যে কোন আন্দোলনেই দাবি থাকে। দাবি না থাকলে সেই আন্দোলন স্বীকৃতি পায় না। দাবি হল, যাকে বলে, আন্দোলনের প্রকাশ। ভাষার মত। কোন আন্দোলন হলেই, যারা আন্দোলন করছে না, তারা জিজ্ঞেস করে -- ওদের দাবি কী?
যদিও, আন্দোলনটির দাবি কী, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটি করছে কারা। এই "করছে কারা" -টিও আন্দোলনের আরেকটি প্রকাশ। যেমন, ধরা যাক, কোনো একটা অফিসের অস্থায়ী কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। তাঁদের দাবি থাকতে পারে, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দিতে হবে, মাইনে বাড়াতে হবে, স্থায়ী করতে হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করছে। তাঁদের নানা দাবি থাকতে পারে। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন -- এভাবে মোটা দাগের বিভাজনের মাধ্যমে সেই সব আন্দোলনকে ধরা হয়। সেই আন্দোলনের একটা নিজস্ব পরিচয় আছে, কোন শ্রমিক আন্দোলনের দাবি কী, কোন ছাত্র আন্দোলনের দাবি কী কী, তা নিরপেক্ষ ভাবেই। দাবি যা-ই হোক -- আন্দোলনের ধারাবাহিকতা একটা পরিচয়ের জন্ম দেয়। যেমন, আমাদের এখানে গত শতকের শেষ অর্ধে প্রচুর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন হয়েছিল। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের একটা চার্টার অফ ডিমান্ড থাকে, কিন্তু সেটা বড়ো কথা নয়। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন নিজেই একটা শক্তি। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন না থাকলে মালিক শ্রমিকের ঘাড়ে চেপে বসে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থাকলে সেই ভার কিছুটা লাঘব হয়। শ্রমিক আন্দোলন এবং তার ব্যাপ্তি শ্রমিকের মধ্যে ভাই-ভাই বোধ বাড়ায়। একই কথা হয়ত ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিন্তু কৃষক আন্দোলন কি এরকম? আমাদের দেশে কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস, ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য এবং গভীরতা শ্রমিক বা ছাত্র আন্দোলনের চেয়েও অনেক বেশি। ইতিহাসের চর্চা যারা করেন, তাঁরা ভাল বলতে পারবেন এ ব্যাপারে -- কৃষক আন্দোলন আমাদের দেশে চিরকালই রাজনৈতিক। ইদানিং কালের কৃষক আন্দোলনগুলিও মোড় ঘোরানো আন্দোলন। যেমন পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলন। সারা দেশে জমি অধিগ্রহণবিরোধী কৃষক আন্দোলন। বিশ্বায়নের যে রথ আমাদের দেশের ওপর দিয়ে চলছিল এক দশকের ওপর ধরে, তাকে বাধা দেয় সেই কৃষক আন্দোলন। "সেজ" বা "স্পেশাল ইকনমিক জোন" শব্দটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। শতাব্দী প্রাচীন 'জমি অধিগ্রহণ আইন'-কে বদলে দেয়। কৃষিজমির রূপান্তর থমকে দেয়। বিশ্বায়নের এক দেড় দশকে কৃষিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, সর্বনিম্ন বৃদ্ধির ক্ষেত্র হিসেবে -- এসবই ছিল সরকারি বেসরকারি বৌদ্ধিক মহলের অভ্যাস। 'চাষার ছেলে কি চিরকাল চাষ করবে?’ -- এই ছিল বয়ান। সেই বয়ানের মধ্যে যেমন বাস্তবতার সত্যদর্শন ছিল, কিন্তু একইসাথে ছিল চাষের বৃত্তি-কে লঘু করা। গত দশকের কৃষক আন্দোলন সেই চাষির বৃত্তিকে লঘু করার ওপরচালাকির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন ও কৃষিসমাজের বিভিন্ন বর্গের অবস্থান- একটি উপক্রমণিকা
কিন্তু চাষির ছেলে যে আর চাষকে বৃত্তি হিসেবে নিয়ে থাকতে পারছে না কিছুতেই, বদলে যাওয়া দুনিয়ায় সে গরিব ও ক্ষমতাহীন হয়ে যাচ্ছে -- এ বাস্তবতা বদলায়নি। এই বাস্তবতা বদলানোর জন্য সে একের পর এক উপায় খুঁজে চলেছে এই দশকের নানা আন্দোলনগুলির মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে অনেকগুলিই দেখতে হয়ত "কৃষক আন্দোলন" নয়, কিন্তু তা আদতে কৃষকের আন্দোলন। যেমন, গুজরাতের পতিদার বিদ্রোহ। আপাতদৃষ্টিতে উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে পতিদারদের সংরক্ষণের আন্দোলন। কিন্তু পতিদার মানে হল কৃষক। ভাগচাষি বা ক্ষেতমজুর নয়, যে কৃষকের জমি আছে। কিন্তু সে কেন সংরক্ষণ চাইছে? কারণ, তার চাষ করে আয় একজন সবচেয়ে নিচুতলার সরকারি কর্মচারির আয়ের চেয়েও অনেক কম হয়ে গেছে। ফলে তার পক্ষে সম্ভব নয় উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য সন্তানকে প্রস্তুত করা, একইসাথে পরিবারের কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা না করলে বা চাকরি না করলে তার চাষের প্রাথমিক খরচ সামলানোই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। আবার সেই আন্দোলনও হয়েছে, যা দেখতেও "কৃষক আন্দোলন"। যেমন ২০১৭ সালে মধ্যপ্রদেশে মন্দসৌর-এর কৃষক বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহে গ্রাম থেকে শহরে আনাজ ও দুধের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় কৃষকদের সংগঠিত জোট। পুলিশ অবরোধে গুলি চালায়। অন্তত তিনজন কৃষক মারা যান। এই বিদ্রোহের আনুষ্ঠানিক দাবি ছিল -- কৃষিঋণ মুকুব, চাষের জলের জন্য বিদ্যুতের চড়া বিল, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য কম, সরকার ফসল কেনে না, ফসলের দাম নেই, মান্ডিতে কৃষকের শোষণ -- ইত্যাদি। জাঠ বিদ্রোহ, মহারাষ্ট্রের মারাঠা কোটা আন্দোলন ও কৃষকদের লং মার্চ -- কৃষক আন্দোলনের এরকম আরো নানা উদাহরণ আছে এই দশকে। যার অনেকগুলিই হয়ত নিজেদের তথাকথিত কৃষক আন্দোলন বলবে না, বা কৃষক আন্দোলন-ও তাকে নিজের পংক্তিতে ফেলতে চাইবে না। পাঞ্জাব বাদে অন্যান্য রাজ্যে এই কৃষক আন্দোলনগুলি পঞ্জাব থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি গঠনের রূপরেখাও তৈরি করছে নানা আন্দোলনের মাধ্যমে। গঠন -- মানে, চাষির সন্তান যে চাষকে ফের বৃত্তি হিসেবে নেবে, এবং স্বচ্ছন্দে থাকবে, তার নিশ্চয়তা। যার স্তম্ভ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি, সরকারি মান্ডির পরিমাণ বৃদ্ধি ও সেখানে ব্যবসায়ীরা যাতে দু-নম্বরী করতে না পারে, সরকারের ফসল ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষিঋণ ও দুর্বিপাকজনিত ক্ষতিপূরণ, চাষের জল ইত্যাদির জন্য বিদ্যুতের বিল-এ ভর্তুকি প্রভৃতি। এবং একইসাথে কৃষকের ছেলের উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে পরিবারের কারোর কারোর নিয়মিত উচ্চতর আয়ের বন্দোবস্ত -- যা কৃষির প্রাথমিক পুঁজি বিনিয়োগে কাজে লাগবে। চাষির পরিবারের কেউ যাতে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে, বা চিকিৎসা করতে গিয়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য না হয় খরচ সামলাতে না পেরে -- তার দাবিও আছে। উদাহরণ স্বরূপ পতিদার আন্দোলনের একটা দাবি, পতিদারদের বাড়ির ছেলে মেয়েদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার ফি মুকুব করা। বলাই বাহুল্য, যে, এই গঠন-এর রূপরেখায় সরকারের ভূমিকা নির্ধারক। সরকার তো একটা এজেন্সি মাত্র -- আসলে চাষি চাইছে, এই গঠনে সামগ্রিকভাবে সমাজ যেন তার পৃষ্ঠপোষকতা করে। ঠিক যেভাবে সরকারের বকলমে সমাজ পৃষ্ঠপোষকতা করে অন্যান্য নানা বৃত্তি-কে। তার জমি আছে, তা একটা স্থাবর সম্পত্তি বটে, কিন্তু কৃষি বৃত্তিতে তা তো উৎপাদনের উপকরণ বই কিছুই নয়।
আরও পড়ুন, বেণীর সঙ্গে মাথা
ঠিক এখানেই আঘাত হেনেছে নয়া কৃষি আইন তিনটি। আইনগুলি করা হয়েছে পঞ্জাবের নেতৃত্বে কৃষকদের নিজেদের অর্থনৈতিক স্তরের ও সামাজিক মর্যাদার পুনর্গঠনের আন্দোলনগুলির রূপরেখাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে। আইন তিনটি আপাতদৃষ্টিতে কৃষি বিপণনে কর্পোরেটদের আরো বেশি সুবিধা করে দেবার বন্দোবস্ত। কৃষি বিপণনে কর্পোরেটরা আছে অনেকদিন ধরেই। পেপসি আলুর চুক্তি চাষ আজ এক দশক কি তারও বেশি দিন ধরে চলছে। কিন্তু জমছে না। মেট্রো ক্যাশ এন্ড ক্যারিও প্রায় আট বছর হতে চলল, মান্ডি বা এপিএমসি লাইসেন্স নিয়ে কিছু নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পাইকারি ব্যবসা করছে। খুচরো ব্যবসায় টাটা বিগ বাস্কেট, রিলায়েন্স ফ্রেশ, আদানি বিগ বাজার চলছে কিছুদিন হল। আগরওয়াল এঞ্জিন তেল, আদানি ফরচুন তেল, টোডি ইমামি তেল -- এসব তো আরো বহুদিনের ব্যাপার। কিন্তু কৃষি বিপণনে থাকলে শুধু ঠিক জমছে না, কৃষি বিপণনে থাকার ছদ্মবেশে চাষ বা কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করা, এক দায়িত্ববিহীন ক্ষমতা -- এ নাহলে আর কর্পোরেট কেন? তাই, এই তিনটি বিল শুধু কৃষি বিপণনে কর্পোরেটদের আরো বেশি সুবিধা করে দেবার বন্দোবস্ত নয়। এই তিনটি বিল কৃষি বিপণনের ছদ্মবেশে কৃষিকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ববিহীন ক্ষমতাপ্রদান। বলাই বাহুল্য -- কর্পোরেট মানেই তাই -- সীমিত দায়িত্ব, লিমিটেড লায়াবিলিটি। দায়িত্বহীনতা হল কর্পোরেট পুঁজির একমাত্র স্বাতন্ত্র্য, অন্যান্য ধরনের পুঁজির থেকে। কৃষকেরও পুঁজি আছে। ব্যবসায়ীরও পুঁজি আছে। তারা সবাই পুঁজির যে চিরায়ত চরিত্র -- তা উদবৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে উৎপাদন ও সঞ্চলনের প্রক্রিয়ায় -- তার থেকে আলাদা নয়। কর্পোরেট পুঁজিরও সেই চিরায়ত চরিত্র আছে। তার স্বাতন্ত্র্য তার লাম্পট্যে। এই লাম্পট্যের জোরেই সে পুঁজি হিসেবে বাকি সব পুঁজিকে পেছনে ফেলে দেয়।
ফলে এই আইন তিনটি কৃষকদের নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব পুনর্গঠনের যে বাসনা, যা তার নানা রূপের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোচ্ছিল এই দশকে -- তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। তাই কৃষকরা চাইছে, তিনটি আইনের বাতিল। সংযোজন সংশোধন নয়, একেবারে বাতিল। গত দশকে কৃষক আন্দোলন ছিল প্রতিরোধের, এই দশকে তা ছিল পুনর্গঠনের। আরেকটি দশক শুরু হচ্ছে, কৃষক আন্দোলন ফের প্রতিরোধে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রবন্ধটি অসাধারণ এগোচ্ছিল, যেন হঠাৎ ই শেষ হয়ে গেল। পটভূমিটি দারুন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, বিশ্লেষণ ও খুব সুন্দর কিন্তু শেষটা একটু আগে হয়ে গেল। কর্পোরেট পুঁজি শুধু নয়, কর্পোরেট কৃষিকে কিভাবে আষ্টে পৃষ্টে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কিভাবে কেন এখন লাভ তেমন করতে পারছে না, মন্ডি ব্যবস্থায় খামতি কি থাকছে আরেকটু আলোচনা করলে ভালো লাগত।
এই প্রসঙ্গে আরো আলোচনা প্রকাশ হলে কৃষি আন্দোলন সম্পর্কে আরো জানতে পারি ।..যেটা এই মুহূর্তে খুব দরকার জানবার !!
আরো জানালে ভাল লাগবে। mrsghose@gmail.com