পরীক্ষা হবে না: বিশের গোড়ায় ফেরার তাগিদ
গৌতম রায়
মাধ্যমিক , উচ্চ মাধ্যমিক রাজ্য সরকার বাতিল করেছেন করোনা আবহে।মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, কি হবে মূল্যায়ণের ধারা, সেটি অল্প কিছু দিনের ভিতরে জানানো হবে। এই খবরের এক দুদিনের ভিতরেই একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে খবরের কাগজগুলিতে , সেটি হল; পরীক্ষা বাতিলের অবসাদে এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আত্মঘাতী হয়েছেন।ছোট খবর।দিনহাটার ১৬ বছরের আত্মঘাতী বর্ণালী মন্ডল কে নিয়ে ভাববার তো এখন দরকার নেই।কারণ, সামনে তো কোনো ভোট নেই।যেমন ভুলে গিয়েছি কোচবিহার সদর হাসপাতালের নার্স বর্ণালী দত্তকে।তেমন করেই ভুলে যাবো বর্ণালী মন্ডলকেও। বাম- ডান কোনো রাজনীতির মানুষ ই এই খবর টা ঘিরে খুব একটা যে উদ্বিগ্ন এমনটা অন্তত সামাজিক গণ মাধ্যম দেখে মনে হচ্ছে না। যদিও ফেসবুকের শক্তিমানেরা ইতিমধ্যেই বর্ণালীর ছবি দেওয়া পোস্টার নিজেদের দেওয়ালে সেঁটে দিয়েছেন।
মমতা পরীক্ষা বন্ধ করে প্রশ্নপত্র ফাঁস রুখে দিয়েছেন- এমন খিল্লিতেই আপাতত ফেসবুকীয় রাজনীতিকেরা সব থেকে বেশি ব্যস্ত।ফেসবুকের বাইরে কতোজন রাজনীতিক এখন আমাদের এই রাজ্যে আছেন, তা ঠিক চল্লিশ পেরোনো চালসে পড়া চোখে ঠাওর হচ্ছে না।কারণ, বিধানসভা ভোটের পর এক মাস কেটে যাওয়ার পর দায়িত্বশীল বিরোধিতার অঙ্গীকার করা বিজেপি নিজেদের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত।আর বামপন্থী তাবড় তাবড় নেতারা মনে হয় ভোট পর্যালোচনাতে এতোটাই ব্যস্ত যে জনগণের সাধারণ সমস্যার মতো ' পেটি' বিষয়ে ওঁদের সময় দেওয়া এখন সম্ভবপর নয়।
পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তটি কি মমতার জনমোহিনী রাজনীতির ই একটি অংশ? মানুষকে কিছু না পাওয়ার দুঃখ ভোলাতে কিছু পাইয়ে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখার একটা কৌশল? এই প্রশ্ন তোলার অধিকার এবং যোগ্যতা বিরোধীদের।কিন্তু সংসদীয় ব্যবস্থায় যাঁরা বিরোধী, অর্থাৎ; বিজেপি, তাঁরাও তো এই পাইয়ে দেওয়া পথের ই পথিক।সুতরাং বিজেপি এ নিয়ে মুখ খুলবে- এটা আশা করাটাকেই আমার কাছে অন্যায় বলে মনে হয়।
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যবস্থা মানুষকে সুবিধা করে দেওয়ার , এক কথায় একটু স্বস্তি দেওয়ার নেহরু ঘরাণার অর্থনীতির কংগ্রেস নিজের হাতেই গঙ্গা যাত্রা ঘটিয়েছে।বাজার অর্থনীতির সর্বনাশা এই পথের বিরুদ্ধে হাঁটার পক্ষে অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্ববিশ্রুত অর্থনীতিবিদ যতোই সাওয়াল করুন না কেন, ঠেকে শিখে ও সেই পথে ফিরে আসার কথা কংগ্রেস আজ পর্যন্ত উচ্চারণ করে নি।
প্রশ্ন হল, বামপন্থীরা এই রাজ্যে যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন কি তাঁরা বাজার অর্থনীতিকে রোখার প্রশ্নে সত্যিই আন্তরিক ছিলেন? রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়াবলী সাধারণ মানুষের উপকার করে - এটা ক্ষমাতায় থাকাকালীন বামপন্থীরা বিশ্বাস করলেও বাস্তবে যদি সেই ভাবনার প্রয়োগ ঘটাতেন , ছোট পরিসরেই বলি, তাহলে ভরা বাম জামানায় কলকাতা মহানগরীর বুকে সাউথ সিটি মল মাথা তুলতে পারত না।বৃহত্তর শিলিগুড়ি শহরের বুকে চা বাগান উঠিয়ে সেখানে হাউজিং কমপ্লেক্স হতো না। অর্থনীতি এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে দেশব্যাপী আন্দোলন করে জ্যোতি বসু, অশোক মিত্রেরা জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের একটা বড় রকমের প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করেছিলেন।ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাস্ক, পরবর্তী কালে জি এস টির ধারণা দেওতে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত ক্ষমতা এবং অর্থনীতিকে কেন্দ্রের কেন্দ্রীভূত করবার কাজে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন-- এই বাস্থবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না।
তাই এই জায়গা থেকেই মমতার জনগণেশ কে খুশি করবার যে মানসিকতা , সেই মানসিকতা কে ঘিরে খিল্লি , উপহাস না করে মানুষ কে তাঁর ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবার প্রশ্নে বামপন্থীদের এই চরম গা ঢিলেমি তা যেকোনো সামাজিক প্রশ্নেই শাসককে মাইলেজ দেবে।আর সেই ফাইলেজের খেসারত দিয়ে বসবে বর্ণালী মন্ডলের মতো কিশোর- কিশোরীরা।
বাজার অর্থনীতি মানুষকে নিশ্চেষ্ট করে রাখার, আন্দোলনবিমুখ করবার যে রাজনীতির আমদানি ঘটিয়েছে সেই রাজনীতির শিকার আমাদের রাজ্যের বামেরাও- অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই সহজ সত্যটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
কর্মসংস্থানের দাবির প্রশ্নটি কি কোনো একটা জায়গায় এসে দুটি চারটি অনুগ্রহ পেয়ে আর ধারালো থাকছে না? মমতার ডোল রাজনীতির প্রতিবাদ করে ও ধারাবাহিক ভাবে নিজেদের সাধ্য মতো একটা আধটা জায়গাতে সেই দানখয়রাতির মানসিকতা কে বজায় রেখে কি মানুষকে তাদের ন্যায্য দাবি ভুলিয়ে দিচ্ছে না খোদ বামপন্থীরাই? সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের তুলে ধরতে না পারলেও রেড ভলেন্টিয়ার ইত্যাদির ভিতর দিয়ে নিজেদের তুলে ধরবার অঙ্গীকার করা বামপন্থীরা কেন মাধ্যমিক - উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিলের ফলে তরুণ প্রজন্মের ভিতরে যে হতাশা তৈরি হয়েছে- তাকে ফেসবুকের আওতার বাইরে তুলে ধরবে না? পুলিশ অনুমতি দেবে না এই কোভিড কালে আন্দোলনের।তাই বলে কেন পরীক্ষা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের উপর কতোখানি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে কোনো উদ্যোগ দেখা যাবে না?
বরদাসুন্দরী দেবীর গৃহপোষ্য মামাতো ভাই বোঝাতে চেয়েছিল তার চেপে ধরাতেই মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে পারে নি রামকানাই।তেমনি ই একটা বড় অংশের বামফ্রন্টীয় বামেরা বোঝাতে চাইছেন, সুপ্রিম কোর্টে তাঁদের মামলার ফলে ই ভয়ে ভয়ে প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি ভ্যাকসিন নীতি বদলের কাগুজে ঘোষণা করেছেন। ভাবতে কোনো ক্ষতি নেই।অলীকভাবনা কিন্তু মানুষকে প্রভাবিত করতে পারবে না।কারণ, রাজনীতিহীন ফেসবুক- টুইটারের রাজনীতি , রাজনীতির প্রশ্নেই মানুষকে অলস, জড়ভরতে পরিণত করেছে।
মেধাকে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার বাজার অর্থনীতির যে কৌশল- তাই যে উঁকিঝুঁকি মারছে স্কুল স্তরের শেষ ধাপের পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার ভিতর দিয়ে- এসব নিয়ে ভাববার মতো সময় কোথায় রাজনীতিদের? তাঁরা এখন পরীক্ষার মূল্যায়ণে ছাত্রের বাবা মায়ের প্রাপ্ত নম্বর দেখা হবে- এইসব ছ্যাবলামো সূচক ফেসবুক বিপ্লবেই ব্যস্ত। নেতা তাঁর ছেলের অনলাইন ক্লাসের ছবি পোষ্টাচ্ছেন, কারণ জনবিচ্ছিন্ন সেই নেতা জানেন ই না তাঁর এলাকায় , তাঁর ছেলের বয়সী কয়জনের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ আছে?
পরীক্ষা বন্ধের অবসাদে বর্ণালী আত্মঘাতী হয়েছে।অবসাদ ঘিরে আন্তর্জাতিক দুনিয়া তৎপর।জাপানে মহামারীর আকার ধারণ করছে অবসাদ।তাই সেই দেশের সরকার বিষয়টি মোকাবিলার উদ্দেশে একটা গোটা দপ্তর খুলেছে।এইসব খবরে দরকার নেই শাসকের।দরকার নেই বিরোধীদের।দুটো চারটে বর্ণালী মন্ডল আত্মঘাতী হলে তাঁদের কার কি এসে যায়? রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুর ছেলেমেয়েদের তো আর ইস্কুলের দাগানো ' মূল্যায়ণ' ঘিরে ভাবনা নেই।কারণ, আমরা তো সেই বিশ শতকের প্রথম যুগে মুখ দেখে নম্বর দেওয়ার যুগের দিকেই বেশ জোর গতিতে পিছিয়ে যাচ্ছি।তাই না?
বাম হোক আর ডানপন্থী, সবাই neoliberal আদর্শে বিশ্বাসী, যেখানে (প্রাইভেট tuition, competitive coaching) পয়সা ফেললে তবেই শিক্ষা জোটে , আর পয়সা না ফেললে জোটে পাস করার certificate, যেটার কোন মূল্যই নেই। সবার জন্য শিক্ষা একটা তামাশা, যেটা তুলে দেওয়াই উচিত।