হাজার বছরের পুরানো মহাসুখতত্ত্ব = ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার সমন্বয়।
‘সুখ’ মানব জীবনের পরম কাঙ্ক্ষিত অদৃশ্য একটি বস্তু। সুখপ্রাপ্তির জন্য মানুষ কত কিছুই না করে থাকে। কেউ সম্পদে সুখ পায়, তো কেউ সম্মানে, কেউ মোহে, তো কেউ মদিরায়। আবার সুখ পেয়েও হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক ভোগে। সুখ যেন বালকের ঢিল ছোড়া পুকুরের ঢেউ - উপভোগ করতে না করতেই মিলিয়ে যায়। এই সুখ, স্বল্পসুখ, অতিসুখ, মহা সুখ, অসুখ - এই নিয়ে জগত আর জীবন বয়ে চলেছে অবিরত।
প্রাচীন কাল থেকেই এই সুখের সন্ধানে মানুষ পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে। গৌতম বুদ্ধ সুখের সন্ধানে নিশ্চিত রাজ্যপাট, সুন্দরী স্ত্রী, রাজকীয় বিলাসিতা সব ছেড়ে জঙ্গলে চলে গিয়েছিলেন। তবে যে সুখ আমরা সর্বক্ষণ খুঁজি সে সুখের অণ্বেষণ তিনি করেন নি। তিনি অণ্বেষণ করেছিলেন এক মহাসুখের - যে সুখপ্রাপ্তিতে ইহজগতের সকল দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি লাভ করা যায়। শুধু ব্যক্তি বিশেষ নয়, পৃথিবীর সকল জীব-জগত যাতে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি পায় তার সন্ধান পাওয়ার জন্য তিনি কঠিন সাধনা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছিলেন সেই মহাসুখ প্রাপ্তির পথ। অসংখ্য ভক্তের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। ধীরে ধীরে এক নতুন ধর্মের প্রবর্তন হল। যা বৌদ্ধ ধর্ম নামে সুপরিচিত হল। এই ধর্ম নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ। হাজার বছর আগে রচিত চর্যাগীতিতে বৌদ্ধ ধর্ম-সাধনার কথা রয়েছে গূঢ়ার্থে। চর্যাগীতির রচয়িতারা কেউ প্রত্যক্ষ কবি নন। তাঁরা ছিলেন বৌদ্ধ মহাযানী মতাবলম্বী বজ্রযান সাধক। নিজেদের সহজিয়া সাধনার তান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ধর্মভাবনার কথা গূঢ় সংকেতের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন চর্যার গানগুলিতে। এই ধর্ম সাধনার মূলে রয়েছে মহাসুখতত্ব। বৌদ্ধ ধর্মের গোড়া থেকেই এর কথা বলা হয়েছে, যেমন বলা হয়েছে যাবতীয় তৃষ্ণা নিবৃত্তিই হল নির্বাণ লাভের প্রধান উপায়। সাহজযানীদের মহাসুখ বা সহজানন্দই মহাযানীদের বধিসত্বাবস্থা।
বৌদ্ধ ধর্মতত্বের বিচারে শূন্যতা ও করুনার অভিন্ন অদ্বয় মিলনেই একে লাভ করা যায়। প্রথম দিকে বৌদ্ধ সাধকরা মনে করতেন জীবকে বারবার ভবচক্রে ঘুরে মরতে হয়। এর ফলেই পৃথিবীতে মানুষ জন্ম গ্রহন করে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে। জন্মই দুঃখের মূল। জন্ম হয় অস্তিত্বের কারনে। ভব আছে বলেই অস্তিত্বের সৃষ্টি। এই অস্তিত্ব-চেতনা আসে তৃষ্ণার ফলে। তৃষ্ণা আসে বেদনা থেকে। বেদনা আসে ষড়ায়তন (পঞ্চেন্দ্রিয়+মন) থেকে। ষড়ায়তনের আগমন ঘটে নামরূপ পরিচয়ের ফলে। নামরূপ আসে সংস্কার থেকে। সংস্কার আসে বিজ্ঞান থেকে। বিজ্ঞান আসে অবিদ্যা থেকে। সুতরাং সাধনার দ্বারা অবিদ্যাকে দূর করতে পারলে অর্হৎ-ত্ব (বুদ্ধ প্রদর্শিত পথে নির্বাণ লাভ) লাভ হবে। মহাযানীরা শূন্যতার সঙ্গে করুনার সমন্নয় সাধন করে নিজের মুক্তির সঙ্গে জীব জগতের মুক্তির কথাও ভাবেন। বৌদ্ধ তন্ত্রে স্বীকৃ্তি পেল – ‘শূন্যতা করুনাভিন্নং বধিচিত্তং তদুচ্যতে’। এই বোধিচিত্ত বা মহাসুখ লাভ চর্যায় সহজ সাধকদের একমাত্র লক্ষ্য। যাবতীয় অবিদ্যাকে দূর করে সহজিয়া সাধক প্রজ্ঞাবান হয়ে ‘জগত–প্রপঞ্চকে শূন্য স্বভাব’ বলে যখন অনুভব করেন, তখন তাঁর সংকীর্ণ স্বার্থ-সীমায় বদ্ধ খন্ডিত সত্ত্বার বিলুপ্তি ঘটে। এ যেন সমুদ্রের সুবিশাল জলরাশির মধ্যে ক্ষুদ্র বারিবিন্দুর একিভূত হওয়া। এমত অবস্থায় সাধক জগতের সমস্ত জীবের জন্য করুনাবোধে আপ্লুত হন। চর্যাগীতির অন্তর্নিহিত ধর্ম ও সাধনার তত্ত্ব-কাঠামো বৌদ্ধধর্মের উপর গড়ে উঠলেও তার প্রকৃতি ছিল বিমিশ্র। বুদ্ধের মহাপরিনির্বানের পর তাঁর বানীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিয়ে শিষ্যদের মতপার্থক্য দেখা দেয়। এই মতভেদ দূর করার জন্য শ্রমণ ও ধর্মনেতারা একাধিক ধর্মসংঘের সম্মেলন আহ্বান করেন।
খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতকে বৈশালিতে আহুত দ্বিতীয় ধর্ম সম্মেলনে বিরোধ এত প্রবল হয়ে ওঠে যে বৌ্দ্ধ ধর্ম্-ভাবনা দ্বিধা বিভক্ত হয়। প্রাচীন থেরবাদী সম্প্রদায় হীনযান ও প্রতিবাদীরা মহাযান নামে পরিচিত হয়। ‘যান’ শব্দের অর্থ ‘শকট’ বা বাহন,অর্থাৎ সাধনায় সিদ্ধিলাভের পথ ও পদ্ধতি। হীনযান ও মহাযানের মধ্যে মূলত পার্থক্য হল উভয় ধর্মের সাধনার লক্ষ্য বা ‘আশয়’। হীনযানরা নির্বাণ লাভের উপায় হিসাবে ধ্যা্ন, কঠোর নিয়ম,আচার অনুষ্ঠান ও আচার-পদ্ধতির ‘চর্যা’র মাধ্যমে সংসারে-চক্রে ঘূর্ণমাণ ব্যক্তিগত দুঃখ কষ্টের ‘অস্তিত্ব’কে ‘অনস্তিত্বে’ লুপ্ত করার সাধনা করতেন। শূন্যতার সাধনার এই ধর্মাদর্শ কেবল নিজের মুক্তির জন্য বলে আপেক্ষিক সংকীর্ণতায় এঁরা হীনযানী। অপর দিকে মহাযানীরা ধর্ম সাধনার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উদার। পাল রাজাদের আমলে পূর্ব ভারতে মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে। মহাযানী সাধন পন্থার লক্ষ্য হল, ‘অহৎ-ত্ব’ অর্থাৎ নিজের মুক্তির জন্য নয়, অনস্তিত্বে বা শূন্যতায় বিলুপ্ত হওয়া নয়, বুদ্ধত্ব বা বোধিসত্ত্ব অবস্থা লাভ। নির্বাণ লাভ বলতেও তাঁরা তাই বোঝেন। সেখানে শুধু নিজের মুক্তি নয় সকল জীবের মুক্তি এঁদের কাম্য। যেমন শাক্য মুনি বুদ্ধত্ব লাভের আগে জীবজগতের কল্যানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তেমন মহাযানীরা বুদ্ধত্ব লাভের আগে সেই বোধিসত্ব অবস্থার উপর বিশেষ প্রাধান্য দিতেন। এই মহাযানীরা রূপভেদে বজ্রযান এবং পরে বিভাজিত হয়ে কালচক্রযান ও সাহজযান নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে মহাযানী ধর্মে বৈচিত্র ও রূপান্তর দেখা দিল, সৃষ্টি হল ‘পারমিতা নয়’ ও ‘মন্ত্র নয়’ নামক দুটি পন্থা বা উপায়। উচ্চকোটির দর্শক ভাবনার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে ‘পারমিতা নয়’ সাধারণ মানুষের পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব ছিল না। এই জন্য সর্ব সাধারণের আয়ত্তের কথা ভেবে ধর্মাচার্যেরা মন্ত্র সাধনার বিধান দেয়। ফলত মন্ত্র, মূদ্রামন্ডল ইত্যাদির দ্বারা বোধিসত্ত্ব অবস্থায় উপনীত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এই ভাবে ‘মন্ত্র নয়’ তথা মন্ত্র যানের হাত ধরে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ঘটে, যার নাম ‘বজ্রযান। মন্ত্রমূদ্রা ইত্যাদি ছাড়াও দেবদেবীর পূজা, ধ্যান, আভিচারিক ক্রিয়া কর্ম, তান্ত্রিক যৌনাচার, কায়াসাধনা, বা গুহ্যযোগ সাধনা বজ্রযান সাধনার অন্তর্ভুক্ত হয় । ‘বজ্র’ শব্দের অর্থ শূন্যতা তাই এর অপর নাম শূন্যতা যান। বজ্রযান সাধনায় শূন্যতা, বিজ্ঞান ও মহাসুখকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নির্বিকল্প মহাজ্ঞান নৈরাত্মা দেবী এবং বোধিচিত্ত দেব অনেকটা জীবাত্মার মতো। এই বোধিচিত্ত নৈরাত্মায় লগ্ন হয়ে যখন তার মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন মহাসুখের আনন্দ অনুভূত হয়। ইন্দ্রিয়াশ্রয়ী এই সাধনায় ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তি গুলি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে বোধিচিত্তকে অক্ষয় অজরাময় ও বজ্রের মত কঠিন করে তোলে। বজ্রযান পরবর্তী কালে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। কালচক্রযান ও সহজযান। সাধনার দ্বারা কাল বা সময়ের গতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া কালচক্রযানী সাধকদের কাম্য। সহজযান সম্প্রদায়ের সাধকরা গুরু প্রদর্শিত পথে দেহ সাধনার মধ্যে দিয়ে মহাসুখ লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন। দেহকে এরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা দেহের মধ্যেই সবকিছু ধরে রাখতে চান। বজ্রযানীদের মন্ত্র-তন্ত্র, দেব-দেবীর প্রতীক অবলম্বনে যোগাচার, পূজা, আচার-বিধিকে সহজযানীরা পরিহার করেন। সাধ্য ও সাধনা উভয় ক্ষেত্রেই ‘সহজ’কে উপলব্ধি করতে চান মহাসুখের মগ্ন হবার পন্থায়। চর্যাগীতিতে এই সহজপন্থীদের কথাই বেশি লক্ষ্য করা যায়। যদিও ‘কায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল’ ইত্যাদি গানে কালচক্রযান সাধনার ইঙ্গিত আছে। ড: শশিভূষণ দাশগুপ্ত এই ধর্মের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে জানিয়েছেন, মহাযানী ধর্ম সাধনায় সমাজের সর্বস্তরের পারগামী মানুষের স্থান হয়েছিল বলেইবিচিত্র ধর্ম বিশ্বাস ও সাধন পদ্ধতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল এর মধ্যে। ফল স্বরূপ কালক্রমে মহাযান ধর্মে বৈচিত্র ও রূপান্তর দেখা দিল। কিন্তু বৌদ্ধ সহজযানীদের এই সাধন প্রক্রিয়া খুব জটিল প্রক্রিয়া যা গুহ্য দেহসাধনার উপর নির্ভরশীল। একটু সহজ করে বলা যাক। প্রাচীন কাল থেকেই তন্ত্রসাধনায় কল্পিত হয়েছে মানব শরীরের দুটো নাড়ী। শরীরের বামদিকে যে নাড়ী থাকে তাকে বলে ‘ইড়া’, আর ডানদিকে যে নাড়ী থাকে তাকে বলে ‘পিঙ্গলা’। বৌদ্ধ সাধনায় এই দুটি যথাক্রমে শুন্যতা ও করুনার প্রতীক।
সাধনার মধ্যে দিয়ে সাধকের যাবতীয় উপলব্ধি এই দুই নাড়ীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। সাধককে লক্ষ্য রাখতে হয় যেন দুই নাড়ী দিয়ে উপলব্ধি সমান ভাবে প্রবাহিত হয়। কারণ দুয়ের সমন্নয় প্রয়োজন। উক্ত বামা ও দক্ষিণা নাড়ীর মাঝে সুষুম্না নাড়ীর অবস্থান। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে যার নাম ‘অবধূতিকা’। বাম ও দক্ষিণ নাড়ীর স্বাভাবিক গতি নিম্নাভিমুখি; সাধনার প্রথম ধাপে এই গতিকে রোধ করতে হবে। তারপর সেই গতিকে একীভূত করে অবধূতিকার পথে উর্ধে প্রবাহিত করতে পারলেই সহজানন্দ লাভ হবে। অবধূতিকার পথে সহজানন্দের অনুভূতি দেহের মধ্যে কোথায় কিভাবে হয়, তার জন্য কল্পিত হয়েছে চারটি চক্র বা পদ্ম - (১) নাভিতে নির্বাণ চক্র-প্রথমানন্দের অনুভব (২) হৃদয়ে ধর্ম চক্র - পরমানন্দের অনুভব (৩) কন্ঠে সম্ভোগ চক্র – বিরামানন্দের অনুভব (৪) মস্তিষ্কে উষ্ণীষ চক্র-সহজানন্দের অনুভব। সাধন সম্মতভাবে নাভিমূলে স্থিতা নিম্নাভিমুখী সুপ্ত কুল কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করে মস্তষ্ক উষ্ণীষ চক্রে সহস্রার পদ্মেউপনীত করাই মহাযানী সহজ সাধকের পরম কাম্য। মস্তিষ্কের মহাসুখ চক্রের আবস্থান বলে সেই অনুভুতি স্তরে পৌঁছাতে পারাই হল মহাসুখ লাভ। অপর পক্ষে মহা সুখ লাভের ক্ষেত্রে সহজিয়া সাধকরা দেহের তিনটি প্রধান নাড়ি এবং চারটি চক্র, পদ্ম বা কায়কে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। মহাযানীরা পরিহার করতে বলেছেন বক্রপথ, অর্থাৎ শাস্ত্রপাঠ,জপতপ,ইত্যাদি বাহ্য আচার অনুষ্ঠান। চর্যাগীতিতে বামগা আর দক্ষিণ গা নাড়ীর বিচিত্র সাংকেতিক নাম আছে।
*এ নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করা যাবে।
তথ্য সূত্র -
(1) চর্যাগীতির ভূমিকা -জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী
(2) বৌদ্ধ ধর্ম ও চর্যাগীতি-ড:শশীভূষণ দাশগুপ্ত
(3) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
(4) চর্যাপদ-রমজান আলী সম্পাদিত।
নামরূপ, বিজ্ঞান, অবিদ্যা এই শব্দগুলো যদি একটু বুুুঝিয়ে দেন, ভাল লাগছে