ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর জীবন নিয়ে দুটি লেখাকে একত্রিত করে এই বই। একটি লেখা স্বয়ং দেবীপ্রসাদের, অন্যটি তাঁর স্ত্রী চারুলতা রায়চৌধুরীর। ‘নিজের কথা’ নামে দেবীপ্রসাদের এই আত্মজীবনীমূলক রচনাটি ১৯৪৮ সাল থেকে ‘শনিবারের চিঠি’-তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। চারুলতা রায়চৌধুরীর মূল রচনাটি ইংরেজিতে। নাম, ‘Life with an Artist’। এটাও ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হযেছিল ‘The Modern Review’ পত্রিকায়, ১৯৬২ সাল থেকে। এটি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা অনুবাদে ১৯৬৪ সাল থেকে ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দেবীপ্রসাদ এবং তাঁর স্ত্রী চারুলতার এই দুষ্প্রাপ্য রচনাদুটিকে সংকলন করে এই বইটি সম্পাদনা করেছেন শিল্প সমালোচক ও শিল্প ইতিবৃত্তকার প্রশান্ত দাঁ।
শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী ও স্ত্রী চারুলতা
বাংলার এক প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের সন্তান দেবীপ্রসাদকে শিল্পী হয়ে ওঠার পথে প্রচুর বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ‘নিজের কথা’ নামে এই রচনাটিতে তার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। নিজের ডানপিটে স্কুলজীবনের নানা মজার ঘটনাও এখানে লিখেছেন তিনি। লিখেছেন তাঁর সার্কাসে খেলা দেখানো থেকে শুরু করে আরও নানা দুরন্তপনার কথা। সন্তানের পেশাদার শিল্পী হওয়া, তখনকার দিনের সম্ভ্রান্ত ধনী জমিদার পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া ছিল কল্পনার অতীত। দেবীপ্রসাদের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। দেবীপ্রসাদের পিতা আপত্তি না করলেও তাঁর পিতামহ এবং মাতৃকুলের সকলেই দেবীপ্রসাদের শিল্পশিক্ষার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে দেবীপ্রসাদের পিতা উমাপ্রসাদ ও তাঁর পরিবারকে অচ্ছুত করে দেওয়া হয়েছিল। এজন্য অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে দেবীপ্রসাদকে। কখনও তিনি একরঙা ছাপা ছবিতে রং করার কাজ করে গেছেন, কখনও বা তাঁকে পথে পথে ফেরিওয়ালার মতো ছবি বিক্রি করতে হয়েছে। তাঁর জীবনের এই পর্যায়ের অনেক বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতার কথা এই স্মৃতিকথা লিখেছেন তিনি।
পিতা উমাপ্রসাদ রায়চৌধুরী। শিল্পী দেবীপ্রসাদের নিজের করা ভাস্কর্য
রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর ছবি আঁকা শিখতে যাওয়ার কথা। প্রথমে তাঁর কাজ অবনীন্দ্রনাথের ভালো না লাগলেও, পরে দেবীপ্রসাদকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট বন্ধুত্বও হয়ে যায়। প্রাচ্য শিল্পরীতি ও শৈলীর সঙ্গে দেবীপ্রসাদের প্রথম পরিচয় হয় অবনীন্দ্রনাথের কাছেই। এর পরই তিনি বিদেশি কায়দায় কাজ শেখার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ইতালিয়ান শিল্পী Boiyess-এর কাছে প্রবল উৎসাহ নিয়ে তৈলচিত্র আঁকা শিখতে শুরু করে দেন তিনি। টাকাপয়সা নেই, তাই বিনিময়ে গুরুর জুতো পালিশ, বন্দুক পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে, ঘর ঝাঁট দেওয়া অবধি সব কিছুই নিঃশব্দে করে যেতে হয়েছে দেবীপ্রসাদকে।
প্রতি মাসে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট কিছু একটা রোজগার না হলে যখন আর চলছে না, তখন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুপারিশে মিত্র ইনস্টিটিউশনে চল্লিশ টাকা মাইনেতে ড্রয়িং টিচারের পদে যোগ দেন তিনি। এই সময় থেকে ‘ভারতী’ ও ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ছাড়াও সংগীত ও সাহিত্যে তাঁর অনুরাগ ছিল ছোটোবেলা থেকেই। এর কিছু পরেই দেবীপ্রসাদ তদানীন্তন মাদ্রাজের (চেন্নাই) সরকারি চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদে যোগ দেন এবং চারুলতা দেবীকে বিবাহ করেন। টানা আঠাশ বছর এখানেই অধ্যাপনা করেন তিনি। এই সময়টাতেই দেবীপ্রসাদের কাজের খ্যাতি ক্রমশ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই সময়কার স্বাধীন জমিদার, লাট-বেলাট ও বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষেরা নিয়মিত তাঁর স্টুডিওতে যাতায়াত করতে থাকেন দেবীপ্রসাদকে দিয়ে তাঁদের মূর্তি বা প্রতিকৃতি করানোর জন্য।
তাঁরই তৈরি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তির সামনে শিল্পী দেবীপ্রসাদ
ইওরোপ ও আমেরিকার নানা নামি প্রদর্শনীতে প্রায়ই তিনি অংশগ্রহণ করে চলেছেন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন বিদেশি পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাঁর কাজের প্রশংসা।
শিল্পীপত্নী চারুলতা রায়চৌধুরীর এই রচনাটিতে রয়েছে দেবীপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ এবং তাঁদের বিবাহিত জীবনের বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার কথা। এই রচনায় শিল্পী দেবীপ্রসাদ ছাড়াও মানুষ দেবীপ্রসাদের এক অন্তরঙ্গ ছবি খুব সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে। তাঁর ছোটোবেলার দুরন্তপনা থেকে শুরু করে পরিণত গার্হস্থ্য জীবনের নানা ঘটনার কথা প্রাঞ্জলভাবে ধরা রয়েছে এই রচনায়। শৈশব থেকে দেবীপ্রসাদের নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস, তাঁর সংগীত ও শিকারের প্রতি আকর্ষণ, এবং শিল্পচর্চার কথা খুব সহজ ও সাবলীলভাবে লিখেছেন এই লেখিকা। একজন শিল্পীর স্ত্রী হওয়ার সঙ্গে আর পাঁচজন মানুষের স্ত্রী হওয়ার পার্থক্য এবং সমস্যা ঠিক কোথায়, সেটা খুবই সুন্দর ভাবে বর্ণিত হয়েছে এই রচনায়। যা বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া, লেখা অসম্ভব।
বইটির মুদ্রণ ও বাঁধাই যথাযথ। বইয়ের প্রিন্টার্স লাইনে প্রচ্ছদের নামাঙ্কন যিনি করেছেন, তাঁর নাম থাকলেও, প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটির কোনো পরিচিতি নেই। থাকলে ভালো হত।