গৌরচন্দ্রিকা
আমি শাড়ি পরতে ভালবাসি। সেই যখন কুট্টিপারা ছিলাম- শাড়ি পরিয়ে দেবার আবদার শুনে তখন কোন জাদুবলে যে জেম্মা ঐ সাড়ে পাঁচ মিটারের কাপড়টাকে সামলে সুমলে আমার সাড়ে তিন ফুটিয়া শরীরে পরিয়ে দিত! সে শাড়ি পরে নেচেকুঁদে ছুটে বেড়ালেও কখনই ফসফস করে খুলে যেত না! মা-ও আমার খুব শাড়ি পরতে ভালবাসে, বছরে পুজোয় তখন একটা ভালো শাড়ি মায়ের হত, মায়ের সাধের সেই সবেধন নীলমণি পুজোর শাড়ি আমায় সরস্বতী পুজোয় পরতে দিতে হবে বলে বায়নাবাজি-কান্নাকাটি কিছুই কখনো বাদ রাখিনি। এমনকি কাঁচা আলপনার ওপর অসাবধানে বসে পড়ে সেই শাড়িতে সাদা ছোপ লাগিয়ে কাঁচুমাচু মুখে বাড়ি ফিরেছি; একটুও বকুনি খাই নি, কিন্তু মায়ের হাসিখুশি মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেছে।
পুজোর শাড়ি ছাড়া এমনি সারা বছর উপহার দেয়া থেকে শুরু করে হাজারো উৎসব অনুষ্ঠানে বাপির ইশকুলের কালো ব্যাগে করে আসতো রাজবলহাটের তাঁতিবাড়ি থেকে কিনে আনা তাঁতের শাড়ি। আমার তখন ধারণা ছিল চমৎকার করে মাড় দেয়া বইয়ের মত পাট করে শাড়ির রঙেরই দড়ি বাঁধা সুতির শাড়িকে বলে তাঁতের শাড়ি! সিল্কের শাড়ি যেগুলো আলো ঝলমলে ঝাঁ চকচকে দোকান থেকে মা-বাপি কিনে আনে, সেগুলো অন্য কোন গ্রহের বস্তু! কেমন হাঁদা আমি? তাঁত তো একটা বোনার যন্ত্র বই আর কিছু নয় - তাতে সুতি বুনলে সুতির শাড়ি, রেশম বুনলে সিল্কের শাড়ি।
বড় হয়ে, মানে অনেক অনেক বড় হয়ে, ধরা যাক কয়েক মাস আগে বুঝলাম যে শাড়ির প্রতি আমার ভালোবাসায় প্রচুর খাদ, আদতে শাড়ি নিয়ে আমি কিচ্ছুটি জানি না। শুচিস্মিতাদি আমার সব ছবিতেই বাছাবাছি না করে লাভ রিয়াক্ট ইত্যাদি দেয়, সে একদিন একটা ছবি দেখে জানতে চাইলো-
শু - এটা কি শাড়ি পরেছিস রে?
পু - হ্যান্ডলুম বোধহয়, আমি ঠিক জানি না।
শু - সে আবার কি অশিক্ষিতের মত কথা! হ্যান্ডলুম তো শাড়ি বোনার কায়দা, শাড়িটার কি নাম?
পু- ...
কেমন লজ্জার কথা! এদিকে শাড়ি ভালোবাসি বলে বড়াই করে বেড়াই, অথচ জানিই না যে হ্যান্ডলুমই বা কী, বা সিল্কের শাড়িও তাঁতেই বোনা হয়! সেই শুরু, শুচিস্মিতাদিকে প্রশ্ন করে করে পাগল করে দেয়া শুরু করলাম তারপর থেকে। হ্যান্ডলুমের শাড়ি নিয়ে লেখাপত্র পড়লাম। দময়ন্তীদি, স্বাতীদির শাড়ি সংক্রান্ত চমৎকার সব পোস্ট অনেকদিন থেকেই চোখে পড়তো, কিন্তু তেমন করে মাথা ঘামাইনি এর আগে, খুঁজে পেতে সব বের করলাম। একটা পুরো নতুন জগত দরজা খুলে দাঁড়ালো আমার সামনে। আমাদের দেশের প্রতিটা রাজ্যের হস্তশিল্পের এত বৈচিত্র্য- এত ইন্টারেস্টিং- নানা রকমের বয়নপদ্ধতি, ছুঁচের কাজ, কাপড়ের গায়ে প্রাকৃতিক রং দিয়ে এঁকে ভরিয়ে তোলা, কাঠের ব্লকে রং ছুপিয়ে শাড়িতে কাজ, যাযাবরদের তামার পয়সা কড়ি উজ্জ্বল রঙের সুতোয় নকশা তোলা, আমাদের বাংলার নিজের নক্সি কাঁথা - কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি!
শিখলাম লুম মানে তাঁত, কাপড় বোনার যন্ত্র - হ্যান্ডলুম মানে হাতে চালানো তাঁত - ভারতের আর বাংলার গ্রামে গ্রামে কোন আদিযুগ থেকে - দাদুর থেকে বাবা - বাবা থেকে ছেলে- হাতে ধরে সারা জীবনের যত্নে এই শিল্প শিক্ষার সম্পূর্ণতা। দাদু-বাবা-ছেলে বললাম বলে এ নয় কিন্তু যে এই হ্যান্ডলুম শাড়ির পেছনে বাড়ির মেয়েদের পরিশ্রম কিছু কম! কাকভোরে উঠে সুতো রং করা থেকে শুরু করে তাঁতে সুতো পরানো এবং বুনতে শুরু করার আগে পর্যন্ত আরও নানা অজস্র কাজে তাদের হাতের ওম লেগে থাকে। কয়েকজন মহিলা তাঁতিরও সন্ধান পেয়েছি এই কদিন খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে। বলা যায় এই তাঁতবস্ত্র এক পরিবারভিত্তিক জীবিকা এবং শিল্প।
কিন্তু সময় এগোনোর সাথে আসে পাওয়ারলুম - মেশিনের শাড়ি। তবে মেশিনে সূক্ষ্ম রেশম সুতো বোনা প্রায় অসম্ভব- অসম্ভব নানারকম বৈচিত্র্যময় কঠিন বুননের কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা। সে না হয় মেশিনের শাড়ির যুগ এলো, কিন্তু সঙ্গে করে সে খুলে দিলো মানুষের বদমাইশির ঝাঁপি - শুরু হলো অসম্ভব কম দামে পলিয়েস্টার সুতোর মিশেলে তৈরী শাড়ি আসল সিল্ক বলে বিক্রি করা, মেশিনের কাজ বাজারে হ্যান্ডলুম বলে চালানো। অসম্ভব কম দাম কেন? কারণ একটা মেশিনে যদি দিনে ১২ টা শাড়ি তৈরী করা যায় শুধু মাত্র একজনের তত্ত্বাবধানে - সেখানে একটা শাড়ি হাতে চালানো তাঁতে বুনতে সময় লেগে যেতে পারে ৩ থেকে ১২ দিন- নির্ভর করছে শাড়ির নকশার সূক্ষ্মতার ওপর। ভারতের হ্যান্ডলুম শাড়ির যাতে মেশিনের সস্তা নকল না হয় তা আইন দিয়ে সুরক্ষিত করা আছে, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, জি-আই ট্যাগের ব্যবস্থা আছে - কিন্তু এ পোড়া দেশে মানছে কে আর দেখছে কে? ফলতঃ তাঁতিদের অবস্থা সঙ্গিন, নামমাত্র মজুরিতে যে অসামান্য শিল্পের চর্চা তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন - তার মূল্য দেবার লোক আর বাজারে মেলা ভার।
এ নিয়ে একটু শখের পড়াশোনা করতে করতেই শাড়ি চেনার ঝোঁক চাপলো। ঠিক করলাম এবার থেকে উচিত দাম দিয়ে বছর অন্তত একটা করে আসল হাতে বোনা শাড়ি কিনবো- নিজের জন্য কিনবো, মায়ের জন্য কিনবো, কাউকে উপহার দিতে হলেও শরণ নেবো আমাদের দেশের তাঁতিদের। যে শাড়ি কিনছি, গায়ে পরছি, তাকে নিয়ে জানবো - কে তাকে বানাল- কি তার ঐতিহ্য - কি তার ইতিহাস-ভূগোল- শুধু ভালোবাসি বলে দায় ঝেড়ে ফেলবো না- যোগ্য মর্যাদাটুকু ভালোবাসার জিনিসকে না দিলে চলবে কেন?
আপাতত ঠিক করেছি বিভিন্ন হ্যান্ডলুম ক্লাস্টারের (মানে বলা যায় তাঁতিদের এক একটা গোষ্ঠী বা ঘরানা) খোঁজ নিয়ে সরাসরি তাঁতিদের থেকে জিনিস কেনার চেষ্টা করবো - সম্ভব না হলে যাচাই বাছবিচার করে আসল হ্যান্ডলুম বিক্রি করেন এমন লোকের থেকে শাড়ী কিনবো। যেমন যা জানতে পারবো, খোঁজ খবর পাবো, আমার চেনা সবাইকে জানাবো - কী কিনছি, কোথা থেকে কিনছি- সব খবরাখবর টুকে রাখার চেষ্টা করবো। থেমে থেকে চললেও এই সিরিজটা হয়তো চলবে। আশা করি সেসব লেখা পড়ে আরও কিছু লোক উৎসাহী হবেন, কিনবেন আমাদের দেশজ শিল্প - সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের এই ঐতিহ্য কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে না।
যেসব লেখাপত্র পড়ে আমি এই বিষয়ে উৎসাহী হয়েছি-
নিচের ছবি ২৫-২৬ বছর আগের যেখানে আমি পরে আছি আমার জেম্মার "সাউথ ইন্ডিয়ান সিল্ক" শাড়ি।
চলুক।
খুব ভালো লিখেছিস পূবালী। এটা আমিও বলে বোঝাতে পারি না handloom এ শাড়ি টা বোনা হয় কিন্তু শাড়িটা কী? আর material ই বা কী? সব ঘুরে ফিরে একই উত্তর আসে "দিদি এটা handloom.নিয়ে যান"