এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  সমাজ

  • নারীবাদী সাহিত্য - সংঘাত ও প্রণয় : জয়িতা ভট্টাচার্য

    Jayeeta Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সমাজ | ২৫ নভেম্বর ২০২২ | ১৫২১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বাংলা কবিতার রত্নভাণ্ডারের  কবিদের নাম যদি পাঠককে  জিজ্ঞেস করা হয় এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হবে রবীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ, মাইকেল মধুসূদন, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ এবং অবশ্যই বুদ্ধদেব বসু। দশক ফেরের তালিকায় লক্ষ্য করে দেখুন নেই কোনো মহিলা কবির নাম।

    অথচ কতজন পাঠক জানেন, কতজন পাঠক বই পাবেন প্রায় একই সময়ের কতিপয় মহীয়সী মহিলা কবির নাম।

    প্রায় বিস্মৃত আজ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক হানা ক্যাথারিন মলেন্সের "ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত" (১৮৫২), আমরা ভুলে যাই ১৮৭৬ এ লেখা কবি, ঔপন্যাসিক ও বিজ্ঞান প্রবন্ধকার স্বর্ণকুমারী দেবীর কথা, আমরা জানি না ত্রিপুরার কবিও লেখক ফয়জুন্নেসার একমাত্র প্রকাশিত উপন্যাসের কথা।

    তাঁরা সকলেই পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য সমাজে উপেক্ষিত থেকে গেছেন।

    কিছুটা এর মধ্যে প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মাহমুদ খাতুন সিদ্দিকার কাব্যগ্রন্থ "পসারিণী" সম্পর্কেও এমনকি অক্ষরকর্মীরা ওয়াকিবহাল নয়। হয়ত এই পুরুষশাসিত সাহিত্য অঙ্গনে তাই কবি কামিনী রায়ের পর দীর্ঘ নিরুদ্দেশে নারী কবি।

    একেবারে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে ধীরে ধীরে প্রচারের আলোয় উঠে আসেন সেলিনা হোসেন, মহাশ্বেতার দেবী।

    আধুনিক কালে প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় আমরা কেবল জানি পাদপ্রদীপের আলোয় আসা মহাশ্বেতার দেবী, কবিতা সিংহ, দেবারতি মিত্র, মল্লিকা সেনগুপ্ত অথবা তসলিমা নাসরিনের নাম।

    দুর্ভাগ্য, সাহিত্য সমাজে এখনও কবি বলতে পুরুষ কবিদের নামই মনে আসে প্রথমে। পাঁচশ কবির নাম বলতে গেলে পাঠক চারশ পঁচানব্বুই জন পুরুষ কবির নাম বলবেন আর গুটি কয়েক নারী কবির নাম শেষ পাতে চাটনি।

    এমনকি শূন্য দশকেও আড়ালে থেকে যান জেলার কবিনী গীতা কর্মকার, নীলিমা সাহা, রিনা কংসবণিকের নামও।

    ফেসবুকের আলোয় প্রধানত দেখা যায় নাগরিক ও গোষ্ঠীপ্রিয় নারী কবিদের কবিতা।

    ব্যাপারটি নারী শব্দকর্মী হিসেবে নিরাশাজনক তো বটেই। মনে রাখতে হবে সিরিয়াস সাহিত্যের আঙিনায় পা রাখার সুযোগ ও অনুমতি পেয়েছেন নারীরা অনেকদিন পরে।

    অথচ বৈদিক যুগের গায়ত্রী, পারমিতা, গার্গী প্রভৃতি পণ্ডিতের নাম পাই। পরে খনা র নাম তো আমরা সকলেই জানি। এরপর ধীরে ধীরে নারীর লেখনী চলে গেল আড়ালে। লোকায়ত সাহিত্যের উঠোনে নারীর সাক্ষর নেই।

    উপমহাদেশের প্রথম কবিনী চন্দ্রাবতী-র রামায়ণ অনেকদিন পর্যন্ত স্বীকৃত নয় যেহেতু তিনি নারী হয়েও তীব্র। তাঁর রামায়ণে রামের চেয়ে গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য পেয়েছে সীতা। সামাজিকভাবে এই নিঃশব্দ প্রতিবাদ বোধহয় প্রথম।

    রামি-র কবিতাও কৃষ্ণ ভজনা। অনেকদিন পর্যন্ত মহিলা কবিদের কলম ছিল প্রেমহীন, বীরত্বহীন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবিহীন।

    বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাসে কিন্তু নারীর কলম সেভাবে কখনও সরব নয়।

    পৃথিবীর প্রথম নারী কবি গ্রিসের স্যাফো, ৬৩০ - ৫৭০ খৃষ্টপূর্ব মূলত গীতি কবিতা লিখেছেন। এবং, স্যাফো কবিতা বা গীতিকা অধিকাংশ প্রণয় ও জৈবিক কামনার কথা বলে এমনকি দুই নারীর মধ্যে প্রেমের কথাও। যার থেকে স্যাফিক বা লেসবিয়ান শব্দটির উৎপত্তি।

    মধ্যযুগের পর থেকেই সম্ভবত নারী শামুকের খোলোসে ঢুকে লুকিয়ে রাখল আগুন। শুরু সামন্ততান্ত্রিক পুরুষশাসিত সমাজের।

    অনেকেই কবিতা লিখেছেন পুরুষ নামে, অনেকে লুকিয়ে চুরিয়ে।

    বাংলাদেশের  কবি নারীরাও লিখেছেন আধুনিক কাল অবধি বিচ্ছিন্ন ভাবে। তাঁদের দাবিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    অনেক নারী লিখেছেন সন্ত্রস্ত হয়ে সমাজের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে।

    পরবর্তীতে উঠে এসেছেন স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী কালে অনেকে। ক্রমশ সংখ্যাটা বৃদ্ধি পেলেও, এমনকি তাঁদের কবিতাও পুরুষ কবির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না উৎকর্ষে ও বীরত্বে। সুপ্রাচীনকাল থেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যাবতীয় অবদমন ও নিয়মের শৃঙ্খল তাকে করে তুলেছে আরষ্ট। যদি বা নারী কবিদের দেখা পাওয়া যায় প্রাচীন সময়ে সেসব রচনা ইস্টদেবতার উদ্দেশ্যে বা প্রকৃতি বিষয়ক নেহাত মাঝারি মানের কবিতা। দশকের পর দশক এভাবেই কেটেছে। নারীর কবিতায় মানবী প্রেম থাকা যেন গুনাহ্।

    একমাত্র ব্যতিক্রম পাঁচের দশকের কবিতা সিংহ। তিনি একমাত্র বিরল কবি যিনি লিঙ্গ  নিরপেক্ষ সামাজিক ও রাজনীতি সচেতন কবিতা ও উপন্যাস  লিখেছেন। লিখেছেন বীরত্বের কবিতা  মেয়েদের সৃজনশীলতার ওপর প্রতিবাদের কবিতা সমস্ত ট্যাবুর বিরুদ্ধে। তিনি ক্রোধী কবিতা লিখেছেন। এই ক্রোধ তাঁর শৈশব থেকে বৈষম্যের মধ্যে পালিত হওয়া বঞ্চনার ও অপমানের প্রতিবাদের ভাষা যা শব্দে প্রকাশ করেছেন।

    নারীর লেখা উচ্চমানের সামাজিক বা রাজনৈতিক কবিতা খুব কম। হালে মল্লিকা সেনগুপ্ত বা তসলিমা সরব প্রতিবাদে পুরুষতান্ত্রিকতার।

    মায়া এঞ্জেলুর মত কতিপয় কবিরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজকে চ্যালেঞ্জ করে সরাসরি তীব্র প্রণয় কবিতা লিখেছেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন।

    আমাদের বিষয় প্রণয়মূলক উৎকর্ষ কবিতা। এটা ঘটনা, সত্যি বলতে কী মনে রাখার মত নেই বিশেষ বাংলায়। এই প্রসঙ্গ আমাকে ভাবিয়ে তোলে শূন্য দশকে যখন পেছন পানে চাই।

    বিদেশি কবিতার ক্ষেত্রেও নারী কবির কবিতা বেশিরভাগ স্বীকারোক্তি মূলক বা কনফেশনাল পোয়েট্রি। সিলভিয়া প্লাথ যেমন। রয়েছে প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা কিন্তু প্রেম নেই সরাসরি আছে নামহীন সামগ্রিক প্রেমের কবিতা।

    ধরা যাক একটি সাধারন প্রশ্ন। 

    আমরা আজ অবধি পাইনি কোনো পুরুষ " বনলতা সেন" অর্থাৎ নারী কবির সৃষ্ট কোনো স্বপ্নের পুরুষ যার সঙ্গে পাঠক একাত্ম বোধ করতে পারে। একজন নারী মনে মনে তার  প্রিয় পুরুষের জায়গায় যাকে বসাতে পারে। নেই। অনেক ঘেঁটেও পাইনি নারীর কবিতায় তেমন কোনো কল্প প্রেমিক। যেমনটি আমরা পেয়েছি প্রকৃতি ও নারী একাকার হয়ে যাওয়া বনলতা সেন,
    যেমনটি এক শিল্পিত নারী "নীরা", যেমনটি মলয় রায় চৌধুরীর কল্পনায় রক্ত মাংসের বাস্তব নারী "অবন্তিকা"। তেমনটি নেই কোনো পুরুষ মহিলা কলমে।

    তবে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে নারী কবিরা খুব আনরোমান্টিক? নারী কবি যাঁরা জনপ্রিয় হয়েছেন আমরা দেখি তাঁরা নয় পুরুষের সুরক্ষিত বলয়ের মধ্যে বসে লিখেছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা অথবা বঞ্চনার কথা যন্ত্রণার কথা। আছে যদিও বা প্রেমের কবিতা  সেগুলি সামগ্রিকভাবে 'প্রেম' বিষয়ক, একটি বিশেষ পুরুষ  আকার দিতে অপরাগ যেন।

    চর্যাপদের কুক্কুরিপাদ (যদি তিনি মহিলা ধরে নি) থেকে শুরু করে চন্দ্রাবতী, ঠাকুরবাড়ির প্রগতিশীলা স্বর্ণকুমারী দেবী বা তসলিমা কেউ আঁকেন নি কোনো বিশেষ পুরুষ। প্রাচীন যুগ হতে প্রণয়মূলক কাব্য সাধারনত ধর্মীয় চরিত্রের। খোলা তলোয়ার কবিতা সিংহ, দেবারতি মিত্র বা মল্লিকা সেনগুপ্ত প্রতিবাদে মুখর যতটা প্রেমের ব্যাপারে ততটাই উদাস যেন।

    কবিতা সিংহ সমাজের নগ্ন রূপ তুলে ধরেছেন,

    "আমিই সেই মেয়েটি সেই মেয়েটি
    যে জন্ম থেকেই বিবাহের
    জন্য বলি প্রদত্ত
    যার বাইরের চেহারা
    চোখ-নাক-মুখ-ত্বক-চুল-রং
    নিয়েই দর কষাকষি
    কাল না ফর্সা
    খাদা না টিকালো
    লম্বা না বেঁটে
    খুতখুতে না টানা টানা
    যার মাথার বাইরেটা নিয়েই সকলের ভাবনা
    মাথার ভেতরটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই"
    (আমি সেই মেয়ে)

    ১৮৬৭ সালে বাংলা উপন্যাস লেখা হয় "মনোত্তমা" কিন্তু  লেখিকার নাম গোপন, শুধু লেখা থাকে "হিন্দুকুল-কামিনী-প্রণীত"।

    চিত্রটা খুব ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে তবু পাল্টায় না।

    ১৯৭৯ সালে প্রথম হিন্দি ভাষার লেখিকা মহাদেবী বর্মাকে বলা হয়ে থাকে। তিনি নিও-রোমান্টিসিজম বা ছায়াবাদী কবিতা সূচনা করেন তাঁর লেখায় মহিলা হিসেবে। অর্থাৎ নারী লেখিকা মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছেন অনেক বিলম্বে ও বিলম্বিত লয়ে। এই পরিস্থিতিতে পুরুষ নিয়ে কবিতা লেখার সাধ পূরণ হয় নি কখনও।

    আরেকটি সমস্যা হলো নারীর কবিতাকে পাঠকের তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে  মিলিয়ে দেখার প্রবণতা। শূন্য দশকে হালে কিছু নারী কবি প্রতিবাদের নয়া সড়ক হিসেবে উগ্র যৌনতামূলক কবিতা লিখছেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা উৎকর্ষে পাশ করে নি। আর প্রেমিক পুরুষের বর্ণনা আর যৌনতা দুটি ভিন্ন অবশ্যই। 

    কেন এত সতর্ক কেন সাবধানী হতে হয় কবিকে। কেন এই সীমাবদ্ধতা।

    ব্যক্তিগত জীবনে নারী কবিরা যতই জমজমাট হোন লেখার সময় কেবলই পুরুষের বিরুদ্ধে নালিশ আর অসহায়তার কথা কেন?

    হয়ত সহানুভূতি উৎসারিত জনপ্রিয়তা তাঁদের সন্তুষ্ট রেখেছে অথবা ... এই দ্বিতীয় কারণটি  নিয়ে সন্দেহ জাগে তার মানে কি নারী সাহিত্য এখনও vulnerable?

    এর উত্তর খুঁজতে গেলে আরো একটু খনন প্রয়োজন।

    একটু পেছিয়ে যাওয়া যাক।

    মেরি এলমান তার ‘থিংকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা (১৯৬৮)’ গ্রন্থে যাকে অভিহিত করেছেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা ‘শৈশ্নিক সমালোচনা’ হিসেবে। তাঁর মতে পুরুষ সমালোচকের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্রী; ওই বই সমালোচনার নামে তারা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব।

    বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস বলছে, তীব্র পুরুষতান্ত্রিক সব তত্বকথা যেখানে নারীর স্থান অতি হীনভাবে প্রকট।

    পুরুষতান্ত্রিকতার চোখরাঙানি ফেমিনিস্ট সাহিত্যকে বহু কাল দমিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর কয়েকজন স্মরণীয় পুরুষ সাহিত্যিকের কথায় যা স্পষ্ট। শেক্সপিয়ার মনে করেছেন "নৈতিক বিচ্যুতির নামই নারী"। রুশো বলছেন "নারী অশুভ দরকারি"। হেগেল বলেছিলেন,"নারীর ঘিলু দশ আউন্স কম"। দেরিদা কলমকে শিশ্নের সাথে আর যোনিচ্ছদকে কাগজের সাথে অভিন্ন করে দেখেছেন। কলম-শিশ্ন লিখে চলে কুমারী পৃষ্ঠার ওপর, এ বোধের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এ বোধ অনুসারে লেখক পুরুষ ও প্রধান : নারী তার অক্রিয় সৃষ্টি।

    যেমন, শেক্সপিয়রের ওথেলো দেসদিমোনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে : এই শুভ্র কাগজ, এই উৎকৃষ্টতম বইটি কি তৈরি হয়েছিল এতে ‘বেশ্যা’ লেখার জন্য?

    নিৎসে তো স্পষ্টতই বলেছেন, "নারী বন্ধুর উপযুক্ত নয়। তারা এখনও বিড়াল কিংবা পাখি কিংবা খুব বেশি গাভী। পুরুষ নেবে যুদ্ধের প্রস্তুতি আর নারী হবে যোদ্ধাদের প্রমোদ সামগ্রী "।এমনকি তিনি এও বলেছেন, "যদি মেয়েদের কাছে যাও চাবুক নিতে ভুলো না"।

    খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাই নারীবাদ ও ফেমিনিস্ট লিটারেচার সাহিত্য ইতিহাসের এক বিপ্লবের সূচনা।

    এমনকি রবীন্দ্রনাথও নারীকে দুর্জ্ঞেয় করে তুলেছেন, "অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা"। অথবা আহমেদ ছফার কথায় "নারী হইল রহস্যের আধার"।

    এর তীব্র বিরোধিতা করে উলফেনস্টাইন বলেছেন "নারীও একটি প্রাণীর মত মলত্যাগ করে, যৌনকর্মে লিপ্ত হয়"।

    ১৯২১ থেকে ১৯৬৯ যদি একটি ট্রানসিশনাল সময় হয়, এর অন্তর্বর্তী সময়ে সিমন দ্য ব্যোভরের "The Second Sex" লিখেছেন যখন এমনকি গর্ভপাত নিষিদ্ধ ইয়ুরোপে। যেমন আমেরিকার বেটি ফ্রিডানের "Feminine Mistake" (১৯৬৩), এই দুজনকে ইউরোপ ও আমেরিকার নারীবাদী আন্দোলনের পুরোধা বলা যায়।

    বাংলা সাহিত্যে সেভাবে একমাত্র কবিতা সিংহ ছাড়া সাহসী কলম নেই এই সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশের বিরুদ্ধে। বুদ্ধদেব বসু তাই নারীকে অনায়াসেই "মনোহীনা" বলেন। মলয় রায়চৌধুরী আরো প্রাসঙ্গিক ভাবনা উস্কে দিলেন। এখানে পুরুষ লেখকরা মনে করেন, নারী লেখে না, লিখিত হয়, নারী কবিতাকল্পনালতা; নারী আঁকে না, অঙ্কিত হয়; নারী ভাস্কর হয় না, ভাস্কর্য হয়। নারীর লেখা বড়জোর গর্ভনিসৃত অশুদ্ধ রক্তধারা অথবা এক তুলতুলে, নরোম গর্ভফুল, যেন নারী লিখে মস্তিষ্ক দিয়ে নয়, গর্ভ দিয়ে! যেন তার শিল্পসৃষ্টির কারখানা তার জরায়ু।

    এই চিত্র যে খুব পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। সমাজের দৃষ্টি  আজও কলমে বৈষম্য করে স্পষ্টভাবে। হয়ত এটাও একটা কারণ নারী সাহিত্য ও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে এখনও পাঠক একাত্ম করে ফেলেন। এই কারণে সমাজমাধ্যমেও এই প্রতিচ্ছবি দেখি নারী লেখিকার যৌন সম্পর্কের গল্প বা কবিতায় ভ্রুকুটি।

    একজন পুরুষ  লেখক অনায়াসেই যখন নীরার নাভি বা যোনির কথা লিখতে পারেন পাঠক তাকে কবিতা হিসেবেই পাঠ করে চমৎকৃত হন কিন্তু নবনীতা দেবসেন তাঁর রচনায় খোলাখুলি লেখেন এমনকি "অনুপম" উপন্যাসটি লেখার সময়ও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে মেলাতে চেয়েছে পাঠক। একজন পুং চরিত্রের সঙ্গে বিবাহোত্তর প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমের গল্প লিখতে গিয়ে তাঁকে তাঁর মা ও মেয়ের নিষেধ শুনতে হয়।

    আমি যখন "অনুপম" সিরিজের কবিতা লিখি এক পুনরাধুনিক কবি মেসেঞ্জারে এসে বারণ করে ও শেষে ব্লক করে। যদি সৃজনশীল মানুষের মনন এত সীমাবদ্ধ হয় স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ
    পাঠক তার ব্যতিক্রম  হয় না। সামাজিক সম্মান ও নিন্দের ভয়ে ইচ্ছে থাকলেও তাই নারী কবিদের বহু সময় কম্প্রোমাইজ করতে হয়।

    নারী কবির সামনে কেউ চায়ের কাপ এনে দেয় না। বেড়ে দেয় না খাবার যত্ন করে। অর্থাৎ ভাবনার যে নিরিবিলি পরিসর প্রয়োজন তা তাঁরা আজও  পান না। তাই তাঁদের লেখা এখনও  সম্পূর্ণ হয় নি যা থেকে নিরপেক্ষ মান বিচার করা যায়।

    "বাবা লিখছে বিরক্ত করো না, শব্দ নয়", তাঁর চাই নির্জনতা, চাই কয়েক পেগ মদ্য, সাঁওতাল রমণী থেকে শহরের এলিট পিঠ কাটা ব্লাউজের নারীর ফর্সা বুক।

    নারী কবি ঘাম মুখে রান্নাঘরে শব্দ সাজায়, সন্তান পালন করতে করতে ছন্দ খোঁজে, সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে। অতএব সময় বহিয়া যায়, কবি তার ফাঁকে কিছু কিছু লিখে রাখে, সম্পাদকের নজর পড়লে কিছু নাম হয়। তবু সাহিত্য পুরস্কার কচ্চিৎ জোটে ভাগ্যে তাঁর।

    কল্পনার ভেলা ভাসিয়ে গভীরতর উপলব্ধির পথে যেতে তার শতেক বাধা। সমাজের নানা ফিসফাস চলতেই থাকে।

    পুরুষ কবির সঙ্গে দশ পা হাঁটলে শুরু হয় গসিপ। ভালো লিখলে বড় সাফল্য পেলে, "নিশ্চয়ই অমুকের ইয়ে, তাই" এইসব তো জলভাত। মূলত দেশীয় কৃষ্টি এটি।

    কয়েক দশক আগেও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে যখন নারীবাদী আন্দোলন সক্রিয় হতে শুরু করেছে দেগে দেওয়া ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি কিন্তু পিছিয়ে ছিলো না। ১৮৯৯ সালে মিশরের আইনজীবী ক্কাসিম আমিনের "তাহরির-আল-মার" (Women's Liberation) বইটি উল্লেখযোগ্য। ১৯২৩ সালে হোজা শরোভি "ইজিপশিয়ান ফেমিনিস্ট ইউনিয়ন" গঠন করেন।
    ১৯৫৬ সালে প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল গামের "রাষ্ট্রীয় নারীবাদ" প্রবর্তন  করেন। এভাবে ক্রমশ বিশ্বময় নারীবাদ তথা নারীর কলম শানিত হয়েছে। আমরা পিছিয়ে আছি হয়ত অনুকরণপ্রিয়তার জন্য।

    কবিতা উপন্যাসের প্রেমিক এখনও সৃষ্টির অপেক্ষায়।

    সুতপা সেনগুপ্তরর লেখা শ্যামরায়ের প্রেমের কবিতা সম্পর্কে জেনেছি শ্রদ্ধেয় Debjani Basu দির থেকে, এরকম কিছু কিছু প্রয়াস আছে, তবে এখনো সেইসব মানসপ্রেমিক জনপ্রিয়তার নিরিখে পেছিয়ে।

    হয়ত একদিন পরিবর্তন হলেও হতে পারে এই চিত্র। নারীর কলমে সৃষ্টি হবে কোনো বহু কামনার এক পুরুষ।

    চেষ্টা করে যেতে হবে। কর্মকে শানাতে হবে নারী সমাজকে উপেক্ষা করে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৫ নভেম্বর ২০২২ | ১৫২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jayeeta Bhattacharya | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ১৮:৪৩514150
  • এতে ছবিটা এচটিএমএল হয়ে গেছে । ঐ অংশটা মুছে দিলে ভালো হয় ।
  • যোষিতা | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ১৯:২৩514151
  • অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক
  • Suchetana Mukhopadhyay | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ২০:২৬514152
  • আমার দুর্দান্ত লাগলো। এমন লেখার জন্য অভিনন্দন নেবেন জয়ীতা।
  • Ranjan Roy | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ২৩:১৩514156
  •   এখন অনেক মহিলা সাহসী  এবং গভীর কবিতা লিখছেন। আমার চোখে পড়েছে -- অনিতা অগ্নিহোত্রী, বীথি, চট্টোপাধ্যায়, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, বেবী সাউ, যশোধরা রায়চৌধুরী, সায়ন্তনী পতিতুণ্ড।
    এদের মধ্যে অনিতা, যশোধরা এবং সায়ন্তনী ভাল গদ্য লেখেন। 
    কবিতা সিংহের সময়ে রাজলক্ষ্মী দেবী, সাধনা মুখোপাধ্যায়, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, নবনীতা, কেতকী কুশারী ডাইসন ভাল কবিতা লিখতেন।
    অবশ্য এসব নেহাতই আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগা  পছন্দ -অপছন্দ। আমি কোন সমঝদার ক্রিটিক নই। অন্য মত থাকতেই পারে।
  • Kishore Ghosal | ২৫ নভেম্বর ২০২২ ২৩:৩৫514158
  • দারুণ লেখা।  নিঃসন্দেহে চিন্তা ও ভাবনার বিষয়।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন