এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  সমোস্কিতি

  • জঁ লুক গোদার 

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    সমোস্কিতি | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১১৪৪ বার পঠিত
  • জঁ লুক গোদার (৩/১২/১৯৩০ - ১৩/০৯/২০২২)

    একানব্বই বছর বয়সে মারা গেলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ লুক গোদার। তিনি বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। এই পরিচালক তাঁর কাজের জন্য বিতর্কিতও ছিলেন। ফ্রান্সের নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র ধারা তাঁর হাত ধরেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং পরবর্তীতে এই ধারা অন্যান্য পরিচালককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশক থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় এলেও ষাটের দশকে তাঁর নতুন ভাবনার ছবি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি শুধু চলচ্চিত্র পরিচালকই ছিলেন না, ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচকও। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বিখ্যাত ‘কাইয়ে দ্যু সিনেমা’ নামক চলচ্চিত্র পত্রিকায় চলচ্চিত্র সমালোচনা লিখতেন। এর আগেও ১৯৫২ সালে ঐ পত্রিকায় ‘Hans Lucas’ ছদ্মনামে লিখতেন। প্রথম পরিচালনায় আসেন তথ্যচিত্র পরিচালনা দিয়ে। ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে শুটিং করেন, নিজেই চিত্রনাট্য ও সম্পাদনা করে করেন ‘Operation Beton’। পরে নিজেই চিত্রনাট্য লিখে সম্পাদনা করে দশ মনিটের ছবি করেন ‘Une Femme Coquette’ নামে। ১৯৬০ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘের ছবি ‘Breathless’ করার আগে আরো কয়েকটি ছবি করেন। ১৯৫৭ সালে পরিচালনা করেন ‘All Boys are Called patrick’ এবং ১৯৫৮ সালে করেন Charlotte et Son Jules’।  আর এক পরিচালক ক্রুফোর তোলা অসমাপ্ত ছবি ‘Une Histoire d’Eav’ তিনি শেষ করেন। পরে করেন ষাটের দশকের বিখ্যাত ছবি ‘Breathless’। তখন ইউরোপে ষাটের দশক মানেই রাজনীতি, অর্থিনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, মনস্তত্ত্ব – জীবনের সব ক্ষেত্রের ধারণাগুলোকে ভেঙ্গে নতুন করে গড়ে তোলার দশক। আর সেই দশকেই নিজেকে বদলালেন গোদার। ক্যামেরার কাজ, সম্পাদনা, বিষয় বৈচিত্র সবেতেই পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করলেন। তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্রে ছিল তাঁর সমান দক্ষতা। আঙ্গিকের দিক থেকে জাম্প কাট বা মিজ ওঁ স্যেন যদিও প্রচলিত ছিল তবু তিনিই Breathless এ তার স্বার্থক প্রয়োগ করে জনপ্রিয় করে তোলেন। গোদারের গল্প বলার ধরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার। নতুন নির্মান কৌশলের সঙ্গে বিষয়বস্তুরও বৈচিত্র আনলেন। তাঁর ছবিতে আনলেন সমসাময়িক ঘটনা, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, প্রাগবসন্ত, মাও সে তুং, প্যালেস্তাইনের মাতৃভূমির লড়াই, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম। তিনি তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্রের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৈরি করলেন জনজাতি কাহিনি বা এথনো ফিকশনের ধারা। তাঁর ব্রেথলেস ছবিতে ষাটের দশকের নাত্সি বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের কথা সচেতনতার সঙ্গে রাখলেন তিনি। ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশে ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলন, শ্রমজীবী মানুষের বিক্ষোভ তাঁর ছবির বিষয় হয়ে উঠল। এই সময়ের দশ বারোটি ছবি তাঁর স্বতন্ত্র কাজের কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৩ সালে মুক্তি প্রাপ্ত দ্য লিটল সোলজার, ছবিটি ১৯৬০ সালে তৈরি হলেও তিন বছর নিষিদ্ধ ছিল কারণ ছবিতে আলজেরিয়ায় ফরাসি উপনিবেশিক শাসনের সমালোচনা করেছিলেন। এ ছাড়া আরো যে ছবি উল্লেখ করা যায় সেগুলি হল ‘My life to live (1962), ‘La Carabiniers’ (১৯৬৩), ‘Band of Outsider’ (১৯৬৪), ‘A married Woman’ (১৯৬৪), ‘Pierrot le fou’ (১৯৬৫), ‘Alphaville’ (১৯৬৫), ‘Masculin Feminin’ (১৯৬৬), ‘Made in USA’ (1966), ‘La Chinoise’ (1967), ‘Week-end’ (1967) প্রভৃতি।    

    ষাটের দশকের পরে তাঁর ছবির অনুপ্রেরণায় চলচ্চিত্র পরিচালকের নতুন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। অবশ্য চলচ্চিত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতি দশ বছর অন্তর নিজেকে বদলেছেন তিনি। দশকে দশকে না হলেও তিনি পরবর্তীতে নিজেকে বদলেছেন। পরের দিকে তাঁর ছবিতে উগ্র রাজনীতি অনুপস্থিত থেকেছে। বেশি করে এসেছে মানবতাবাদ, এসেছে মার্কসবাদ। তিনি ২০০১ সালে করেন ‘In Praise of Love’, ২০০৪ সালে করেন ‘Our music’,  ২০১০ করেন ‘Film Socialisme’, ২০১৪ সালে করেন ‘Goodbye to Language’ এর মত ছবি।

    জীবনের প্রতি রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অতিবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর ছবিতে ব্যক্তি বিশেষের সঙ্গে এসেছে গোটা সমাজ, রাজনীতি, হত্যা, মাওবাদ। আর দশকে দশকে নিজেকে পরিণত করে তোলা এই বিবর্তিত পরিচালক কারো কাছে প্রশংশিত হয়েছেন, আবার কারও কাছে সত্য কথনের জন্য বিরক্তিরও কারণ হয়েছেন। তিনি মনে করতেন সত্য ও সৌন্দর্যের দুটি আলাদা দিক আছে, তা হল তথ্যচিত্র ও কাহিনিচিত্র। আবার তিনি সত্যের ওপর জোর দিয়ে বলেছেন, আমি গল্প বলতে ততটা আগ্রহী নই, যতটা আগ্রহী চলচ্চিত্রে একরকম নক্সা তৈরি করতে। সেই ছাঁচে আমি আমার ভাবনা চিন্তা বুনন করতে পারি। তাঁর মতে ফটোগ্রাফি সত্য হলে চলচ্চিত্র সেকেন্ডে চব্বিশবার সত্য। 

    সারা জীবনে একাধিক কাহিনিচিত্রের সঙ্গে বেশকিছু তথ্যচিত্র করেছেন। ডাচ চলচ্চিত্র পরিচালক ইউরিজ ইভেন্সের সঙ্গে করেছেন Far From  Vietnam(১৯৬৭), একক পরিচালনায় করেছেন Sympathy for the Devil (১৯৬৮), ‘British Sound’(১৯৬৯), JLG/JLG-Self Portait in December (১৯৯৫)। শেষের দিকে একাত্ম হয়েছিলেন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে। কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনে ও দূরদর্শনেও। জীবনের শেষ ছবি করেছেন ২০১৮ সালে ‘The Image Book’।  নিজের বিবর্তন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি শুরুতে ছিলাম বুর্জোয়া চলচ্চিত্র পরিচালক, তারপর প্রগতিশীল পরিচালক, তারপর এখন আর চিত্র পরিচালক নই; বিপ্লবী, চলচ্চিত্র কর্মের কর্মী বিশেষ, যখন কর্তব্য-কর্ম হিসাবে রাজনৈতিক কর্ম শিখতে হয়েছে’। চলচ্চিত্র পরিচালকের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে অন্য পরিচালকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘শ্রমিকশ্রেণি বা সামাজিক প্রশ্ন নিয়ে ছবি করলেই দায়বদ্ধ বলা যায় না, যা করছেন তা স্রষ্টার সচেতন ভাবনার দায়বদ্ধতা প্রমাণ করে’। এই সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন পরিচালক তাঁর দুনিয়াকে কালো চশমার ওপার থেকে দেখতেন, দেখতেন সেই সব দৃশ্য যা খালি চোখে দেখা যায় না। আর এই কালো চশমার ওপার থেকে দেখা অন্যায়, অনাচার, হত্যালীলা, শোষন - এ সবকিছুকে নিজের নতুন আঙ্গিকে নতুন ভাবনায় সচেতনতার সঙ্গে প্রকাশ করতেন ‘সেকেন্ডে চব্বিশবার সত্য’ তাঁর চলচ্চিত্রে। অবশ্যই বলা যায় তাঁর ইচ্ছামৃত্যু বিশ্বাঙ্গণে একটি বৈচিত্রময়, বর্ণময় আসন চিরতরে শূন্য করে দিল।

    তথ্যসূত্র
    চলচ্চিত্রের অভিধান - সম্পাদক ধীমান দাশগুপ্ত, বাণীশিল্প, ২০০৬
    প্রবীর মিত্র, আদি অকৃ্ত্রিম গোদার, মুহূর্ত, ২০২২
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • সমোস্কিতি | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১১৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন