সুস্মিতা সোম সমাজ সচেতন লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক। অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে সমস্ত কিছুকে বিশ্লেষণ করতে চান। গবেষণার সত্য এবং তথ্যকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি অনুসন্ধান করেন। লোকবিশ্বাস এবং কিংবদন্তি নির্ভর বিষয়কে হয়তো প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেন কিন্তু সত্যকে কখনোই দূরে সরিয়ে রাখেন না। ‘মালদহ রাজ্য-রাজনীতি, আর্থ-সমাজনীতি’ গ্রন্থটি কলকাতার ‘সোপান’ থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৮-তে। আটটি বিষয়সূচি ছাড়াও সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট তিনি ব্যবহার করেছেন। গ্রন্থটির সূচনায় প্রাচীন ভারতবর্ষে গৌড়, গৌড়বঙ্গ ইত্যাদির বিবিধ উল্লেখ করার পাশাপাশি মধ্যযুগে গৌড়ের প্রকৃত অবস্থান, দেশি-বিদেশি রাজা-সম্রাটদের ভূমিকা, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ের পাশাপাশি মালদহ জেলার অতীত-বর্তমান এবং বিভিন্ন জনজাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের পরিচয় দিয়েছেন। প্রাচীন বাংলার ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থার উল্লেখ করে মালদহ জেলায় তা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে— সে সম্পর্কে তিনি পরিচয় দিয়েছেন। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিদ্রোহ ও বিপ্লবের নানা প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরেছেন আলোচনায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মালদহে তার প্রভাব সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় অবতীর্ণ হয়েছেন। জমিদারি প্রথা এবং মালদহে জমিদারদের অতীত-বর্তমান সব কিছুকেই সুন্দর ভাবে আলোচনায় এনেছেন।
মালদহ জেলার অতীত ও মধ্যযুগের ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে প্রাচীন গৌড়পুরের কথা উল্লেখ করে, গৌড় রাষ্ট্রের উদ্ভবের ইতিহাসকে তিনি তুলে ধরলেন। শশাঙ্ক (৫৯০ – ৬২৫ সাধারণাব্দ) থেকে গৌড়ের যে বিবর্তনের ইতিহাস তা ক্রমশ প্রতিষ্ঠা করলেন বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণের মত অনুসরণে।
পাল ও সেন যুগে বারবার এই গৌড় রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তনের ইতিহাসকে তুলে ধরে গোপাল-ধর্মপাল-দেবপাল হয়ে মহীপালদের বৃত্তটিকে যেমন তুলে ধরলেন তেমনি বল্লাল সেন, লক্ষ্মণ সেনদের হাত থেকে কীভাবে ক্ষমতা চলে গেল বখতিয়ারের হাতে তারও অনুসন্ধান করেছেন। ইতিহাসের ঘটনাকে এমনই সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন যাতে মনে হয় সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিনের কথা, লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী যা লাখনৌতি হিসেবে পরিচিত ছিল— সেখানে তুর্কি আমিরদের প্রবেশ এবং ক্রমশ খালজি-মামলুক শাসনাধীন থেকে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহর কথা উঠে এসেছে। ইতিহাসের বিস্মৃত প্রেক্ষাপটে অতীতের সত্যকে কল্পনার ফুলে সাজিয়ে তুললেন। অধুনা মালদহের প্রত্ন-ধ্বংসাবশেষগুলির ইতিহাসের চিহ্নগুলিকেও বর্ণনায় স্থান দিলেন।
গৌড়ে প্রবেশের মূল তোরণ আনুমানিক ১৪২৫ সালে নির্মিত দাখিল দরোয়াজ়া
তুঘরল খাঁ, বলবনি বংশ, তুঘলক বংশ, ইলিয়াস শাহি বংশ প্রভৃতি বংশ ও পরম্পরাকে বর্ণনা করে তাদের সৃষ্ট সৌধ ও কৃতিত্বকে তুলে ধরতে চাইলেন। পাণ্ডুয়া ও আদিনা মসজিদের প্রসঙ্গ এবং হিন্দু-মুসলিম মিলিত স্থাপত্য প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পরিবেশিত হয়েছে। হিন্দু রাজা গণেশ, মহেন্দ্রদের এবং বারবাক শাহ, ইউসুফ শাহের রাজত্বকাল ও কৃতিত্বকে তুলে ধরেছেন। হাবসি রাজত্ব, সুলতান হোসেন শাহের সিংহাসন লাভ এবং হাবসি বিদ্রোহ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। বাংলার সাধারণ মানুষের সহিষ্ণুতা এবং পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে দীর্ঘকাল সহিষ্ণুতার সঙ্গে বসবাস করার দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা গবেষক-প্রাবন্ধিক তুলে ধরেছেন। হোসেন শাহ, নসরৎ শাহ, মাহমুদ শাহ প্রমুখের আমলে বাংলার শান্তি-শৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রীয় শক্তি কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল তার বর্ণনা করেছেন। কদম রসুল মসজিদের কিছু অংশ যে নসরৎ শাহের কৃতিত্ব সে কথা তুলে ধরেছেন। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং শেরশাহের গৌড় আক্রমণের চেষ্টার প্রসঙ্গ বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। গৌড় অধিকার এবং পরবর্তীকালে কালিঞ্জর দুর্গ জয় করার সময় বারুদ বিস্ফোরণে ১৫৮৫ সাধারণাব্দে শেরশাহের মৃত্যু প্রসঙ্গ নাটকীয় ভাবে উঠে এসেছে।
রাস্তাঘাট, সরাইখানা থেকে বাংলার সুশাসনের নানা বিচিত্র প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। প্রাবন্ধিক অতীতের সঙ্গে বর্তমানের মেলবন্ধন করলেন অদ্ভুত ভাবে। ভ্রমণকাহিনির বর্ণনার মতো স্থান-কালকে বর্ণনা করলেন আর তারই সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থানটির ইতিহাস বর্ণনা করলেন। বিদেশি শক্তিগুলি বাংলা তথা ভারতবর্ষকে আক্রমণ কিংবা লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে কীভাবে অগ্রসর হচ্ছিল এবং শাসকরা তা কীভাবে প্রতিরোধ করেছিলেন তার ইতিহাসও উঠে এসেছে আলোচনায়। বিশেষত পোর্তুগিজ অনুপ্রবেশ, তাদের বন্দিত্ব ও মুক্তিলাভের সমস্ত প্রসঙ্গই উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক। কররানি বংশ, ষোড়শ শতকের বাংলা রাজধানী টান্ডা এবং আফগান পরবর্তী মোগল যুগ ও তৎকালীন বাংলার অবস্থা। মানসিংহ-জাহাঙ্গির, শাহজাহান, ঔরঙ্গজেব প্রমুখের পাশাপাশি মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খান, সিরাজ-উদ্দৌলা, মিরজাফর, মিরকাশিম-সময়কালীন বাংলা ও মালদহের পরিবর্তনের নানা ইতিবৃত্ত এবং ইংরেজ আমলের নানা উত্থানপতনময় কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। শুধুমাত্র ইতিহাসের বর্ণনা নয়—ইতিহাসকে আকর্ষণীয় করে সমস্ত প্রকার পাঠকের উপযোগী করে বর্ণনা করলেন লেখিকা।
মির কাশিম (সৌজন্য ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল জাদুঘর)
মির কাশিম পরবর্তী বাংলায় ইংরেজদের উপনিবেশ প্রস্তুত হতে লাগল। ইংরেজ সৈন্যদের খরচ চালাবার জন্য বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম দেওয়া হল। সবই মিরজাফরের মতো পুতুল নবাবের সৌজন্যে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে থেকেই প্রকৃতপক্ষে নবাবি আমল শেষ হয়েছিল। ইউরোপীয়ান কোম্পানিগুলো মালদায় এসে হাজির হয়েছিল নতুন বাজার ধরতে। রেশম সুতো বার করার কাজ এক ফরাসি ব্যক্তির সহায়তায় ইংরেজরা প্রথম শুরু করে এবং জর্জ উডনির উদ্যোগে সিঙ্গাতলায় একটি কুঠি স্থাপন করেন। টমাস হেঞ্চম্যান সিল্ক কাপড়ের ওপর লাক্ষার কাজ করার জন্য পুরস্কৃত হন। মালদহে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র প্রস্তুত হত— চান্দেয়ী, ইলাচী, চারকোনী, নেহালেওয়ার, মঞ্জিল, মলমল, তানজির ইত্যাদি। ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর মকদমপুরের জমিদার রাজা রায়চৌধুরীর কাছ থেকে ১৫ বিঘা জমি মাত্র ৩০০ টাকায় ক্রয় করে কুঠি তৈরি করে যা ক্রমশ ইঙ্গলেজাবাদ থেকে ইংরেজবাজার বা ইংলিশবাজারে পরিণত হয়। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গলেজাবাদ ইংরেজবাজারে পরিণত হয়।
মালদহ জেলা গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে পাঠকের জন্য তুলে ধরলেন। অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই মালদহ অঞ্চলটি পরিচিত থাকলেও ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ পূর্ণিয়া থেকে শিবগঞ্জ, কালিয়াচক, ভোলাহাট, গরগরিবা থানা, দিনাজপুর জেলার মালদহ ও বামনগোলা থানা ও রাজশাহী থেকে রোহনপুর ও চাঁপাই থানা নিয়ে মালদহ গড়ে উঠল। মুরশিদাবাদের নবাব মিরকাশিম প্রদত্ত দুটি তামার তৈরি বড়ো আকারের নাকাড়া ডঙ্কা, বেশ কিছুকাল আগেও দেখা যেত। এই ডঙ্কা মাদারি পিরদের প্রতি আনুকূল্যের নিদর্শন। ক্রমশ ভুতনিদিয়াড়া, সাঁওতাল পরগনা থেকে পূর্ণিয়ার মালঞ্চা মালদহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সীমান পরিবর্তন ঘটে এবং ভাগলপুর বিভাগ থেকে রাজশাহি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে। অনেক স্থান নামেরই বারবার পরিবর্তন হয়েছে। ভোলাহাট থানার নাম হয় ইংরেজবাজার। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের কারণে জেলার থানাগুলির বিভাগ হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারে। স্বাধীনতা দিবসের ক্ষেত্রেও মালদহ শহর ও জেলা সংকটে ছিল। মালদহের প্রথম জেলা সমাহর্তা ছিলেন ড. এম কে আচার্য (আইসিএস)। ইংরেজবাজার এবং ওল্ড মালদা পৌরসভা গড়ে ওঠে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। তথ্য বলছে ১৮৫৬ সালে চৌকিচারী ইউনিয়নের স্বীকৃতি পায় ওল্ড মালদা। পুরাতন মালদার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন শ্রীকৃষ্ণমোহন দাস। এই ধরনের অসংখ্য তথ্য ভরা রয়েছে গ্রন্থটিতে। বসন্ত, কলেরা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি রোগ ১৯৩০-৪০-এর সময়ে মালদহে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। পৌরসভার রাজস্ব আদায় ও উন্নয়ন এবং রাস্তাঘাটের সংস্কারের নানা প্রসঙ্গ আলোচনা সূত্রে এনেছেন।
লক্ষণাবতি টাঁকশালে তৈরি মুঘিত অল-দিন ইউজ়বকের (১২৫৪-১২৫৭) রৌপ্যমুদ্রা
সুলতানি যুগের লক্ষ্মণাবতি টাঁকশাল, ফিরুযাবাদ, শহর নও জন্নতাবাদ, মাহমুদাবাদ, বারবকাবাদ ইত্যাদি টাঁকশালের কথা তুলে ধরেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে। পঞ্চদশ ষোড়শ থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত মালদহ অঞ্চলের ব্যাবসাবাণিজ্য ও সমৃদ্ধির নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নানা তথ্য তিনি পরিবেশন করেছেন। নৌশিল্প এবং কৃষিজ ফসল সম্পর্কেও বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। ধান, আখ, বাঁশ ছাড়াও কাঁসাজাত সামগ্রী, স্বর্ণ-রৌপ্য সামগ্রী, কার্পাসজাত সামগ্রী অর্থনীতির মূল ছিল। এ ছাড়াও রেশম বস্ত্র, পাটজাত সামগ্রী, নীল, আম, তামাক, মাছ ও সবজি, প্রাণী সম্পদ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে চলেছে। মালদহের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের কথাও বিভিন্ন সূত্রে আলোচনায় স্থান পায়।
অতীত বর্তমানের প্রেক্ষিতে জেলা মালদহে বসবাসকারী মানুষের সাহায্যে কীভাবে সামাজিক কাঠামোটি গড়ে উঠেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক সময় পর্যন্ত যে সামাজিক বিন্যাস বারে বারে বদলে গেছে তার নানা উদাহরণ দিয়েছেন। পাল-কৈবর্ত সংঘাত এমনই উদাহরণ। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের নানা পরিবর্তনও উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক-গবেষক লেখিকা। দস্যু-জলদস্যুদের বারবার আক্রমণের সামাজিক বিন্যাসের নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন বর্ণনাকেও তুলে ধরেছেন। মৈথিল এবং মুসলমান অধিকার মালদহের শুধু নয়, বাংলার জাতি-ধর্ম এবং সমাজ ব্যবস্থাতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। মগ-ফিরিঙ্গি অত্যাচারের প্রভাব এবং শ্রীচৈতন্য সমকালীন বাংলার আর্থসামাজিক নানা ক্ষেত্রকে প্রতিফলিত করেছেন লেখিকা। শারশাহবাদিয়া, নদেগুষ্টি, হোসেনা গোয়ালা, চামকাটি মুসলমান, নেড়ানেড়ি, সখী ভাব বৈষ্ণব, মতুয়া সম্প্রদায়, ডোরাবাধা ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলির উদ্ভব ও নানা কার্যকলাপের চিত্রকে অঙ্কন করেছেন। দুর্ধর্ষ ঠিয়াপাতি সম্প্রদায় এবং বাংলার ডাকাত ও ডাকাতির ক্ষেত্রে মালদহ জেলার ভূমিকা। বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ইতিহাসের রূপরেখার সঙ্গে সামাজিক রূপান্তরিত কাঠামোয় রাজবংশী, কিষাণ, চাঁই, সাঁওতালি, সদগোপ, বারুই ইত্যাদির সঙ্গে হরিজন সম্প্রদায় এবং ডাইনি ও ডাইনি প্রথা সম্পর্কেও নানা তথ্য তথ্য পরিবেশন করেছেন।
প্রাচীন বাংলার ভূমি ও রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। রাজস্ব ব্যবস্থার নানা চিত্র হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। ভূমির প্রকারভেদ ও মূল্য সম্পর্কে নানা বিবরণ এবং সুলতানি যুগের কর কাঠামো, গ্রামীণ কর ব্যবস্থা, বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও কর কাঠামো, মোঘল সম্রাট আকবরের আমলের রাজস্ব ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মুর্শিদকুলি খাঁ, সুজাউদ্দিন খাঁর আমলের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার পরাজয় এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তার প্রভাব তথা পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, পাঁচশালা বন্দোবস্ত, দশশালা বন্দোবস্ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ও রাজস্ব ব্যবস্থা এবং প্রাচীন ভারতে স্থানীয় সরকার বিষয়ে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার স্বায়ত্তশাসন, বঙ্গীয় স্বায়ত্তশাসন আইন, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ইত্যাদি বিষয়গুলির সঙ্গে মালদার ইংরেজবাজার পৌরসভার কর আদায় ব্যবস্থা পৌরপতিগণের অবদান এবং বিভিন্ন জনমুখী উন্নয়নমূলক ভাবনার কথা ধরা পড়েছে। প্রসঙ্গত যদুনন্দন চৌধুরী, পঞ্চানন মজুমদার, উপেন মৈত্র, নীলমণি ঘটক, মহ. জিয়াউদ্দিন প্রমুখের অবদানের কথা উঠে এসেছে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মালদহ অঞ্চলের মানুষের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের নানা পরিচয় উঠে এসেছে ‘বিদ্রোহ ও বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে অতীত ও বর্তমানের মালদহ’ অংশটির মধ্যে। গৌড়বঙ্গের মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গোপালের মতো জনকল্যাণের জন্য রাজা নির্বাচন সমগ্র দেশের জন্যই গর্বের। বরেন্দ্রভূমিতে দীব্বকের নেতৃত্বে কৈবর্ত বিদ্রোহ, ধর্মীয় আন্দোলন ও তার প্রেক্ষিতে মালদহের সামাজিক পরিকাঠামো নানা ভাবে পরিবর্তিত হওয়ার কথা উঠে এসেছে। নীল বিদ্রোহ, কৃষক বিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে ক্ষত্রিয় সমাজে ধর্মীয় আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনের প্রসঙ্গগুলি বিস্তৃত ভাবে বর্ণিত। উইলিয়াম কেরি মদনাবতীতে এসে কীভাবে তাঁর বিস্তৃত ক্ষেত্রটিকে তুলে ধরেছিলেন এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলিতে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলা ভাষার উন্নতিতে তাঁর অবদান এবং মদনাবতীতে মুদ্রণ যন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক তথ্য পরিবেশন করেছেন লেখিকা। মালদহ জেলায় বন্যা বিধ্বস্ত কালিয়াচক, রতুয়ায় বন্যা বিধ্বস্ত মানুষের আন্দোলনের কথাও গ্রন্থের মধ্যে ধরা পড়েছে। ধরা পড়েছে বস্ত্র সংকট চলাকালীন মালদহের মানুষের দুর্দশার কথা।
মালদহের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মালদহে তার প্রভাব বিষয়ে এই অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে নানা প্রতিবাদী আন্দোলন এবং বাংলা ভাগের পরিকল্পনা এবং স্বদেশি আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির ভূমিকার কথা আলোচনায় স্থান পেয়েছে। জাতীয় শিক্ষা সমিতি এবং শিক্ষা আন্দোলনে মালদহবাসীর ভূমিকা, জাতীয় শিক্ষা সমিতির প্রতিষ্ঠা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, এবং গণ আন্দোলনের প্রথম পর্বের নানা তথ্য, রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন—মালদহ জেলায় তার প্রতিক্রিয়া বিষয়ে বিশদে আলোচনা করলেন প্রাবন্ধিক। খাদি ভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠা লগ্নে সামাজিক সচেতনতা এবং বিপ্লবী যতীন দাসের মৃত্যু এবং সমগ্র জেলা ব্যাপী তার প্রভাব কীভাবে মানুষের মনে স্থান পেয়েছিল তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। মালদহ জেলায় নঘরিয়া অধিবেশন, কৃষক সভা ও নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আগমন, বামপন্থী শক্তিবৃদ্ধি, মালদহবাসীর মনে তার প্রভাবের নানা পরিচয় রয়েছে। আইন অমান্য আন্দোলন এবং মুসলিম লিগ ও হিন্দু মহাসভার প্রভাবের নানা প্রসঙ্গ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জেলায় দুর্ভিক্ষ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের যে ব্যাপক প্রসার তার বিচিত্র চিত্র আলোচনায় এসেছে। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের প্রসঙ্গটি সেভাবে আলোচিত হয়নি এ কথা হয়তো ঠিক তবুও সাম্প্রতিক ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গটি সঠিক ভাবেই স্থান পেয়েছে। স্বাধীন ভারতে উদ্বাস্তু সমস্যা এবং মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটের প্রসঙ্গ এসেছে। গ্রামে, জেলায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাগুলির ভূমিকা—মালদহ সমাচার, গম্ভীরা পত্রিকা, গৃহস্থ, মূরলী, স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থান আলোচিত হয়েছে। হরিশচন্দ্রপুর, ভালুকা, পিপলা, সিংহাবাদ, চাঁচল, কলিগ্রাম, মানিকচক, দিয়ারা, বুলবুলিচণ্ডী, কালিয়াচক প্রভৃতি অঞ্চলের বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্দোলনকারীগণের প্রসঙ্গ যথেষ্ট শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। মালদহের সুযোগ্য সন্তান হিসেবে বিনয়কুমার সরকার, রাধেশচন্দ্র শেঠ, হরিমোহন ঝা, কুমুদনাথ লাহিড়ী, বিপিন বিহারী ঘোষ, প্রিয়নাথ সেন প্রমুখের পাশাপাশি দুর্গাকিংকর ভট্টাচার্য থেকে দোকড়ি চৌধুরী প্রমুখের জীবনী ও কর্ম কৃতিত্ব বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে মালদহের মহিলারা যে পিছিয়ে ছিল না তার পরিচয় পাওয়া যায় সুধারানী দেবী, সুরেন্দ্রবালা রায়, তরুবালা সেন, রেণুকা লাহিড়ী প্রমুখের আলোচনা প্রসঙ্গে। আলোচনার সূত্র ও তথ্যগুলি সংগ্রহ করে তার যথাযথ ব্যবহার করেছেন প্রাবন্ধিক।
মালদহ জেলার অতীত বর্তমানের জমিদারি প্রথা ও কয়েকজন জমিদার বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জমিদারি প্রথার উদ্ভব এবং তার ক্রমবিকাশের ধারা, মালদহ জেলার কথা তুলে ধরেছেন। বাইশ হাজারি এস্টেট, ষষ বা ছয় হাজারি এস্টেট, বাংলার মহাশ্মশান পরবর্তী জমির চরিত্র এবং বাংক্লার ডাকাত ও জমিদারির একটি আন্তঃসম্পর্কের প্রসঙ্গ আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। কৃষি ব্যবস্থায় নীল চাষ প্রসঙ্গ এবং শাসন-শোষণের বিষয়গুলি উঠে এসেছে। জমিদার হিসেবে সুখ্যাতি ও কুখ্যাতির কথা উঠে এসেছে। হরিশচন্দ্রপুর জমিদারি, বিরুয়া জমিদারি, আলাল জমিদারি, অমৃতি জমিদারি, ইংরেজবাজার জমিদারি, মথুরাপুর, মালতিপুর, আইহো প্রভৃতি জমিদারির কথা উঠে এসেছে। জমিদার এবং তাদের বংশ পরিচয়, বর্তমানে তাদের অবস্থান এবং জমিদারদের কৃতিত্বের কথা নানা ভাবে আলোচনায় স্থান পেয়েছে।
আলোচনার ভাষা প্রাঞ্জল, পাঠকের উপযোগী। অনেক তথ্য সমাবেশ করেছেন আকর্ষণ বৃদ্ধির কারণে। যদিও মুদ্রণ প্রমাদ অনেকটাই কম তবুও তথ্য সন্নিবেশের ক্ষেত্রে পুনরুক্তি ঘটেছে অনেক ক্ষেত্রে। ‘অমৃতি’ই যে প্রাচীন ‘রামাবতী’ নগরী এ বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। ইটাহার সংলগ্ন ‘আমাতি’ গ্রামকেও অনেকে চিহ্নিত করেছেন। সহায়ক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করলেও গ্রন্থকার তথ্যসূত্র বা পাদটীকা সেভাবে দেননি। কিংবদন্তি এবং লোকমুখে প্রচারিত তথ্য সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পৌরাণিক-ঐতিহাসিক বিষয় অনেক সময় একই মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে লেখিকার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে—একটি গ্রন্থে সমগ্র মালদহের অতীত ও বর্তমানকে বন্দি করার মধ্যে। সোপান প্রকাশনার সুন্দর ছাপা এবং ভালো পাতা ব্যবহারে বইটির মর্যাদা বজায় রেখেছে।