(১)
চোখ বন্ধ করে ছোটবেলার কথা ভাবলে অংশুমান ওদের বাড়ীটাকে দেখতে পায়। সুপুরি গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নিভে-আসা বিকেলের আলোর ল্যাটিসওয়ার্ক ওদের দোতলা বাড়ীটার গায়ে; বৃষ্টি ধরে এসেছে, বাড়ী ঢোকার মুখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অংশুমান: দৃশ্যটা এরকম। চটির ভেতরে অংশুমানের পা-টা কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে; সামনে জলে ভিজে, গহীন সমুদ্রের নীচে যেসব জাহাজ তলিয়ে গিয়েছে আর কেউ মনেও রাখেনি তাদের কথা, সেইরকম দেখাচ্ছে ওদের বাড়ীটাকে। আর একটা কালো লম্বা দাঁড়াশ সাপ অংশুমানের ডানকাঁধ থেকে গা বেয়ে কোমর বেয়ে সরসর করে নেবে যাচ্ছে মাটিতে; নেমে বাড়ীর সামনে সদ্য জল পাওয়া ঢলঢলে আকন্দের ঝোপে মিলিয়ে গেল।
(২)
বাড়ী ঢুকে আস্তে আস্তে সে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল রান্নাঘরের দরজার কাছে; মা চা করছিল — সেই দৃশ্য দ্যাখে সে, দ্যাখে কিভাবে সসপ্যান থেকে ছেঁকে চা ঢালা হয় কাপে কাপে। বিকেলের ম্লান হলুদ আলো ক্রমশ মরে এসে প্রগাঢ় বেগুনি হয়ে গেলে অংশুমান ছাদে উঠে গেল, এইরকম আলোয় তার দারুণ মনখারাপ করে। ছাদে এসে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকল সে। ধীরে ধীরে একটা পেতলের ঘড়ার পিছনে হাত বাড়িয়ে সে বের করে আনল পাতলা সাপ্তাহিক পত্রিকাটা, তারপর কমে আসা আলোয় খুঁজে বের করল একটা বিশেষ পাতা। তারপর গুমরে গুমরে কাঁদতে শুরু করল, তার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল টপটপ এবং একইসঙ্গে মাকড়সার ঝুল লেগে থাকা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে চোখ মুছে নিচ্ছিল বারবার।
(৩)
প্রতিসপ্তাহে পত্রিকাটার প্রচ্ছদকাহিনী শুরু হত একটা প্রশ্ন দিয়ে। প্রচ্ছদে সেই প্রশ্নটা ছাপা হত, যেমন — গৃহস্থের কিসে কিসে কল্যাণ হয়? জর্জ বুশ কেন ইরাকে যুদ্ধ শুরু করলেন? নেতাজী কি বেঁচে আছেন? — সবই খুব কৌতুহল-উদ্দীপক প্রশ্ন। হাতে ধরে রাখা পত্রিকাটার প্রচ্ছদের প্রশ্নটার দিকে সে তাকিয়েছিল একদৃষ্টে, তার চোখ থেকে একফোঁটা জল পড়ে ধেবড়ে গেল প্রশ্নচিহ্নটা। পত্রিকাটা লুকিয়ে রেখে ছাদ থেকে নীচে নেমে আসার সময় সিঁড়ির চৌকাঠের কাছে সে দেখল গুটলি পাকিয়ে শুয়ে রয়েছে সাপটা, ভয়ে সে চিৎকার করে উঠল।
(৪)
এইভাবে অংশুমানের অসুখটা বাঁধল; সাপের ভয়ে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে লাগল সে। বিশেষত বিকেলের দিকে বিছানায় শুয়ে বই পড়তে পড়তে যখন হঠাৎ তার খেয়াল হতো ঘরের ভেতরে আলো এত কমে এসেছে যে কালো যুক্তাক্ষরগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে গায়ে গায়ে, তখন জানলার বাইরে তাকালে তার মনটা কেমন করুণ হয়ে আসত। হাতে ধরে রাখা বইটা থেকে ভৌগোলিক অভিযানের কাহিনীগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে উঠত। এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় সে তলিয়ে যেত ম্যাগেলান অথবা বার্থোলোমিউ দিয়াজ, জেমস কুক অথবা ডেভিড লিভিংস্টোনের পরিণতির কথা ভাবতে ভাবতে, যারা নতুন দেশ খুঁজতে বেরিয়ে কেউ ঝড়ে জাহাজ ডুবে মরে গ্যাছে তো কেউ প্রাণ দিয়েছে আদিবাসীদের বিষমাখানো তীরে।
(৫)
এমনিতে জ্বর-টর হলে অংশুমানের ভালো লাগে। প্রত্যেক গ্রামেরই একটা অসুখ-বিসুখের শহর থাকে, যেখানে লোকে যায় ডাক্তার দেখাতে; ফেরার সময় রুগ্নচোখে তারা কুড়িয়ে আনে শহরের রাস্তাঘাটের টুকরো টুকরো ছবি, আলোঝলমলে স্মৃতি। মার্কোপোলোর মতো তারা ফিরে এসে শোনায় সেই আশ্চর্য শহরে কিভাবে সতর্কতার সাথে চলাফেরা করতে হয়। মুখে মুখে তারা এঁকে দেয় শহরের একটা সিনেম্যাটিক রেখাচিত্র, যেন পড়ন্ত বিকেলে ঘোড়ার গাড়ির পর্দা সরিয়ে দেখা দৃশ্যগুলি — ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ময়দান, গঙ্গার ধার আর ইডেন গার্ডেনস; আর ট্রামগুলি ও বাসগুলি, আর সেই শহর, অংশুমান মনে মনে ভাবে খুব শক্ত অসুখ করলে একদিন সে যাবে সেখানে — কলকাতায়।
(৬)
কলকাতায় অংশুমানের ছোটমাসিরা থাকে। তার দাদু এককালে চাকরি করতেন খিদিরপুরের মার্চেন্ট অফিসে। তবু, যদ্দূর মনে পড়ে, কলকাতার নাম সে প্রথম জেনেছিল তার দিদুর সূত্রে, যিনি সবসময় সাদা কাপড় পরতেন কারণ তিনি ছিলেন বিধবা। রেলে চাকরি করতেন তিনি; অফিস থেকে ফিরে ছাতামাথায় সূর্যাস্তের সময় তিনি অংশুমানদের বাড়ী আসতেন, এসে দাঁড়াতেন উঠোনের কোণে অনেকদিন আগে বাজ-পড়ে-ন্যাড়া নারকেল গাছটার তলায়। অংশুমানকে তিনি এনে দিতেন রেলের বাতিল টিকিট; দেশলাই বাক্স-সাইজের আয়তকার বাদামী টিকিটগুলো ছিল কার্ডবোর্ডের মতো শক্ত এবং সেগুলো সাজিয়ে ঘর তৈরি করা যেত।
(৭)
টিকিটের গায়ে সংখ্যা ও অক্ষরগুলো অংশুমানের কৌতুহল জাগাতো। অনেক টিকিটে হেইচডব্ল্যিউএইচ লেখা দেখে 'এর মানে কী?' জিগ্যেস করায় তাকে বলা হয়েছিল ওগুলো হাওড়ার টিকিট, কলকাতা যাবার। বছরখানেক পরে একদিন ইস্কুলের ইংরেজি বইতে সে খুঁজে পায় কলকাতা শহরের একটা রঙচঙে ছবি — সারি সারি হলদে ট্যাক্সি-ট্রাম-বাসভর্তি শহরের রাস্তা আর পিছনে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির সিল্যুয়েট; ওরকম একটা ফ্ল্যাটেই তৃণাদি'রা থাকত।
(৮)
ওরা যখন অংশুমানদের বাড়ী বেড়াতে আসত, তৃণা অংশুমানকে ওদের ফ্ল্যাটের মোটা মোটা দৈত্যাকার সবজেটে শ্যাওলাধরা পাইপগুলোর গল্প শোনাত, যাদের গা বেয়ে সারাদিন নাকি টপটপ জল পড়ে; আর বলত ভূতের কথা। রাত্রিবেলা ফ্ল্যাটের আসবাবগুলো নড়ত ঠকঠক করে, বন্ধ ঘরের ভেতর টেবিলে কাগজপত্রগুলো ফরফর করে উড়ত। অংশুমানের ছোটমাসি কলকাতা শহরে মোট আটবার বাড়ীবদল করেছিল; প্রতিবারই কোনো না কোনো অশরীরী উপদ্রব তৃণাদি'দের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।
(৯)
অংশুমানের ছোটমাসির প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন সুচিত্রা সেন। তখনও কালার টেলিভিশন আসেনি বাড়ীতে; অংশুমানদের একটা সাদা-কালো টিভি ছিল। ছোটমাসিরা এলেই তাতে সুযোগমতো সিনেমা দেখা হতো। মিসেস সেনের ব্যাপারে যাবতীয় খুঁটিনাটি ছোটমাসির মুখস্থ ছিল; আর সুচিত্রার গল্প শুনতে শুনতে অংশুমান লক্ষ্য করত পর্দায় রিনা ব্রাউনের সেই ডানগালচোখ চুলে-ঢাকা উদ্ধত সুন্দর মুখ, যেখানে ঘৃণা ও ক্রোধ ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো আছড়ে পড়ছে তিনবার মাটিতে পা ঠোকার সাথে সাথে — হোয়াই? হোয়াই? হোয়াই?
(১০)
সুচিত্রা যখন চিবুকটা সামান্য উঁচু করে ক্যামেরার দিকে তেরচাভাবে তাকিয়ে কাটা-কাটা ডায়ালগ বলতেন, অংশুমান মনে মনে ভাবত কলকাতা শহরের একটা বাড়ীর কথা, যেখানে একজন বিদেশী অভিনেত্রী তাঁর নিজস্ব জগতে বাস করেন এবং গোটা শহরটা তার কল্পনায় মিশে যেত সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। দীর্ঘকায় হাইরাইজগুলির পিছনে যখন সূর্য অস্ত যায়, তখন গঙ্গার বুক থেকে আলো এসে সোনালী মাকড়সার জাল বুনে দেয় কলকাতার রেশমি কালো চুলে; উদ্ধত শহর তখন গ্রীবা বাঁকিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে, আর কাতারে কাতারে মুখহীন মানুষের দল পিঁপড়ের মতো হাওড়ার পুল বেয়ে, ট্রেন ধরে ঘরে চলে যায় পরদিন ভোরে ফের ডেলিপ্যাসেঞ্জার সেজে শহরে ফিরবে বলে।
(১১)
এক-একবার অবশ্য সিনেমা দেখা হত না, কারণ ছোটমাসিরা আসার কিছুদিন আগে হয়তো হঠাৎ একটা ভোঁতা আওয়াজ করে বিরাট দৈত্যের মতো উঁচু ট্রান্সফর্মারটা উড়ে গ্যাছে; এমনি সময়ে ট্রান্সফর্মারটা বিশেষ নজরে পড়ত না, কিন্তু পুড়ে যাবার পর বোঝা যেত ওইটাই গ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, কেননা এরপর আর একমাস কারেন্ট থাকবে না, ফলে দিনগুলো ছোট হয়ে গেল।
(১২)
কারেন্ট না থাকলে যেটা মূল সমস্যা সেটা হচ্ছে জল, কারণ অংশুমানদের ছিল কম্প্রেসার পাম্প, জেট নয় — সাবমার্সিবলের নাম তখনও অজানা — গাঁকগাঁক করে চলত যখন পাম্পটা, আধঘন্টা ধরে, বাড়ীতে আর কারোর কোনো কথা বলার বা শোনার জো থাকত না। আধঘন্টা পরে থামলে মনে হত পৃথিবীতে যুদ্ধবিরতি হলো। কারেন্ট না থাকলে, বলাই বাহুল্য, পাম্প নেই — সেক্ষেত্রে উপায় হচ্ছে শ্যাওলাসবুজ টিউবওয়েল, যার নীচে শানবাঁধানো জায়গাটা লাল হয়ে থাকত আয়রনের দাগে আর যেটা সম্পর্কে বাড়ীর সকলেরই আতঙ্ক ছিল কারণ বেশিরভাগ সময় অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকা পিস্টনটায় খুব চাপ দিলে তবে একটু জল উঠত, কিন্তু হ্যান্ডেলের ওপর থেকে যদি হাত পিছলে যেত কোনোভাবে, লাফিয়ে উঠে হ্যান্ডেলটা থুতনি ফাটিয়ে দিত, তারপর সেই থুতনি সেলাই করতে যেতে হত ডাক্তারের কাছে।
(১৩)
হ্যারিকেনগুলোয় কেরোসিন ভরে রাখা হয়েছিল, একটার কাঁচ ফাটা ছিল, ট্রান্সফর্মারটা পোড়বার পরে অংশুমানের মা তাকে দোকানে পাঠিয়েছিল কাঁচ কিনে আনতে। কাঁচগুলো মোছা হয়েছিল ভালো করে, ভুষোকালির দাগ ছিল না একটুও; ফলে দিব্যি আলো দিচ্ছিল। দালানে মাদুর পেতে বসেছিল তৃণা ও অংশুমান, পাশে হ্যারিকেন; তৃণা পায়ের নখে নেলপালিশ লাগাতে লাগাতে রবিনসন ক্রুশোর গল্পটা বলছিল; হ্যারিকেনের আলোয় তাদের লম্বা ছায়া পড়েছে অনেকদূর, প্রায় দালানের ঐ প্রান্তে দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা মইটা পর্যন্ত। জানলার বাইরে হাওয়া ঘুরে ঘুরে খসখস শব্দ তুলছে, চাঁদ উঠেছে কি ওঠেনি বোঝা যাচ্ছে না, কারণ উঠোনের ওপর ঝামড়ে রয়েছে আমগাছটা। অন্ধকারের ভেতর গল্প শুনতে বেশ লাগে, চোখ ব্যস্ত থাকে না শব্দগুলো পড়তে, ফলে বাক্যগুলো সরাসরি ছবি হয়ে যায় অংশুমানের মগজে।
(১৪)
বাইরের ঘরটায় দাদু রেডিও শুনছেন। আকাশবাণীর খবর। কলকাতা ক প্রচার তরঙ্গে। অংশুমান জানে আকাশবাণী নামটা রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। উঠোন পেরিয়ে বাড়ীর পাঁচিল টপকে বাগান। সেখান থেকে কটাশ ডাকছে মাঝে মাঝে, কটাশকে চোখে দেখা যায় না। এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে ভেসে ভেসে আসছে আকাশবাণীর বেতার তরঙ্গ। তাকেও চোখে দেখা যায় না, শুধু রেডিওর নব ঘোরালে শুনতে পাওয়া যায়। একটা শহর রয়েছে ওইদিকে; বাগান পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে রেললাইন, তারও অনেক অনেক পরে, যেখানে আকাশবাণীর অফিস। ঐ শহরটার নাম কলকাতা।
(১৫)
আশ্চর্য বর্ষাপ্রবণ ছিল সেইসব বছরগুলো। মৌসুমী হাওয়ার দেশে তখন সবসময় বৃষ্টি পড়ত; ধানের শীষের মতো বৃষ্টির শব্দ শোনা যেত অবিরাম। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত বর্ষার কাঁচভাঙা আলো, একটু অসতর্ক হলেই যেন পা কেটে যাবে। কিন্তু এই ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে ঋতুর প্রভাব গ্রাম্য জীবনে খুব সুখকর ছিল না; সবচেয়ে স্পষ্ট যে সমস্যাটা অংশুমান টের পেত সেটা হচ্ছে অসংখ্য নামহীন পোকামাকড়ের উপদ্রব। চেনা যে জন্তুগুলো সবথেকে বেশি চোখে পড়ত, সেগুলো ছিল উচ্চিংড়ে, ক্যান্দাই এবং অবশ্যই, আরশোলা।
(১৬)
বহুবছর পরে 'দ্য প্যাশন অ্যাকোর্ডিং টু জি.এইচ.' পড়তে গিয়ে এই ঘটনাটা অংশুমানের মনে পড়বে: অংশুমানের মা চিরকালই ভীষণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লোক; ফলে বর্ষাকালে তার খুব সমস্যা হতো। অর্ধেকদিনই খাবার সময় পোকামাকড় এসে পড়লে না খেয়ে উঠে যেত। একদিন রাতে, অংশুমানের মা তখন কলেজে পড়ে, দিদু থালায় ভাত বেড়েছেন দুজনের, হ্যারিকেনের আলোয় খেতে খেতে হঠাৎ একটা আরশোলা দিদুর পাতে এসে পড়ল। দিদু তখন ভাবলেন আরশোলাটাকে পাতের পাশে ফেললে মেয়ের চোখে পড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে থালা ফেলে উঠে যাবে, সারারাত খালিপেটে থাকবে মেয়েটা; ফলে তিনি কোনো শব্দ না করে ভাতসুদ্ধু আরশোলাটাকে মুখে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন।
(১৭)
বিয়ের পর, অংশুমানের দাদুর মনে আছে, স্ত্রী খুব প্রাণ নিয়ে, খুব গাঢ় হয়ে জিগ্যেস করেছিল — বলো তো, 'বকের পাখায় আলোক লুকায় ছাড়িয়া পুবের মাঠ', এই লাইনটা কার লেখা? তিনি না ভেবেই বলেছিলেন — রবিবাবু বোধহয়; 'বলাকা' হয়তো, বক রয়েছে যখন। — মোটেই না, এটা যতীন সেনগুপ্তের লেখা। — যতীন সেনগুপ্ত? কাজলা দিদির? — আরে না, কাজলাদিদি, সে তো যতীন্দ্রমোহন বাগচির। — বাগচি? আর যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত কে যেন ছিল? — সে তো কংগ্রেসের নেতা, নন-কো'র সময়ে — ও, তেষট্টি দিন অনশন করেছিল, তাই না? — ধ্যাত, সে তো যতীন দাস। এতগুলো যতীন নামের মানুষ জীবনের সার্থকতায় পৌঁছেছে, পৌঁছুতে পেরেছিল সকলেই, ভেবে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন, অবশ্য তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিলেন এইসব মানুষের, সকলেরই কীর্তিকাহিনী বেশ সুস্থিতভাবে তাঁর স্ত্রী মনে রেখেছে দেখে।
(১৮)
অংশুমানের ঠাকুমা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ইস্কুলে পড়েছিলেন; সেখানে চমৎকার সেলাই শিখেছিলেন তিনি। বুড়ো বয়েসেও জটিল কলকার নকশা বুনে কাটাতেন গ্রীষ্মের লম্বা দুপুরগুলো; আর অংশুমানকে পুরোনোদিনের গল্প শোনাতেন। সাতচল্লিশ সালের সেইদিনটি কীরকম মাইকে মাইকে ঘোষণায়-হুল্লোড়ে কেটেছিল, বলতে ভালোবাসতেন। আরেকটি ঘটনার কথাও বলতেন, ইস্কুলে পড়াকালীন যখন প্রবল বন্যা হয়েছিল; এক বৃষ্টিধূসর দিনে থানা থেকে চোঙামুখে পাড়ায় পাড়ায় লকগেট ভাঙার হুঁশিয়ারি প্রচার করা হচ্ছিল। অংশুমানের স্মৃতিতে দুটো ঘটনা কিভাবে যেন মিশে গেছিল, ফলে স্বাধীনতা বললেই তার চোখে ভেসে উঠত বন্যার টইটম্বুর জল আর মাঝে মাঝে সতর্কতা জারি।
(১৯)
ছোটবেলা থেকে অংশুমান দেখেছে দালানের দেয়ালে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটার পাশে বাবার ঠাকুমার একটা সাদা-কালো অস্পষ্ট পোর্ট্রেট টাঙানো; তাঁকে সবাই, সে শুনেছে, বোলো নামে ডাকত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বোলোর বাবা বাগদাদে গিয়েছিলেন বেঙ্গলি রেজিমেন্টের হয়ে লড়তে। তার মাসকয়েক আগেই জেনারেল স্ট্যানলি মডের নেতৃত্বে বাগদাদ দখল করেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা এবং মার্চ ১৯, ১৯১৭ তারিখে বাগদাদবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ঘোষণাপত্রে জেনারেল মড জানিয়েছেন: '…. I am charged with absolute and supreme control of all regions in which British troops operate; but our armies do not come into your cities and lands as conquerors or enemies, but as liberators.'
(২০)
বাগদাদে পৌঁছে ব্যাটেলিয়নের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে; ক্রমে ক্রমে তারা স্থানান্তরিত হয় বসরায়। আর্মিস্টিসের পরেও বিভিন্ন কাজে বসরায় থাকতে হয়েছিল তাদের এবং বোলোর বাবা বেশ অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ফলে দেশে ফিরে মেয়েকে তিনি সচ্ছলতায় বড়ো করেছিলেন। অংশুমানের দাদুর বাবা কাজ করতেন আড়িয়াদহর জুটমিলে; বোলোর বিয়ে হয়েছিল তাঁর সাথে। কিন্তু লোকটি ছিলেন অলস প্রকৃতির; কাজ ছেড়ে একসময় তিনি ছোটছেলেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন কবিরাজীচর্চায় মন দিতে। বড়ছেলেটিকে নিয়ে বোলো কিছুদিনের জন্যে বদ্যিবাটীতে বাপের বাড়ী গিয়ে থাকেন।
(২১)
গ্রামে আসার পর একদিন বোলোর স্বামী হঠাৎ মারা যান; চান করার সময় পায়ে জোর না পেয়ে আস্তে আস্তে তিনি বসে পড়েন কলতলায় এবং বালতির জলে মাথা ডুবিয়ে রেখে শেষ নিঃশ্বাস ফ্যালেন। তাঁর ছোটছেলেটি বাবাকে খুঁজে পায় এই অবস্থায়। দিনদুয়েক পরে বদ্যিবাটী থেকে লোকজন এসে পৌঁছানো অব্দি সে একা থাকে ঐ বাড়ীতে। সেই দু-তিনটি নক্ষত্রবিহীন রাতের নিঃসঙ্গতা আজীবন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এর বেশ কিছু বছর পরে অংশুমানের ছোটদাদু বাড়ী থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
(২২)
বাবার মৃত্যুর পর অংশুমানের দাদু কলকাতায় কাজ খুঁজতে গেলেন; বোলো ছোটছেলেকে নিয়ে বদ্যিবাটীতেই থাকতেন। তখন মন্বন্তরের ফলে কলকাতা সারসার কঙ্কালের শহর। মৃত্যুর যে স্বাভাবিক সম্ভ্রমটুকু ছিল এইসব নিঃস্ব মানুষের জীবনে, খরা ও দুর্ভিক্ষ তা কেড়ে নিয়েছে চিরতরে। অনেকবছর পরে যখন অংশুমান খেতে বসে ভাত নষ্ট করবে, তার দাদু তাকে নিস্পৃহভাবে বলবেন যে একদিন ফ্যানের জন্যে মানুষ কত হাহাকার করেছে; আর সঙ্গে সঙ্গে তা শুনতে পেয়ে ঘর থেকে অংশুমানের ঠাকুমা বেরিয়ে এসে স্বামীকে ধমক দেবেন। সেইসব অন্ধকার দিনগুলির স্মৃতি ভুলে যাওয়া যাক।
(২৩)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অংশুমানের দাদুকে চূড়ান্ত অভাবের মধ্যে পড়তে হয়েছিল; বাধ্য হয়ে তিনি নাম লিখিয়েছিলেন সুইসাইড স্কোয়াডে। ফলে বিস্কুট, পাঁউরুটি, এগপাউডার ইত্যাদি রেশন পেতেন তিনি। কিন্তু বোলো যখন জানতে পারলেন যে ছেলে সুইসাইড স্কোয়াডে নাম লিখিয়েছে, তিনি একটা আশ্চর্য কাজ করে বসলেন: বদ্যিবাটী ছেড়ে গ্রামে স্বামীর ভিটেতে ফিরে এলেন তিনি। সেই ঘরবাড়ি তখন বুকসমান জঙ্গল; একাহাতে তিনি কেটে সাফ করলেন সব আগাছা। তারপর একখানা ঘর তুললেন। অনেক পরে যখন ক্রমে ক্রমে দোতলা বাড়ী হয়, বোলোর মাটির ঘরটা জীর্ণ হয়ে রয়ে যায় বাড়ীর সামনে; আর এই পোড়োঘরের জানলা থেকেই দাঁড়াশ সাপটা খসে পড়েছিল অংশুমানের কাঁধে।
(২৪)
কলকাতায় ভবানীপুরে জগুবাবুর বাজারের ওপর একটি ঘর নিয়ে থাকতেন অংশুমানের দাদু; ইকমিক কুকারে রেঁধে খেতেন। ছেলেকে, জেদ ছিল তাঁর, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। সিটি কলেজে তখন ফিজিক্সের হেড ছিলেন সি আর দাশগুপ্ত; তাঁর সুপারিশে অংশুমানের বাবা ভর্তি হয়ে গেল। হ্যারিসন রোডের ওপর একটি পায়রার খুপরির মতো ঘরে ছেলেকে রাখার সামর্থ্য ছিল অংশুমানের দাদুর। কিন্তু নিজে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় থাকার চেষ্টা করলেন না তিনি; মন্বন্তর, জাপানী বোমার আতঙ্ক আর ব্ল্যাকআউটের শহর, ছেচল্লিশের দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহর, যেখানে তিনি কাটিয়েছেন যৌবনের দিনগুলো, তাঁর প্রিয় কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন গ্রামে।
(২৫)
খবরের কাগজ আর একটি রেডিও, এই ছিল কলকাতার সঙ্গে তাঁর একমাত্র যোগসূত্র। সিনিক্যাল মানুষ ছিলেন তিনি, নেসফিল্ডের গ্রামার বইটা ছিল তাঁর অবসরের সঙ্গী। সাহেবদের অধীনে কাজ করতে করতে চোস্ত ইংরেজি শিখেছিলেন; ব্রিটিশ কলকাতার প্রতি আশ্চর্য নস্ট্যালজিয়া ছিল তাঁর। একলা থাকতে ভালোবাসতেন। পুজোর সময় অষ্টমীর গভীর রাতে অংশুমানরা সবাই যখন দুর্গামন্দিরে চলে যেত, ফাঁকা বাড়ীতে তিনি একা থাকতেন। অংশুমান দেখত সন্ধিপুজোর আগে সবাই চুপচাপ, পাঁঠাবলি হবে; হাড়িকাঠে পরিত্রাহী চিৎকার করতে থাকা ছাগলটাকে ঢোকানো হচ্ছে, মরে যাবার আগের সেই আপ্রাণ অসহায় চিৎকার। অংশুমান পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসত দুর্গামন্দির ছেড়ে; ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে দ্রুত।
(২৬)
বাড়ীর সামনে এসে অংশুমান দেখতে পেত বাইরের ঘরটায় দাদু আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন; মাথাটা ঢুলে পড়েছে বুকে আর পাশের রেডিওটা থেকে বেরিয়ে আসছে বেগম আখতারের গলা — জো ছো না কো রে ছে আআআআড়ি/ জোছোনা কোরেছে আআআড়ি/ আ সে না আমার বাআআআড়ি/ আসেনা আমার বাআআড়ি/ গলি দিয়ে চলে যাআআআয়। যেন জোড়া পাকুড়গাছের গুঁড়ি থেকে পূর্ণিমার রাতে নরম আঠালো সাদা রস গড়িয়ে গড়িয়ে জমা হচ্ছে চামিন্দীর মাঠে, যেখানে ঘাসফড়িঙেরা খেলা করে, তাদের পায়ে পায়ে ছড়িয়ে যায় ময়ূরগন্ধ আর মানুষের শরীরে তীব্র শোক জাগে। ঠিক সেইমুহূর্তে পিকাসোর বুড়ো গিটারবাদকের নীল অবয়ব দেখতে দেখতে অংশুমানের মগ্নতা চুরমার হয়ে যেত ঢাকের জোরালো আওয়াজে।
(২৭)
মার্চ ১৬, ২০০৩ ডিক চেনি জানিয়েছিলেন: 'I think things have gotten so bad inside Iraq, from the standpoint of the Iraqi people, my belief is we will, in fact, be greeted as liberators.' তারপর থেকে ইরাকের যুদ্ধপরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়েছে; ইতিমধ্যে কালার টেলিভিশন এসে পৌঁছেছিল অংশুমানদের বাড়ী। ইরাক দেশটা সম্বন্ধে অংশুমানের কোনো ধারণাই নেই; বিবিসিতে দ্যাখে সে জলপাই পোষাক-পরা মিলিটারি গুলি চালায় ট্যার-ট্যার করে, দূরে মিনার ভেঙে পড়ল, দুম করে বোমা ফেটে ছাইরঙা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল টেলিভিশনের পর্দার অনেকখানি জায়গা।
(২৮)
শীতের শুরুতে অংশুমানের মা ভাবল, এসব মনের ব্যাপারে হোমিওপ্যাথিই ভালো কাজ দেয়। এমনিতে অংশুমান ডাক্তারখানা যেতে চায়না; বিশেষত পেটে ক্রিমির জন্যে বড়ো বড়ো ট্যাবলেট খাওয়ানোর পর থেকে। কিন্তু এইবার সে রাজী হয়ে গেল সহজেই কারণ হোমিওপ্যাথি ডাক্তার তেঁতো ওষুধ দেয় না। ডাক্তারের সহযোগী, ওষুধ প্রস্তুত করেন যে মহিলাটি, তিনিও অংশুমানকে গেলেই ওষুধহীন সাদা সাদা মিষ্টি বড়ি খেতে দেন। ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে অংশুমান মায়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ী ফিরতে লাগল।
(২৯)
পিচরাস্তা ধরে কিছুদূর যাবার পর মা বলল — পাকারাস্তা ধরে যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, গিয়ে সন্ধ্যে দিতে হবে। চল মাঠের রাস্তাটা ধরি, চট করে গ্রামে ঢুকে যাব। দুজনে নেমে এল মাঠে। ধানশূন্য রুক্ষ শীতের মাঠ। ধুলো ধুলো আলপথ, আর দূরে সূর্য প্রায় নেমে এসেছে দিগন্তের কাছে। আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে অংশুমান হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। ওর মা তাড়াতাড়ি ওকে ধরে বলল — কি হল? ওটা তো একটা শুকনো ডাল। ডালটা আকাশী নীল হাওয়াই চটি-পরা পায়ে করে সরিয়ে দিল। অংশুমান একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। ফের চলতে চলতে ও হঠাৎ শিউরে উঠে একবার নিজের কাঁধে হাত বুলিয়ে নিল।
(৩০)
দোতলার ঘরে বিছানায় শুয়ে বারান্দায় রাখা নিভু-নিভু হ্যারিকেনটার দিকে চুপ করে চেয়েছিল অংশুমান। নিঝুম রাত্রি। তার বাবা-মা ঘুমিয়ে পড়েছে; ঘুম নেই তার চোখে। সে শুনেছে বাবা-মা তাকে নিয়ে কলকাতা চলে যাবার পরিকল্পনা করছে। অংশুমানের পড়াশোনার জন্যে, সবকিছুর জন্যে — গ্রামে কিছু নেই আর। তৃণাদি'র কথা ভাবে সে; তৃণা তাকে শিখিয়েছে খাওয়ার সময় সর্বদা বাঁহাতে জলের গ্লাস ধরতে। — তুই এতো ভীতু আর জড়োসড়ো কেন? কিচ্ছু নেই, ভূতটূত, এমনকি এই দ্যাখ — সেদিন দুপুরে অংশুমানের চোখের সামনে তৃণা একটা পুজো-করা ফুল মাড়িয়ে দিয়েছিল পায়ের তলায় — কিছু হলো?
(৩১)
দুপুরের সেইমুহূর্তে অংশুমান দেখেছিল ঝাঁ-ঝাঁ রৌদ্রের প্রখরতা কয়েকশ গুণ বেড়ে গেল হঠাৎ, আর তৃণা, কী আশ্চর্য স্পর্ধা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে ফুলটা গোড়ালিতে চেপে; সেইদিন বিকেলে একা একা অংশুমান ফের গিয়ে ঢুকেছিল চিলেকোঠায়, বের করে এনেছিল পত্রিকাটা, যার প্রচ্ছদের প্রশ্নটা ছিল — নতুন বছর কেমন কাটবে? পাতা ওলটাতে ওলটাতে অংশুমান পৌঁছে গেছিল সেই প্যারাগ্রাফটায় যেখানে লেখা — অমুক রাশির ক্ষেত্রে মাতৃস্থানীয়া ব্যাক্তির মৃত্যু; 'অমুক' রাশিটা অংশুমানের।
(৩২)
অংশুমানের মায়ের আবৃত্তির শখ ছিল। অংশুমানের দিদু রেলের চাকরিটা পেয়েছিলেন দুর্ঘটনায় মৃত স্বামীর জায়গায়; অনেকে পরামর্শ দিয়েছিল তাঁর পরিবর্তে তাঁর মেয়ে চাকরিটা করলে স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে পারবে। কিন্তু সেকথা না শুনে তিনি তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। অংশুমান জানে তার মায়ের একটা চাপা দুঃখ আছে। টেলিভিশনে আবৃত্তির প্রোগ্রাম থাকলে অংশুমান দেখেছে তার মা মন দিয়ে শোনে, যখন মহিলা সঞ্চালক সঠিক উচ্চারণ শেখান — আব্-বৃতি নয়, আ-বৃত্-তি।
(৩৩)
যুদ্ধ এগিয়ে চলেছে ক্রমে; শোনা যায় সাদ্দাম ধরা পড়েছে, সাদ্দামের ফাঁসি হবে। টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে ওঠে উস্কোখুস্কো চুলদাড়িসুদ্ধু লোকটার মুখ। নীচে লেখা আসে: ট্রায়াল অফ সাদ্দাম হুসেন। টাকমাথা একজন জজসাহেব রায় শোনাতে থাকেন আর দাড়িওলা লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। কী ভাষায় কথা হচ্ছে অংশুমান বোঝে না, ভাষাটা ইংরেজি নয়। সত্যি লোকটাকে মেরে ফেলা হবে? ফাঁসির দিন বিচ্ছিরি ব্যাঁকাট্যারা ফুটেজ ভেসে আসে টেলিভিশনে। সেলফোনে তোলা হলদে রঙের সেই ছবিতে দেখা যায় সাদ্দামের গলায় পড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একটা মোটা দড়ি। টেলিভিশনের সামনে সবাই দমবন্ধ অপেক্ষা করতে থাকে। কতটা দেখাবে? পুরোটা?
(৩৪)
মা চা করছিল — সেই দৃশ্য দ্যাখে সে, দ্যাখে কিভাবে সসপ্যান থেকে ছেঁকে চা ঢালা হয় কাপে কাপে। বছরের শেষবিকেল ফুরিয়ে আসছে দ্রুত, মাসখানেক পরে নতুন বছরে ওরা চলে যাবে কলকাতায়; সব ঠিক হয়ে গ্যাছে। সেই আবিষ্কারের গল্পগুলো পড়ে ফেলেছে অংশুমান, শেষ কাহিনীটিতে এসে সে খুঁজে পায় একটা নতুন দেশ, যেখানে স্পেন-পোর্তুগালের দুর্ধর্ষ নাবিকেরা পৌঁছাতে চেয়েছিল জীবন বাজি রেখে: এক উজ্জ্বল সকালে পোর্তুগালের রাজা মানুয়েল বসে আছেন তাঁর সভাকক্ষে, সামনে স্তুপীকৃত মানচিত্র ও নেভিগেশন চার্টগুলি; উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারত অভিযানের জন্যে যোগ্য লোক নির্বাচন করতে পারছেন না তিনি। তাঁর সামনের দালান দিয়ে তাঁকে সেলাম করে চলে যাচ্ছে রাজকর্মচারীর দল। তিনি ঠিক করলেন এইবার মুখ তুলে যাকে দেখবেন তাকেই তিনি দায়িত্ব দেবেন এই অভিযানের; একটি সুদর্শন যুবক স্যালুট করে চলে গেল। চিনতে পারলেন মানুয়েল; তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠলেন — ডেকে আনো ভাস্কো দা গামাকে।
(৩৫)
ঝুঁকে ড্রয়ারের ভেতর কী একটা খুঁজছেন অংশুমানের দাদু আর বছরের শ্রেষ্ঠতম আলো এসে পড়েছে তাঁর গায়ে। এখন নদীর খাতে পোষা আলো ক্রমে মরে আসছে, ঘাসের নরমে ফড়িঙের দেহ অযথা শুকিয়ে যায়, ডুমুর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে — দুদিকে নক্ষত্রজন্ম, মাঝখানে বিস্তৃতপক্ষ মাছের গায়ে পিছলানো রোদের মতো এই অন্তর্বর্তী জীবন তাঁর দীর্ণ হয়ে পড়েছে — এইরকম বোধ হলো। অংশুমানের দিকে ফিরলেন তিনি — এটা তোকে দিলাম। অংশুমান দেখল একটা পাঁচটাকার কয়েন, ১৮৭০ সালের; কুইন ভিক্টোরিয়ার ছবি খোদাই করা। কয়েনটা হাতে নিয়ে সে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল আর দেখতে পেল চোখের সামনে তাদের বাড়ীটা কেমন পুরোনো হয়ে যাচ্ছে হঠাৎ; মাকড়সার জালে ছেয়ে যাচ্ছে সিলিঙগুলো, চুন খসে পড়ছে বন্ধ গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটার তলায়, গুঁড়ো গুঁড়ো নক্ষত্রের ধুলো ও বালিতে সম্পূর্ণ ঢেকে যাচ্ছে তাদের উঠোনটা।
[উপন্যাসের খসড়া]