কোভিড ঘিরে ভারতের গা ঢিলেমি দক্ষিণ এশিয়ার বিপদ বাড়াবে
গৌতম রায়
ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহারে কোভিডের আক্রমণ এতোই ভয়াবহ যে শবদেহ সৎকারের বদলে মানুষ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিচ্ছে।মনসামঙ্গলের লখিন্দরের ভেলার যেন পুনর্নিমাণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ , বিহারের গঙ্গানদীর পানিতে।খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনকেন্দ্র বারানসীতেও ভয়ঙ্কর অবস্থা। কিছুদিন আগে কুম্ভমেলায় যে ব্যাপক জনসমাগম ঘটেছিল তার জেরে ভারতের উত্তরবলয়ে কোভিড এখন কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে। গঙ্গার পানিতে ভেসে যাওয়া কোভিডে মৃত লাশগুলি কুকুর, শিয়ালেরা টেনে খাচ্ছে এটা এখন উত্তরপ্রদেশ , বিহারের পরিচিত দৃশ্য।
এই অবস্থায় গুজরাটে নয়টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের উদ্বোধন করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব দারুণভাবে সফল বলে দাবি করেছেন।ভারতে দৈনিক সংক্রমণ এখন ও প্রায় দেড়লক্ষ ।গড়ে দৈনিক মৃত্যু প্রায় তিন হাজার। গোটা ভারতজুড়েই কার্যত লক ডাউন। বিজ্ঞানীরা বলছেন ; করোনা ভাইরাস চরিত্র বদল করে দিনের পর দিন আর ও মারাত্মক হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় অমিত শাহের কোভিড কেন্দ্রিক ঘোষণা মানুষের ভিতরে প্রয়োজনীয় সতর্কতার ক্ষেত্রে একটা গা ছাড়া ভাব তৈরি করবে বলেই সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা।
কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের ক্ষেত্রে একদিকে থালাবাসন বাজানো, নিষ্প্রদীপ করার কথা অপর দিকে সচেতনতার কথা ভারত সরকার বলেছিল। প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউ ঘিরে আন্তর্জাতিক স্তরের বিজ্ঞানীরা যে সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন, সেগুলি যথাযতভাবে দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে ভারত সরকার বা ভারতের অঙ্গরাজ্যের কোনো সরকার ই প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে নি।কেরলের বামপন্থী সরকার কোভিড মোকাবিলায় প্রথম থেকেই যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত অবস্থান নিলেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সতর্কতার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাও বিতর্কের উর্ধে নয়।
কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময়কালে নিজেদের সাফল্য ঘিরে প্রচারে এতো বেশি মশগুল থেকেছে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলি যার ফলে পরের ধাক্কা ঘিরে সচেতনতাই সে ভাবে তৈরি হয় নি। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পরিকাঠামো তৈরি ঘিরেও সাফল্যের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে একটা বড়ো রকমের শূন্যতা। পরবর্তীতে কোভিড যে আবার থাবা বসালে তার মোকাবিলায় যে পরিকাঠামো তৈরি করে প্রতিরোধ গড়া দরকার- সেই প্রক্রিয়াটাই পুরোপুরি থমকে গিয়েছিল।ফলে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ গোটা প্রশাসনিক পরিমন্ডলকেই চরম অনিশ্চয়তার ভিতরে ঠেলে দেয়। হাসপাতালে বেড না পেয়ে যে বিপুল পরিমাণ রোগী দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারা যান, তার মূল কারণ হল; এই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার প্রশ্নে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রথম ঢেউ মোকাবিলা ঘিরে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।
কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময়কালে ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ছিল গড়ে এক লক্ষের তলায়।দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে গড়ে চার লক্ষ। এই অবস্থায় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে বলে অমিত শাহের যে ঘোষণা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।টিকাকরণের প্রশ্নে রাজনীতি যতো হচ্ছে, বাস্তবে কর্মসূচি পালন সে পরিমাণে হচ্ছে না। সরকারী উদ্যোগ ঘিরে ভারতের সর্বত্র ই ক্রমশঃ অসন্তোষ দানা বাঁধছে।প্রতিটি রাজ্যেই কার্যত টিকাকরণ কর্মসূচি শাসক দলের হাতের নাগালে থাকছে।ফলে শাসকের অনুগ্রহের বাইরে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ সেভাবে টিকা পাচ্ছে না।ক্ষমতার বৃত্তে টিকাকরণ সীমাবদ্ধ থাকার দরুণ যে রাজ্যগুলিতে বিজেপি ক্ষমতায় আছে , সেই রাজ্যগুলিতে টিকাকরণেও চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে মুসলমানদের টিকাকরণ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।আবার পশ্চিমবঙ্গে বামমনষ্ক সেবাকর্মী , যাদের রেড ভলেন্টার বলে পরিচিতি তৈরি হয়েছে, অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে তারা সেবাকাজ করলেও রাজনৈতিক কারণেই তাদের টিকাকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা বাতিল করেছে।
ভারতের সর্বত্র ই বেসরকারী উদ্যোগে টিঈআকরণের কর্মসূচি জোরদার ভাবে চলছে।তবে হাজার থেকে দেড় হাজার - বেসরকারী স্তরে একটি ডোজ টিকার দাম।ফলে বেসরকারী স্তরে টিকাকরণের সুযোগ কেবলমাত্র উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত ই নিতে পারছে।শ্রমিক, কৃষক, প্রান্তিক মানুষদের ব্যাপক হারে টিকাকরণ করানোর জন্যে ভারতের কোথাও ই বিরোধী দল গুলি সংগঠিত কোনো আন্দোলন করছে না।ফলে এইসব।মানুষদের টিকাকরণ ঘিরে সরকারের ও বিশেষ একটা হেলদোল নেই।পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবেশি বাংলাদেশে বিশেষ ভারতীয় ধরণের করোনা ভাইরাস যাতে সংক্রমিত না হতে পারে, সেইজন্যে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ব্যাপক হারে টিকাকরণ জরুরি। কিন্তু এই ব্যাপারে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেই।বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আজ পর্যন্ত একটি বিরোধী দল ও একখানা বিবৃতি পর্যন্ত দেয় নি।স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি , যারা একাধারে রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করছেন এবং আক্রান্তদের পাশে সেবাও দিচ্ছেন, তারাও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি তে ব্যাপক হারে টিকাকরণের ভিতর দিয়ে প্রতিবেশি বাংলাদেশে সংক্রমণ রোখার বিষয়টিকে সে অবস্থায় তুলে ধরছে না।
সরকারী স্তরে বিনামূল্যে পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের মাধ্যমে টিকাকরণের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।তবে সেই টিকাকরণ ঘিরে ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই সেখানকার শাসকদলের আধিপত্যের কথা শোনা যাচ্ছে।উত্তরপ্রদেশে সরকারী স্তরের টিকাকরণ বিজেপি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।বিহারে নিয়ন্ত্রণ করছে নীতীশকুমারের দল।রাজস্থানে নিয়ন্ত্রক কংগ্রেস , কেরলে সি পি আই ( এম) আবার পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস।ফলে সরকারী দলের সঙ্গে সংযোগ নেই যেসব মানুষদের তাদের পক্ষে হয় বেসরকারী স্তরে অনেক বেশি গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে টিকা নিতে হচ্ছে, নতুবা হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হচ্ছে কবে সরকারী স্তরে টিকার ভাগ্য ছেঁড়ে।
ভারতে সংক্রমণ আগের থেকে কমলেও এখনো দিনে গড়ে দেড় লক্ষ মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে।দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই কমবেশি লকডাউন চলছে।এই অবস্থায় যদি কোভিডের বিপদ এবং টিকা ঘিরে গা ঢিলেমি ভাব চলতেই থাকে তাহলে যে কোনো সময়ে এই সংক্রমণের সূচক হু হু করে বৃদ্ধি পাবে।অক্সিজেনের চাহিদা কমে এসেছে বলে আত্মতৃপ্তির যে মানসিকতা গুজরাটে বেসরকারি অক্সিজেন প্রান্টের উদ্বোধনে অমিত শাহ দেখিয়েছেন তা জনমানসে কোভিডের বিপদ কে খাটো করে দেখিয়ে যে বিপদ তৈরি করছে তার ফল যে কেবলমাত্র ভারতকেই পোয়াতে হবে তাই নয়।ভারতে সংক্রমণের সূচক উর্ধমুখী হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই কোভিড সংক্রমণের সূচক আবার ও অনেকটাই উর্ধমুখী হবে।
ভারতের নীতি আয়োগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সদস্য বিনোদ পল কোভিড বিধি মানার ক্ষেত্রে এতোটুকু শীথিলতা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে যে মন্তব্য করেছেন ।এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ , ওড়িশার ইত্যাদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বিনামূল্যে টিকার দাবিতে কেন্দ্রের সঙ্গে যে বৈঠকের প্রস্তুতি নিয়েছেন তাতে নড়চড়ে বসছে ভারত সরকার। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ডেল্টা স্ট্রেন কে চিহ্নিত করেছে জিনোম সিকোয়েন্সের দায়িত্বে থাকা ইন্ডিয়ান সার্স কোভ ২ জেনেটিক্স কনসর্টিয়াম এবং ন্যাশানাল সেন্টির ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ।এই ডেন্ট্রা স্ট্রেন প্রথম খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ভারতেই।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রজাতি বলে চিহ্নিত করেছে।
ব্রিটেনের কেন্টে আলফা নামক যে প্রজাতির ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল তার থেকে পঞ্চাশ গুণ ক্ষতিকর সংক্রামণের ক্ষমতা রাখে এই ডেল্টা।সেই কারণেই এই ডেল্টার সংক্রমণ ভারতে এতো তীব্র আকার ধারণ করেছে।মহারাষ্ট্রের অমরাবতী এলাকায় এই ডেল্টা স্টেইনটির প্রথম সন্ধান মিলেছিল।মহারাষ্ট্র থেকেই তা পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
মার্চ থেকে মে মারাত্মক সংক্রমণ চালাবার পর এখন সূচক নামতে শুরু করলেও তৃতীয় ঢেউয়ের যে আশঙ্কা বিজ্ঞানীরা করছেন, তার মোকাবিলায় টিকাকরণ কর্মসূচি কে সর্বাত্মক করাই একমাত্র উপায়।সেই সঙ্গে মাস্ক , স্যানেটাইজার , শারীরিক দূরত্বের মতো ব্যবস্থা গুলিকে জোরদার ভাবে বজায় রাখা জরুরি। অমিত শাহ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্যে যাই বলুন না কেন, বিনোদ পলের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা ইত্যাদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা টিকাকরণ ঘিরে কেন্দ্রের উপরে যে সন্মিলিত চাপ তৈরি করছেন, সেটিকে এড়িয়ে যাওয়া আর কেন্দ্রের পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না।