যথেষ্ট সময় নিয়েও নতুনকে স্বীকার করতে না পারার মধ্যে যেমন মূর্খের জড়তা আছে, পুরোনোকে এক ঝটকায় অস্বীকারের মধ্যেও সমমাত্রায় অস্থিরের মূর্খামি আছে। প্রযুক্তির ব্যবহার উৎকৃষ্টতায় পৌঁছোয় যখন তা জাড্যের প্রকৃতিকে ধারণ করতে পারে। পুরোনো থেকে নতুনে এক স্বতঃস্ফূর্ত চলাচল, একটা ফেড ইন ফেড আউট দরকার পড়ে। শার্প কাট অনেক কিছু মুছে দেয়, চিরতরে।
ঠিক যেমন আমাদের মুদ্রণ সংস্কৃতিতে লেটারপ্রেসের চলে যাওয়া আর ডেস্কটপ-ভিত্তিক ব্যবস্থা চালু হওয়া। কম্পিউটারকে মেনে নিতে এত দেরিই-বা হল কেন; আর মেনে নেওয়া যখন হল, তখন তা এমন আদেখলের জায়গায় পৌঁছেই-বা গেল কেন! গত শতকের শেষ আর চলতি শতকের শুরুর দিকে কলকাতা ও আশপাশের মফস্সলে রাতারাতি প্রায় স্ক্র্যাপের দরে বিক্রি হয়ে যেতে থাকল লেটারপ্রেসগুলি, তার জায়গায় ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে উঠল ডিটিপি ইউনিট। আপাতভাবে মনে হবে, তাতে তো ভালোই হল। ঠিক, কিছু ভালো হলও। মুদ্রণের শ্রম কমল, সময় কমল, হয়তো খরচও খানিক কমল। প্রযুক্তির যে ব্যবহারিক সুফলগুলি অবশ্যকাম্য। কিন্তু এই যে মুদ্রণ ব্যাপারটিকে ‘আপাতভাবে’ বেশ সহজ মনে হতে লাগল, মনে হতে লাগল চাইলেই ছাপাছাপির ছোটোখাটো ব্যাবসা শুরু করে ফেলা যায়, এমনকী পাঞ্জাবি পরে সম্পাদক বা প্রকাশকও হয়ে ওঠা যায় বেমালুম, তাতে ঠিক কী কী ক্ষতি হল বাংলা বাজারে, তা আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো একটু অশ্লীলই হবে। সে-প্রসঙ্গ থাক বরং। তবে, গ্রুমড হওয়ার, শিক্ষানবিশি করার, হাতে-কলমে কাজ শেখার প্রসঙ্গ যে একপ্রকার উঠেই গেল, তা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা যায়।
আসলে মুদ্রণ প্রযুক্তির এই আকস্মিক পট পরিবর্তন সবথেকে বেশি বদলে দিল আমাদের মন-মানসিকতা। এ নিয়ে অন্যত্র সবিস্তার আলোচনার চেষ্টা করেছি অতীতে, এখানে সেই পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটব না। কেবল একটা কথারই পুনরুক্তি করব, ব্যবহারিক দিক থেকে ইতিহাসকে আদ্যন্ত অপ্রয়োজনীয় বলে ধরে নেওয়ার একটা অধিকার আর দীক্ষাই যেন পেয়ে গেল আমাদের মন ও মগজ। অতীত যেটুকু রইল, তা দীর্ঘশ্বাসে আর স্মৃতি মৈথুনে। বিশেষ সংখ্যার ন্যাচারাল শেড হয়ে উঠল আরেকটু গাঢ়, সেপিয়ার কাছাকাছি।
এইসব নিয়ে কথা হয়তো কম হয় না, কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয়? পুরোনো হরফের সংরক্ষণে, পুরোনো মুদ্রণ প্রযুক্তিকে ধরে রাখতে, পুরোনো বাঁধাই পদ্ধতির আর্কাইভিং-এ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা দিবস পালন করা বাঙালির অবদান ঠিক কী? সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা কতদূর? এসব আমরা ভাবতে চাই না, কারণ সংরক্ষণ অপেক্ষা হাহাকার আমাদের অধিক প্রিয়। গত বছর কয়েকে বাংলা হরফ প্রসঙ্গে পঞ্চানন কর্মকারের নাম বেশ উঠে আসতে দেখি। তাই নিয়ে গালগল্প করে লেখালিখিও কম হয় না। কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে, প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো সেই ট্র্যাডিশন, উইলকিন্স-পঞ্চাননে যার শুরু, তা এই এতদিন জীবিত ছিল শহর কলকাতার বুকে। ধাতব বিচল হরফ বানানোর পদ্ধতি, অবিকল না হলেও, তার কাছাকাছি তো বটে। যার মৃত্যু ঘটল গত মাসে; ২০২০ সালের এই ডিজিটাল অগাস্টে।
হ্যাঁ, লেটারটাইপ ফাউন্ড্রি। এটিই ছিল বাংলার শেষ হরফ ঢালাইখানা। যেখানে তৈরি হত লেটারপ্রেসে ছাপার ধাতব হরফ। কয়েক সপ্তাহ আগেই মুছে গিয়েছে তার অস্তিত্ব। কী এই ফাউন্ড্রির ইতিহাস? এককালে এটিই ছিল বিখ্যাত শ্রী টাইপ ফাউন্ড্রি। তার মালিক ছিলেন বাংলা হরফের দুনিয়ায় বিশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। যতীন্দ্রচন্দ্র হুই। আড়ালে থাকা মানুষ, কিন্তু হরফ ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ব্যাবসার চেয়ে হরফের নিত্যনতুন ডিজাইনের প্রতিই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। শ্রী টাইপ ফাউন্ড্রির বিভিন্ন হেডিং টাইপ ছিল বিখ্যাত। একাধিক টাইপফেস রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পায়। ১৯৬৮-৬৯ সাল নাগাদ ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। কবি নন, এই লেখকের বিষয় ছিল আপাত নীরস – বাঙালির শিল্প-বাণিজ্য। একটি লেখায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন আরেক বিখ্যাত হরফ নির্মাণকারী সংস্থা কালিকা টাইপ ফাউন্ড্রির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মলয় চক্রবর্তীর কথা। বিশ্বকর্মা লিখছেন – ‘মলয়বাবু বললেন, টাইপের শ্রী যাকে বলে, লোকের চোখের সামনে তা কিন্তু তুলে ধরেছিলেন ‘শ্রী’ টাইপ ফাউনড্রীর যতীন্দ্রচন্দ্র হুই মশায়। তিনি আবার প্রিন্টিং মেশিনারী ব্যবসায়ী ইন্ডোসুইস কম্পানির অংশীদারও ছিলেন একসময়ে। হেডিং-এর টাইপে মৌলিকত্ব আনা ছাড়াও নানাভাবে যতীনবাবু টাইপ ফাউন্ডারদের পথিকৃৎ ছিলেন।’
কলকাতার টাইপ ফাউন্ড্রিগুলির গৌরবময় ইতিহাসের কথা লিখতে গিয়ে অতুল সুর ‘বাংলা মুদ্রণের দুশো বছর’ গ্রন্থে খানিক জায়গা নিচ্ছেন। পঞ্চানন কর্মকারের দাদা গদাধরের বংশধর অধরচন্দ্র কর্মকারের অধর টাইপ ফাউন্ড্রি থেকে শুরু করে তা তাঁর সমসময় পর্যন্ত গড়াচ্ছে। পঞ্চানন ঘরানার শেষ উল্লেখযোগ্য ছেনিকাটা শিল্পী হিসেবে রুদ্র টাইপ ফাউন্ড্রির শর্বরীভূষণ কর্মকারের কথা আসছে, তৎকালে আধুনিক ‘সুপার কাস্টার’ মেশিনের প্রসঙ্গও বাদ যাচ্ছে না। ১৯৭৭ সালের এই লেখাটিতে একটি পরিসংখ্যানও দিচ্ছেন তিনি – ‘এখন কলকাতায় প্রায় ৪০টা টাইপ ফাউণ্ডারি আছে। তাদের ব্যবসায়ে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা বিনিযুক্ত। ২০ জন টাইপ ফাউণ্ডারকে নিয়ে ইণ্ডোসুইস ট্রেডিং কোম্পানির যতীন হুই মহাশয় বেঙ্গল টাইপ ফাউণ্ডারস্ এসোশিয়েশন নামে একটি সমিতি গঠন করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে এক সময় ইণ্ডোসুইস ট্রেডিং কোম্পানি কলকাতার নানা ছাপাখানায় মুদ্রণের নানারকম সাজসরঞ্জাম ও যন্ত্র থেকে আরম্ভ করে রোটারি মেশিন পর্যন্ত সরবরাহ করত।’ সব দিক থেকে কলকাতার মুদ্রণ জগতে এমনই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন যতীন্দ্রচন্দ্র হুই।
এই যতীনবাবুর কাছ থেকে হাতবদল হয়ে এই ঢালাইখানা যায় তাঁরই পছন্দের মানুষ কানাইলাল চক্রবর্তীর কাছে। কানাইবাবু টাইপের ব্যাবসা শুরু করেন ১৯৫৬ সালে। নাম ছিল লিটল টাইপ ফাউন্ড্রি। অফিস ৭ নম্বর এজরা স্ট্রিট। শুরুতে নিজেদের কারখানা হয়নি, অন্য ফাউন্ড্রি থেকে মাল নিয়ে ছাপাখানায় ডেলিভারি করা হত। সেই সূত্রেই যতীনবাবুর সঙ্গে আলাপ। হাল ধরার আর কেউ নেই, তখন যতীনবাবু ব্যাবসা বিক্রি করে দিলেন পরিশ্রমী তরুণ কানাইলাল চক্রবর্তীকে। ১৯৬৫। ১২ বি, নেতাজি সুভাষ রোডে শ্রী টাইপ ফাউন্ড্রির নামের জায়গায় নতুন বোর্ড লাগল – লেটারটাইপ ফাউন্ড্রি। সেখানেই গো-ডাউন, বিক্রয়কেন্দ্র। আর টাইপ তৈরির কারখানা হল বাগমারিতে। বছর পনেরো পরে কারখানা উঠে এল কলকাতার দক্ষিণে। হাতে চালানোর মেশিন, স্বয়ংক্রিয় মোনোকাস্টিং মেশিন – সার সার যন্ত্রে তখন অবিরাম কাজ চলছে। মাসে অন্তত পনেরো দিন, ডে অ্যান্ড নাইট! তাতেও জোগান দেওয়া যেত না, আগাম অর্ডার দিয়ে যেতে হত প্রেস মালিকদের। গোটা অফিসে, কারখানায় যেন সর্বদা দক্ষযজ্ঞ চলছে। দম ফেলার ফুরসত নেই কারো। বাংলার অন্যতম বৃহৎ এই ফাউন্ড্রির দিকে তখন তাকিয়ে ত্রিপুরা, অসম, ওড়িশা, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, এমনকী বাংলাদেশও। প্রবাদপ্রতিম জে সি হুই আর তাঁর শ্রী টাইপ ফাউন্ড্রির শেষ ভৌগোলিক চিহ্নটুকু রাখা যায়নি। এবার বাংলা বর্ণমালার সেই উজ্জ্বল ইতিহাস একেবারে সাফ হয়ে গেল।
শেষে একটু নিজের কথা বলি। এই মৃত্যু ছিল প্রত্যাশিতই। কারণ লেটারপ্রেসের চল গত পনেরো-কুড়ি বছরে কমতে কমতে এখন তলানিতে। কাজেই, তার হরফ বানানোর কাজও যে বন্ধ হবে, তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু এই পদ্ধতিকে ধরে রাখার, কলকাতার ফাউন্ড্রিগুলির ইতিহাস ডকুমেন্টেশনের কোনো ব্যবস্থা হয়েছে বলে শুনিনি। আর এখান থেকেই আরেক দফা প্রশ্ন করার শুরু। তবে তা নিজেকে, নিজেদের। হাহুতাশ বাদ দিয়ে নিজেরাই কিছু করতে পারি কি না, সেই ভাবনায় ঝাঁপ দেওয়া। আত্মবিজ্ঞাপন নয়, আপাতত তথ্যটুকু সাঁটে দিয়ে রাখছি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েক জন বন্ধু মিলে সংগ্রহ করেছি এই ফাউন্ড্রির বেশ কিছু যন্ত্রপাতি, হরফ বানানোর বিবিধ যন্ত্রাংশ। জানি না এদের যথাযথ মর্যাদা দিতে পারব কি না। বাংলার মুদ্রণের সংস্কৃতি ও তার ইতিহাসকে সবিস্তারে ধরে রাখতে চাইছি আমরা। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। তখন বিজ্ঞাপন নিয়েই আপনাদের কাছে হাজির হব। আশা রাখি, হতাশার নুন-মরিচ ছড়ানো দীর্ঘশ্বাসের বদলে সমর্থন ও সহযোগিতার উল্লাস আমাদের পথ দেখাবে।
এমন তথ্য সমৃদ্ধ সুলিখিত প্রবন্ধের জন্য সুস্নাত বাবুকে ধন্যবাদ। বিশ্বকর্মার লেখা বই টি আমার কাছে আছে। একদা এক দুুটি
পত্রিকার কাজে যুক্ত থাকার সূত্রে এই জগৎ টির অল্প খবর পেতাম। পরিবর্তন ও চোখের সামনে ঘটলো। যা কিছু সংরক্ষণের দরকার ছিলো - সেই প্রসঙ্গটি এনে ভালো করেছেন।