এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  নববর্ষ

  • দৌড়

    অরিন্দম বসু
    ইস্পেশাল | নববর্ষ | ১৬ এপ্রিল ২০২১ | ২০৮৩ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • গোষ্ঠতলায় আজ ঘোড়দৌড়। ফি বছর পয়লা জ্যৈষ্ঠেই দৌড় হয়। এলাকার সকলেই জানে। তাই দুপুর থেকেই সেখানে ভিড় জমতে শুরু করেছে।
    নেপালগঞ্জের হাটের ভেতরে দুর্গামন্দির। তার গায়ে যে ব্রিজ সেটা পেরিয়ে বাঁদিকে নামলেই কৃষ্ণরামপুর। রাস্তার পাশেই লাল সিমেন্টে বাঁধানো গোষ্ঠতলার চৌকো থান। শিব, গৌর-নিতাই, কৃষ্ণর ছবিওয়ালা চকচকে টাইল্‌স বসানো তিন দিকের দেওয়ালে। চারপাশে বাঁশ খাটিয়ে তাতে রঙিন কাগজের পতাকা আর শিকলি। একটু দূরে মেলা বসেছে। প্লাস্টিকের ছাউনি মাথায় নিয়ে জিলিপি, নিমকি, খেলনা, রান্নাঘরের হরেক জিনিস, আচারের দোকান। নাগরদোলা আর চরকিও আছে। মাইকে কেউ ফুঁকে চলেছে— ‘বন্ধুগণ, কৃষ্ণরামপুর বালক সংঘের পরিচালনায় রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে গোষ্ঠতলার মাঠে এক বিশাল ঘোড়াদৌড় প্র‌তিযোগিতার আয়োজন করা হইয়াছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ঘোড়াদৌড় শুরু হবে। আপনারা দলে দলে যোগদান করে এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলুন।’
    বরাবর দৌড় এমনিই হত। গত কয়েক বছরে তাতে উপলক্ষ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তীতে খামোকা ঘোড়দৌড় হতে যাবে কেন? যারা এরমধ্যেই দলে দলে যোগদান করতে শুরু করেছে তাদের কেউই যদিও ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিশোরকুমারের গান শুরু হয়ে গিয়েছে। পৃথিবী বদলে গেছে....যা দেখি নতুন লাগে...।
    নেপালগঞ্জে আজ হাটবার। ভোর চারটে থেকে মাছ নিলামের খোটি চালু হয়ে যায়। আলো ফুটতে না ফুটতেই সবজির হাট শুরু। ঝিনকি, বারুইপুর, সূর্যপুর, মাগুরখালি, জুলপিয়া, পানাকুয়া, বলাখালি থেকে মাল এসে হাট জমজমাট করে রাখে। হাটের মানুষ এসে দৌড়ের মাঠের ভিড় আরও বাড়িয়ে চলেছে।
    মাঠ অনেকটা নাবালে। পাশেই উঁচু জমি। সেখান থেকে হেলে পড়া একটা বাবলা গাছের ছায়ায় গামছা পেতে পেটমোটা ব্যাগে মাথা রেখে শুয়ে ছিল সইদুল। খানিক দূরে মুখ নামিয়ে ঘাস খাচ্ছে তার বাদামি মাদি ঘোড়াটা। বাংলাদেশ থেকে দু’হাত ফেরতা হয়ে তার কাছে এসেছিল। এক বছর হল ছেলে হয়েছে। আরও কিছুটা দূরে ঘুরছে সেটা। খেয়ে নিক যা পারে। আজ মা-বেটা দুজনকেই ছুট করাবে সইদুল।
    ‘কী দোস্ত? খবর কী তোর?’
    সইদুল উঠে বসতে না বসতেই উঁচু জমি থেকে খানিকটা মাটি ধসিয়ে হড়বড় করে যে নেমে এসে দাঁড়াল সে ধ্রুবকুমার। রোগাটে শরীর। হাফ হাতা শার্ট, প্যান্ট, পায়ে রবারের চপ্পল। কালো মুখে সাদা দাঁতের হাসি।
    লুঙ্গি সামলে উঠে দাঁড়িয়ে হাসল সইদুলও। ‘এই তোদের এখেনে ফের এনু তো দৌড় করতি। তোর খবর কেমন? এত্‌খনে আসার সময় হল!’
    ‘ও কথা আর বলিসনি। পঞ্চাত প্র‌ধানের বাড়িতে কাজে গেছলাম। তার পাকা দোতলা কিন্তুক রান্নাঘর এলো। চারটে বাঁশের খুঁটির ওপ্‌রে পেলাস্টিক চাপানো ছেল। এখন পাকা গাঁথনি করাচ্ছে। অ্যাসবেস চাপাবে। আর একদিনের কাজ হলি শেষ হয়। সে কাল হবেখন। আজ এই দৌড় বলে আমি বেলাবেলি ছুটি করে চলে এনু। নইলে যদি তুই ফের আছাড় খাস!’ বলতে বলতে গুবগুবিয়ে হেসে উঠছিল ধ্রুব। সেইসঙ্গে বিড়ির প্যাকেট খচমচিয়ে বাড়িয়ে ধরল সইদুলের দিকে।
    বিড়ি ধরিয়ে দুজনেই গিয়ে বসল ছায়া ঘেঁষে। ক্যানিংয়ের বেতবেড়িয়া থেকে আসে সইদুল ইসলাম। আগে সে ঘোড়ার সওয়ারি হত। সেই থেকে ঘোড়ার নেশা। তারপর নিজেই একটা কিনে ফেলেছিল। মদ্দ ঘোড়া। পরে সেটা বেচে মাদিটা এনেছে। দশ বছর ধরে দৌড়ে ঘোড়া নামাচ্ছে সে। তবে এই কৃষ্ণরামপুরে আসছে বছর পাঁচেক হল। প্র‌থম বছরেই ছোটার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে বিরাট আছাড় খেয়ে পড়েছিল সইদুল। পিছনে তখন ধেয়ে আসছে অন্য সব ঘোড়া। চাট খেয়ে হাত কিংবা পা ভেঙে যেতে পারত। ধ্রুবকুমার দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের ভেতরে। হুমড়ি খেয়ে সে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিয়েছিল সইদুলকে। সেই তাদের মোলাকাত। তারপর থেকে দুজনেই জানে, বছরে এই একবার ঘোড়দৌড়ের সময় হলে তাদের দেখা হবেই। একবার এসে ঘোড়া নিয়ে ধ্রুবর বাড়িতেও গিয়েছিল সইদুল। বিস্তর ভিড় জমেছিল সেবার।
    সইদুল জানতে চাইল, ‘তোর পরিবার, ছেলেমেয়ে আসে নে দৌড় দেখতে?’
    ধ্রুব ঘাড় ঘুরিয়ে হাত তুলে দেখাল। ‘এসছে তো। হোই হোথায় বসেছে।’
    সে যে জায়গাটা দেখাল সেখানে কয়েকটা নারকেল গাছের নীচে অনেকগুলো ঘোড়া ঘাসবিচালি চিবোচ্ছে। মানুষজন ভিড় করে দেখছে তাদের। কোনও ঘোড়াকে হলুদ পেচ্ছাপ করতে দেখে হেসে গড়িয়ে যাচ্ছে মেয়ে-বউরা। বেলুনওয়ালা, ঘটিগরম, চানাচুরওয়ালা ঘুরে বেড়াচ্ছে। হনুমান, স্পাইডারম্যান আর ছোটা ভীমের মুখোশ একসঙ্গে বাঁশের বাঁকে ঝুলিয়ে ঘুরছে একজন। এইসময় ধ্রুবর বছর আটেকের ছেলে লাফ দিয়ে নেমে এল তার কাছে।
    ‘বাবা, ওইটা খাব, কিনে দাও, দিদিও খাবে বলতেছে।’
    ‘কী খাবিটা কী?’
    ‘ওই যে, বোঝে না সে বোঝে না।’
    ‘অ্যাঁ!’ ধ্রুব হাঁ হয়ে তাকাল। ‘ও তো পেপসি রে বোকা।’
    ছেলে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘তুমি বোকা। কিচ্ছু জান না। কিনে দেবে কিনা বলো।’
    ঝেঁঝে ওঠে ধ্রুব। ‘না, ও খেলি পেট খারাপ করবে। যাঃ।’
    ছেলে তার হাত ধরে ঝুলে পড়ে। ‘না, কিনে দাও। দিতিই হবে।’
    সইদুল তাকে ডাকল। ‘আয়, ইদিকে আয়। তোর বাপ দেবে নে, চাচা দেবে।’
    লুঙ্গির গেঁজ থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে ধ্রুবর ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয় সে। ছেলে লজ্জা লজ্জা মুখে একবার তাকায় বাবার দিকে। ধ্রুব বলে, ‘যাঃ, কিনগে যা।’ তারপর সইদুলের দিকে তাকিয়ে বোকার মতোই হাসে। ‘বোঝো, পেপসির কী বাহারি নাম দেছে!’
    সইদুল গামছায় মুখের, গলার ঘাম মুছে নেয়। ‘তোর আমার দিন নেই রে ভাই। ছেলেপিলে এখন খুব স্যায়না। দেখছি তো আমার দুটোরেও।’
    ধ্রুব বলল, ‘তাদের তো দৌড় দেখতে নিআসতে পারিস একবার।’
    মাথা নাড়ল সইদুল। ‘সে তারা দেখেছে। তাদের মাও গেছে কয়েকবার। আমাদের ওখেনেও তো হয় বোশেখ মাসে।’
    একলপ্তে লম্বা জমি না পেলে ঘোড়দৌড় হতে পারে না। ধান কাটা শেষ হলে কোথাও কোথাও তেমন জায়গা মেলে। সরু ধান হলে চৈত্র মাসের শেষ থেকে বৈশাখের গোড়ায় কাটা শেষ। মোটা ধান কাটা শুরু হয় বৈশাখের শুরুতে। সে মাসেরই পনেরো তারিখ থেকে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে যায় নানা জায়গায়। ক্যানিং, তালদি, মথুরাপুর, পাথরপ্র‌তিমা, রায়দিঘির কয়েকটা দৌড় ঘুরে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সইদুল। ততদিনে তারও চাষবাসের কাজ সারা হয়ে গিয়েছে।
    মাঠে এখন অনেক ঘোড়া নেমে পড়েছে। খয়েরি, কালো, ছাই, সাদা, পাটকিলে। কোনওটা তেজীয়ান, কোনওটা দুবলা। কারও সওয়ারি দড়ি ধরে ঘুরছে। কারও দড়ি লুটোচ্ছে কিন্তু সহিস খেয়াল রাখছে ঠিকই। কোনও ঘোড়া পা ছুড়ছে, চিঁহি চিঁহি ডেকে উঠছে কেউ আবার। ধান কেটে নেওয়ার পর শুকনো খরখরে নাড়াগাদি রয়ে গিয়েছে মাঠের কোথাও কোথাও। তার মধ্যেই শুকিয়ে যাওয়া পুকুর থেকে তুলে আনা কচুরিপানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হয়েছে। এসব টোকাপানা আর ঝুবড়িপানা। তাদের কালো ছাই ছড়িয়ে রয়েছে মাঠময়। ঘোড়া আর মানুষের পায়ে পায়ে উড়ছে। তাদেরই পায়ের চাপে থেঁতলে যাচ্ছে বেঁটে বান গাছের পাতা আর ছোট ছোট সাদা ফুল।
    গান থামিয়ে মাইক আবার কথা বলে উঠল— ‘আমাদের ঘোড়াদৌড় আর কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। এই দৌড়ের প্র‌থম পুরষ্কার চার হাজার এক টাকা, দ্বিতীয় পুরষ্কার তিন হাজার এক টাকা...’
    ধ্রুব জানতে চাইল, ‘কতগুলো ঘোড়া এসছে রে এবারে?’
    ‘বলতেছে তো পঁয়তিরিশটা। আমার লম্বর সাতাশ।’
    ওরা দুজনেই জানে এই দৌড়ের পুরষ্কারের নিয়ম আলাদা। দৌড়ে যে ঘোড়া পনেরো নম্বর হবে তার মালিকও পাবে ন’শো এক টাকা। আর ষোলো নম্বর ঘোড়া থেকে বাকিরা সবাই সাতশো এক টাকা করে পাবে। তবে তারপরেও কথা আছে। সেই কথাটাই বলা হচ্ছে এখন— ‘ঘোড়ার মালিকদের বিশেষভাবে জানানো যাইতেছে যে মাঠে নেমে কোনও ঘোড়া যদি না দৌড়ায় তাহলে পুরষ্কার দেওয়া হইবে কিনা তাহা কমিটি চিন্তা ভাবনা করিবে।’
    দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে। গাছের মাথার দিকে চলেছে জৈষ্ঠের রোদ। সইদুল বলল, ‘আমার এবারে দুটো ঘোড়া ছুটবে জানলি। মাদিটার ছেলে হয়েছে তো।’
    ধ্রুব অবাক হয়ে তাকাল। ‘কই? সে কোথায়?’
    ‘হোই বাঁশবনের কাছে ঘাস খেতেছে। মায়ের রং পেয়েছে। ওরে আমি কচে বলে ডাকি। একখানা হাঁক দিলিই সেখেন থে ছুট্টে আসবে।’
    ধ্রুব মুচকি হাসি দিল। ‘তোর তো তালে এবার ডবল পেরাইজ রে!’
    উদাস মুখে দূরে তাকিয়ে সইদুল। ‘আল্লায় জানে কী জোটে! গা-পোষ জীব তো। বেশি বেশি ছোলা খাওয়াতে পারলি হত। সে আর হয় নে। ওই গমসেদ্দ, খড়, বিচুলি, ভুষি খেতি দি। টাকা পেলে বেশি করে খাইয়ে দোব। কিন্তু বড় পেরাইজ আমাদের কপালে আছে? অ্যাদ্দিনে একটা গোয়লঘর বানাতে পারলুন নি। ঘরের পাশের চালায় রাখতি হয়। মায়ের নাম সাধে দিইছি পাগলি! ছেলেটাকে মাঝেমধ্যিই চাট মারে। তার হাঁটুর কাছে দগদগে ঘা হয়ে গিইছে।’
    ‘ওই কচিটারে তুই দৌড় করাবি! এক বছর বয়েস মোটে!’
    হাত নাড়ল সইদুল। ‘আরে এ তো মানুষের বাচ্চা নয় যে টলমল করবে। এ হল ঘোড়ার বাচ্চা। ছুটিয়ে দেখি না। দৌড়টা শিখুক। দৌড়ের ভিত্‌রে থাকলে দৌড় শিখবে।’
    ধ্রুবকুমার বলল, ‘হ্যাঁ, ঝ্যাত পারিস ছুট করিয়ে নে। পরে পরে আর দৌড় হয় কিনা দ্যাখ।’
    সইদুল খানিকটা চমকে তাকাল। ‘ক্যানে? দৌড় হবে নি ক্যানে?’
    ধ্রুবর ঠৌঁটের ডানদিকের কোনায় হাসির খোঁচা। ‘মাঠ না থাকলি দৌড়টা হবে কোথায়? এই যে গোষ্ঠতলার এই মাঠে হচ্ছে— এ কি একজনার জমি? সবাই মিলে ছেড়ে দেছে তাই হতে পারছে। তোমার জমি তুমি ঘোড়দৌড়ের জন্যি দিলে, লোকের আনন্দ হল। আবার চাষের সময় তুমি চাষ করলে, তোমার আনন্দ হল। সে আর হবে নি। আসছে বছর তারা ঝদি জমি বেচে দেয়, ত্যাখন?’
    ‘বেচে দেবে?’
    ‘দিতিই পারে। সেরমই তো কথা চলছে। আমাদের এখেনে এই ধর বিরিজ পেরিয়ে বাস যেতেছে গড়িয়া, সোনারপুর, বারুইপুর। সোই কবরডাঙা থেকে জুলপিয়া রোড আমতলা অব্দি দৌড় লাগিয়েছে। বাস, অটো, ট্রেকার সব চলছে, বাইক উড়ছে। এখেন থেকে টাটা ম্যাজিক গাড়ি যেতেছে আমতলা, পৈলান। সেখেন থেকে লোকে এরপর মেট্রো রেলে চাপবে। দ্যাখ না দ্যাখ সব পালটে যাবে। কলকাতা এসে খেয়ে নিচ্ছে সব। রোডের ধারের জমি সত্তর-আশি হাজার ট্যাকা কি লাখ ট্যাকায় কাঠা বিকোচ্ছে। কত কোম্পানির লোকেরা জমি কিনবে বলে ঘুরছে। তাদের পোজেক্ট হবে। শালি জমিও নে নিচ্ছে। পরে সব বদল করে নেবে। ডোবা, জলা, পুকুর, ভেরি, ঘেরি, ভেরি সব যেতে লেগেছে। উঁচু লম্বা বাড়ি বানাবে। ফ্যালাট বানাবে। চাষিবাসি মানুষ থাকবে নে, জমিও থাকবে নে। দালাল লাইগে দেছে চারধারে। তারা দিনরাত লোভ দ্যাখাচ্ছে।’
    দৌড় দেখার জন্য চারদিকে লোক যত বাড়ছে তাদের সকলের কথা, হইচইও তত বড় হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই সইদুল বলল, ‘সে আমি দেখনু, তোদের চরবগলাপুরের দিক থেকে যদ্দুর নজর যায়, সব জমিতে মাইলকে মাইল নীল-সবুজ বেড়া বস্যে দিয়েছে।’
    ‘ও ফাইবারের বেড়া সব। চাষের জমির মালিকানা হাতবদল হয়ে গিইছে। ভেতরপানে যাদের জমি তারাও কাঠায় দশ-বিশ হাজার করে দর পাচ্ছে, ছেড়ে দিচ্ছে। এই তো দ্যাখ না, আমাদের ঘরেই কী গোলমাল লেগেছে। বাকি তিনভাই বলতেছে বাপকেলে জমি রেখে কী হবে। চাষ করে আর চলে না। বেচিই দিত। মাঝখানে আমার ভাগের জমি রয়েছে, আমি বেঁকে বসিছি, তাই পারছে না। কিন্তুক আমাদের ওখেনেই সামসুলরা চার ভাই তাদের চারবিঘা জমি তো বেচেই দিল কোম্পানিকে।’
    সইদুল বলল, ‘সে যে দেয় দিক গে। তুই জমি ছাড়িস নে। যেখেনে চাষ সেখেনে বাস। আমার তো বছরে এই ক’টা দিনের বেপার। বাকি সময় তো চাষবাস করেই খেতি হয় নাকি! আমাদের ওখেনে কিন্তু এসব হয় নে।’
    সেই চোরা হাসিটা আবার ফিরে এল ধ্রুবকুমারের ঠোঁটে। ‘হয় নে, হতে কত্‌খন। কোনও জায়গা ছাড় পাবে নি।’
    কথা বলতে বলতেই ধ্রুব খেয়াল করছিল দূরে একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাকাচ্ছে আড়ে আড়ে। তাদের ওদিককারই লোক, ভক্তিপদ পোদ্দার। এবার সে হাত নেড়ে ডাকল ধ্রুবকে।
    এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই ঘাড় বেঁকিয়ে সে বলল, ‘ওই মোসলাটার সাথে তোর কীসের এত কথা রে?’
    ধ্রুবর মাথাটা ঝাঁ করে উঠেছিল। তবু সে বলল, ‘তোর সে খবরে দরকার কী? মোসলমান আমাদের এখেনে নেই! খিরিস্তানও তো আছে। আমরা তাদের সাথে বলি নে?’
    ‘বলবি নে। সব বাইরে থেকে ঢুকে আমাদের দেশে বসে খাচ্ছে। এদের বের করি দিলে দেশটা বাঁচে। দ্যাখ না, সে সময় আসতেছে।’
    ধ্রুব জানে ভক্তিপদ কেন এসব বলছে। কাঁধে কোন পতাকা চাপিয়ে সে এখন ঘুরছে তাও জানে। কত দিক দিয়ে যে কত উৎপাত! বলল, ‘ও লোক তো দৌড়ের জন্যি আসে। কার পাকা ধানে মইটা তুলেছে শুনি!’
    ‘সব দৌড় বন্ধ হয়ে যাবে দেখবি।’
    ধ্রুব হাত নেড়ে বলল, ‘তোরা তোদের মতো দৌড়ো না দেখি। আমরা আমাদের মতো দৌড়ব। শেষাগত কী হয় দেখা যাবে।’
    ধ্রুবর রোখ দেখে পায়ে পায়ে সরেই পড়ছিল ভক্তিপদ। আবার মাইকে গলা ভেসে এল— ‘আমাদের ঘোড়াদৌড় শুরু হতে চলেছে। সওয়ারিদের অনুরোধ করা হইতেছে তারা যার যার ঘোড়া নিয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যান। ওখান থেকেই দৌড় শুরু হবে।’
    ধ্রুব দেখতে পেল সইদুল তার কচে আর পাগলির দড়ি ধরে দুপাশে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে। কাছে এসে সইদুল বলল, ‘দুটোকে এবার এমনিই ছোটাব। পিঠে কাউরে চাপাবুনি।’
    এখানে যেসব ঘোড়া দৌড়োয় তাদের পিঠে জিন থাকে না। ওঠার জন্য রেকাবও নয়। লাফ দিয়ে চড়তে হয়। তবে ঘোড়ার পেটে-পিঠে ঘুরিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হয় সাইকেলের চাকার টিউব। তাতে পা আটকে থাকে আর হাতে ধরা থাকে লাগাম। বেশিরভাগ ঘোড়ার পিঠেই থাকে কোনও বাচ্চা ছেলে। সওয়ারি ওজনে হালকা না হলে চলবে না। তাদের বুকে-পিঠে কাগজে লেখা নম্বর আটকে দেওয়া হয়।
    সইদুল তার ঘোড়াদের নিয়ে চলে যেতে যেতে একবার তাকাল ধ্রুবর দিকে। তারপর বলল, ‘আল্লার বল আর ভগমানেরই বল, দুনিয়া তো একটাই। কত জমি কেড়ে নেবে আমাদের কাছ থে? জমি থাকবে, মাঠও থাকবে। দৌড়ও থাকবে। দৌড় চললি তোর সাথে আমার মেলামেশাও চলবে। আমরা নড়বড়ে না হলিই হল।’
    ঘোড়াগুলো যে পথে দৌড়ে আসবে তার দু’ধারে এখন ঘেঁষাঘেষি লোক। দূরে কলাগাছের সারির গায়ে গায়ে মানুষও সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। পুকুরপাড়ের উঁচু জমিতে জায়গা করে নিয়েছে অনেকে। যারা পেরেছে তারা চড়ে বসেছে আশপাশের গাছের মাথায়। দু-একটা পাকা বাড়ির ছাদেও উঠেছে। কাগজের ভেঁপু পোঁ পোঁ করে বাজছে নাগাড়ে।
    উত্তর দিকে, মাঠের শেষমাথায় দুটো বাঁশ দূরে দূরে খাড়া করে রাখা। তাদের মাঝখানের দড়িতে খিরীশ গাছের ছোট ছোট ভাঙা ডাল ঝোলানো পরপর। ওখানে পৌঁছতে পারলেই দৌড় শেষ। ধ্রুব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে ভিড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বউ, ছেলে-মেয়ে মাঠের উল্টোদিকে।
    দক্ষিণ দিক থেকে হইহই উঠল। দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই আওয়াজের ঢেউ ভেসে আসছে এদিকেও। ওই দেখা যাচ্ছে ঘোড়াদের। কেশর উড়ছে হাওয়ায়। খুরের দাপটে উড়ছে সাদা ধুলো আর কালো ছাই। ছিটকে যাচ্ছে ঘাস-পাতা-খড়ের কুচি। ধ্রুবর সামনে দিয়ে চলে গেল কয়েকটা ঘোড়া। তাদের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে যেন। নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। ধ্রুব দেখতে পেল সইদুলের মাদি ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে আসছে। তার থেকে অনেক দূরে বাচ্চাটা। এই যাঃ, পাগলি তো দাঁড়িয়ে পড়ল। আরে, সে তো উল্টোবাগে চলেছে। হলটা কী? মাকে দেখে ছেলেও থমকে গিয়েছে। কোনওমতে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য সব ঘোড়া। ভিড়ের ভেতরে ভেতরে ধাক্কা বাঁচিয়ে ছুটে আসছিল সইদুলও। ধ্রুব দু’হাতে চাপড় বাজিয়ে গলা ফেঁড়ে উঠল— ‘হেই হেই, ও কচে, দৌড় থামাসনি বাপ। না দৌড়লি মুশকিল। ছোট ছোট।’
    সইদুল পৌঁছতে না পৌঁছতেই ধ্রুবর কথাতেই কিনা কে জানে, বাচ্চাটা ঘুরে দাঁড়াল। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল একবার। তারপর আবার শুরু করে দিল তার দৌড়। রোদ এখন কিছুটা নরম। গাছের পাতায় সে হলুদ রং ধরিয়েছে। সেই রোদই আবার ছায়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে কাত হয়ে এসে পড়ে ছিল মাঠে। সেই আলো আর ছায়ার ভেতরে দুজন মানুষ আর একটা ঘোড়া ছুটছিল খুব।

    "তথ্যকেন্দ্র'এ পূর্বপ্রকাশিত।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১৬ এপ্রিল ২০২১ | ২০৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন