এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সময়কালের উজানে কতকগুলি ঢেউয়ের জল

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ মার্চ ২০২৪ | ৩৯১ বার পঠিত


  • একটি গাছ, একটি পাখি, একটি যন্ত্রণা, একটি রুমাল, একটি ছবি, একটি ঘড়ি, একটি চিঠি, একটি চিত্রলিপি, একটি সম্পর্ক এবং একটি ঘুমপুতুল।

    এই হল সাদিয়া সুলতানার কতকগুলি জিয়নকাঠি। দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধের যন্ত্রনাকাতর ক্যালাইডোস্কোপ। এই দিয়েই হয়েছে ‘উজানজল’-এর নির্মাণ।

    সাদিয়া সুলতানার মুন্সিয়ানা ঠিক কোথায়? কতকগুলি চিহ্ন, কতকগুলি আখর, কতকগুলি ইঙ্গিতের মধ্যে দিয়ে গল্পের ঠাস বুনোট। মেদবর্জিত গল্পগুলি তোমার, আমার এবং তাদের পুর্বপুরুষের, এসে পৌছচ্ছে আমাদের কাছে, আখরকথায়, উত্তরপুরুষের কাছে।

    আমাদেরকে, এখনও, চিহ্নিত করা হয় ‘ওপার বাংলার’ বলে, বাঙাল বলে, রিফিউজি’র জেনারেশান বলে। আমরা কি সম্পূর্ণ ভুলতে পেরেছি ওপার বাংলাকে? আমাদের বাবা কিম্বা ঠাকুর্দা-ঠাকুমার রক্তের মধ্যে থাকা ঘাসফুল-হিজলের গন্ধের ঢেউ কি আমার রক্তের মধ্যেও নেই? --- “নিজের দেশ ছেড়ে অন্যের দেশে রিফিউজি পরিচয়ে নতুন করে জীবন-জীবিকা শুরু করার দিনগুলোর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে ভুবন মিত্র শাফায়েতকে মিহি গলায় কত কী বলছেন, মানুষটার অস্ফুট কণ্ঠস্বর ভেদ করে শাফায়েত সব শব্দ বুঝতে না পারলেও তার কন্ঠের অকৃত্রিম আবেগ ধরতে পারে।” আর শুধু কি আমরা। ওই ‘ওরা’? ওদেরকেও তো চলে যেতে হয়েছিল একদিন, আমাদের মতো। ওদেরকেও কি হাতছানি দিয়ে ডাকে না নাখোদা মসজিদের উড়ন্ত পায়রার ঝাঁক? --- “মোতি নম্রপায়ে খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায়। পবন তার প্রিয় দাদাভাইকে দেখে ছটফট করতে করতে বলতে থাকে, ‘বাপের ভিটে... বাপের ভিটে’।” ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ কোথাও যেন এক হয়ে যায় ইছামতীর তীরে। --- “বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিনই যাদব কুশিয়ারার কাছে আসে। স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিয়োগরেখা দ্যাখে। কুশিয়ারা নদী চঞ্চল, রহস্যের আধার।”

    সাতচল্লিশ এসে থামে একাত্তরে। এখন আর ওরা দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের অধিবাসী নয়। ওরা মুক্তিযুদ্ধকামী। --- “যুদ্ধে যাবে বলে দুই বাক্যের একটা চিঠি লিখে চুপিসারে ঘর ছেড়েছিল তারা।” তারা যায়, অনেক ফিরে আসে, অনেকে ফিরে আসে না। --- “যুদ্ধের কালে ঐখানে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে মানুষ মেরেছে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। রাতের আঁধারে মানুষের লাশ কবরে নামিয়ে মাটিতে চারা বুনেছে আহসনুল্লাহর নানা মোকাররম।” কিম্বা “এই কুয়ো এমনি এমনি বন্ধ হয় নি। হাত-পা বাঁধা অর্ধগলিত লাশে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কুয়োর মুখ। তিন-চার হাত নীচ থেকে পানির বদলে লাশে ভরেছিল। কোনটার মাথা ছিল। কোনটার মাথা ছিল না। নাক-মুখ কাপড়ে জড়ানো ছিল। নিচের দিকে ছিল হাড়গোড় আর মাথার খুলি।” যারা আসে না, তাদের অনেকের কোন কবরচিহ্ন থাকে না, থাকে স্মৃতিচিহ্ন। --- “একাত্তর সালের তেরো ডিসেম্বর রাত নটা বেজে পনেরো মিনিটে বাবাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে যায় তখন বাবার হাতে এই ঘড়িটা ছিল। পরের দিন শান্তি কমিটির সদস্য বাবার ছাত্র কচি ঘড়িটা মায়ের হাতে দিয়ে গিয়েছিল। বাবার ঘড়িটা সেদিন ফিরে পাওয়া গেলেও লাশটা খুঁজে পাওয়া যায় নি।”

    কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি শুধুই আবেগের? হতাশারও তো বটে! কত মানুষের ঘর প্রমানের অভাবে বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। কত মানুষ সাক্ষীর অভাবে এক ঝটকায় হয়ে গেছে শহীদ থেকে রাজাকার। আবার কত তৎকালীন রাজার পেয়াদারা আজ বর্তমান রাজার বিদূষক হয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। --- “দেশের চিহ্নিত একজন যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে আজ আপনার হাসি হাসি মুখের ছবিটি যখন দেখেছি তখন থেকেই যেন স্মৃতিরা সজোরে পেছনে টানছে।” সাদিয়া সুলতানার চোখ এ-ও এড়ায়নি।

    এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে মধ্যে মনুষ্যত্বের ফল্গুধারা। মানুষ বাঁচে, মানুষই তাকে মারে, আবার মানুষই তাকে বাঁচায়। সেই সময়ে কত মানুষের অকৃপণ উদারতায় কত পরিবার রক্ষা পেয়েছে, তার খবর রাখে কয়জন? তারা নিজেরাও কি কখনও বুক ফুলিয়ে এই কথা বলে বেড়ায়? মনুষ্যত্বই যেখানে স্বাভাবিক সোপান, তাকে অযথা সোনা দিয়ে বাঁধানোর প্রয়োজন মনে করেন নি বহু মানুষ --- ওপারেও, এপারেও। বনান্তরালে আত্মগোপন করা হিন্দু সন্তান আব্বার কোলে মানুষ হয়, কিম্বা একটা রুমাল রয়ে যায় আদি অকৃত্রিম ভালোবাসার চিহ্নরূপে।

    সাদিয়া সুলতানার ছোটগল্প আমাকে স্তব্ধ করে দিল। একই উজানজলের এতরকম ঢেউ! ঢেউয়ের মধ্যে মধ্যে কতরকম কলতান। কতরকম বিয়োগব্যাথার চোরাঘুর্ণি। কতরকম আনন্দের উত্থান পতন। কিন্তু এর সাথে সাথে গল্প হঠাৎ হঠাৎ করে অদ্ভুত পথে বাঁক নেয়, এবং শেষ হয়। আমাকে চমকে দেয়। যেমন ‘বিরিক্ষ’, যেমন ‘দাগমোচন’। যেমন ‘জলের বিপরীতে’। যেমন ‘যার নাম রেনুবালা’।

    আবার ফ্ল্যাট, ম্যাড়ম্যাড়ে লেখা কি নেই? আছে। যেমন ‘ভিটে’। যেমন ‘রূপসার জল’। যেমন ‘স্মৃতিলেখা’। যেমন ‘চৌহদ্দি’। 

    তবে, আমার মতে ওনার সুন্দরতম গল্পগুলো অ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্মের হাত ধরেই এসেছে। কিছুটা সুররিয়েল, কিছুটা ম্যাজিক রিয়েলিজম। সেগুলো আমাকে ভাবিয়েছে বেশি। আমাকে চমকে দিয়েছে। আমাকে কিছুক্ষণ বই বন্ধ করে চুপ করে বসে থাকতে বাধ্য করেছে। প্রত্যেকটা বাক্যের চয়নে অসম্ভব গভীরতা এবং মুন্সীয়ানা। যেমন ‘বিরিক্ষ’। যেমন ‘লাশটা খুঁজে পাওয়া যায়নি’। যেমন ‘ঘুমপুতুলের মৃত্যু’।

    সাদিয়া সুলতানা। আপনার আরও লেখা পড়ার ইচ্ছা রইল। আপনি আরও লিখুন। আমাদের দুর্ভাগ্য, আপনার বই এপার বাংলায় সুলভ নয়। 

    ==================================

    উজানজল
    সাদিয়া সুলতানা
    ঐতিহ্য প্রকাশনী
    মূল্যঃ ২০০ টাকা
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

    ==================================

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন