হাজার বছরের পুরানো মহাসুখ তত্ত্ব = ইড়া,পিঙ্গলা ও সুষূম্নার সমন্নয় পর্ব – ২/শেষ পর্ব ।
মহাসুখ লাভের ক্ষেত্রে সহজিয়ারা যেমন দেহের তিনটি নাড়ী এবং চারটি চক্র, পদ্ম বা কায়কে গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি পরিহার করতে বলেছেন বক্রপথ, অর্থাৎ শাস্ত্রপাঠ, জপতপ, বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদি। চর্যাগীতির বামা ও দক্ষিনা নাড়ীদ্বয়কে বিচিত্র নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- বামগা নাড়ী । দক্ষিণগা নাড়ী নিবৃত্তি প্রবৃত্তি বজ্র পদ্ম আলি কালি গঙ্গা যমুনা চন্দ্র সূর্য ললনা রসনা ধমন চমন শুন্যতা করুনা (উপায় স্বরূপ) (প্রজ্ঞা রূপিনী) অর্থাৎ বামগা নাড়ী যেখানে চিহ্নিত 'নিবৃত্তি', 'বজ্র', 'আলি','গঙ্গা', 'চন্দ্র', 'ললনা','ধমন', 'প্রজ্ঞা রূপিনী শূন্যতা' এবং সেখানে দক্ষিণগা নাড়ী চিহ্নিত যথাক্রমে 'প্রবৃত্তি', 'পদ্ম', 'কালি', 'যমুনা', 'সূর্য', 'রসনা', 'চমন', 'উপায় স্বরূপ করুনা'। উপরি উক্ত এই দুই নাড়ীর মিলিত রূপ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের পরম কাম্য। কেননা অদ্বয়রূপিণী অবধূতিকার (মধ্যগা নাড়ী) মাধ্যমেই সহজানন্দের মহাসুখ পাওয়া যায়। চর্যায় সিদ্ধ সাধক কবিদের মতে মহাসুখের গভীর অনুভব অনির্বচনীয়। তাড়ক পা বলেছেন - ‘বাক পথাতীত কাঁহি বখানী’ (৩৭ সংখ্যক পদ), অর্থাৎ সাধকের অনুভবে সহজ মহাসুখ ব্যাখ্যার অতীত। তাঁদের মতে, সহজানন্দ হল ‘অনুত্তর’ (যার পর নাই) বলেই তা নিরুত্তর। সহজ সাধকদের এই মহাসুখানুভূতি এক তুরীয় অনুভূতি। মহাযান সম্প্রদায়ের সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকেরা গুরু প্রদর্শিত পথকে গুরুত্ব দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই দেহ সাধনা বা কায়াসাধনা যোগ ভারতবর্ষের চিরায়ত ধর্ম পরম্পরায় লক্ষ্য করা যায়। উপনিষদের ‘ভান্ডে ব্রহ্মান্ড’ থেকে শুরু করে সহজিয়া বৈষ্ণবদের সাধনায় ‘যা আছে ভান্ডে তাই আছে ব্রহ্মান্ডে’, এমন কি বাউলদের দেহতত্ত্ব সাধনার গানেও এই বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। সাধনার ক্ষেত্রে কঠিন পথ অবলম্বন না করে সহজ উপায়ে নিজের দেহের মধ্যেই মহাসুখ অণ্বেষণ করেছেন চর্যার সাধক কবিরা। দেহের সহজ স্বরূপে সহজানন্দের সন্ধান করেছেন তাঁরা। ‘সহজ’ শব্দটি তাদের কাছে একটি ইতিবাচক শব্দ বা প্রত্যয়। ‘সহজ’ শব্দটির দ্বারা সাধারনত আমরা বুঝি সরল (easy), অথবা সহ জাত (in born)। কিন্তু চর্যাপদের সহজযানী সাধকেরা ‘সহজ’ কথাটিকে আরো গূঢ়ার্থে গ্রহন করেছেন বলে অনেকের ধারণা। তাঁদের কাছে ‘স’ আর ‘হ’ এর যোগফল বা যুগ্ম স্বরূপ হল ‘সহজ’। সেখানে ‘স’ অর্থে প্রজ্ঞা বা শুন্যতা, এবং ‘হ’ অর্থে উপায় বা করুণা, আর ‘জ’ অর্থে যোগফল। সহজিয়া সিদ্ধ সাধকদের কাছে প্রথমটি স্ত্রী স্বভাব বিশিষ্ট তত্ব অর্থাৎ নৈ্রাত্মাদেবী, দ্বিতীয়টি পুরুষ ভাবযুক্ত তত্ত্ব অর্থাৎ বজ্রচিত্ত। আর এই ‘স’ এবং ‘হ’ এর মিলিত অবস্থাকে বলেছেন ‘সহজ’ অবস্থা। সহজানন্দ লাভের জন্য সহজযানী সাধকেরা ‘সহ জ’ অর্থাৎ জন্মের সহিত জাত দেহকেই আশ্রয় করে থাকেন। মন্ত্র, ধ্যান, জপ, তপ ,পূজা, অর্চনা, আগম -বেদ-পুরান প্রভৃতি শাস্ত্রপাঠের বাঁকা পথ তাঁরা পরিহার করেন এবং করতে বলেন। প্রচীন সাধক ও গীতিকার লুই পা ধ্যান ও সমাধির অসারত্বের কথা বলেছেন - “সঅল সমাহিঅ কাহি করি অই। সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরি অই।” অর্থাৎ সমাধির দ্বারা কী হবে? তাতেও সুখ দুঃখ ভোগ করতে হবে এবং তাতেও মৃত্যু নিশ্চিত। লুই পা - এর শিষ্য দারিক পা ৩৪ নম্বর গানে একই কথা বলেছিলেন বিস্তারিতভাবে – “কিন্তো মন্তে কিন্তো তন্তে কিন্তোরে ঝাণ বখানে। অপইঠান মহাসুহলীলে দুনখ পরম নিবাণে।” অর্থাৎ মন্ত্র তন্ত্রে কী হবে,কী হবে ধ্যানের ব্যাখ্যা করে? যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা বর্জন করে মহাসুখে লীন হয়ে পরমনির্বাণ উপলব্ধি করো। কাহ্ন পা ৪০ নম্বর গানে ‘আগম পথী ইষ্ট মালাকে’ জঞ্জাল বলেছেন। কারণ এগুলি দৃষ্টি গোচর। চর্যার সিদ্ধাচার্যেরা আচারসর্বস্ব বেদ ধর্মের দুর্বলতার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন ২৯ নম্বর গানে - “জাহের বাণচিহ্ন রূবণ জানি। সো কইসে আগম বেএ বখানী।” এ থেকে অবশ্য মনে হতে পারে চর্যাগীতির সাধক কবিরা পরধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু। কিন্তু তা নয়, বরং অন্য ধর্মের তুলনামূলক প্রসঙ্গ এনে নিজেদের সাধনাকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। লুই পা র একটি পদে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। চর্যাগীতি অনুযায়ী এই ‘সহজ মহাসুখ’ মনগোচর কোনও জিনিস নয়, কায়, বাক, চিত্ত দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। সুতরাং যে তত্ব্ বুদ্ধির অগম্য, যে উপলব্ধির স্বরূপ অন্যকে বোঝানো সম্ভব নয়, আগম বেদ ইত্যাদি শাস্ত্র গ্রন্থের দ্বারা তার ব্যাখ্যা কিভাবে সম্ভব? সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দেয়েছেন কবি লুই - “উদকচান্দ জিম সাচন মিচ্ছা”। জলে ওপর চাঁদের প্রতিবিম্বের মত সহজ মহাসুখ সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়,এতে তার অস্তিত্বও প্রতিপন্ন হয় আবার নাস্তিত্বও প্রতিপন্ন হয়, তাই এ তত্ত্ব ভাবাভাবের অতীত।
চর্যার সাধন মার্গে গুরুর অপরিহার্য ভূমিকা বিশেষ ভাবে স্বীকৃত হয়েছে। সহজ সাধকরা একমাত্র তাঁদের গুরুর নির্দেশ মেনে চলতেন। লুই পাদের মত প্রবীণ সিদ্ধ আচার্য বলছেন, ‘গুরু পুচ্ছিঅ জান’। তাঁদের গুরুদের সদগুরু বলা হত। ৮ নম্বর গানে কম্বলাম্বর পাদ বা কামলি পা বলেছেন - ‘বাহতু কামলি সদ্গুরু পুচ্ছি’। সাধনার পথে সবদিক থেকে সদগুরুকে হতে হবে ‘অনুত্তর স্বামী’। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সহজ সাধনার পথ যেহেতু একটা অভ্যাস প্রকর্ষ, সেহেতু তা শিক্ষা করতে হয় গুরুর বচনের মাধ্যমে। এসম্পর্কে আরও বলা আছে, চর্যার সহজ সুখের উপলব্ধি ‘স্বয়ং বেদ্য’ এবং তা ‘কহিম্পি ণ জাই’, অর্থাৎ ভাষায় ব্যাক্ত করা যায় না, তা নিজেকে অনুভব করতে হই। এখানে গুরু ‘সহজ’ লাভের উপায় মাত্র। তিনি কখনই উপদেশ নির্দেশের দ্বারা সহজানন্দের উপলব্ধি শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারেন না। গুরুর উপদেশে শিষ্য কেবল সঠিক পথে চালিত হয়। ব্যাখ্যার অতীত অনির্বচনীয় বিষয় গুরু যাতে বেশি বাগাড়ম্বর না করেন এবং যথার্থ শিষ্য যাতে না শোনেন সেজন্য ৪০ নম্বর গানে সাধক কাহ্ন পা গুরু শিষ্যের কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছেন - “ আলে গুরু উএসই সীস। বাকপথাতীত কাহিব কীস।। জে তই বোলী তে ত বিটাল। গুরু বোব সে সীসা কাল”। অর্থাৎ গুরু শিষ্যকে বৃথাই উপদেশ দান করে, যা বাক্যপথের অতীত তা কিভাবে বলা সম্ভব! সুতরাং যত বলবে ততই ভুল হবে। কেননা সহজ সাধনায় গুরু বোবা আর শিষ্য কালা।
চর্যায় সাধ্য ও সাধন এর কথা বলা আছে, আচরনীয় ও অনাচরনীয়ের কথাও বলা আছে, কিন্তু সাধনার পদ্ধতি বিষয়ে তেমন কিছু বলা নেই। তবে এই ‘সহজ মহাসুখ’ প্রাপ্তির পদ্ধতি যে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব কালের পদ্ধতির তুলনায় পৃথক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বৌদ্ধধর্মের মহাযানী ধর্ম সম্প্রদায় পরে বজ্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদি উপবিভাগে বিভক্ত হয়েছিল, তাঁদের ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে মতবাদের পার্থক্য থাকলেও নির্বাণ সম্পর্কে সকলে একমত ছিলেন। সহজিয়া ধর্মসাধনার অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু এবং ভাগ্যচক্রে সংঘটিত পুনর্জন্মের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে নির্বাণ লাভ করা। যাঁরা দীক্ষিত সহজিয়া সাধক তাঁরা কতগুলি তান্ত্রিক আচার-আচরণের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন বলে বিশ্বাস করতেন। এই সাধনতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বৌদ্ধগান ও দোহাগুলি রচিত। তাই চর্যাগীতি প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের পদসংকলন। এখানে সহজযানভিত্তিক তান্ত্রিক যোগসাধনার কথাই ব্যক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ সহজিয়া সিদ্ধাচার্যগণের মতবাদ ব্যাখ্যা করলে যা পাওয়া যায় তা হল, জীবনের যাবতীয় তৃষ্ণা, আসক্তি ত্যাগ করে চিত্তকে শূন্যতাবোধে স্থাপন করে শুদ্ধ করতে হয় এবং করুণার সংস্পর্শে এসে চিত্তের নির্বাণ লাভ সম্ভব হয়, তাতে পরিতৃপ্তি আসে এবং পরিতৃপ্ত নির্বাণের মাধ্যমে মহাসুখ লাভ হয়। এই মহাসুখই হল জীবের মূল লক্ষ্য এবং তাতেই সহজানন্দ অর্থাৎ সহজ স্বরূপকে উপলব্ধির এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ লাভ হয়। চর্যাগীতির রচয়িতাগণ বেশির ভাগই কামরূপ বাংলা, ওড়িষ্যা, বিহারের বাসিন্দা ছিলেন, সেই কারণে তাঁদের রচনায় সরলার্থে এই অঞ্চলের সমাজচিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি এই সহজিয়া ধর্মের প্রভাবে এই অঞ্চলের মানুষ প্রভাবিত হয়েছে । পরবর্তীতে বাংলার বৈষ্ণব ধর্মে ও বাউল সম্প্রদায়ের সাধনায় ও গানে এই সহজিয়া ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।
তথ্য সূত্র –
(১) চর্যাগীতির ভূমিকা-জাহ্নবীকুমার চক্রবরতি
(২) বৌদ্ধ ধর্ম ও চর্যাগীতি – শশীভূষণ দাশগুপ্ত
(৩) বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়
(৪) চর্যাগীতি – রমজান আলী সম্পাদিত