আমার মনে হয় এই দুনিয়ায় ভাব্নারাই সবথেকে বেশি শক্তি ধরে। ওরা গ্রহ তারাদেরও এতোল বেতোল করে দিতে পারে। ইচ্ছে করলেই পারে। আমি শুনেছি। শুনলেই সবকিছু বুঝে নেওয়া যাবে তেমন দাবি অবশ্য আমার কোনদিনই নেই। মাথার খুলির মধ্যে আখরোটের মত দেখতে যে অদ্ভুত জিনিষটা আছে, তার যেটুকুন ক্ষমতা তাই দিয়ে কী বোঝা যায় ! এই দুটো আঙুলে গোনা যাবার মত বুঝশক্তি দিয়ে আমি শুধু এটুকু ধরতে পারি, যে ঐ আকার আয়তনহীন-কে বা জানে কী দিয়ে তৈরি 'জিনিষ'গুলো কিন্তু তোমার পুরো মনটাকে 'ইলিতিবিলি' করে দিতে পারে। না, 'ইলিতিবিলি' বলে আসলে কিছু হয়না। চুড়ান্ত রকম ভাবে 'আপসাইড ডাউন' এর ধারণা বোঝাবার জন্য আমি এ শব্দটা বানালাম।
তো, ভাবনারা। হ্যাঁ, ভাবনারা তোমার মনে ক্যাটিগরি ফাইভ হারিকেন তৈরি করতে পারবে। এমন মাত্রার কম্পন তুলতে পারবে যা দুনিয়ার কোন রিখটার স্কেল দিয়েই মাপা যায়না। ভাবনারা তোমার কানেকানে ফিসফিস করবে। শুনছো? তুমি বদ্ধমূল বিশ্বাসে তখন জানবে যে তোমার নাম 'প্রমিথিউস'। দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে আনা। তার থেকে বড় আর কোন উদ্দেশ্য নেই তোমার । জানবে।
'অস্তিত্বে' পৌঁছে যাবার যে কোমল গরম অনুভূতি, আলতো করে তোমাকে সেই সহজতার বারান্দায় নামিয়ে দিয়েও যাবে হয়তো একদিন।এই ভাবনারা।
ওদের আমি চিনি সে আজ নতুন কথা নয়। বুঝলে? সত্যি বলতে গেলে বলতে হয় ভাবনাদের সাথে আমার সম্পর্ক, মানে, ঐ একটু বেশ 'জটিল' আর কি! এই উথাল-পাথাল ভাবনার ঝাঁককে কাগজের মধ্যে নামতে দিও কখনো । সবসময়েই একটা ভীষণ সুন্দর গ্রাফিতির মত দেখায়। একটু বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেই গ্রাফিতি হয়ে যায় একটা 'মান্ডালা'। অদ্ভুত, না? অদ্ভুত না?
দ্বিতীয় নক্সা : ম্যাজিক
জাদুগরী ব্যপার স্যাপার কিন্তু কক্ষণো কারু সাথে ঘটেনা। জাদু, ম্যাজিক, শুধু 'থাকে'।একটা কনস্ট্যান্ট। কারুর কারুর তাকে বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকে। কারুর থাকেনা। ব্যস! আর কখনো কখনো এমনও হয় যে, তুমি যে ম্যাজিকের ভাষা জানো সেটাই তুমি জানতে পারবেনা, যদ্দিন না জানতে পারছো! সব গুলিয়ে গেলো তো? অমনিই হয়। এর'মই ও 'উদ্ভুট্টি। কিম্বা ম্যাজিক্যাল।
আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই জানতাম যে আমি ম্যাজিকের ভাষা দিব্যি পড়তে পারি। শুধু অক্ষরগুলো তখন চিনতামনা। সেটা কেমন করে সম্ভব আমাকে জিজ্ঞেস কোরোনা। বললাম তো উদ্ভুট্টিই এসব কারবার।
তারপর একদিন এলো, যখন সব বদলে গেলো।
সে এক ঝলমলে দিন ছিলো গ্রীষ্মকালে। বাকেট্লিস্টের একটা বাক্সে টিকচিহ্ন দেবার জন্য আমি সাঁতার কাটতে গেছিলাম । গ্রেট লেকগুলোর মধ্যে একটায়। মিশিগান।
গভীর অন্ধ্কার জল, তার মধ্যে আস্তে আস্তে নিজের বল্গা খুলে দিতে হয়। আমি টের পেয়েছিলাম জল আমার সাথে কথা বলছে। না, ওর কথা 'শোনা' যায়না। তোমায় বুঝতে হবে, সারা শরীর দিয়ে। ও স্রোতের ভাষা বলে। ঢেউ এর ভাষা। অতলের ভাষা। তরলের। আর আরো কতকিছুর, পৃথিবীর শব্দ দিয়ে যার নাম বলা যায়না।
বিশাল গভীর মিশিগান, আমার সাথে কথা বলেছিলো। আপনজনের মত।
সেই থেকে আমি জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। মিসিসিপি নদী ভয়ানক রেগে থাকে। মানুষরা ওকে এমন বিষিয়ে দিচ্ছে। রাগবে না তো কি করবে? হুরন লেক আবার খুব লক্ষ্মী মতো। মিশুকে, হাসিখুশি। মস্ত লেক সুপিরিয়র কি গম্ভীর! আমার সেই কঠিন নিষ্ঠুর শিকারী কাকুর মত। যিনি এককথায় আমার জন্য নিজের প্রাণটা দিয়ে দিতে পারতেন! ডেড সী ও চুপচাপ খুব। ইন্ট্রোভার্ট। সমাহিত। অথচ ভূমধ্য সাগর? ভূমধ্য সাগর আমাকে বলেছিলো ওকে 'খাতুনা' বলে ডাকতে। এক নম্বরের ফ্লার্ট একটা!
না, এসব আমি বলতে যাইনা কারুর কাছে। বলে কী হবে? আমি যে জলের সঙ্গে কথা বলতে পারি কেউ তো আর বিশ্বাস করবে না?
তৃতীয় নক্সা : পদ্ধতি
'প্রসেস' কথাটাকে আমি বাংলা করে 'পদ্ধতি' লিখলাম। কিন্তু দুজন এক লোক নয়। সব্কথার বাংলা হয়না। প্রসেসের গল্পই বলতে চাইছিলাম। পদ্ধতির নয়।
আসলে প্রসেসের গল্পও নয়। গল্পটা অন্য একজনের। বলছি।
তো, একদেশে এক আমি ছিলো। সে সবকিছুর মধ্যে সবচেয়ে ভালোবাসতো তাদের প্রসেসকে। বাঁচার প্রসেস। থাকার প্রসেস। বাংলা ভাষা বারবার আমার পায়ে খোঁচা দিচ্ছে দেখেছো? 'থাকার' মানে বাস করার নয়। 'থাকার' মানে এক্জিস্ট করার। কেমন দেরি করিয়ে দিচ্ছে, দেখেছো?
কী যেন? ও হ্যাঁ। আমি বাঁচতো 'প্রসেস' ভালোবেসে। প্রত্যেকটা দিন শুধু জেগে ওঠার মধ্যেই কত ভালোলাগা। জেগে ওঠা, নিঃশ্বাস নেওয়া, অস্তিত্ব, দিনটার মধ্যে দিয়ে দিয়ে হাঁটা। তার পরের দিন, তার পরের দিন, তার পরের দিন। ভালোলাগাই শুধু। আমি দিনগুলোর রাস্তা হাঁটা নিয়েই ভালোবাসায় জড়িয়েমড়িয়ে থাকতো। ওর কোথাও পৌঁছোনোর নেই। কিছুই খোঁজারও নেই।
সবকিছু একরকম থাকেনা অবশ্য। কোথাওই না। সব বদলে যায়। একদিন। কিম্বা অনেকদিন ধরে। আমি হোঁচট খায়। মুখ থুবড়ে পড়ে। আবার পড়ে। আবার পড়ে। 'প্রসেস' কিভাবে, কোন রাস্তা দিয়ে চলছে, আমি ঝুপসি কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ঠাহর পায়না।
আমি হন্যে হয়ে রাস্তা খোঁজে, যে রাস্তা ও খোঁজেনা। ও অপেক্ষা করে থাকে, যে অপেক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছে।
সেই আমিটা কোথায় গেলো? যে শুধু প্রসেস ভালোবেসেই জীবনে হাঁটতো? কোথায় গেলো কিজানি! তাই ভাবছি বসে বসে।
ভিন্টেজ কেকে! এমন নেশাধরানো লেখা, পড়েই মনে হয় ধুস্স ফুরিয়ে গেলকেন। আর তেমনি সাথের ছবিটা।
হমম, ফুরিয়ে যাওয়াটা বেশ আপশোসের ব্যাপার ...
দেখেছিলাম বর্গাকার বিশাল একটি নকশার হালকা আভাস, তিনজন ভিক্ষু আসনপিঁড়ি, পাশে পিতলের বেশ কয়েকটি শঙ্কু রাখা, ভিন্ন রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ প্রস্তরচূর্ণ ভরা শঙ্কুগুলি ... শ্রমণ সামনে ঝুঁকে ছোট ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করছেন, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দিচ্ছে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ... ধীরে ধীরে "মন্ডলা' নির্মাণ চলছিল। তারপর আশ্চর্য আলপনাটি এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলা -- অনিত্য জীবন বোঝাতে। ভাসিয়ে দেওয়া নদীতে। এবার নদী বহন করবে ওই প্রস্তরচূর্ণ, বালি -- যেন পৌঁছে যাবে সবার কাছে- সকল প্রাণীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবে শুশ্রূষা-
লেখাটিও তাই।