেজ অফ সেপ্টেম্বর,
    এপ্রিল, জুন অ্যান্ড নভেম্বর।----”।

    আমি চুপ, শুধু দাদুর জন্যে কেমন একটা কষ্ট হোল। ঠিক করলাম দাদু আর যা যা শেখাবে কিছুই বুবুলকে বলব না।

    হ্যাঁ, দাদু শিখিয়েছিল স্বাস্থ্যবিধি।

    “আঁত-অ তিতা, দাঁত-অ নুন,
    প্যাডের ভরিস তিন কুন।
    কানে কচু চোউখ্যে ত্যাল,
    তার বাড়িত বদ্যি না গ্যাল।”

    মানে আঁত বা অন্ত্রে বা নাড়িতে তেতো – অর্থাৎ খালি পেটে বা খাওয়ার শুরুতে তেতো খেতে হবে, উচ্ছে বা করলা।এর ফলে হজম ভাল হবে, পেট পরিষ্কার হবে।আর খাওয়া শেষ হলে পাতে পড়ে থাকা সামান্য এক চিমটে নুন, সেইটা দিয়ে হালকা হাতে একটু দাঁতে ঘসে নিলে অ্যাসিড হবে না। দাঁত ভাল থাকবে।ঠেসে খাবে না দাদুভাই। পেটের তিনকোনা ভরবে, ব্যস্‌ বাকি এক কোনা জলের জায়গা, ওর জন্যে বাঁচিয়ে রাখবে। কচুর কচি লতার ডগা দিয়ে চুলকোলে কান সাফ হবে। আর স্নানের আগে তেল মাখার সময় অল্প করে চোখে ছোঁয়াতে হবে। এইগুলো বরাবর মেনে চললে তোমার বাড়িতে ডাক্তার-বদ্যি আসার কোন দরকার হবে না।

    বাঃ এসব তো ভাল কথা। ডাক্তার আসবে না; তেতো মিকশচার বা ট্যাবলেট গিলতে হবেনা। ইঞ্জেকশনও না? দাদু হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দেন। আমি উৎসাহিত। সেটা দেখে দাদু টপ গিয়ারে গাড়ি চালান। আরো আছে নাতি, শুইন্যা রাখ।

    “চিৎ হইয়া শুয়ো বাবা,
    তেল মাইখ্যো থাবা থাবা।
    সকাল সকাল জাইগ্যো,
    যেখানে সেখানে হাইগ্যো”।

    বুঝলাম, কাৎ বা উপুড় হয়ে নয়, চিৎ হয়ে শোয়াটাই আদর্শ শয়নমুদ্রা, বিষ্ণুর অনন্তশয়ন গোছের। চানের সময় সর্ষের তেল গায়ে মাখতে হত, তাতে কিপটেমি চলবেনা। মুঠো মুঠো করে গায়ে লাগিয়ে ঘষে ঘষে গায়ে মিলিয়ে দিয়ে তবে জল ঢালার অনুমতি। ভোরে উঠতে আমার কোন অসুবিধে নেই, ভালই লাগে। আর ভোরে আকাশবাণীর প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে দেড় বা দু’মিনিট ধরে যে সিগনেচার টিউনটি বাজে, বাঁশি ও বেহালায় মিলেমিশে সেটাও খুব ভালো।

    কিন্তু শেষ ফরমানটা ? ‘যেখানে সেখানে হাইগ্যো’? এ কেমন কথা!যত্র তত্র বাহ্য করা? না, এটা আমার দ্বারা হবে না। দাদু এটা কী শিক্ষা দিচ্ছেন?

    - আগেকার দিনে দেশের বাড়িতে ছেলেদের জন্য পায়খানা ছিলনা। একটা খাটা পায়খানা থাকত, বাগানের কলাগাছের বনের আড়ালে, পর্দা দেয়া। সেটা খালি মেয়েদের জন্যে। ছেলেরা যাইব মাঠেঘাটে, খেতে নদীতে, পুষ্কুনির (পুকুরের) পাড়ে। এই কথাটার মানে প্রাকৃতিক ডাকের বেগ আইলে সাড়া দিবা, চাইপ্যা বইয়া থাকলে শরীর খারাপ হয়।

    দাদুর অনেক শিক্ষাই ভুলে গেছি বা গ্রহণ করি নি। কিন্তু এই লেসন সারাজীবন কাজে এসেছে। তাই আমার ‘যেখানে সেখানে'র লিস্টি বেশ লম্বা। তাতে সিউড়ি ও বক্রেশ্বরের বাসস্ট্যান্ডের পেছন, রাজগিরের কাছে বিপুলগিরির টিলার আড়াল, বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের পুকুরপাড়, ছত্তিশগড়ের বনেবাদাড়ে, নদীর পারে, পাহাড়ের গুহার কাছে, কখনও বাসের ক্লিনারের থেকে জলের জন্যে টিনের কৌটো চেয়ে, ধানক্ষেতে সাপের খোলসের সামনে এবং দিল্লির একটি ঐতিহাসিক স্মারকের গলিতে শ্বেতপাথরের বারান্দায় — সর্বত্র আমি অকুতোভয়।

    আর কানে কচু? জীবনে একবারই সুযোগ এসেছিল। নাকতলা হাইস্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র, হেঁটে স্কুলে যাবার পথে পাশের বাড়ির অজিতকাকু দেখালেন রাস্তার পাশের হাঁটুসমান উঁচু ছোট ছোট কচুগাছ। পাতাগুলো সবুজ, অনেকটা হরতনের আকৃতি। কাকু শেখালেন কোন ডাঁটি ছিঁড়ে তার আগাটায় দুটো টোকা মেরে থেঁতো করে কানে সুড়সুড়ি দিতে হয়। চেষ্টা করতেই কানের ভেতরে একটা আরামদায়ক ঠান্ডা অনুভূতি। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল - আঃ!

    কাকু মুচকি হাসলেন। এরপর দুজনে একসঙ্গে বাসরাস্তা অব্দি গেলে আমিই ছিঁড়তাম দুটো কচুর পাতা ডগা শুদ্ধ, একটা কাকুর জন্যে।

    এরপরে দাদু পড়লেন ঋতুচক্র, সপ্তর্ষিমন্ডল, ধ্রুবতারা চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণ নিয়ে।

    - বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য দুইমাস - গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ দুইমাস বর্ষাকাল এভাবে। পাশের বাড়ির বুবুলকে এসব শোনাবো না, প্রতিজ্ঞা করেছি — ও সাউথ পয়েন্টে পড়ে। কিন্তু পেট আইঢাই করছে, ভবম নাপিতের গল্পটার মত। শেষে রান্নাঘরে গিয়ে ছোটকাকে শোনালাম। ছোটকা খুশি হয়ে বলল - এই ছড়াটা শোন।

    “গ্রীষ্ম গেল, বর্ষা এল, শরত হেমন্ত,
    এরপরেতে আসবে জেনো শীত-বসন্ত”।

    ইতিমধ্যে ঠাকুরমার ঝুলি থেকে ‘বুদ্ধু-ভুতুম’, ‘লালকমল-নীলকমল’ ও ‘শীত-বসন্ত’ পড়ে ফেলেছি।

    নবগ্রহ ‘জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম’ দিয়ে শুরুও হোল, কিন্তু আমার মনে গেঁথে গেল রাহু আর কেতু।

    “অর্ধকায়ং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত্যবিমর্দকম,
    সিঙ্ঘিকায়াঃ সুতং রৌদ্রং তং রাহুং প্রণমাম্যহম’’।।

    আমার বড়মা(দাদুর মা), দাদু ও ঠাকুমা বৈষ্ণব, ত্রিপুরার পত্তন গ্রামের গোঁসাই পরিবারের কয়েক পুরুষের যজমান। বড়মা ও ঠাকুমা রোজ শ্বেতচন্দন পিষে ফোঁটা লাগায়, তুলসীমালা জপে। বড়মা শালগ্রাম শিলা ওপার থেকে আসার সময় সঙ্গে আনতে ভোলেনি। রোজ চান করায় আর একটা মজার গান গায়।

    “আইল রে চৈতন্যের গাড়ি সোনার নদীয়ায়।
    অদ্বৈত তার ইঞ্জিনিয়ার, নিত্যানন্দ টিকিটমাস্টার,
    গৌরাঙ্গ বইস্যা ড্রাইভার সেই গাড়ি চালায়”

    দাদু এবার শেখালেন বিষ্ণুর ষোড়শনাম। মন্দ লাগেনি। আজও মনে আছে।

    “ঔষোধে চিন্তয়েৎ বিষ্ণুং ভোজনে চ জনার্দনম,
    শয়নে পদ্মনাভঞ্চ বিবাহে চ প্রজাপতিম”।

    দাদু বোঝান - ওষুধ খাওয়ার সময় ওঁ শ্রীবিষ্ণু উচ্চারণ কইর‍্যা খাইলে বেশি কাজ করে। বিবাহরে কয় প্রজাপতির নির্বন্ধ, কার্ডের উপর প্রজাপতির ছবি ছাপা থাকে। তারপরে যে “নারায়ণং তনুত্যাগে”, এইজন্যেই কেউ মারা গেলে কইতে হয় তাঁর নারায়ণ-প্রাপ্তি হইয়াছে। তারপরে যেই এল ‘দুঃস্বপ্নে স্মর গোবিন্দং সঙ্কটে মধুসূদনং’ – আমার হাসি পায়।

    কারণ কালবৈশাখী এলে জানলার কপাট দমাস দমাস করলে দাদু বিছানায় গুটিশুটি মেরে ‘দোহাই মধুসূদন! দোহাই মধুসূদন!’ করতে থাকে। আমি আরশোলা দেখলে ভয় পাই, কিন্তু বন্ধ ঘরে ঝড়কে ভয় পাইনে।

    ছোটপিসি বোঝায় - শোন, এখানে কী করে টের পাবি? আমাদের বাজিতপুরে ঝড় আসতো খোলা মাঠের উপর দিয়ে ধানক্ষেতে ফসলের মাথা নুইয়ে সামনের দীঘির জল উথাল পাথাল করে। তার সোঁ সোঁ শব্দে বুক কাঁপে। আমাদের আটচালা বাড়ির টিনের চাল উড়ে যায়, ভেঙে পড়ে নারকোল গাছের পুরনো ডাল, আমবাগান জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কাঁচা আম আর গরু বাছুর হাম্বা হাম্বা ডাকতে ডাকতে ছুটতে থাকে ভয়ে। আমাদের নাটমন্ডপ ছিল পাকা, আর তার পাশে একটা পাকা পায়খানা ছিল। কালবৈশাখী এলেই তোর দাদুর পায়খানা পেত আর আটচলা ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে সেই পাকা পায়খানায় বসে চেঁচাতে থাকত - ‘দোহাই মধুসূদন! দোহাই মধুসূদন!’

    তখন তোর দাদু ভুলে যেত আমাদের সবার কথা, ঝড় থামলে তবে ওখান থেকে বেরত।

    আমি দাদুর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাই আর নানান গল্প শুনি। সকালে হাতমুখ ধুয়ে দাদুর সঙ্গে খানিকটা গীতাপাঠ চন্ডীপাঠ করি। দাদু আমাকে বিশ্বরূপদর্শনযোগ বোঝান। কিচ্ছু বুঝিনা, কিন্তু একটা অজানা ভয়ের কালোছায়া আমার ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে থাকে। তার অনুপ্রাসবাহুল্য শ্লোকগুলিতে বেশ ধমক দেয়ার ভাব।

    “দংষ্ট্রাকরালানিচতে মুখানি,
    দৃষ্টৈবকালানলসন্নিভানি,
    দ্বিষো ন জানে ন লভেচশর্ম্মঃ,
    প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাসঃ”

    রেডিওতে খবর পড়ছে কোথায় কোথায় ভীষণ বন্যা। আমার মনে দাগ কাটে না। কিন্তু একদিন দেখি এক ভদ্রলোকের গলায় চাদর দিয়ে হারমোনিয়াম ঝোলানো উনি “এস নগরবাসী এস এস ত্বরা” গাইতে গাইতে এগিয়ে গিয়ে বাড়িগুলোর ব্যালকনির নীচে দাঁড়াচ্ছেন। সঙ্গে যাঁরা দোহার দিচ্ছেন তাঁরা একটা বড় চাদরের চারটে কোণা ধরে মেলে দিচ্ছেন, উপর থেকে উড়ে এসে তাতে পড়ছে আধুলি, টাকা, এমনকি পুরনো জামা বা শাড়ির পুঁটলি। কেউ কেউ নীচে নেমে এসে হাতে দিয়ে যাচ্ছেন।

    পরের দিকে আরেকটা দল আসত, তাদেরও কাঁধে ঝোলানো হারমোনিয়ম, কিন্তু বড্ড বেসুরো, আর কথাগুলো একেবারে সাদামাটা - ‘এবার বন্যায়/ ভেসে গিয়েছে/ মেদিনীপুর’। একইভাবে পরের বছর অন্য কোন ‘পুর’।

    কিন্তু একদিন দাদু বললেন - লক্ষণ ভালো নয়। এইযে ঘন ঘন তুফান, বন্যা হইতাছে, এর একটা মানে আছে। কলিযুগের অন্ত। এবার আইব কল্কি অবতার, কালো ঘোড়ায় চইড়্যা। তারপর হইব মহাপ্রলয়। সে এমন বন্যা এমন ঝড় যাতে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হইব।শাস্ত্রে আছে, শাস্ত্রবচন মিছা হয় না। কল্কি অবতারের রূপ মনে আছে তর?

    ব্যস্‌ আমিও শুরু করে দিই দশাবতারের শেষ অবতারের স্তোত্রঃ

    “ম্লেচ্ছনিবহনিধনে কলয়সিকরবালম্‌, ধূমকেতুমিব কিমপিকরালম
    কেশবধৃতকল্কিশরীর জয় জগদীশহরে’’

    দাদু খুশি হলেন, কিন্তু রাত্তিরে আমার চক্ষে নাইরে নিদ! মহাপ্রলয় হবে? সব ধ্বংস হয়ে যাবে? এই বাড়ি, এই ছাদ, সামনে বুবুলদের বাড়ি, ট্রামলাইন, হাওড়া ব্রীজ, কোন বিদেশে চাকরি করতে যাওয়া বাবা, শিশুবিদ্যাপীঠ গার্লস স্কুল? কিছুই থাকবে না? এই ভয়ংকর খবর পাওয়ার পর দাদু কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে! ফুরুৎ ফুরুৎ নাক ডাকছে! আমাকেই কিছু করতে হবে।

    আমি প্রাণপণে কৃষ্ণকে ডাকি। হে কৃষ্ণ হে দীনবন্ধু! আমাদের বাঁচাও! আমিতো তোমার ভক্ত। আমার প্রার্থনা শুন, সাড়া দাও। এই দুনিয়ারে ধ্বংস কইরো না।

    দাদুর নাকের আওয়াজ ছাড়া কোথাও কোন সাড়া নেই। আমি হতাশ হয়ে কেঁদে ফেলি। ফোঁপানো ক্রমে বেড়ে যায়। এবার দাদুর ঘুম ভাঙে? কী হইসে? পেট ব্যথা?

    - কৃষ্ণরে ডাকতাছি। মহাপ্রলয় যেন না হয়।

    -- কী না হয়? আরেকবার ক’!

    দাদু উঠে জল গড়িয়ে খান, আমাকেও এক গেলাস দেন। তারপর লাইট নিভিয়ে বলেন — তর পেট গরম হইসে। যা, পাশ ফির‍্যা ঘুমা দেখি।

    আমি অবাক, বড়রাও কি অনেক কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে? গীতা ছেড়ে চন্ডী ধরি। মধুকৈটভ বধ, শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ, সুরথ রাজার রাজ্য উদ্ধার - বেশ লাগে।

    এরপর অর্গলাস্তোত্র ও দেবীকবচ খুলে পড়তে থাকি। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে চন্ডী নানান নামে অধিষ্ঠিত।

    “স্তনৌরক্ষেত মহাদেবী মনঃশোকবিনাশিনী,
    হৃদয়ে ললিতাদেবী, উদরে শূলধারিণী”

    বাঃ; কিন্তু আমার তো স্তন নেই, মহাদেবীকে কী দরকার? তবে উদরে যে শূলবেদনা বলে সেটা কি এই দেবী রেগে গেলে হয়?

    কিন্তু এটা কী? ‘মেঢ্রং রক্ষতু দুর্গন্ধা, পায়ুমে গুহ্যবাহনা’? দেবীর নাম হবে দুর্গন্ধা, গুহ্যবাহনা? তারা আমাদের ওইসব নোংরা জায়গায় থাকবেন? ছিঃ, আমার জন্যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাতা বন্ধ হয়ে গেল।

    এবার কী করি? পেয়েছি, দাদুর বালিশের পাশেই রাখা আছে - গুপ্তপ্রেসের হলুদ পাতলা মলাটের পঞ্জিকা। পাতা ওল্টাই আর অন্য এক দুনিয়ার খবর পাই।

    একগাদা কোডে লেখা ব্যাপারস্যাপার বুঝতে পারিনা। অমুক ঘটিকায়, তমুক তিথিতে, তমুক নক্ষত্রে, যাত্রা নাস্তি, হলকর্ষণ যোগ, মৎস-মাংস-অলাবু-স্ত্রীসম্ভোগ নিষিদ্ধ। দুর ছাই! এবার বিজ্ঞাপনের পাতা, আহা! জলন্ধরের মন্ত্রপূত আঙটি, কামাখ্যার বশীকরণ আঙটি, ছ’ঘরা পিস্তলের খবর - যার আওয়াজে বন্যপ্রাণী দস্যু সব ভীত হয়, নাটকে উপযোগ হয়। লাইসেন্স অনাবশ্যক। দস্যু মোহন সিরিজের বই। কতগুলোঃ আবার মোহন, রমা ও মোহন, রমার বিয়ে, রমাহারা মোহন, মোহন ও স্বপন একশ’র উপর। দাদুকে বলি কিনে দিতে। উনি গা’ করেন না। রেগে যাই, বলি - বড় হয়ে চাকরি করে নিজে নিজে কিনব। দাদু হাসেন। বলেন-তখন তোর অন্য বই পড়তে ইচ্ছে হবে।

    অন্য চারটে বই দেখি, সবগুলো দু’টাকা করে। গহন রাতের কান্না, হত্যাকারী কে? মিঃ এক্স এবং খুন-চুরি-ডাকাতি-গুম। ঠিক করি, লাস্ট বইটা নেব, ওতে চারটে জিনিস আছে, বাকিগুলোয় একটা করে।

    এরপর চোখ যায় সচিত্র কোকশাস্ত্র (কাশ্মীরের প্রসিদ্ধ কোকাপন্ডিত বিরচিত) দুর, কী যে বলে! কোন মাথামুন্ডু নেই। রেখে দেবার আগে চোখ গেল - সচিত্র প্রেমপত্র। তার বিজ্ঞাপনে একটি চারলাইনের কবিতাঃ

    “তরুণী হৃদয় কাঁদে ফুকারিয়া নীরব প্রেমের ক্রন্দনে,
    কতদিনে ধরা দিবে হে নিঠুর আমার এ বাহুর বন্ধনে।
    শূন্য এ হৃদি হোল যে শুষ্ক সহে নাকো আর বিরহ,
    এস চুপিসাড়ে মরমের দ্বারে নিঝুম রাতের প্রিয়”।

    ভোম হয়ে বসে ভাবছি -‘ নিঝুম রাতের প্রিয়’ ব্যাপারটা কী? এমন সময় ঠাকুমা ঢুকে জিজ্ঞেস করল-অমন প্যাঁচামুখ কেন? কী হয়েছে? আমি বললাম- নিঝুম রাতের প্রিয় কারে কয়? ঠাকুমাকে পঞ্জিকায় লাইনটা দেখলাম। গালে ঠাস করে একটা চড় পড়ল। পঞ্জিকা কেড়ে নিয়ে বললেন - আরেকদিন যদি এতে হাত দিয়েছিস!

    আজও অপেক্ষায় থাকি - মরমের দ্বারে কোন নিঝুম রাতের প্রিয় যদি চুপিসাড়ে আসে!

    মাঝখানে দাদু আমাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি বোঝাতে শুরু করলেন। মুখস্থ করালেন রঙ্গলালের কবিতা - স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃংখল বল কে পরিবে পায় রে, কে পরিবে পায়?

    দাদু আবৃত্তি করলেন নবীন সেনের পলাশির যুদ্ধ থেকে। প্রথমে মীরজাফর, মীরমদন, মোহনলাল, লর্ড ক্লাইভ, অত্যাচারি বিলাসপ্রিয় নবাব সিরাজদৌল্লা সব গল্প আগে শোনালেন। উমিচাঁদ, জগতশেঠ, খাল কাইট্যা কুমীর, পলাশির আমবাগান—সবই হোল। আমার খালি মনে রইল-হুররে হুররে করি গর্জিল ইংরাজ।

    এসে গেলেন হেমচন্দ্র।

    ‘বাজ্ রে শিঙ্গা, বাজ এই রবে, সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
    সবাই স্বাধীন মানের গৌরবে ভারত কেবল ঘুমায়ে রয়’।

    তারপর বললেন - এইটা শোন।

    ‘চীন ব্রহ্মদেশ অসভ্য জাপান
    তারাও স্বাধীন তারাও মহান
    দাসত্ব করিতে করে হেয়জ্ঞান
    ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়’।

    এইখানে জাপানরে ‘অসভ্য’ কওয়াটা ঠিক হয় নাই। অন্য দেশরে অসইভ্য কওয়ার তুমি কেডা? পরে বোধহয় শব্দটা বদলাইয়া দিছিল, ঠিক মনে নাই। ইংরেজ কবি মিল্টনের মত তিনিও শেষ বয়সে অন্ধ হইয়া ভগবানের কাছে পিটিশন দিয়া কবিতা লেখছিলেন - ‘বিভু, কী দশা হবে আমার’?

    --কেন এমন হইল দাদু? অই যে জাপানরে অসইভ্য কইয়া গালি দিছিল, হেই পাপে?

    - ছিঃ, এমন কথা কইতে নাই। পাপপুণ্যের বিচার করার তুমি-আমি কে? ঈশ্বরের মর্জি আমরা নগণ্য মানুষ কতটুকু বুঝি? কখনও মাইনষের অঙ্গবিকৃতি নিয়া হাসি তামশা কইরো না। কে জানে পূর্বজন্মের কোন পাপে কার কী দশা হয়!

    এতসব ভালো ভালো কথা বলে শেষে আমাকে খারাপ মানুষ চিনতে শেখালেন সেই শরীরের খুঁত দেখে।

    “শ’ও মে ফুলি, হাজার মে কান,
    উসসে বড়া হ্যায় তিজেতান।
    তিজেতান কহতা এইসা বাত,
    হাম নহী সেকেঙ্গে করমজীকে সাথ”

    যার চোখের সাদা জায়গায় কালো স্পট আছে সে হইল শয়তানিতে একশ নম্বর । যে কানা সে একহাজারগুণ বদমাইশ, হের থেইক্যা বড় ধড়িবাজ তিজেতান, মানে ট্যারা। কিন্তু সেই ট্যারাও হার মাইন্যা যায় করমজী মানে করমজা চৈখ্যার কাছে।

    -- সেটা আবার কী?

    -- আরে যার চোখের মণি করমচার মত। ঘটিরা যারে বিড়ালচোখো কয়।

    এইসব বুঝে সুঝে দাদুকে জিগাই — এইসব তো পুরুষমানুষের লক্ষণ, মাইয়ামানুষের ভাল খারাপ ক্যামনে বুঝন যাইব? মানে শরীরের কোন লক্ষণ দেইখ্যা?

    দাদু হতভম্ব। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ে স্নান করে ভিজে কাপড়ে ঠাকুমা ঘরে ঢুকল। আমার প্রশ্ন শুনে ভুরূ কুঁচকে দু’পলক তাকিয়ে কানটা পেঁচিয়ে ধরল।

    - যা ছাদে গিয়ে খেল। এই বয়সেই তরে মাইয়ামানুষের শরীরের লক্ষণ বুঝন লাগত না।

    ছাদে দৌড় লাগাতে গিয়ে আমার কেমন মনে হল — আসলে মাইয়ামানুষের শরীরে খারাপ কিছুই নাই, সবটাই ভাল। ওই ধারণাটি আজও পাল্টায় নি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬
  • ধারাবাহিক | ০৮ জুন ২০২১ | ২৯৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১১ জুন ২০২১ ০৫:২০494832
  • কি মায়াময় শৈশব! পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে ফিক করে হেসে ফেলেছি, শেষ বাক্যে অট্টহাসি। 


    ফন্টটি পাঠ বান্ধব নয়। শুভ 

  • Ranjan Roy | ১১ জুন ২০২১ ২৩:৩২494856
  • বিপ্লব,


      সোলেইমান লিপি ফন্ট চলবে? আগে ওটাতেই লিখতাম।

  • Pritha | 122.18.***.*** | ১২ জুন ২০২১ ২৩:০৮494889
  • চমৎকার লেখা

  • Nirmalya Nag | ১৩ জুন ২০২১ ২২:০০494923
  • চমৎকার 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন