‘‘গান কেউ অন্ধকারে নিজে নিজে লেখেনি কখনো
আমাদের সকলেরই বুকে মেঘ পাথর ভেঙেছে
সে শুধু তোমার জন্য, গান্ধর্ব, তোমার হাত ছুঁয়ে
এই শিলাগুল্মগুলি চিরজাগরূক বোধ নিয়ে আসে’’
এ গ্রহের যতেক নদীতে তুমি স্বচ্ছন্দে আছো, এমনটাই আমি কল্পনা করতে চাই
আছো অরণ্যের অজস্র অক্ষরে
তোমায় সঙ্গ দেয় তারা
ট্রামে জোড়াসাঁকোর পথে
হাঁটে কদমে কদম রেখে তোমার সঙ্গেই
যত মিছিলে, ধীরে, ভেসে-যাওয়া একফালি মেঘের মতন!
কল্পনা করতে চাই, স্বচ্ছন্দে রয়েছো তুমি রাত্রি যখন বদলে যায়
কথোপকথনে সেই সব পথের সঙ্গে কোনও মানচিত্রে নেই চিহ্নমাত্র যার
উৎকণ্ঠিত শহরপটে ঢুকে পড়ছো তুমি
কর্কশ শোরগোলে ভরা অন্ধকার যত অলিতে-গলিতে, যারা গান গায়
সব ট্র্যাফিক জ্যাম ফিকে হয়ে গেলে
কল্পনা করতে চাই, মেঝেহীন অলিন্দগুলির এ কোণে ও কোণে
স্বচ্ছন্দে সুস্থিত তুমি
সকালের ধারালো রোদ্দুর যেন
সন্ধের আকাশের মতো লেফাফার অন্দরে
তখন নির্ভার, ভাসমান মেঘেদের লৌহ দরোজার থেকেও নির্ভার—
দেখে চলেছো সব, করে চলেছো প্রতিধ্বনি
হাতে হাত
উৎসবমুখরতা থেকে চলেছো তুমি
নিথর নীরবতায়
চার দেয়ালের—
হাতির সেই কানের খুব কাছে চলে যেতে চাই
প্রতিটি তালের বদলে কেঁপে ওঠে যেই কান
প্রদক্ষিণ করে চলে সেই সব মুখমণ্ডল, যারা হাতড়িয়ে ফেরে
ঠিক সেই শব্দ যার খুবই প্রয়োজন
আশ্রয় খুঁজে সেই সবকিছু থেকে যা নেই কোথাও কোনোখানে
তাদের ভুবনে
না, অপু আর দুর্গা কিংবা তেমনই অসংখ্য বাচ্চার মতো রেলগাড়ির খোঁজে দৌড় দেওয়া, পাকশী গ্রামে চরকি কাটা শঙ্খকে আমি দেখিনি। রবি, ঋত্বিক, সোমনাথ হোর বা আরও অনেকের মতোই পদ্মাপাড়ের রূপপুর, শাপুরের মতো প্রত্যন্ত গ্রাম ও ছোটো ছোটো জনপদের কোলে কোলে ডিঙি বেয়ে ভেসেও বেড়াইনি আমি।
সে ১৯৮১-র কথা। মানবেন্দ্র বন্দ্যেপাধ্যায় আমায় পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর সাদা-কালো সহকর্মীর সঙ্গে। যদি আমার খুব ভুল না হয়ে থাকে, আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি রুমে দু-এক রাউন্ড টেবিলটেনিসও খেলেছিলাম সেদিন।
দুটো ছবি আমার মনের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কেবলই: সারা দুনিয়া থেকে আসা পিকচার পোস্টকার্ড খচিত দেয়াল থেকে দেয়ালে ঠাসা বইয়ের আলমারি ঘেরা তাঁর ‘বই’ঠকখানায়(!) কথপোকথন চলছে রবীন্দ্রসংগীত ঘিরে, শুনছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো, দেখছি তাঁর অনুপম শরীরী ভাষার নানা ভঙ্গিমা—এই এক ছবি; আর-এক ছবি—স্থিতি, গতি, লয়—এই তিনের ধারণার রকমফেরে কবি ও সুপণ্ডিত শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথ পাঠের যে পথরেখা তৈরি করেছেন, তা থেকে উৎসারিত কাব্যরস নিয়ে নাগাড়ে বলে চলেছেন প্রবাল দাশগুপ্ত।
না, আরও একবার হেসে আমাকে শঙ্খ ঘোষ বলেন, মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়।
না, শঙ্খ ঘোষের জিনিয়াসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত নয় গুজরাট, যথেষ্ট পরিচিত নয় ‘ছন্দোময় জীবন’ কিংবা ‘ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার’-এর ইস্তেহারের সঙ্গেও।