ওরা সংখ্যায় ৪২। ঠিকানা 'ললিতভূমি'। পেশা আর পাঁচজনের চেয়ে একটু আলাদা। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে কিংবা হাতের কাজ নিয়ে বসে দিনটা শুরু করে। কারো বয়স ১২, কারো ২০, তো কারো ৬০। জলপাইগুড়ি রাজবাড়ি পাড়ার অস্থায়ী আবাস ললিতভূমিতে এই মুহূর্তে রয়েছে শহরের ৪২ জন রূপান্তরকামী। যাঁদের সিংহভাগই ভিন রাজ্যের বাসিন্দা।
চিত্রাঙ্গদা' কিংবা' আরেকটি প্রেমের গল্প'বাইরেও রূপান্তরকামীদের স্ট্রাগলের ছবির যে আরও মাত্রা থাকতে পারে, তা বোঝা যায়, পিপাসা, রাজদীপ, আকাশদের দেখলে। জন্মগতভাবে ট্রান্সজেন্ডার হবার ফলস্বরূপ পরিবার আত্মীয় বন্ধুর চোখে এককথায় এরা একটু 'অস্বাভাবিক'। কখনও পরিত্যক্ত কখনও বা বিবাহিত জীবন থেকে বহিষ্কৃত। অতএব আশ্রয়, নিজের বাসস্থান থেকে বহুদূরের কোনো রাজ্যের 'হিজড়ে খোল'।
জলপাইগুড়ির ললিতভূমিও এরকমই একটি বাসস্থান। যেখানে পিপাসারা ঘুরে ঘুরে, কখনও নিজের হাতের কাজের জিনিস তৈরি করে কোনওমতে রুটি রুজির জোগাড় করছে।
স্কুলের শৌচাগারে যাবে। কিন্তু কোন শৌচাগার? পুরুষদের? না মহিলাদের?
যদি বালিকা বিদ্যালয় না হয়ে থাকে, তাহলে সেই শৌচাগারে গেলে যে হয়রানি হয় (তা সে শারীরিক হোক, কিংবা মানসিক)- তা সইবার মত মানসিক জোর ক’জনের ঐ বয়সে? ফলত, ৬-৭ ঘন্টা কিডনিতে চাপ পড়তে থাকে অনেক পড়ুয়ারই। শরীরে কষ্ট হলও বিড়ম্বনা কিছুটা এড়িয়ে চলা যায়।
সমস্যা কিন্তু বাইরে নয় কেবল, ঘরের ভেতরে সবার আগে একটি মেয়ের ‘ছেলে ছেলে ভাব’, কিংবা একটি ছেলের ‘মেয়েলিপনা’ মানতে সবার আগে নারাজ কিন্তু হন গর্ভধারিণী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এই ‘অস্বাভাবিকতা’ বয়ঃসন্ধিকালের এক অভিশাপ রূপে প্রতিভাত হয় চেনা লোকের কাছেই। ফলে প্রিয়জন পরিত্যক্তি, শেষে ঘরছাড়া।
এদের মধ্যে যাদের বয়স ১২ থেকে ১৪-র মধ্যে, বাড়ি ছাড়ার পর তারা আর স্কুলের মুখ দেখেনি। কখনও ভয়, কখনও লজ্জা, কখোনও আবার অভিভবকহীনতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলত, রোজগারের চেষ্টায় নেমে পড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
সমস্যাটা আরো প্রকট হয়ে দাঁড়ায় অসুস্থতার সময়ে। টুকটাক জ্বর, সর্দি ছাড়াও বড় কোনো অসুখ হলে আকাশ, রাজদীপ দের ভরসা করতে হয় হোমিওপ্যাথি কিংবা আয়ুর্বেদ ওষুধের ওপর। কারণ জিজ্ঞাসা করলে পিপাসাদের উত্তর, 'আড়ষ্টতা'।
তাদের কথায়, আমাদের জন্য না আছে স্বাস্থ্যবিমা, না আছে বিশেষ কোনো সুযোগ সুবিধা। সাধারণদের থেকে আমাদের শারীরিক অসুবিধাটা যে কতটা আলাদা, তা অনেকেই জানেন না। তাই অসুখ বিসুখে টোটকা ছাড়া উপায় থাকে না। আইকার্ড পর্যন্ত নেই অনেকের।
ট্রান্সজেন্ডার মেল টু ফিমেলদের অনেকের তৃতীয় যৌনতার স্বীকৃতি নেই। আধার কার্ড, ভোটার কার্ডে তাঁরা রয়ে গেছেন পুরুষ হিসেবেই। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অন্যতম প্রতিনিধি জলপাইগুড়ি শহরের বিশিষ্ট ওড়িশি নৃত্যশিল্পী সৌগত মুখার্জি জানান, “শিক্ষা, কর্মসংস্থান ছাড়াও চিকিৎসার ক্ষেত্রে দুর্দশার অন্ত থাকে না। আমার নাচের স্কুলের অধিকাংশই রূপান্তরকামী। এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ললিতভূমির ভরণপোষণ খানিকটা মেটায়। প্রাক্তন সাংসদের কাছে বহুবার গেলেও কোনো সমাধান হয়নি।” একই কথা জানানো হয়েছিল পুরপিতাকেও।অভিযোগ,তিনি মুখের ওপর বলেছেন, ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে ভাবার সময় নেই’।
তবে ভোটের আগে এঁদের কাছে এসে পড়েন জনপ্রতিনিধিরা। বুঝে কিংবা না বুঝে। ভোটের আগে জেলা প্রশাসনের ইলেকশন ওসি পুষ্পা লেপচা তাঁদের হস্টেলে গিয়েছিলেন ভোট দেবার প্রশিক্ষণ দিতে। সেখানে কেউ কেউ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন -ভোট দেবেন না।কারণ, বহুবার বহু জায়গা ঘুরেও ট্রান্সজেন্ডার ভোটার কার্ড হয়নি।
তবে উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের নালসা রায়ে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। তার পর থেকে ওই শ্রেণির মানুষদের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বীকৃতি খানিকটা বেড়েছে। ভোট-রাজনীতির তাগিদে তাঁদের থেকে দূরে সরে থাকতে পারছেন না কোনও দলই। রূপান্তরকামী-সহ তৃতীয় লিঙ্গের লোকজন সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে কতটা বঞ্চিত, বিভিন্ন জেলায় ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে নেমে তা চাক্ষুষ করেছে রাজ্যের শাসক শিবির। ওই কর্মসূচিতে রূপান্তরকামীদের কাছে খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্পের সুফল ও সুরক্ষা পৌঁছে দিতে তৎপর হয়েছে তৃণমূল সরকার। প্রসঙ্গত, এ বার নতুন ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড চালু হল তিন বছর পরে। নতুন বোর্ডের মেয়াদ তিন বছর। গত ২৫ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রক ট্র্যান্সজেন্ডার পার্সনস (প্রোটেকশন অব রাইটস) রুলস ২০২০ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য জেলাশাসককে আবেদন করবেন রূপান্তরকামীরা। তার সঙ্গে লিঙ্গের বিষয়ে হলফনামা দিতে হবে। জেলাশাসক তা পরিবর্তন করতে পারবেন। কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াই লিঙ্গের সার্টিফিকেট বা শংসাপত্র দিতে হবে’। ওই আইনে বলা হয়েছে, অনলাইন পদ্ধতি চালু না হওয়া পর্যন্ত শারীরিক ভাবে জেলাশাসকের কাছে গিয়ে আবেদন জমা দিতে হবে আবেদনকারীকে। সন্তানের হয়ে তাঁর মা-বাবাও আবেদন করতে পারবেন।
জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু একটি বিশেষ সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন কিছুদিন আগে। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, জেলার মহিলা ও পুরুষ ভোটারের সংখ্যা। অবাক হতে হয়েছে, রূপান্তরকামীদের সংখ্যাতে।লক্ষ লক্ষ পুরুষ, মহিলা ভোটারের পাশে রয়েছে মাত্র ২০ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। অথচ,জেলায় এঁদের সংখ্যা কয়েক হাজার। কিছুদিন আগে রূপান্তরকামীদের সরকারি ভাবে নথিবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। নয়া আইন চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত যাঁরা ইতিমধ্যেই লিঙ্গ পরিবর্তন করে মহিলা, পুরুষ বা রূপান্তরকামীর শংসাপত্র পেয়েছেন, তাঁদের আর নতুন করে আবেদন করতে হবে না। এ বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলিকেও রূপান্তরকামীদের কল্যাণে বোর্ড গঠনের নির্দেশিকা পাঠিয়েছে কেন্দ্র। তাঁদের দাবিদাওয়া মেটানোর পাশাপাশি সরকার থেকে কী ধরনের সাহায্য বা অনুদান তাঁরা পেতে পারেন, সেই সব বিষয় দেখভালের কাজ করবে এই সব বোর্ড। এ ছাড়া তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সচেতনতা-সহ যাবতীয় বিষয়ে জানার জন্য রূপান্তরকামীদের সাক্ষাৎকারের বন্দোবস্ত করার এক্তিয়ারও দেওয়া হয়েছে ওই বোর্ডের।
বাম জমানায় এই লিঙ্গের মানুষেরা যে উপেক্ষিত হয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।‘এক্সপোজার’ ছিল না, ফলে উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে- একথা মেনে নিচ্ছেন সবাই। তবে, রূপান্তরকামীরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, তৃণমূল সরকার আসার পরে বামপন্থীরা তাঁদের নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন।
তৃণমূল নেতা, এস জে ডি এ চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন সাংসদ বিজয় চন্দ্র বর্মণকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অসহায়তা বা অনুন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথমে বুঝতেই পারেননি। খানিকটা সময় লাগল কোন শ্রেণির মানুষের কথা বলা হচ্ছে, তা বুঝতে। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, দেখছি, দেখা যাক কী হয়, ইত্যাদি।
তবে, জলপাইগুড়ির রূপান্তরকামীদের বিষয়টি কানে গিয়েছে খোদ নারী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজার কানেও। তিনি জেলাশাসককে চিঠিও দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। দু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আপাতত, ভোট হওয়া বা না হওয়া কোন দিক থেকেই রূপান্তরকামীদের আশা প্রত্যাশার যোগ বিয়োগের হিসাব নেই বললেই চলে।
স্বাভাবিকভাবেই, পরিবর্তন নিয়ে রূপান্তরকামীরা আশাবাদী নন। তাঁদের মত, গেরুয়া শিবিরের নেতারা ৩৭৭ ধারা নিয়ে রায় পাল্টে দেবার সপক্ষে সোচ্চার হয়েছেন, এই ধরনের যৌনতাকে প্রকাশ্যে ভারতীয় সনাতন সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছেন বারবার।
জলপাইগুড়ির সদর ব্লকের বিধায়ক তথা কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা সুখবিলাস বর্মা বলেন, “বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছুই জানিই না। ফলে, তাদের উন্নয়নও নিয়েও কিছু বলা সম্ভব নয়।”
জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ ডা জয়ন্ত কুমার রায়কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “আমার কাছে কেউ এই বিষয়ে কিছু জানাননি। যদি কেউ জানান, তবে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।”