এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • নৃত্যের তালে তালে, ইতিহাস কথা বলে

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ৫৬২৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)


  • নৃত্য দেখিয়া পালাইতেছেন কেন? আপনাকে বলিতেছি -- নৃত্য দেখিতে বলিতেছি না। একটু আলোচনা তো করা যাইতেই পারে! নৃত্য যে আপনি করেন না তাহা তো নহে, কিন্তু স্বীকার করিতে ভয় পাইতেছেন। -- সে যাহা হউক, আলোচনায় আসা যাউক।

    দেখুন আপনি নৃত্য করুন আর নাহি করুন, পৃথিবী কিন্তু জন্মলগ্ন হইতেই নৃত্য করিতেছে। -- কেন? কথ্থকের চক্রদার পরন? সেই জন্ম লগ্ন হইতেই ঘুরিতেই আছেই, ঘুরিতেই আছে... আমি তো সাতাশটি বার ঘুরিয়াই, মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গিয়াছিলাম। পৃথিবী যে ঘুরিতেছে, তাহার তথ্য সূত্র চাহিবেন না। ঘোরাঘুরির ছবি তুলিতে পারিব না।

    যাহা হউক, আপনি আদিম যুগে নিশ্চয়ই নৃত্য করিয়াছিলেন। -- পূর্ব জন্মের কথা বলিতেছি! -- পূর্ব জন্মে ‘বিশ্বাস করি না’ বলিলে ছাড়িব না। ইহা দশাবতারের দেশ। ভগবান বিষ্ণু এইখানে দশবার জন্ম গ্রহণ করিলেন, আর আপনি একবারও করিলেন না, তাহা হইতে পারে না। আপনি নিশ্চয়ই আদিম কালে জন্মিয়াছিলেন, এবং পশুশিকার করিয়া আনিয়া আগুনে পুড়াইতে দিয়া, তাহার চারিদিক ঘুরিয়া নারী, পুরুষ সকলে মিলিয়া নৃত্য করিয়াছিলেন, তাহা নহে?। ওহ্, আপনি তো আবার জাতিস্মর নন, তাই মনে করিতে পারিতেছেন না। ইহা তো সত্য যে নারী, পুরুষ উভয়ই প্রাচীন কাল হইতে নৃত্য করিয়া আসিতেছে।

    আচ্ছা তাহার পরের যুগে জন্মাইয়াছিলেন তো? অর্থাৎ সভ্যতার আরম্ভের যুগে, ঐ হরপ্পা-মহেঞ্জাদড়োর যুগে? নিশ্চয়ই জন্মাইয়াছিলেন! যুগে যুগে এত মানুষ এতবার জন্মাইল, এত কষ্ট করিল, ভগবান তাহাদের উদ্ধার করিতে এতবার আসিলেন আর আপনি একেবারে সটান সভ্য জগতে আসিয়া, বিজ্ঞানের আঙুর ফল খাইতে লাগিলেন, তাহা তো হইতে পারে না! আপনি সে যুগে জন্মাইয়াছিলেন ও নিশ্চয়ই নৃত্য করিয়াছিলেন! সোম রস পান করিয়া সন্ধ্যা বেলায় নৃত্য করেন নাই? আর ঐ যে সাতটি ছিদ্র যুক্ত বাঁশি? ওটা নিশ্চয়ই আপনার ছিল। আপনি বাজাইতেন,আর কেহ নৃত্য করিত! বীণাটা কে বাজাইত? রাজা? না আপনি? কিছুই মনে পড়িতেছে না?

    আচ্ছা, বৈদিক যুগে আপনি নিশ্চয়ই জন্মিয়াছিলেন! শ্রদ্ধেয় প্রঞ্জানানন্দ স্বামী বলিয়াছেন, সমবেত নৃত্যের প্রথম নিদর্শন নাকি বেদ হইতে পাওয়া গিয়াছে। আমি তো বলিতেছি, সেই আদিম কালে যখন পশু শিকার করিয়া আনিয়া আনন্দে দলবাঁধিয়া আদিম মানুষ নৃত্য করিত, আর কেমন করিয়া পশুটি শিকার করিল তাহা অভিনয় করিয়া দেখাইত, সেই সময় সমবেত নৃত্যের আরম্ভ। আপনি কী বলেন?

    --পুরুষ মেধ, অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষ পর্বে সমবেত নৃত্যের উল্লেখ রহিয়াছে ঠিকই! বৃষ্টি আনয়নের জন্য বৈদিক যুগে মুণি ঋষিরা যখন মহাব্রত অনুষ্ঠান করিতেন তখন তো নারীরা নৃত্য করিত। তা আপনি সেই সময় কলস ভর্তি জল লইয়া অন্য নারীদের সহিত যজ্ঞবেদীর চারিদিক ঘুরিয়া (বাম দিক থেকে ডান দিক) নৃত্য করিতেন নিশ্চয়ই। তখন তো মুনি ঋষিরা যজ্ঞ মন্ডপ নির্মান করিয়া হোম করিতেন, গগনস্পর্শী অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিত। উদাত্ত কণ্ঠে সুরের লহরী তুলিয়া তাঁহারা দেবতার স্তুতি করিতেন,আর নারীরা যজ্ঞবেদীর চারিদিকে নৃত্য করিত। যজ্ঞাদি উৎসবের পর ‘অবভৃথ’ স্নান নামে একটি উৎসব হইত না? ঐ উৎসবে রাজা-রাণীর সহিত অন্যান্য পুরুষ ও নারীরা তেল, হলুদা মাখিয়া নৃত্য করিত, তাই না?। -- আপনি সেই যুগে নারী রূপে জন্মাইয়াছিলেন নিশ্চয়ই।

    ঋকবেদের কোনো কোনো সূক্ত থেকে নৃত্য, গীতের কথা জানা যায়। আমি যতদূর জানি ৮/৯০/২৫, ৯/৩৬/৮ সূক্তে নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায় ! অষ্টম মন্ডলে নবম সূক্তে, তিন নম্বর ঋকে ইন্দ্রকে নর্তনকারী মহান বলে অভিহিত করা হয়েছে

    --“ইন্দ্র ইন্নো মহানাং দাতা বাজানাং নৃতুঃ।”

    —উঁহু, আপনি যে সে জন্মে ইন্দ্র ছিলেন না, তাহা আমি বুঝিতে পারিয়াছি।

    দশম মন্ডলে অষ্টাদশ সূক্তে তিন নম্বর ঋকে বলা আছে, -
    “প্রাঞ্চো আগাম নৃত্যয়ে হসায় দ্রাঘীয়।
    আয়ু প্রতবং দবীনাঃ”

    অর্থাৎ আমরা নৃত্য করি ও হাসি সেই কারণে দীর্ঘ দিন বাঁচিয়া থাকি।

    ঋকবেদের চতুর্থ মন্ডলে ষোলো নম্বর সূক্তে চতুর্থ সংহিতায় আছে-
    “অন্ধা তামংসি দুধিতা বিচক্ষে নূভ্যশ্চকার নৃতমো অভিষ্টৌ।”

    অর্থাৎ নৃত্য শ্রেষ্ঠ সূর্য এসে জগৎকে দেখতে সক্ষম হইবেন,তিনি অভিষ্ট নিবিড়,অন্ধকার নাশ করেন।

    বিখ্যাত কলা সমালোচক শিলভা লেভি বলেছেন --
    “The Rigveda already knows maidence who dance and attract the lovers and atharva veda tells how men dance and sing to music.”..(Ref.Maxmuller “scared book of the cast---vol.1)

    যজুর্বেদ এ রাজসনের সংহিতায় ‘সূত’ ও ‘শৈলূষ’ শব্দ দুটির উল্লেখ রহিয়াছে। সেখানে বলা হইয়াছে -
    “নৃত্যায় সূত্র,গীতায় শৈলুষ

    যাহারা সূত তাহারা নাচিত, যাহারা শৈলূষ তাহারা গান গাহিত। আপনি সূত ছিলেন না শৈলূষ ছিলেন? --- আহা! চটিয়া যাইতেছেন কেন?

    ঠিক আছে আলোচনা করা যাউক। সামবেদ সংহিতার যুগে সাম গানের সহিত নাকি বীণা বাজানো হইত! ব্রাহ্মণ্য যুগে গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের কথা জানা যায়। ইহারা নৃত্য গীতে কৃতবিদ্য ছিল। তান্ড্যমহাব্রাহ্মণ এর থেকে জানা যায়, ঋত্বিকেরা যখন ‘রাজনসাম’ গান গাহিতেন পুরনারীরা ‘কান্ডবীণা’ বাজাইয়া গীত করিত। -- আপনি কিছুই মনে করিতে পারিতেছেন না? পারিলে আপনি আমার তথ্য সূত্র হইতেন। রামকৃষ্ণ তেলেঙ্ বলেছেন, “The closing of the sacrifice was enjoyment with the concludeoj a peculiar dance.”

    সামবেদের যুগে দেশী ও মার্গী নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহা সম্পর্কে কিছু মনে পড়ে? দেশী নাকি তালাশ্রয়ী, আর মার্গী, ভাবাশ্রয়ী নৃত্য!

    যজুর্বেদ এ ‘ইরাতি’ শব্দটির উল্লেখ রহিয়াছে। ‘ইরাতি’ শব্দের অর্থ হইল আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্য। আপনি এই নৃত্য নিশ্চয়ই করিয়াছেন বলিয়া আমার ধারণা।

    এই যুগে দুন্দুভি বাজানো হইত... মনে পড়ে?

    যাহা হউক, অথর্ব বেদের যুগে মানুষ কুসংস্কার আচ্ছন্ন ছিল তাই না? যাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করিত। সেখানে অপ্সরাদের নিয়ে অদ্ভুত ধারণা তৈরি হইয়াছিল । অপ্সরা রা নাকি জলে বাস করিত, তাহারা অদৃশ্য হইয়া যাইতে পারিত, গন্ধর্ব পত্নীরা কখোনো মেঘে, কখনো বিদ্যুতে, কখনো নক্ষত্রলোকে বিচরণ করিত বলিয়া তাহাদের ধারণা ছিল ইত্যাদি। সেই যুগে তাহারা অর্জুন গাছের তলায় ময়ূর ময়ূরীর সহিত নৃত্য করিত। সেই যুগে রোগ, মহামারী হইলে নৃত্য গীতের মাধ্যমে তাহা দূর করিবার চেষ্টা করিত।

    রামায়ণের যুগে নিশ্চয়ই একবার জন্ম হইয়াছিল আপনার! সেই যুগে নৃত্য করেন নাই? রাম, রাবণ দুজনেই নৃত্যে পারদর্শী ছিলেন। সেই যুগে অপ্সরারা মুণি ঋষিদের ধ্যান ভাঙাইত। সুন্দর কাণ্ডে রাবণের গুণাগুণ বিচারের জন্য নৃত্যের কথা উল্লেখ রহিয়াছে। তাণ্ডব নৃত্যের অনেক কঠিণ পদক্ষেপ রাবণ জানিতেন। তাঁহার নৃত্যে সন্তুষ্ট হইয়া ভগবান শিব তাকে চন্দ্রহাস দান করেন। এই যুগে নৃত্যের মান শাস্ত্রীয় পর্যায়ে উন্নীত হইয়াছিল। কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডেও নৃত্যের উল্লেখ পাওয়া গেছে। রাজপরিবারের সকলে নিদ্রা যাইবার সময়, নিদ্রা থেকে জাগ্রত হইবার সময়, যুদ্ধক্ষেত্রে যাইবার সময়, শুভ অনুষ্ঠানের সময় নৃত্য গীতের আয়োজন করা হইত। আদি কান্ডের ষষ্ঠ সর্গের পঞ্চোত্তারিংশ অধ্যায়ে রহিয়াছে -

    “নর্ত্তক সঙ্ঘানাং গায়কানশ্চ গায়তম।
    মনঃকর্নমুখবাচ সুশ্রাব জনতা তত।”

    রাবণের রাজসভায় নৃত্য পটিয়সীদের নৃত্য প্রদর্শনের কথা জানা গিয়াছে। -- আপনি এই পটিয়সীদের একজন হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, না?

    আচ্ছা, হরিবংশ পুরাণে যে ‘হোল্লিসক নৃত্য’, ‘রাসনৃত্য’, ও ’ছালিকা নৃত্যের’ উল্লেখ আছে আজিকের দিনের অনেক শাস্ত্রীয় নৃত্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না? হোল্লিসক নৃত্যের সঙ্গে আমি তো মনিপুরী রাস নৃত্যের মিল পাইয়া থাকি।

    ওহ্, মহাভারতের কথা তো বলা হইল না! আদি পর্বে (২০০/৯৯), অরণ্য পর্বে (৪০/৬), বিরাট পর্বে (৯/১৭) নৃত্যের উল্লেখ আছে। যাদবদের ভূখণ্ডে সুভদ্রার নৃত্য দেখিয়া অর্জুন মুগ্ধ হইয়াছিলেন। রম্ভা মেনকা, উর্ব্বশীর মত অপ্সরাদের নামও তো পাওয়া যায়। মেনকা ইন্দ্রের নির্দেশে বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ করিয়াছিল।

    বৃহস্পতি পুত্র ‘কচ’ নৃত্য, গীতে পারদর্শী ছিলেন এবংশিষ্যা দেবযানীর হৃদয় হরণ করিয়াছিলেন। দেবযানী নিজেও নৃত্য গীত পটিয়সী ছিলেন। কচ ও দেবযানীর পরম্পরা অবশ্য এখনও চলিতেছে।

    বাণ পর্বে অর্জুন অমরাবতীতে অপ্সর্ বিশ্ববসুর পুত্র সঙ্গীত বিশারদ অপ্সর চিত্রসেনার কাছে নৃত্য, গীত, বাদ্য শিক্ষা নিয়াছিলেন।

    “ততো বাদিত নৃত্যাভ্যাম, নৃত্তং, গীতং চ বাদ্যং চিত্রসেনাবদাপ্নহি”

    বিরাট পর্বে অর্জুন যথারীতি ‘ইন্টারভিউ’ দিয়া বিরাট রাজার রাজসভায় বৃহন্নলা নাম নিয়ে চাকুরী লইয়াছিলেন। অর্জুন নিজের পরিচয় দিয়াছিল

    – “নৃত্যামি, গায়ামি চ বাদয়াম্যহম প্রনর্তনে কৌশলনৈপুনং মম”।

    বিরাট রাজকন্যা উত্তরাকে অর্জুন নৃত্য শিখাইয়াছিলেন। সে যুগে বীণা, বেণু, মৃদঙ্গ, শঙ্খ, ভেরী,গজঘন্টা, নূপুর, দুন্দুভি, জারিজ, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হইত।

    সেই যুগে আপনি অর্জুন হইয়া জন্মিয়াছিলেন নাকি?

    হইলেও হইতে পারেন। ইন্দ্রের সভায় আপনাকে কোন কোন অপ্সরা নৃত্য, গীত প্রদর্শন করিয়া মনোরঞ্জন করিয়াছিল মনে করিতে পারেন?.. রম্ভা?.. ঘৃতাচি?.. মেনকা?... ঊর্বশী? .. না সকলে মিলিয়া একসঙ্গে ..?

    খাণ্ডবদাহ পর্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জন যমুনার তীরে বন্ধু - বান্ধব ও পুরনারীদের লইয়া পান, ভোজন ও নৃত্য করিয়াছিলেন বলিয়া জানি। .. আপনি কিছু জানেন নাকি?.. সেই যুগে কোন্ ধরনের নৃত্য পরিবেশিত হইত তাহা স্পষ্ট করিয়া উল্লেখ নেই। আপনি কি স্মরণ করিতে পারেন?

    দ্বিতীয় শতকে উড়িষ্যার মহারাজা মেঘবাহন খারবেলের রাজত্বকালে নিশ্চয়ই জন্মাইয়াছিলেন! তাঁহার গুহাশিল্পে যে নারী মূর্তিগুলি খোদিত আছে, তাহার মধ্যে কোনোটা পূর্বজন্মে আপনার ছিল নাকি? কী যেন সেই গুহা গুলির নাম? - হাতিগুম্ফা, রাণীগুম্ফা, মঞ্চপুরী, স্বর্গপুরী....। আচ্ছা, রাণীগুম্ফায় নারী মূর্তির হাত মুষ্টিবদ্ধ কেন? ইহাও কি নৃত্যের মুদ্রা? ওড়িষি নৃত্যে ঘুষি মারা শিখাইত নিশ্চয়ই। --- আপনি তো কিছুই বলিতে পারিতেছেন না!

    আপনি পূর্ব জন্মে পৌন্ড্র নগরের কার্তিকেয় মন্দিরের কমলা দেবদাসী ছিলেন না? --- আহা হা ভাবিতে পারিতেছি না, আপনি নৃত্য করিতেছেন আর কাশ্মীর রাজ জয়াপীড় দেখিতেছেন।

    হুমায়ুনের শাসনকালে পারস্য হইতে নর্তকীরা আসিয়া উত্তর ভারতের নর্তকীদের সঙ্গে মিশিলে মোট চার ধরনের নর্তকীর আবির্ভাব হইয়াছিল - লোলোনীস, ডোমনীস, হর্কিনিস, ও হেনসিনিস - এদের মধ্যে আপনি কোন ধরনের নর্তকী ছিলেন?

    আকবরের রাজসভায় সেলিমের আনারকলি হইয়া আসিয়াছিলেন নাকি? — আহা হা চটিয়া যাইতেছেন কেন!

    আপনি ওয়াজেদ আলি শাহ এর নাম মনে করিতে পারেন? ১৮৪৭ খ্রিঃ ১২ ফেব্রুঃ লক্ষ্ণৌর সিংহাসনে বসিয়াছিলেন। হ্যাঁ, উনি আমজাদ আলির দ্বিতীয় পুত্র। এইটা তো আপনার মনে আছে দেখিতেছি! তাহার মানে এই সময় আপনি লক্ষ্ণৌর এক নৃত্য পটিয়সী হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, এবং আপনি জাতিস্মর হইয়া এইবার জন্মাইয়াছেন। --- কী বলিলেন? ইতিহাস বইয়ে পড়িয়াছেন? ওহ্,.... আমি ভাবলাম....

    যাহা হউক, এই ওয়াজেদ আলি স্বয়ং নাকি ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি প্রভৃতি নানা ধরনের গান রচনা করিয়াছিলেন। কথ্থক নৃত্য খুব বিকশিত হইয়াছিল তাঁহার আমলে। ওয়াজেদ আলি ‘যোগিয়া’ উৎসব শুরু করিয়াছিলেন, এইটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য বিষয়। গেরুয়া বসন পরিধান করিয়া তিনি যোগী সাজিতেন, আর নর্তকীরা যোগিনী সাজিত। তাঁহার ‘কাইজার বাগে’ নাটক পরিবেশিত হইত। তাঁহার সভায় দুইশত তবলা বাদক ও দুইশত নর্তকী উপস্থিত থাকিত। আপনি পূর্ব জন্মে ঐ দুইশত নর্তকীর মধ্যে একজন ছিলেন নিশ্চয়ই। --- আহা! চটিয়াযাইতেছেন কেন?

    ঐ রাজা এতটাই নৃত্য-গীত করিতে ব্যস্ত ছিলেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই সুযোগে তাঁহার রাজ্য কাড়িয়া, তাঁহাকে নজরবন্দি করিয়াছিল।

    রায়গড়ের মহারাজা চক্রধর সিং এরও তো একই অবস্থা হইয়াছিল তাই না? রাজারা দেশ না চালাইয়া নৃত্য করিলে কী হয় দেখিয়াছেন তো? এখনকার শাসক দিগের বলিবেন ইহা হইতে শিক্ষা লইতে! ইহারা বড্ড বেশি নৃত্য করে, কখনো ‘যোগী’র সহিত, তো কখনো ‘ভোগী’র সহিত – কী বলিলেন? আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। --- দেশ যখন বিদেশের হস্তে যাইবে তখন টের পাইবেন! আপনাদের সকল নৃত্য বন্ধ হইয়া ‘খেমটা’ নৃত্য আরম্ভ হইবে!

    আচ্ছা, আপনি কয়েকশো বছর আগে নিশ্চিত একবার জন্মাইয়াছিলেন! -- দক্ষিণের তাঞ্জোরের রাজদাসী হইয়া। এই ধরিয়া লন, বালা স্বরসতীর প্রমাতামহী, সুন্দরীম্মা? অথবা তাঁর কন্যা বীণা ধানম? রাজসভায় বীণা বাজাইতেন। বীণা বাজাইলে অবশ্য নিজে না নৃত্য করিয়া অন্য কে নৃত্য করিতে সাহায্য করা হয়। নাকি তার কন্যা জয়াম্মা ছিলেন? বালাস্বরসতী আপনি ছিলেন না, সে আমি বুঝিতে পারিয়াছি। আপনার সঙ্গে এতক্ষণ আলোচনা করিয়া বুঝিয়াছি আপনি আগের জন্মে নৃত্য পটিয়সী ছিলেন না, থাকিলে এই জন্মে নৃত্যের নাম শুনিয়া চটিয়া যাইতেন না। আপনি এজন্মের মতোই পূর্ব জন্মেও অন্যের তালে হাত পা ছুড়িতেন।

    যাহা হউক, আলোচনা অনেক হইল, পূর্ব জন্মের কথা ছাড়ুন, এ জন্মের কথা বলুন। এ জন্মে নৃত্য করেন তো? -- আহাহা চটিতেছেন কেন?

    এই যে এক্ষুনি আপনার আঙুল নৃত্য করিতে করিতে আমার আলোচনার নীচে গিয়া যাহা তাহা ‘কমেন্টস’ করিবে, সেইটাও তো নৃত্য!

    দেখুন, নৃত্য আপনিও করেন, ঠান্ডা মাথায় বসুন, বোঝায়। --- আপনার অফিসে বসের উপর রাগ হইলে কলিগের সহিত তাহাদের তালে তালে নৃত্য শুরু করেন তো! প্রতিবেশী আপনার ভুঁড়ি কমিয়াছে বলিয়া প্রশংসা করিলে কয়দিন তাহার তালে তালে নৃত্য করেন তো! বাসে, ট্রেনে একটি বিষয়ে মনের মিল হইলেই অমনি তাহার তালে তাল দেন, তাহাও তো নৃত্য। বাড়িতে একবার ভার্যার তালে নৃত্য করেন, তো একবার মাতার তালে নৃত্য করেন। সরকার ডিএ বাড়াইলে মহানন্দে উদ্দাম তালে নৃত্য করেন তো! – সরকারি চাকুরি করেন না! -- তাহা হইলে তো বিরুদ্ধ তালে নৃত্য করিয়া থাকেন। ভোটের সময় দাদাদের তালে নৃত্য করেন তো! --- তা..হা হইলে?

    নৃত্য করুন, নৃত্য করিলে শরীর, হৃদয় দুইই সুস্থ থাকে। তবে যখন গৃহে মাতা ও ভার্যা বিপরীত তালে একসঙ্গে নৃত্য করিবে তখন কিং কর্তব্য বিমূঢ় হইবেন না। উহাদের কাহারও তালে নৃত্য করিবেন না। এক জনের তালে নৃত্য করিলে অন্য জন ক্রুদ্ধ হইবে। আপনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত নিজে তাল তৈরি করিবেন। না না আপনি আগের জন্মে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কি না সেই কথা বলিতেছি না। সে আপনি ছিলেন না, আমি নিশ্চিত। হ্যাঁ, যেটা বলিতেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ নতুন তাল তৈরি করিয়াছিলেন। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’তে ঝম্পক তাল (পাঁচ মাত্রার) ‘নিদ্রাহারা রাতের এ গান’-এর জন্য ষষ্ঠী তাল (ছয় মাত্রার), ‘গভীর রজনী শামিল হৃদয়ে’ গানের জন্য রূপকড়া তাল (নয় মাত্রার তাল), ‘দুয়ারে দাও মোরে রাখিয়া’ গানের জন্য একাদশী (এগার মাত্রার তাল), ‘জননী তোমার করুন চরণখানি’ গানের জন্য নবপঞ্চ (আঠারো মাত্রার) তাল তৈরি করেন। সেই রকম আপনিও নিজের তালে নৃত্য করিবেন। যখন মাতা তাঁহার তালে নৃত্য করিতে ডাকিবেন, আবার ভার্যা তাহার তালে নৃত্য করিতে শাসাইবে, ঠিক তখনই আপনি নিজের তালে নৃত্য শুরু করিবেন। দেখিবেন দুই পক্ষই নৃত্য থামাইয়া দিয়াছে। আপনি নৃত্য করুন,যত খুশি করুন, ইহাতে শরীর ও হৃদয় সুস্থ থাকে, আয়ু দীর্ঘ হয়। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে রাখিবেন, ‘ভাবের ঘোরে তাল কাটিলে লয় যাইবে থামিয়া’। তাই ভাবের ঘোরে তাল কাটিবেন না যেন! জীবনের লয় একবার থামিলে আর চলিবে না!

    আজি এই পর্যন্ত, পরে একদিন আসিব আলোচনা করিতে সেইদিন পূর্ব জন্মের কথা মনে করিবার চেষ্টা করিবেন, না হইলে আমি তথ্যসূত্র পাইব না। (এইবারে তথ্য সূত্র চাহিয়া লজ্জা দিবেন না, প্লিজ)।

    *****

    তথ্য সূত্রঃ

    1) A short History of the Muslim rule in India - Ishwariprosad.
    2) নৃত্য বিতান - অনুপ শঙ্কর অধিকারী
    3) নৃত্যে ভারত - ডঃ মঞ্জুলিকা রায় চৌধুরী
    4) কথ্থক নৃত্য – শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ গর্গ
    5) A comprehensive History of India - Nilkanta Shastri
    6) Scared book of the cast - vol.1 Maxmullar
    7) প্রশ্নোত্তরে ভরতনাট্যম - আদিত্য মিত্র
    8) কৃষ্ণ যজুর্বেদ সংহিতা - দুর্গাদাস লাহিড়ী
    9) তত্ত্ব কথায় রবীন্দ্র নৃত্য ও সৃজনশীল নৃত্য - নূপুর মুখার্জি
    10) A history of Indian Music- Swami Prajanananda
    11) শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা - দুর্গা দাস লাহিড়ী
    12) সামবেদ সংহিতা - দুর্গাদাস লাহিড়ী
    13) অথর্ব বেদ সংহিতা - দুর্গাদাস লাহিড়ী
    14) ঋকবেদ সংহিতা - দুর্গাদাস লাহিড়ী

    *পোস্ট টি শেয়ার করতে পারেন কিন্তু কপি পেস্ট করবেন না। - লিপিকা ঘোষ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ৫৬২৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন