এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  অন্যান্য  মোচ্ছব

  •  রোমিলা থাপারের বিরুদ্ধতার স্বর : দৃঢ় অথচ নির্মল

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | মোচ্ছব | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ১৭১৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • রোমিলা থাপারের বিরুদ্ধতার স্বর : দৃঢ় অথচ নির্মল
     
    প্রসঙ্গত এসে যায় শাহিনবাগের কথা। নয়াদিল্লির শাহিনবাগ, ২০১৯ সালে সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এন আর সি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলনে উত্তাল। এই শাহিনবাগের প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রভাব পড়েছিল সারা ভারত জুড়ে। সেই সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন শুরু হতেও দেখা গেছে। প্রতিবাদ আরো জোরদার হত যদি না তারা সরকারের রক্তচক্ষুর থেকেও বেশি ভয় পেত কোভিড-১৯ কে। এই শাহিনবাগের প্রতিবাদে অবস্থানকারীরা ছিল মূলত মহিলা। এদের মধ্যে মুসলমান মহিলাও ছিল। এই প্রতিবাদেও অবস্থানকারী মহিলারা চেয়েছিল নাগরিকত্ব নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাদের আশঙ্কার বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হোক এবং নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করার আশ্বাস দেওয়া হোক। অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার শাহিনবাগে গিয়ে প্রতিবাদে অবস্থানকারীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আসেনি বা সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনও করতেও আসেনি। অসমের দুঃখজনক ঘটনার কথা মাথায় রেখে তাদের এ আবেদনকে তাঁর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছে। তিনি দেখেছেন সেদিনের সেই বিশাল সংখ্যক প্রতিবাদীদের উপস্থিতি ছিল শান্ত ও সুশৃ্ঙ্খলিত। সেখানে মাঝে মাঝে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হচ্ছিল, বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছিল অল্পই। তারা কোনো আক্রমণাত্বক ও অমার্জিত ভাষা প্রয়োগ করেনি যা তিনি সাম্প্রতিক কালের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো  মুখে শুনেছেন। তাঁর কাছে এই প্রতিবাদের সব চেয়ে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা মহিলাদের প্রতিবাদের স্বরূপ। যারা নিজের সামাজিক পরিমণ্ডলেই অবদমিত তারা বিরুদ্ধতার স্বরের মাত্রা বোঝে, তাই তারা ছিল প্রত্যয়ী। তিনি জানিয়েছেন এই আন্দোলনে কখনও কোনো ধর্মের ভাষা ব্যবহার করা হয়নি। আন্দোলনের প্রতিবাদের ভাষা ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ।

    শাহিনবাগের প্রতিবাদের স্বরূপ দেখে তাঁর বহুবছর আগে ঘটে যাওয়া বিরুদ্ধতার আর এক রূপের কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় গত শতাব্দীর চারের দশকের উপনিবেশবাদ- বিরোধী জাতীয়তাবাদের কর্মসূচী। সেই সঙ্গে ভারতের প্রাচীনকালের প্রতিবাদের স্বরূপটিও তিনি খুঁজে ফিরেছেন।
       
    ঠিক এই সময় অধ্যাপক রোমিলা থাপার দিল্লিতে দুটি স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট নেমিচাঁদ স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অপর এর উপস্থিতি; প্রাচীন ভারতে ধর্ম ও সমাজ’। এর তিন মাস কুড়িদিন পর ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় বক্তৃতা দেন, ভি এম তারকুণ্ডে স্মারক বক্তৃতা। বিষয় ছিল ত্যাগ, বিরুদ্ধতা ও সত্যাগ্রহ।
     
    বক্তৃতায় তিনি বলেছেন ভারতে বিরুদ্ধতার প্রচলন সেই প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। বিরুদ্ধতা আমাদের দেশে বিভিন্ন রূপে বারবার প্রকাশিত হয়েছে। এর বিচিত্র রূপ এখন আরোও বেশি করে দেখা যাচ্ছে। আগে বিরুদ্ধতার প্রকাশ ধর্মীয় আঙ্গিকে ছিল, পরে নাগরিক অধিকারের আঙ্গিকে চলে এসেছে।

    প্রাচীনকালের বিরুদ্ধতা, ভিন্নমত, পোষণ ও মতপার্থক্য প্রকাশের মত বিষয়গুলি প্রচলিত ভাবনা ও কর্মধারার সঙ্গে আদান প্রদানের মাধ্যমে নতুন বাকপ্রণালী গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল যা আজকের এই ভারতকে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতে বিরুদ্ধ স্বরের উদ্ভাসের মত তাকে দমন করার চেষ্টাও অর্বাচীন নয়। বেদের সময় থেকেই তা যুগে যুগে হয়ে আসছে, তবে ধরনটা বদলাচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের কাছাকাছি সময় থেকে বৈদিকযুগের মধ্যবর্তী সময়কালে মূল ধর্ম ছিল বেদ ভিত্তিক। তখন বেদ পাঠ করার অধিকার ছিল একমাত্র ব্রাহ্মণদের। তবে এই যুগেও অপর ছিল। সে অপর দাস ও দাসী। তাদের সঙ্গে আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য ছিল। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রাধাণ্যের যুগে এই দাস সংস্কৃতি ছিল অপরের সংস্কৃতি। সে যুগের বেশ কিছু বিত্তশালী দাসের কথা জানা গেলেও দাসীরা মূলত বিত্তবান আর্যদের সম্পত্তি হয়ে থাকত। এই দাসীদের গর্ভে ব্রাহ্মণের ঔরসে জাত সন্তান ছিল সেযুগের কিছু অপর। তারা দাসী পুত্র বলে পরিচিত হত। ব্রাহ্মণের ঔরস জাত বলে এই ব্রাহ্মণরা ছিল দাসীপুত্র ব্রাহ্মণ। এরা সকলে ব্রাহ্মণের সমাসনে বসার অধিকার পেত না।পেত অপমান। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন কীভাবে  ঋষি আইলুসাকে সোমের  যজ্ঞানুষ্ঠান থেকে  অপমান করে  তাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রাহ্মণরা। আর পরে তাঁর যোগ্যতার কারণে কীভাবে তিনি ব্রাহ্মণ সমাজে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেন।  এরকমই  দাসী মামাতেয়র পুত্র ঋষি দীর্ঘতামস যিনি রাজা ভরতের রাজ্যাভিষেক করার অধিকার লাভ করেন। এরকম আর একজন ব্রাহ্মণ  ছিলেন দাসী উষীজাপুত্র কাক্ষিবন্ত। এই বিশেষ ব্রাহ্মণরা বিরুদ্ধতা প্রকাশ করে নিজস্ব পথে চলেনি, বরং তারা এমন এক সংস্কৃতি থেকে এসেছিল যে তাদের অপর হিসাবে গণ্য করা হত আবার তাদের সংস্কৃতিকে জানতে ব্রাহ্মণের মর্যাদা দেওয়া হত। কারণ অপর সংস্কৃতি থেকে আসা দাসীপুত্রদের অধীত জ্ঞান সম্পর্কে মূল ব্রাহ্মণসমাজ আগ্রহী ছিল।

    লেখক বলেছেন শ্রমণদের কথাও। জৈন, বৌদ্ধ ও আজীবিকদের যৌথভাবে শ্রমণ নামে পরিচিত।  খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই আমাদের দেশে এই অপর গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। এই শ্রমণরা বৈদিক ব্রাহ্মণদের বিরোধী ছিল। তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না। বেদ ঈশ্বরের মুখ নিঃসৃ্ত বাণী একথা বিশ্বাস করত না। তারা ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ, পশুবলী নিয়ে প্রতিবাদ করেছিল। শ্রমণদের ধর্মীয় নীতি ছিল উদার। অহিংসা, করুণা, সামাজিক কল্যাণের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল। সেই কারণে নিম্নবর্ণের ব্যক্তির জন্যও শ্রমণের দরজা খোলা থাকত। শ্রমণ ধারার ধর্মগুলিতে সামাজিক নীতিবোধের ওপর বেশি গুরত্ব দেওয়া হয়েছিল।

     বৈদিকোত্তরযুগে শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের চোখেও শ্রমণরা ছিল নাস্তিক, তারা অপর হিসাবে গণ্য হত। তবে শ্রমণরা সমাজের বিশেষ ব্যক্তিদের কাছ থেকে [রাজা, জমিদার, বণিক প্রভৃতি] পৃষ্টপোষকতা লাভ করেছিল, ফলে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের মতাদর্শ বেড়ে চলেছিল। এদের ছত্রভঙ্গ করে দেবার চেষ্টাও করেছে সে যুগের ব্রাহ্মণরা। শ্রমণরাও দেশের বাইরে ধর্ম প্রচারে সফল হয়েছিল যে সফলতা ব্রাহ্মণরা ছুঁতে পারেনি। তবে এই সময়ের ইতিহাস থেকে এই দুটি ভিন্ন ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ধারার পাশাপাশি অবস্থানের কথা জানা যায়।

     তাঁর মতে আমাদের সমাজে এমন কিছু অপরের আবির্ভাব হয়েছে যা বিরুদ্ধতা থেকে জন্ম নেয়নি। সমাজের নিম্নস্তরের ব্যক্তিদের অনেক সময় প্রয়োজন মত ব্যবহার করার জন্য সমাজ থেকে  আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। জন্ম হয়েছে দলিতের। আগে যাদের অটবিকা বা আদিবাসী বলা হত এখন তাদেরই বলা হয় তফশিলি উপজাতি। এরা ছিল মূলত অরণ্যবাসী। পরবর্তীতে অরণ্য কেটে কৃ্ষি উপযোগী করার যোজনায় এদেরকে নিম্নবর্ণের একাংশের অন্তর্ভূত করে নেওয়া হয়েছে।

    এদেশে অপর হিসাবে এসেছে ভক্তিবাদী সন্ত ও সুফি পির। পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উত্থিত ভক্তি সাধক ও বা সুফি পিররা কেউই নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেননি। তারা তৎকালীন পোশাকি ধর্মের রক্ষণশীলতার ভারকে সংস্কার করে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তারা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে ধর্মের ভাষা হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ধর্মীয় উপাসনার প্রচলিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পছন্দ মত কোনো দেবতা বা বিমূর্ত ভাবনার প্রতি অগাধ ভক্তির কথা বলেছে। তারা একইভাবে  ইসলাম ধর্ম বা পুরাণ- নিয়ন্ত্রিত হিন্দুধর্মের বিপরীতে চলেছে। এরাও অপর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এসেছে লাল দেদ ও মীরা বাইয়ের মত মহিলাদের কথা, দক্ষিণ ভারতের মহিলা সন্তদের কথাও। তাদের ধর্ম প্রচারের পথে অনেক বেশি বাধা এসেছে। নারী হওয়ার কারণে তাঁদের কাজ বিরুদ্ধতার পরিচায়ক হয়ে উঠেছিল।

     এভাবেই লেখক কালের সরণি বেয়ে চলে এসেছেন গত শতাব্দীর উপনিবেশবাদ- বিরোধী আন্দোলনের কথাতে। তাঁর মতে ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রবল ও প্রাথমিক রূপ ছিল উপনিবেশবাদ- বিরোধী জাতীয়তাবাদ। উপনিবেশবাদ- বিরোধী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ আন্দোলনও চলেছে। এসেছে গান্ধির সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা। ব্রিটিশ- ভারতীয় ঔপনিবেশিক সরকারের বিশেষ কয়েকটি আইনকে অমান্য করার জন্য দেশের জনগনকে সজাগ করে তোলার উদ্দেশ্যে গান্ধিজি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেন। ব্রিটিশ সরকারের ঐ আইনগুলির বিরোধিতা করা ছিল আইন অমান্য কর্মসূচীর উদ্দেশ্য। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদের এই পন্থা বৈধ বলে মনে করেন তিনি। কারণ প্রতিবাদের লক্ষ্য যাবতীয় আইনের বিরোধিতা নয়, কয়েকটি নির্দিষ্ট আইনের বিরোধিতা। সাম্প্রতিক কালেও এই পন্থা বিরুদ্ধতা প্রকাশের অন্যতম কার্যকারী আঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রে আবার এই পন্থাকেই বে আইনি বলা হয়। তাঁর মতে সরকার নিয়োগ করা হয় সমস্ত নাগরিকের উন্নতিবিধানের জন্য, মুষ্টিমেয় কয়েকজনের স্বার্থরক্ষার জন্য নয়, এই মুষ্টিমেয় জনসংখ্যার স্বার্থ সিদ্ধির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে স্বৈরতন্ত্র। তিনি দৃঢ়স্বরে বলেন প্রতিবাদ জানানোর এই পন্থা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকারের অন্যতম প্রধান অংশ।
     
    শাসকের সঙ্গে শাসিতের, নাগরিকের সঙ্গে কর্তৃত্বকারী প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষমতাসীন অংশের অবাধ ও মুক্ত আলোচনা বা বাক বিনিময় হওয়া একান্ত প্রয়োজন। “যে ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করা সার্থক, তেমন কোনো ভবিষ্যতে যদি আমাদের পৌঁছাতে হয় তাহলে ন্যূনতম মানবাধিকারগুলির সংস্থান ও সুরক্ষা তার সর্বপ্রথম শর্ত।“ বিরুদ্ধতার কণ্ঠরোধ না করে তা থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরী। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন প্রাচীন কালের কৃ্ষক বিদ্রোহের কথা। কৃ্ষকদের অসন্তোষ, শহরের কারিগরদের অসন্তোষ তখনও ছিল। তিনি এও জানিয়েছেন তখন আলোচনার মাধ্যমে দুই পক্ষের সুবিধাজনক সিদ্ধান্তে আসা হয়েছিল।
     
    তিনি এও বলেছেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যে চুক্তির সম্পর্ক সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে সেখানে নাগরিকের জন্য নির্দিষ্ট কিছু অধিকারের কথা যেমন বলা আছে তেমনি বলা আছে নাগরিকের কর্তব্য সম্পর্কেও। নাগরিকের অধিকারকে সম্মান জানান যেমন রাষ্ট্রের কর্তব্য। তেমনি নাগরিকেরও উচিত রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন করা। রাষ্ট্র ও নাগরিকের পারস্পরিক দায়বদ্ধতা সবসময় রয়েছে। রাষ্ট্রবিরোধিতার স্বরূপ, ব্যাপ্তি ও মাত্রা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে রোমিলা থাপার বেশ জোড়ের সঙ্গে গান্ধিবাদকে সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র যদি সহিংস ভাবে জনগণকে অত্যাচার নিপীড়ণ করে সে ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেন অহিংস হয়। উভয় পক্ষের মত ও বাক বিনিময়ে সমঝোতার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করা উচিত। তাঁর মতে- “রাষ্ট্র ও নাগরিকের পরস্পরের প্রতি কর্তব্য এবং তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য উভয়পক্ষ ফলপ্রসূ সংলাপে রত হলে তবেই আমাদের ভবিষ্যত সুরক্ষিত হতে পারে”।

    বলা বাহুল্য, শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়োপযোগী ছিল এই বক্তৃতা, জনপ্রিয়ও হয়েছিল। আন্দোলন থেমে গেলেও তাঁর বক্তব্য চিরস্থায়ী হয়ে গেল। আর বিষয়ের মিল থাকায় দুই বক্তৃতাকে একটি বৃহৎ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে জুড়ে দিয়ে ২০২০ সালে Voices of Dissent নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ বছর ২০২৩ সালে প্রতিক্ষণ প্রকাশনা সংস্থা তারই বাংলা অনূদিত সংস্করণ প্রকাশ করল তাঁর সেই বক্তব্যকে অসংখ্য বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার সংকল্পে। বইটি সুমুদ্রণ ও সঠিক সময়ে প্রকাশের জন্য প্রকাশকের প্রশংসা প্রাপ্য। অনুবাদের ভাষা প্রথমাংশের তুলনায় শেষাংশ বেশ প্রাঞ্জল।
     
    বইটিতে স্বল্পকথা, ভূমিকা, প্রাককথা, উপসংহার ছাড়া মূল বক্তব্য নয়টি ভাগে বিভক্ত। প্রাক কথনেই এই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বহূ ব্যবহৃত দুটি শব্দ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া আছে। বিরুদ্ধতা শব্দটি সম্পর্কে বলা হয়েছে মানুষের জীবন কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন প্রতিষ্ঠান গুলির সঙ্গে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর যে মতবিরোধ তাইই হল বিরুদ্ধতা। আর অপর শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাদের সম্পর্কে যারা নিজের ভিন্ন বলে চিহ্নিত করেছে বা কোনো বিষয়ে মত পার্থক্যের কারণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ভিন্ন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ অপরত্ব অরোপ করা হয়েছে।

    একশো একান্ন পাতার সুমুদ্রিত এই বইটিতে লেখকের সম্পূর্ণ বক্তব্য যে নয়টি ভাগে বইটিতে রাখা হয়েছে তা হল-  দাস্যপুত্রাঃ ব্রাহ্মণ বা দাসীপুত্র ব্রাহ্মণ, শ্রমণের উপস্থিতি, আরোপিত অপরত্ব, ভক্তিবাদী সন্ত ও সূফি পির, ফিরে দেখা, সাম্প্রতিক জাতীয়তাবাদের প্রেক্ষিতে বিরুদ্ধতার একটি আধুনিক আন্দোলন প্রসঙ্গে আলোচনা, গান্ধির সত্যাগ্রহ, প্রতিবাদের সামাজিক অভিব্যক্তি, সত্যাগ্রহের বিপুল জনসমর্থনের পেছনে কি ভারতীয় অতীতে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত বিরুদ্ধতার রূপগুলির ঐতিহ্য ক্রিয়াশীল ছিল?

    আবার উপসংহারে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন - অতীতের এই বিরুদ্ধতার বহুস্বরকে কি আমরা মনে রাখব? এবং আজকের দিনে তাদের বক্তব্য শোনার চেষ্টা করব?

    উত্তর পাঠক খুঁজবেন…।

    বই – বিরুদ্ধতার স্বর  বেদের সময় থেকে শাহিনবাগ
    লেখক - রোমিলা থাপার
    অনুবাদক - যশোমতী দেব
    সহ অনুবাদক ও পাঠসম্পাদনা - প্রসিত দাস
    প্রকাশক - প্রতিক্ষণ
    মূল্য ৪০০ 


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • অন্যান্য | ০৭ জুলাই ২০২৩ | ১৭১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীমু | 223.225.***.*** | ০৭ জুলাই ২০২৩ ১৮:০৩521069
  • বেশ ভালো আলোচনা yes​​
  • upal mukhopadhyay | ০৭ জুলাই ২০২৩ ১৯:৫৫521076
  • ইতিহাসের সত্য। বর্তমানের সত্যানুসন্ধান। জ্ঞান মার্গের বিকল্প ভাবনা। তবে জ্ঞান মার্গের এলিট ডিসকোর্সেও বিরোধিতার স্বর আছে। যেটা আচার্য প্রশান্ত সামনে আনছেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য সম্বলিত গ্রন্থাবলী নজর করা উচিত। বাংলায় প্রকাশ করা দরকার । 
  • মিতা দাস পুরকায়স্থ | 2405:201:a803:fa85:1921:4b6e:4cf6:***:*** | ২৯ জুলাই ২০২৩ ২১:১৬521873
  • রোমিলা থাপারের বইটির সুচারুভাবে বিশ্লেষণ করলেন লেখক। বইটি পড়ার আগ্রহ জেগে উঠলো। অনেক ধন্যবাদ আলোচককে। বিশেষ করে 'অপর' ও বিরুদ্ধ স্বরের আলোচনা খুব ভালো লাগলো
  • Bratin Das | ৩০ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪০521889
  • আমি এই বই টি পড়ি কিন্তু  অধ্যাপক রোমিলা ঘাপার কিছু কিছু বই পড়েছি।
     
    এই আলোচনাকে আমি ঋদ্ধ  হলাম। বইটি সংগ্রহ করবো।লেখিকানকে আন্তরিক ধন্যবাদ  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন