“On a cloudy morning when a thick mist lay like a shroud obliterating everything all around, I suddenly found myself returning to poetry after long pause and a number of poems kind of wrote themselves out at one go.”
— Sankha Ghosh (Prologue. Gaandharva Poems. Paschim Banga Bangla Akademi. 2003.)
‘‘কে আমাকে ডাকল, আমি জেগে উঠলাম…
… কে আমাকে আনল গুহার তলে।
পাথরগুলি বিস্ফার চায়, তারার মতো জ্বলে,
দুয়ের মধ্যে শূন্য আসে বিশ্বভূবন জোড়া
কে আমাকে ডাকল সেই শূন্যে ঝাঁপ দিতে
রক্তমুখী চূড়ার থেকে সজল পৃথিবীতে!’’
‘‘I went out into the roaring wind and paced to and fro along the bastions... suddenly I stopped, for it seemed from the midst of the storm a voice had called to me…”
Rainer Maria Rilke
(Scloss Duino, near Triste. January 1912)
“Who, if I cried out, would hear me among the Angelic Orders?’’
--- Rilke (First Duino Elegy. January, 1912)
“All in a few days, there was a nameless storm, a hurricane, in my mind, everything in the way of fibre and web in me split.”
Rilke (Letter to Princess Marie von Thurn. February 11, 1922)
“For beauty’s nothing
but beginning of terror we are still able to bear,
and why we adore it so because
it serenely disdains to destroy us.”
Rilke (First Duino Elegy)
আল্প্স এবং হিমালয় পর্বতমালার মাঝখানে কোথাও, একই বিন্দুতে এসে মেশে দুটি, ‘দেবদূত’ ও ‘গান্ধর্বরা’, স্থান ও কাল পার করে, সম্বোধন করে, আবাহন করে, প্রোচিত করে গান।
ঠিকই। কিন্তু উড়াল আর অবতরণ ভিন্ন কাহিনি। তেমনই এই দুই কবির মধ্যে মহাকাশচারী অস্তিত্বদের যে খেলা তা দুই ভিন্ন সফর।
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের আবর্তে লিপ্ত হওয়া সহজ সফর নয়। তা সংঘাতের মুখোমুখি হওয়া এবং মনুষ্যমানসের গভীরতম অন্ধকার অঞ্চলে ঝাঁপ দেওয়া। এ সফরে দারুণ বিপজ্জনক ঘূর্ণিতে জাল ফেলেন কবি, উঠে আসে হাঙরেরা এবং তাদের মুখে আবিষ্কার করেন পরম মাধুরী। সেই মাধুরী যা ছড়িয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন করে প্রতিটি দেশ, শহর।
‘‘আর আমি সেই লোভে ঘূর্ণিপাকে মায়াজাল ছুঁড়ে
তুলেছি হাঙর, আর তারই মুখে হেরে মাধুরী।
সে-মাধুরী কী দিয়ে যে খুঁড়ে গেছে সব গঞ্জ গাঁও
এ অন্ধগলিতে বসে তুমি কি জানতেও পাও সেটা?’’
‘‘প্রতিটি ক্ষতের মধ্যে অর্বুদ কালের মাইল মাইল
পথ পড়ে আছে তবু মনে হয় এত কাছাকাছি।
কিন্তু তারও জ্যোতি ছিল, সে ক্ষতর, স্রোতোবেগ ছিল
পাথর-ঘষটানো মুখে পাথরের ভাস্বরতা ছিল
বাণীর বিবাহ ছিল এক সেল থেকে অন্য সেলে।’’
শব্দ কবিতা হয়ে যায়।
অদর্শনের অন্ধকার থেকে জেগে ওঠার সহসা যে ডাক শোনা যায়, তার এবং গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের আবর্তের ছত্রিশটি কবিতার শেষ কবিতাটি—যেখানে কবি অন্তর্দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত দেখেন বন্ধু-হয়ে-ওঠা গান্ধর্বকে যে দেখে আত্ম-র ‘অন্য’-কে এবং শোনে তাঁর স্বর—এ দুইয়ের মাঝখানে পাঠক হিসেবে আমরা রাত্রির পথে এক দীর্ঘ দিনের সফরে রওনা হওয়ার আমন্ত্রণ পাই (ইউজিন ও’নিল-এর সেই নাটকের কথা কি স্মরণে আসে?— A long day’s journey into night!) — সে সফর হৃদয়ের, অন্বেষণকারীর নয়, কবির।
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছের বহু কবিতার জেরা করার ভঙ্গি ব্যক্তিগত থেকে ঐতিহাসিকের মধ্যে, পার্থিব থেকে আধ্যাত্মিকের মধ্যে যাতায়াত করে। পাথর, বাতাস, জল, আগুনের মতো কঠিন ও তরল উপাদানের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে নিরন্তর প্রবহমানতায় এবং ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে ফেটে-পড়া সংঘাত প্রায়শই ইঙ্গিতগর্ভ মীমাংসায় পৌঁছোয়। বাতাসে সারাক্ষণ এক নয়া জন্মের সম্ভাবনা ভেসে বেড়ায়।
‘‘গান্ধর্ব তুমি আজও আমারই এ চোখ দিয়ে দেখো
আমারই ছোঁয়ার নীচে বর্তুলে গহ্বরে এ পাহাড়
নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে নতুন জন্মের প্রতীক্ষায়—… ’’
কিন্তু এ সব ‘ঘটনার’ অধিকাংশই ঘটে পরিমিত গীতিকাব্যময়তার নিয়ন্ত্রণে। কবির মন্থনের ফলে যে বিস্ফোরণ ঘটে তা নাচের মতো ঘোরে ফেরে। ত্রাস, হিংসা এবং অজানা অন্ধকার শক্তিকে পরিশিলিত গতির নিয়ন্ত্রণে আনা হয়, ফলে বেজে ওঠে এক অন্তরঙ্গ কনসার্ট, যেন বেজে চলেছে বেঠোফেনের জীবনের শেষ দিকে রচিত স্ট্রিং কোয়ার্টেটের কোনো একটি।
শঙ্খ ঘোষ পাঠ। শিল্পী প্রবোধ পারিখ। জলরং
আমি যখন শঙ্খ ঘোষকে তাঁর নিজের কবিতা পড়তে শুনি, কে যেন আমাকে সেই অন্তরঙ্গ পরিসরে টেনে নিয়ে যায়, যে পরিসরে কবিতাটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও শব্দতরঙ্গ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, কানে বাজতে থাকে।
‘‘Music heard so deeply that
it is not heard at all,
but you are the music
While the music lasts.’’
T. S. Eliot (The Dry Salvages. Four Quartet)
শঙ্খ ঘোষের কবিতাপাঠের এই যে প্রক্রিয়াটি, এ নিয়ে কিছু বলি এবার। তবে সেটা বলব ফরাসি সাহিত্যিক এল্যান সিক্সু-র কিছু কথাকে নিজের মতো করে নিয়ে। শঙ্খ ঘোষের কবিতাগুলি রয়েছে, আমি তাদের দিকে তাকাই, শুনি, তাদের ভঙ্গিমা ধারণ করি, অক্ষর থেকে অক্ষরে তাদের অনুসরণ করি।
‘‘ডানায় রক্তের দাগ, উড়ে তুমি কোথা থেকে এলে
এই অশথের নীচে দুদণ্ড জিরোও, এর নীচে… ’’
আশ্চর্য এক বিদেশি পথে আগন্তুক, কিন্তু পথ হারানোর কোনো ভয় নেই, আমি এই কবিতাগুলিকে ছুটতে দিই আমার আগে আগে এবং একটি মাত্রার জন্যও তাদের অনুসরণ করা ছাড়ি না, চলি যেখানে তারা আমাকে নিয়ে যায়। একটি ধীর পদক্ষেপের পর আর-একটি ধীর পদক্ষেপে ‘পার্কস্ট্রিট থেকে গড়িয়ায় / আর তার মুক্তদেশে সোনালি সপ্তর্ষিরেখা রেখে’! চলে যাই গ্রামে গ্রামান্তরে, শহরে শহরে, ময়দানে, সেইসব জায়গায় যেখানে কোনোদিনই যাইনি। গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছে সওয়ার হয়ে আমি চলি, তিলমাত্র ভয় নেই যে পৌঁছাব না হয়তো।
বাংলা সামান্যই জানি, এখন আমি শঙ্খ ঘোষ পড়া শুরু করেছি আমাদের গুজরাটি বাচনেই।
‘‘What we don't know in our language, we recognise it in another language.’’
Helen Cixous
এবং গান্ধর্বকে অন্তর থেকে আবাহন করে কবির সঙ্গে গাইতে থাকি।
‘‘আমাকে ডেকেছ কোন দূরাগত শব্দহীন স্বরে
কার্পেটে পশমে নিয়ে গিয়ে বলেছ: ‘দাঁড়াও এইখানে
দেখো এই আলো তুলে’—ভৌতিক প্রচ্ছদ খুলে দেখি
গথিকের হৃৎপিণ্ডে রক্তচোষা কালো গর্ভঘর!’’
কাজেই, এই কবিতাগুচ্ছের সঙ্গে আমাদের সফর পৃথিবীর ওপরে/নীচে।
রবি ঠাকুর-শঙ্খ ঘোষ যুগলবন্দি। শিল্পী প্রবোধ পারিখ।
শঙ্খ ঘোষের কবিতা ও তাঁর গদ্যের কাছাকাছি যতই এগোচ্ছি, রবি ঠাকুরের প্রসঙ্গ আনার যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি একাধিক।
‘‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়; … ’’
(শেষ লেখা। ১৩ মে, ১৯৪১)
আমার কানে কানে এ কি শঙ্খ ঘোষ কথা বলছেন?
‘‘শূন্যতার বাণী ওঠে করুণায় ভরা… ’’।
(শেষ লেখা। ২৬ মার্চ, ১৯৪১)
নাকি আমি আমার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীতগুলির সম্পদ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি বিদ্যাসাগর আবাসনের পথে?! যাতে তিনি আমায় পথ দেখান। নাকি তাঁর ‘না’ কবিতাটি স্মৃতিপথে আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে ‘ততঃকিম্’ পুনঃপাঠে?
‘তারপর কী?
পা থেকে মাথা, মাথা থেকে পা
তারপর?’’
কেন আমি বারবার ফিরে যাই জাবাল সত্যকামে?
‘‘কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনম। গিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে, গুরু কহিলেন মোরে—
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের কাছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যা লাভে। মাতঃ, কী গোত্র আমার?’’
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ব্রাহ্মণ। কথা ও কাহিনী)
‘‘আমরা দুজনে এই বিকেলের কুয়াশা মাখিয়ে
দেখেছি খেতের আর দেখেছি ক্ষতের মুখোমুখি
স্তব্ধতা পোহায় হিম আলপথে সারসের পায়ে।’’
‘‘যেসব মানুষ নেই, যেসব মানুষ মরে গেছে
যেসব মানুষ তবু কথা বলেছিল একদিন
দ্বাদশীর রাতে তারা আমার বাঁকের কাছে এসে
সরাসরি প্রশ্ন করে: বলো কাকে বলে বহমান।
যেসব মানুষ আজও কষ্ট পায়, যেসব মানুষ
শুধু বেঁচে আছে বলে মরে যেতে পারে বারেবারে
তাদের ক্ষতের নীচে আমার চুমুর শব্দ শুনে
কেউ-বা ঘুমিয়ে পড়ে অতর্কিতে ডালপালা ফেলে।’’
‘‘… এসো কবি, অখ্যাতজনের
নির্বাক্ মনের।
মর্মের বেদনা যত করিয়ো উদ্ধার—
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।
অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি
তাই তুমি দাও তো উদ্বারি।
সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়—
মূক যারা দুঃখে সুখে,
নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,
ওগো গুণী,
কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।
তুমি থাকো তাহাদের জ্ঞাতি,
তোমার খ্যাতিতে তারা পায় যেন আপনারি খ্যাতি—
আমি বারংবার
তোমারে করিব নমস্কার।’’
--- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্মদিনে)
এ কি রবি ঠাকুর কথা বলছেন শঙ্খবাবুর সঙ্গে? ১৯৪১-এর ২১ জানুয়ারি?
চলন ভারি সুন্দর। শংখবাবুর ভাবনার একা হওয়ার, একা হয়ে দেখার।জ্যামিতিক পরিসরে বাাঁধার নয় বরং নিজের থেকে নিজেকে বের করে উড়ে বেড়াাানোর।
যেমন সমৃদ্ধ লেখা তেমনি অনুবাদ। স্কেচ ছবি সবমিলিয়ে যেন এক অনন্য অনুভূতি তৈরি হল।