প্রায় চুয়াত্তর বছর বয়সে, কোনো আধুনিকাকে সম্বোধন করে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ—“চুপ করে যে সহিবে সে কখনো কবি নয়।” বস্তুত এই ‘চুপ করে থাকা’ নিয়ে, কবি বলেই, রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন সরব ছিলেন। আমাদের হাতে বাঙালি কবি নয় (ধানসিড়ি, ২০০ টাকা) নামের যে বইটি এসেছে, তা কতকটা এ রকমই নানা সময়ের সাহিত্যিক রুচি ও মূল্যবোধের প্রতিক্রিয়ায় কবির লেখা বেশ কিছু অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গদ্য-এর সংকলন। প্রবন্ধ কথাটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম না। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই লেখাগুলি টুকরো পর্যবেক্ষণ, বর্জিত অংশ, চিঠি, বা টীকা-টিপ্পনী। কখনও বা সাহিত্যিক কৈফিয়ত। এখন এই অপরিচিত কথাটা স্পষ্ট করে বলা চাই। কারণ রবীন্দ্রনাথকে সকলেই চেনেন। দিনকয়েক আগেই কলকাতা শহরের পথেঘাটে প্রায় হরর ছবির মতো এক বিকট পোস্টার সবাই দেখেছি, তাতে লেখা— আমি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথকে এই চেনাটা যে একরকম অপরিচয়ই তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সেটা বাদ দিয়ে তাঁর সমস্ত রচনাংশের কথা যদি ভাবি তবে পরিচয়ের কাঠামো খানিকটা দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বভারতী ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের প্রকাশিত কয়েকটি রবীন্দ্র রচনাবলী, কবির জীবনকালে মুদ্রিত গ্রন্থ, মৃত্যু-পরবর্তী নানান সংকলন, এবং অগ্রন্থিত অনেক রচনার উপর ভর করে। বিশেষত কপিরাইট উঠে যাওয়ার পরে সমস্ত রচনাবলী এসে পৌঁছোলো এক বিরাট সম্ভাবনার সামনে। কারণ আজ মৃত্যু-পরবর্তী আশি বছর পার করেও সম্পূর্ণ কোনো রবীন্দ্র রচনাবলী আমাদের হাতে এসে পৌঁছোয়নি। অনেক লেখাই তাই সুলভ নয়। অনেক তথ্যই তাই চোখের আড়ালে। সেই আড়াল থেকেই এই বইটির সম্পাদক তাঁর মর্জিমাফিক কয়েকটি লেখা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যাতে রবীন্দ্রনাথের একটি ‘শান্ত সমাহিত ভাবমূর্তি’ ঈষৎ টাল খেয়ে যায়। অচেনা এক রবীন্দ্রনাথের দেখা পান পাঠক। নতুন করে আবিষ্কার করে নেন আক্রমণাত্মক এক রবীন্দ্রনাথকে।
রবীন্দ্রনাথ। ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। সৌজন্য—ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্ট। নয়াদিল্লি
সম্পাদক গৌতম সেনগুপ্ত বইয়ের জগতে আর লেখালিখির সূত্রে পরিচিত নাম। তিনি রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য প্রকাশক/সম্পাদক। লেখক এবং অনুবাদক হিসেবেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর নির্বাচিত গদ্যলেখাগুলির অভিপ্রায় আমাদের কিছুটা উন্মুখ করে রাখে—কোন্ রবীন্দ্রনাথকে তিনি অগ্রন্থনার অন্ধকার থেকে তুলে ধরতে চাইছেন? বইটির কিছুটা পরিচয় নেওয়া যাক। মোট সাতাশটি ছোটো বড়ো লেখা এককাট্টা করে গৌতম সাজিয়েছেন বাঙালি কবি নয়। মোট সাতাশটি লেখার তেরোটিই কোনো না কোনো সাহিত্যিক বিতর্ক বা কৈফিয়ত। পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তকের অংশ বা ডায়ারি চারটি, সমালোচনা ও সাহিত্যতাত্ত্বিক মীমাংসা সাতটি আর তিনটি বিভিন্ন সময়ের সাময়িকপত্রের সাহিত্যিক চালচলন সংক্রান্ত। সব লেখাই কবির জীবনকালে অগ্রন্থিত এবং কখনও বা গ্রন্থিত লেখার বর্জিত অংশ। লেখাগুলি অনেকক্ষেত্রেই চট করে হাতের কাছে পাওয়া যায় না। কালসীমা ১৮৮০ থেকে ১৯৪১, কম-বেশি ৬১ বছর। এই সময় পর্বে নানা পরিস্থিতিতে উঠে আসা কিছু সাহিত্যিক প্রশ্ন, বিতর্ক, বিচার-মীমাংসার মধ্যে গৌতম খুঁজতে চেয়েছেন কোনো ‘তীব্র স্বর’ আর সেই স্বরলিপিতেই বাঁধতে চেয়েছেন বইটিকে।
আমার মতন পাঠক গোলমালে পড়ে যাবেন ওই নির্দেশটিতে। কাকে বলছেন তীব্র স্বর। সেই কথাটা পরিষ্কার করতে সম্পাদক সাহায্য নিয়েছেন এই সময়ের বিশিষ্ট ভাবুক সৌরীন ভট্টাচার্য্যের। ভূমিকায় সংকলক সৌরীন বাবুর একোক্তির সাহায্য নিয়েছেন তাঁর অভিপ্রেত ওই তীব্র স্বরটিকে পরিষ্কার করতে। আমার মনে হয়েছে এতে বিষয়টি আরও জট পাকিয়ে গেছে। বইটির ব্লার্বে একটি অংশ উদ্ধার করে বলা আছে—
বাঙালি কবি নয়? এরকম একটা প্রশ্ন যদি তোলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাহলে বিস্মিত না হয়ে উপায় কি! নমুনা হিসেবে বলা যায় ‘‘...আজকাল শতসহস্র বঙ্গীয় বালক আধা পয়সার মূলধন লইয়া (বিদেশী মহাজনদিগের নিকট হইতে ধার করা)... বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে কবিত্ব চাষ করিতেছেন...। তাঁহারা রাশিকৃত অসাড় কবিত্বের খড় তাঁহাদের কাকপুচ্ছে গুঁজিয়া দিন রাত্রি প্রাণপণে পেখম তুলিয়া থাকিতে চেষ্টা করেন”...তীব্র এই স্বর কি বরাবরই ছড়ানো ছিল তাঁর লেখায়?
তীব্র স্বর বলতে এখানে বোঝাচ্ছে ব্যঙ্গ, আক্রমণাত্মক এক স্বরভঙ্গি। অথচ ভূমিকায় সৌরীন বাবুর বয়ানে যে কথা উপস্থাপন করছেন গৌতম সেখানে পাচ্ছি— তুমি যাকে তীব্র স্বর বলছ আমি হয়ত তাকে বলব ভিতরের জোর।
সৌরীন ভট্টাচার্য্যের মুখচ্ছদ ব্যবহার করে এরপর অনেকগুলি দরকারি কথা সম্পাদক উপস্থাপন করলেও নানা প্রসঙ্গে গড়ে ওঠা লেখাগুলির মূল সূত্র পরিষ্কার বোঝা যায় না। তীব্র আক্রমণাত্মক লেখা আর ভিতরের জোর যে ঠিক এক জিনিস নয় বরং উলটো সে উদাহরণ নানা সময়ের রবীন্দ্ররচনায় স্পষ্ট। এই দ্বৈধের ইতিহাস ধরা আছে শঙ্খ ঘোষের নির্মাণ আর সৃষ্টি বইটিতে। তা ছাড়া আর-একটি কথাও সম্পাদনা সূত্রে মানতে পারা মুশকিল, বিশেষত যে লেখা এমনকি রবীন্দ্রনাথের দীক্ষিত পাঠকেরও নাগালে নেই, সেইসব লেখার তথ্যসূত্র থাকলে শুধু উত্তর লেখার সুবিধে হয় এমন নয়, তথ্যগুলো জানা থাকলে পাঠকের কাছে ওই তীব্রতার বহিরাশ্রয়টুকু ধরা পড়ে যায়। সাময়িক উত্তেজনায় যে একজন বড়ো লেখক তাঁর ভিতরের জোরে সরিয়ে দিতে পারেন সেইটে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন একটা প্রসঙ্গের উল্লেখ করি। এই বইয়ের নামপ্রবন্ধ বস্তুত একটি পূর্ব প্রকাশিত প্রবন্ধের উত্তর। ১৮৭৫ সালের কাছাকাছি কালীপ্রসন্ন ঘোষ বান্ধব আর বঙ্গদর্শন পত্রিকায় যথাক্রমে নীরব কবি ও বাঙালি কবি কেন নামে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রায় পাঁচ বছর পরে এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতী পত্রিকায় পর পর রবীন্দ্রনাথের দুটি নিবন্ধ—বাঙালি কবি নয় এবং বাঙালি কবি নয় কেন? ১৮৭৭-এ প্রভাত চিন্তা গ্রন্থে কালীপ্রসন্ন তাঁর নীরব কবি প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। তিনি পূর্ব বঙ্গীয় ব্রাহ্ম সমাজের সহযোগী, বাগ্মী এবং সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা বান্ধব-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জোড়া প্রবন্ধ দুটির প্রথমটি অনেকটা বাদ দিয়ে পরবর্তী কালে সমালোচনা বইটিতে নীরব কবি ও অশিক্ষিত কবি নামে গ্রন্থিত হয়। এই নীরব কবি ধারণাটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতাত্ত্বিক অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। আমাদের মনে পড়ে যাবে দীর্ঘকাল পরেও তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ—“একটা অলক্ষিত অচেতন নৈপুণ্যবলে ভাবগুলি কবির হাতে বিচিত্র আকার ধারণ করে। সেই সৃজনক্ষমতাই কবিত্বের মূল।’’ (সাহিত্যের সামগ্রী) অথবা “প্রকাশই কবিত্ব। মনের তলার মধ্যে কী আছে বা না আছে তাহা আলোচনা করিয়া বাহিরের লোকের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই।’’ (সাহিত্যের সামগ্রী) গ্রন্থভুক্তির সময় তাহলে এই সাময়িক উত্তেজনার অতিরেকটুকু সরিয়ে মূল তাত্ত্বিক অবস্থানটিকেই গ্রহণ করছেন রবীন্দ্রনাথ। নীরব কবিত্বের ধারণা একটি সাহিত্যিক প্রশ্ন, গোটা বাঙালি জাতটাই কবি কি না, সেটা তাৎক্ষণিক অবান্তর পথের তরজা। তাই ওই তীব্র আক্রমণাত্মক স্বর ঠিক অন্তরের জোর নয়। ভিতরের জোর হল ব্যক্তিগত স্বর লেশমাত্র না রেখে নিজেকে ক্রমাগত নির্বাচন করা। কোনো ভাবমূর্তিই তাই স্থায়ী নয়, লেখকের দায় যেমন জবাব দেওয়ার তেমনই নিজের স্বভাবকেও খুঁজে নেওয়ার। সেই দায় থেকেই রবীন্দ্রনাথ যে-কোনো সমাজপ্রশ্নে বা সাহিত্যপ্রতর্কে সরাসরি ছুড়ে দেন নিজেকে ঘূর্ণাবর্তের মধ্যিখানে। যেখানে তাৎক্ষণিকের চাপে ভাষা প্রয়োগ কখনও তীক্ষ্ণ-তীব্র, কারণ তার সামনে প্রতিপক্ষ আছে। আর ভিতরের দিকে সেই প্রশ্নের ঘূর্ণিতে নিজেকেই খুঁজে খুঁড়ে দেখা। সেই চলনে ব্যক্তিলেশ নেই। ক্রমাগত নিজেকেই সৃষ্টি করে চলা। একেই বলতে পারা যায় আবরণ-মোচনের সাধনা। আমাকে আমি থেকে ছাড়িয়ে নেবার সাধনা।
এই বইটির প্রায় সব লেখার সঙ্গেই একটা কোনো সমসাময়িক জবাব দেওয়ার দায় আছে। আর প্রায় সব লেখাই নিহিত হয়ে আছে নিকটবর্তী গ্রন্থিত নিবন্ধে, মার্জিত চেহারায়। বইটির শেষ নিবন্ধটি প্রেস-এ চলে গেছে যখন, রবীন্দ্রনাথ ফিরিয়ে নিয়েছেন সেই লেখা। কিন্তু কেন? একটু তুলে দিই এখানে তার একাংশ— আর্টিস্ট হলেন একা, ইতিহাস হল জনসংঘকে নিয়ে। ইতিহাসের ভিতর দিয়ে লোকে দেশোদ্ধারের কাজ করে...। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিন একাই ছিলেন এবং আজ পর্যন্ত কেউ তাঁকে যথোপযুক্ত সঙ্গ দিতে পারে নি। কথাটা তীব্র এবং সত্যি কিন্তু প্রকাশযোগ্য নয় রবীন্দ্রনাথ-এর কাছে।
আমাদের আলোচ্য বইটিতে এইরকম এক রবীন্দ্রনাথকে পাব আমরা যিনি চলার পথের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হলেও সেই পথের কলহ থেকে তুলে নিতে পারেন সত্যিকারের জীবনবোধ। নানা সংঘর্ষে মনোলীন এক জায়মান আমি-র প্রবাহ। এখানে রইল সেই সাধনার বাইরের দিকের খবর। বইটি সংগ্রহযোগ্য কেননা এর লেখাগুলি সুলভ নয়। পাঠক যদিও সমস্তটাই, প্রায় একই ক্রমে টীকাটিপ্পনী সুদ্ধ পেয়ে যাবেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ১২৫তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর ১৫ খ (২০০৪) খণ্ডটির সাহিত্য ১ অংশে। সে খণ্ড সবাই চোখে দেখার সুযোগ পাননি। সম্পাদক সে সুযোগ করে দিলেন। কিছু মুদ্রণ প্রমাদ এবং ২৪তম লেখাটির নামের ভুল আশা করি পরবর্তী সংস্করণে সংশোধিত হয়ে যাবে।
বাঙালি কবি নয়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সংকলন ও সম্পাদনা: গৌতম সেনগুপ্ত
ধানসিড়ি
মুদ্রিত মূল্য : ২০০ টাকা
প্রাপ্তিস্থান: কলেজস্ট্রিটে দে'জ, দে বুক স্টোর(দীপুদা)
বাড়িতে বসে বইটি পেতে হোয়াটসঅ্যাপে বা ফোনে অর্ডার করুন +919330308043 নম্বরে।
বইটি অনলাইন কেনা যেতে পারে এখানে।
আক্রমণাত্মক রবীন্দ্রনাথ - এরকম একটা ব্যাপার জানতে অন্তত বইটা দেখতে হবে।
সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, এই লেখকের নামের হাইপার্লিঙ্কে ক্লিক করলে যে দু'টি আর্টিকেল আসছে, তার মধ্যে প্রথম লেখাটি 'লা টোম্যাটিনো' বোধ করি এই রিভিউ যিনি লিখেছেন, তাঁর লেখা নয়। আপনারা প্লিস একবার দেখে নেবেন, এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দেবেন।