এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • টিটেনি কাহিনী

    রজিউদ্দীন রতন
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৬৮১ বার পঠিত


  • ব্লাক মামবা নামের এক প্রকার সাপ আছে আফ্রিকাতে। সে বড় ভয়ঙ্কর সাপ। সে সাপ ফোঁসফাঁস করে কিনা জানিনা। করলে তো ভালই, টের পেয়ে মানে মানে তার পথ ছেড়ে কেটে পড়া যায়। কিন্তু তা না হলে আর রক্ষে থাকেনা। সে সাপের এক ছোবলে চটজলদি কেষ্টপ্রাপ্তি নিশ্চিত! চটজলদি মানে একটুও দেরি করে নয়, কখনো কখনো এমনকি মিনিট বিশেকের মধ্যেই অক্কা। সে সাপের আরো কারামত আছে। সাপেদের দৌড় প্রতিযোগিতা হলে উসাইন বোল্টের খেতাবটা জুটতো ব্লাক মামবারই। কারণ এরা সাপেদের মধ্যে সবচাইতে দ্রুত ছুটতে পারে। এখানেই শেষ নয়। ব্লাক মামবার নিশ্চয়ই আরো নানা গুণ আছে। আমি সেগুলো জানিনা। কিন্তু এটা নিশ্চিত জানি, সব মিলিয়ে সে সাপ বড় ভয়ঙ্কর। ভাবছেন বুঝি, যাক বাঁচা গেল। আফ্রিকা থেকে ব্লাক মামবারা এতদূরে আসতে যাবে না। কিন্তু আমি ব্লাক মামবার চাইতে আরো ভয়ঙ্কর এক প্রাণির কথা জানি। আর তার বাস আপনার উঠোনেই। উঁহু, পা উঠিয়ে চৌকিতে বসেও লাভ নেই। তারা থাকতে পারে আপনার চৌকিতে, আপনার হাতে, পায়ে এমনকি নখের ভেতরেও। ভাবতে পারেন আমি গুল মারছি। কিন্তু আসলে এসব সত্যি। চৌকিতেই বরং পা উঠিয়ে জুত করে বসুন। আমি খোলসা করে বলি।

    ব্লাক মামবার চাইতে ভয়ঙ্কর যে প্রাণির কথা বলছি তার নাম টিটেনি। আর তার গোত্রের নাম ক্লসট্রিডিয়াম। সব মিলিয়ে ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি। এরা থাকে আপনার উঠোনেই। যতই ঝাঁট দেয়া আর নিকোনো হোক, এরা থাকেই। ব্লাক মামবারা যদি কখনো জানতে পেতো এদের কী ক্ষমতা, তাহলে বেচারারা নিজের বিষের বাহাদুরি বাদ দিয়ে বরং টিটেনির হাত থেকে পালানোর পথ খুঁজতো। কারণ বলছি, ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি একপ্রকার বিষ বানাতে পারে। নাম টিটেনাস টক্সিন। টিটেনোস্পাজমিন ও বলা হয় এ বিষকে। প্রকৃতিতে যত ভয়ঙ্কর বিষ আছে সেগুলোর প্রথম তিনটার মধ্যে এই বিষ একটা। এই বিষের কাছে ব্লাক মামবার বিষ লেবুর শরবতের মতো! সব শুনলে আপনিও আমার সঙ্গে গলা মিলিয়ে এই কথাই বলবেন।

    ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি'রা মাটিতে থাকে। দেখতে লম্বাটে। লেজ আছে। লেজসহ এরা দেখতে অনেকটা টেনিসব্যাটের মতো। বাতাসে যে অক্সিজেন থাকে, তা এদের জন্য বিষের মতো। অক্সিজেন গায়ে লাগলে টিটেনি'রা মরে যায়। অক্সিজেনের হাত থেকে বাঁচতে তাই এরা শরীরে এক রকমের বিশেষ বর্ম পরে থাকে। সে বর্ম এদেরকে অক্সিজেন থেকে বাঁচায়, তার আর যতো শত্রু আছে তাদের হাত থেকে বাঁচায়, গরমে পোড়ার হাত থেকে বাঁচায়, ঠান্ডায় জমার হাত থেকে বাঁচায় আরো কতো কি! ব্যাঙ যেমন শিতনিদ্রায় গেলে আর সাড়া থাকেনা তার। সে মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে বুঝে ওঠা যায়না সহজে। সেরকম টিটেনি'রাও এদের বর্মের ভেতরে কালঘুমে পড়ে থাকে। কুম্ভকর্ণের সেই ঘুম ভাঙ্গে কেবল বিশষ বিশেষ পরিবেশ আর পরিস্থিতিতে। বিশেষ বিশেষ সেই পরিবেশ আর পরিস্থিতির সবগুলোর কথা আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু মানুষের ক্ষতি করার সুযোগ পেলে যে এরা বর্ম ভেঙ্গে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি। এমনিতে অক্সিজেনের আশে পাশে থাকলে এরা নির্জিব হয়ে পড়ে থাকে, কিন্তু ধরুন উঠোনে পড়ে থাকা একটা পুরোনো লোহায় আপনার পা'টা একটু ছড়ে গেল। অমনি এরা সেই ছড়ে যাওয়া অংশ দিয়ে ঝটপট আপনার শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ে বিষ বানাতে শুরু করে। এখনো কেউ বলতে পারেনা এই বিষ বানিয়ে এদের উপকারটা কী হয়! সবকিছুরই নাকি একটা প্রয়োজন থাকে। যেমন যে ব্লাক মামবার কথা বলছিলাম তার বিষটাও ফাউ কাজের নয়। শিকার করে খেয়ে বাঁচতে তাদের বিষের দরকার হয়। টিটেনি'র ক্ষেত্রে সেরকম না। এদের বিষ এদের নিজেদের কোন কাজেই লাগে না। মাঝখান থেকে তীব্র সেই বিষে মানুষের দফারফা হয়ে যায়। একটা সুঁচ ফুটলেও আর চিন্তার শেষ থাকেনা। যদি এরা সেই ক্ষত দিয়ে শরীরে ঢুকে বসে তাহলেই বিপদ। ব্লাক মামবার বিষ আর কী! হিসেব করে দেখলাম একটা মানুষকে মারতে যতটুকু ব্লাক মামবার বিষ লাগে সেইটুকু টিটেনি'র বিষে কমবেশি দশ লাখ মানুষের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায়। সাধে কী আর বলছিলাম টিটেনি'র বিষের কাছে ব্লাক মামবার বিষ লেবুর শরবতের মতো! আর তাছাড়া ব্লাক মামবা নিশ্চয়ই আপনার উঠোনে এসে লুকিয়ে বসে থাকে না। যদিনা আপনার বাড়িখানা আফ্রিকার জঙ্গলের কাছাকাছি হয়। আর না হয় তা হলই! ব্লাক মামবা'কে তো দেখাই যায়! মুখের ভেতরটা কুচকুচে কালো রঙের ধুসর এই সাপ বছরে যে কয়জন মানুষ মারে তারচাইতে হাজারগুনে বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি।

    তাই বলছিলাম, বাড়ির উঠোনেই ব্লাক মামবার চাইতে ভয়ঙ্কর প্রাণি থাকে। অবশ্য আমার বলারই বা কী আছে! ধনুষ্টংকারের কথা নিশ্চয়ই আপনি আগে থেকেই জানেন। হ্যাঁ, ক্লসট্রিডিয়াম টিটেনি ব্যাকটেরিয়ার বিষের কারণেই ধনুষ্টংকার হয়। এই ব্যাকটেরিয়া'র বিষ কিভাবে মানুষের প্রাণনাশের কারণ হয় তা খুব স্পষ্ট করে এখনো বলা যায় না। তবে একটা ব্যপার পরিষ্কার, টিটেনি'র বিষ মানুষের স্নায়ুর বিষ। মানে এটি সবর্নাশ করে মানুষের স্নায়ুর। আমি এত এত ভয়ের কথা বলছি বলে আবার ভয়ে উঠোনে পা দেয়াই বন্ধ করবেন না। একরত্তি ব্যাকটেরিয়ার ভেতরে এত তেলেসমাতি থাকলে মানুষের ভেতরেও কম থাকার কথা নয়। আর তা থাকেও না। মানুষের শরীরে আছে এক রাক্ষুসী কোষ। এমনিতে এদেরকে বলে ফ্যাগোসাইট। আমি বলি গিলেখাদক। কারণ এরা ব্যাকটেরিয়া ধরে ধরে গিলে খেয়ে ফেলে। এদের পেটে বোধহয় একটা আস্ত হাতি ধরবে। ব্যাকটেরিয়া পেলেই হলো, টপাটপ ধরে গিলে ফেলতে এরা দেরি করে না। গিলেখাদকদের জীবানু ধরে খেয়ে ফেলার প্রকৃয়াটি বেশ মজার। এরা সাধারণত জীবানুর চাইতে অনেক বেশী বড় হয়। গঠনে এরা নরমসরম। ঠিক যেন রুটি তৈরির জন্য মাখানো আটার দলা। রুটি তৈরির জন্য যে আটা মাখানো হয়, সেই আটার একটা দলার গায়ে যদি একটা মার্বেল চেপে ধরা হয় তাহলে যেমন মার্বেলটি টুপ করে সেই আটার দলার ভেতরে ঢুকে যায়। ঠিক সেরকম ভাবে ফ্যাগোসাইট মানে গিলেখাদকরাও জীবানুদের ধরে ধরে নিজের শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। আর কে না জানে, গিলেখাদকদের পুরো শরীরটাই তার পেট। জীবানু একবার গিলেখাদকের পেটে ঢুকলে তার আর রক্ষে থাকে না। সাধারণত জীবানুরা গিলেখাদকের পেটে থাকে ছোট ছোট থলের মতো জায়গায়। জীবানু আটকে রাখার থলে ছাড়াও গিলেখাদকের পেটের মধ্যে থাকে বিষ ভর্তি আরো একরকমের থলি। যখনই জীবানু গিলেখাদকের পেটে পৌঁছায় তখনই বিষ ভর্তি সেই থলেগুলো এসে মিশে যায় জীবানুওয়ালা থলের সঙ্গে। আর সেই বিষে ডুবে জীবানু মরে গলে একেবারে মাংসের কিমার মতো হয়ে যায়।

    তা সে দুঞ্চচারটে হোক আর দুঞ্চচার হাজার, গিলেখাদকেরা জীবানু খেয়েই চলে। তাই গিলেখাদকরা থাকলে আর চিন্তা না থাকার কথা। এমনকি টিটেনি আসলেও চিন্তা না করে ফুর্তি করতে পারার কথা। কিন্তু তা করা যায় না। কারণ জীবানুরা এত সহজে হার মেনে নেয়না। জীবানুর চামড়া সাধারণত দুই স্তরের। ভেতরের দিকে পাতলা একটা, আর বাইরের দিকে শক্ত একটা। অনেকটা হাওয়াই শার্টের উপর পরে থাকা ভারী জ্যাকেটের মতো। জীবানুদের এই সব চামড়া তাদেরকে গিলেখাদকের বিষ থেকে বাঁচাতে পারেনা। আর বাঁচাতে পারেনা বলেই কিছু জীবানু তাদের বাইরের শক্ত চামড়াটা ঘিরে আরো একরকম খোলস বানাতে পারে। এই খোলসকে বলে ক্যাপসুল। জীবানুদের যে বর্মের কথা বলছিলাম, সেটা এই ক্যাপসুল। বর্ম তো শরীরের বাইরে পরে, কিন্তু মজার ব্যপার হচ্ছে জীবানুদের একপ্রকার বর্ম আছে যেটা তারা শরীরের ভেতরে পরতে পারে। পরতে পারে মানে বর্মটা তারা শরীরের ভেতরেই বানিয়ে নেয়। খারাপ পরিবেশে যেখানে তাদের টিকে থাকার অসুবিধা, সেখানে কিছু জীবানু তাদের শরীরের ভেতরের সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঘিরে তৈরি করে এই বর্ম। একে বলে এন্ডোস্পোর। শরীরের ভেতরের এই বর্মও জীবানুদেরকে নানা প্রতিকুলতা থেকে বাঁচায়। এইসব বর্ম পরে থাকলে গিলেখাদকেরাও বিশেষ সুবিধা করতে পারেনা। এমনকি গিলেখাদকের পেটের মধ্য গিয়েও গিলেখাদকের বিষ থেকে জীবানুরা বেঁচে যেতে পারে এইসব বর্মের ক্ষমতায়। কিন্তু জীবানুদের কিছু দূর্বলতাও আছে। তারা যদি বর্ম পরে থাকে তাহলে তারা আর বাচ্চা দিতে পারেনা। তাই বংশবিস্তার করতে হলে শরীরের ভেতরে তাদেরকে বর্ম টর্ম খুলে ঝাড়া হাত-পা হতে হয়। আর ঝাড়া হাত-পা হলে গিলেখাদকেরাও জীবানুদেরকে ঠিকমতো বাগে পেয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে।

    গিলেখাদকরা জীবানুদের বাগে পেলেও বিপদ না কমে বরং বেড়ে যায় কখনো কখনো। এদের হাতে পড়লে জীবানুদের কী দশা হয় সে তো বললামই। পেটের ভেতরে জীবানুদের একেবারে টুকরো টুকরো গুঁড়ো গুঁড়ো করে ছেড়ে দেয় গিলেখাদকরা। কিন্তু অনেক জীবানু আছে যাদের শরীরের এইসব টুকরো-টাকরা অংশগুলৈ মানুষের জন্য বিষ হয়ে দাঁড়ায়। সে আরেক মহা বিপদ। শত্রু থাকলে বিপদ, শত্রু বাড়লে বিপদ আবার শত্রু মারলেও তার রক্ত-মাংস বিষ হয়ে মৃত্যুর কারণ হয়। কখনো কখনো জীবানুরা মারা গেলে তাদের শরীরের ভেতরে লুকোনো বিষ বের হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটা হয় টিটেনি'র ক্ষেত্রে। এরা যে বিষ বানায় তা এমনিতে এদের শরীরের ভেতরেই থাকে। তাই এরা বেঁচে থাকলে এদের বিষ থেকে আমরা নিরাপদ। কিন্তু এরা যখনই মরে যায় তখনই এদের শরীর থেকে বিষ বের হয়ে আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সেই বিষ আমাদের স্নায়ুতে গিয়ে তার সংকেত আদান প্রদানে বাধা দেয়। খাপছাড়া সংকেতে তখন আমাদের মাংসপেশীগুলো বিপজ্জনকভাবে বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। দেখা দিতে থাকে ধনুষ্টংকারের লক্ষণ।

    সুতরাং শত্রু মেরেও নিস্তার নেই। বরং তাতে বিপদ বেশি। আবার শত্রু না মারলেও চলে না। শাঁখের করাতের বোধহয় এরচাইতে ভাল উদাহরণ আর হয় না। সে যাই হোক। সবকিছুর পরেও জীবন তো বাঁচাতেই হয়। আর তাই নির্ভর করতে হয় শরীরের প্রহরীদের আরেক ধরণের তেলেসমাতির উপর। এই তেলেসমাতি দেখায় "বি সেল" (আ দনররড়) নামের একধরণের কোষ। এই কোষেরা হচ্ছে জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শরীরের বিশেষ বাহিনি। বি কোষের সারা শরীরে হাতের মতো ছোট ছোট অংশ আছে। এদেরকে বলে এন্টিবডি। এগুলো একেকটা একেক রকমের। এন্টিবডির সবার আগের কাজ হচ্ছে জীবানু, জীবানুর টুকরো অংশ অথবা জীবানুর তৈরি বিষের সংগে জোড়া লেগে যাওয়া। একেক রকম জীবানুর সঙ্গে একেক রকমের এন্টিবডি গিয়ে জোড়া লাগে। এক রকমের এন্টিবডি জোড়া লাগতে পারে কেবল এক রকমের শত্রুর সঙ্গেই। যেমন বি কোষের যদি বড়শির মতো একটা এন্টিবডি থাকে তাহলে সেটা গিয়ে জোড়া লাগে যে জীবানুর মাছের মতো ঠোঁট সেটার সঙ্গে। বি কোষের সাঁড়াশীর মতো কোন এন্টিবডি থাকলে সেটা গিয়ে আঁকড়ে ধরে যে জীবানুর সরু গলা আছে তাকে। পুরো ব্যপারটা নিভর্‌র করে বি কোষের তৈরি এন্টিবডি জীবানুর কোন অংশের সংগে খাপ খায় তার উপর। জীবানু এলে বি কোষেরা জীবানুর সঙ্গে খাপ খায় এরকম এন্টিবডিগুলো ছেড়ে দেয়। মুক্ত এইসব এন্টিবডি তখন জীবানু অথবা জীবানুর বিষের সঙ্গে জোড়া লেগে যায়। জীবানু যদি বেঁচে থাকে তাহলে বি কোষের এইসব এন্টিবডি তাদেরকে মারতে সাহায্য করে। এমনিতে যদি একটা ফ্যাগোসাইট বা গিলেখাদক যদি পাঁচটা জীবানু খায়, জীবানুর সঙ্গে এন্টিবডি জুড়ে থাকলে সে খেতে পারে অন্তত পাঁচশো জীবানু। এর অনেকগুলো কারণ আছে। একটা কারণ হচ্ছে, জীবানুরা সাধারণত যেসব উপায়ে গিলেখাদকদের ফাঁকি দেয় এন্টিবডি জুড়ে থাকলে তারা আর সেইসব উপায়ে ফাঁকি দিতে পারেনা। তারমানে কোন জীবানুর সঙ্গে লড়াই করার এন্টিবডি থাকলে সেই জীবানুর সংখ্যা দুদ্দাড় করে শুন্যের ঘরে নেমে আসে। এন্টবডিরা থাকলে তাই আর ভয় নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জীবানুর সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট এন্টিবডি শরীরে মজুদ থাকে না। বি কোষ সাধারণত শরীরে অনেক কম সংখ্যায় থাকে। অল্পসল্প বি কোষের অল্পসল্প এন্টিবডি জীবানুদের বিশাল বাহিনির সঙ্গে লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারেনা। তবে এরকম সমস্যার সমাধান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যেই থাকে।
    শরীরে কোন জীবানু ঢুকলে বি কোষেরা বিশেষ সংকেত পায়। এই সংকেত দেয়ার জন্যেও শরীরে আলাদা কয়েক ধরণের কোষ থাকে। সংকেত পেয়ে বি কোষেরা বুঝতে পারে কোন ধরণের কোন জীবানু এসেছে আর তাদের সংগে কোন এন্টিবডি খাপ খায়। আর বুঝতে পারা মাত্রই তারা সংখ্যায় বাড়তে শুরু করে। গুটিকয়েক বি কোষ জীবানুর উপস্থিতি টের পেয়ে সংখ্যায় বেড়ে লাখে কোটিতে পরিণত হয়। এজন্য সময় লাগে সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন। সংখ্যায় যথেষ্ট পরিমাণ হওয়ার পর বি কোষের এই বিশাল বাহিনির একাংশ জীবানুর সঙ্গে লড়তে যায়। এদেরকে বলে প্লাজমা সেল বা প্লাজমা কোষ। বি কোষের বাকি অংশ ঞ্ছরিজার্ভ ফোর্সঞ্জ হিসেবে শরীরে থেকে যায়। এদেরকে বলে মেমরি সেল। যেসব বি কোষ জীবানুর সঙ্গে লড়তে যায় তারা লাখে হাজারে এন্টিবডি বানাতে থাকে। আর সেই এন্টিবডি গিয়ে জোড়া লেগে যায় জীবানুর সঙ্গে। গিলেখাদকরাও তখন টপাটপ ধরে মুখে পুরতে থাকে এন্টিবডি জুড়ে থাকা শত্রুদের। ব্যাস যুদ্ধে জয় তখন একরকম নিশ্চিত। কিন্তু যে বিষধর ব্যাক্টেরিয়ার কথা বলছিলাম তাদের ক্ষেত্র ব্যপারটা এত সহজে শেষ হয়না!

    বলেছিলাম, টিটেনির বিষ থাকে তাদের শরীরের ভেতরে। টিটেনিরা তাই শাঁখের করাতের মতো। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আবার তাদেরকে মারলেও বিপদ। মরে গেলেই তাদের শরীরের ভেতরে থাকা ভয়ঙ্কর বিষ ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক যেন এক তীরন্দাজ শত্রু, যে তার ধনুকে তীর নিয়ে ছিলা টানটান করে ধরে আছে। তাকে মারলেই বিপদ। সে মরে গেলেই তার হাত থেকে তীর ছুটে যাবে! এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও মানুষকে বাঁচায় বি কোষেরা। বি কোষেরা জীবানুর বিষের বিরুদ্ধেও এন্টিবডি বানাতে পারে সেকথা আগেই বলেছি। এইসব এন্টিবডি গিয়ে জোড়া লেগে যায় জীবানুর বিষের সঙ্গে। আর তাতেই অকেজো হয়ে যায় জীবানুর বিষ। অনেকটা শত্রুর খোলা তলোয়ারে একটা খাপ পরিয়ে দেয়ার মতো। কিন্তু বিপদ এখানেও শেষ হয়না। কারণ টিটেনিরা শরীরে ঢুকে লুকিয়ে থাকতে পারে। এরকম অবস্থায় সবসময় বি কোষেরা বুঝতে পারেনা যে শরীরে টিটেনিরা আছে। বি কোষেরা যতক্ষণে টিটেনির উপস্থিতি বুঝতে পারে ততক্ষণে হয়তো টিটেনির বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু জীবানু হোক অথবা জীবানুর বিষ, তার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে বি কোষের বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়। বি কোষ সেই প্রস্তুতি নিতে নিতেই টিটেনির বিষে মানুষের স্নায়ুর ভনক ক্ষতি হয়ে যায়। সাধারণত বি কোষের প্রস্তুতি নিয়ে উঠতে উঠতেই মানুষ ধনুষ্টংকারে মারা যায়। এরকম অবস্থা থেকে বাঁচতে শরীরের লড়াকু কোষগুলোর নিজস্ব কোন উপায় জানা নেই। উপায় যেটা আছে সেটা বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার।

    বিজ্ঞানীরা জানেন জীবানুর উপস্থিতি আছে এরকম সংকেত পেলেই তবে বি কোষেরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তারা তাই বিশেষ উপায়ে বি কোষেদের সংকেত দেয়ার পদ্ধতি বের করেছেন। এই সংকেত দেয়ার জন্যেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জীবানুদেরকেই ব্যবহার করা হয়। হয়তো কোন জীবানুকে মেরে ফেলে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। মৃত জীবানু শরীরের কোন ক্ষতি করতে পারেনা কিন্তু বি কোষেরা ঠিকই সংকেত পেয়ে এন্টিবডি বানাতে শুরু করে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শেষ হলে বি কোষেরা আর যুদ্ধ করার মতো জীবানু খুঁজে পায়না। সবগুলো বি কোষই তখন মেমরি সেল হিসেবে শরীরে থেকে যায়। মেমরি সেলেরা প্রস্তুত হয়ে থাকা বি কোষ। শত্রু এলে তাদের আর প্রস্তুতির জন্য সময় লাগেনা। তারা ত্‌ৎক্ষনাৎ লড়াইয়ে নেমে পড়তে পারে। কখনো কখনো মৃত জীবানু দিয়ে বি কোষেদের সংকেত দেয়া যায়না। এমন ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা জীবানুকে একেবারে মেরে না ফেলে আধমরা করে শরীরে ঢুকিয়ে দেন। কখনো কখনো জীবানুদের শরীরের একটা অংশ কেটে নিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই বিষয়টা নির্ভর করে কোন জীবানুর ক্ষেত্রে বি কোষদের কিভাবে সংকেত দেয়া যায় তার উপর। আগে থেকে বি কোষেদের সংকেত দিয়ে প্রস্তুত করে রাখার এই পদ্ধতিকে বলে ভ্যাকসিনেশন। আর যা দিয়ে বি কোষেদের সংকেত দেয়া হয় সেটাকে বলে ভ্যাকসিন। বাংলায় বললে ঞ্ছটিকাঞ্জ।

    টিটেনি শরীরে ঢুকেছে এরকম সন্দেহ হলেই তাই চটজলদি টিকা নিয়ে বি কোষেদের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করে রাখতে হয়। সামান্য একটা কাঁটা ফুটলেও টিটেনি ঢুকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে শরীরে। তাই যেকোন কাটাছেঁড়ায় একটা টিকা নিয়ে রাখাই ভালো। একবার টিকা নিয়ে বি কোষেদের প্রস্তুত করে রাখতে পারলে সেই বি কোষেরাই দীর্ঘদিন শরীরে মেমরি সেল হিসেবে থেকে যায় আর শত্রুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে একবার বি কোষেরা প্রস্তুত হয়ে গেলে সারা জীবনে আর সেই জীবানুর আক্রমনের ভয় থাকে না। বি কোষেরা সারাজীবন সেই জীবানুর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে বি কোষেরা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শরীরে টিকে থাকে। টিটেনির টিকা নিলে বি কোষেরা শরীরে টিকে থাকে সাধারণত ৫ বছর । তাই একবার টিকা নিয়ে ফেললে দীর্ঘদিন নিশ্চিন্ত থাকা যায়। এমনকি বেঁচে যাওয়া যায় ব্লাক মামবার মতো বিষাক্ত সাপের চাইতেও লক্ষ গুণ বিষাক্ত প্রাণির আক্রমণ থেকে।

    টিকা দিয়ে প্রথম মানুষের জীবন বাঁচান লুই পাস্তুর নামক ফ্রান্সের এক মহাপ্রতিভাবান বিজ্ঞানী। বস্তুত সেই প্রথম মানুষ জানতে পারে কলিযুগে মানুষের মাঝেই থাকে ঈশ্বরের ক্ষমতা। মানুষের মাঝে তাঁরাই ঈশ্বর। কলিযুগের ঈশ্বরেরা মানুষকে কেবল একবার বাঁচিয়েই বিদায় নেননা। তাঁরা যে উপায় বলে যান সেই উপায়ে শত ব্‌ৎসর ধরে মানুষের জীবন রক্ষা পায়। কলিযুগের এইসব ঈশ্বরদের একজন ছিলেন লুই পাস্তুরও । মহান এই মানুষটি প্রথম যে বালকটিকে বাঁচান তার নাম জোসেফ মেইস্টার। সে অবশ্য ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত ছিলনা। তার শরীরে ঢুকেছিল জলাতংকের জীবানু। সেসময় জলাতঙ্ক মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। জলাতঙ্ক ব্যাকটেরিয়ার জন্য হয়না। জলাতঙ্ক যার জন্য হয় সে প্রাণি নাকি জড়বস্তু তা নির্ণয় করা মুস্কিল। ব্যাকটেরিয়া বিষ বানাতে পারে, আর এই যে বস্তু অথবা প্রাণিটির কথা বলছি সে নিজেই একধরণের বিষ। এদেরকে বলে ভাইরাস। এদের কাহিনিও দারুণ চমকপ্রদ। সেই গল্পও নাহয় আরেকদিন বলা যাবে।

    ছবি- সুমেরু মুখোপাধ্যায়
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৬৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন