এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  স্বাস্থ্য

  • বয়স্কা কোভিড রোগী - একটি অভিজ্ঞতা

    কাজরী রায়চৌধুরী
    আলোচনা | স্বাস্থ্য | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৫১৮৯ বার পঠিত | রেটিং ৩.৪ (৫ জন)
  • কোভিড- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

    আমার মা'র গত ২৩ আগস্ট থেকে জ্বর। সেদিন ছিল রোববার। জ্বর উঠেছিল ১০১.৫ পর্যন্ত। মাত্র তিনদিন জ্বর ছিল। পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শে ক্যালপল ৬৫০ আর A to Z সিরাপ চলছিল। ২৬ তারিখ সকালে কোনো জ্বর নেই কিন্তু মা আর বিছানায় উঠে বসতে পারছেন না। ডাক্তারবাবুকে জানাতেই উনি বললেন, এই দুর্বলতাটাই কভিডের লক্ষ্মণ। টেস্ট করতে হবে। ৭৫ এর ওপর বয়েস। বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মেডিকায় ফোন করলাম। ওরা হোম কালেকশনের নম্বর দিলেন। বললেন, পঞ্চম দিনের আগে সোয়াব নিলে সঠিক রেজাল্ট নাও আসতে পারে।

    পরদিন দুপুরে (২৭ আগস্ট) কথা মতো একটি ছেলে ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পিপিই পরে মুখ এবং নাক থেকে সোয়াব নিয়ে গেল। পরদিন অনেক রাতে মা'র পজিটিভ রিপোর্ট মেডিকা থেকে স্বাস্থ্য দপ্তরে চলে যায়। সময় লেখা ছিল রাত ২.২৩ । আমাকেও মেডিকা হোয়াটসঅ্যাপে রিপোর্টের ছবি তুলে পাঠায়। মা'র নাম এবং আমার ফোন নং স্বাস্থ্য দপ্তরে নথিভুক্ত হয়ে যায়।২৯ তারিখ সকাল থেকেই স্বাস্থ্য দপ্তরের বিভিন্ন বিভাগ থেকে সমানে ফোন আসতে থাকে। আমার সঙ্গে টেলিফোনিক জিজ্ঞাসাবাদ রেকর্ড করা হয়। আর একটি ফোনে ফর্ম ফিলাপ হয়। মা'র অসুস্থতা সম্বন্ধে ও কী কী ওষুধ খান, সমস্ত নোট করেন। মা'র পেস মেকার আছে, হাই- প্রেসার ও থাইরয়েড আছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের ডাক্তার ফোন করে সবিস্তারে জানতে চান সেই মুহূর্তে কী কী উপসর্গ আছে। সুগার এবং কিডনির কথা জানতে চান।

    ২৯ তারিখ সকালে মা'র পেট একটু নরম হয়।প্রত্যেকে একটি করে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দেন এবং বলেন সেই নম্বরে পজিটিভ রিপোর্টটা ফরোয়ার্ড করতে। তারপর অ্যাডমিশন বিভাগ ফোন করে জানতে চান, শ্বাসকষ্ট আছে কিনা। ছিল না। তখন বলেন, আপনি চাইলে ভর্তি করতে পারেন, কারণ বয়স্ক মানুষের হঠাৎ সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমি আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি। সঙ্গে সঙ্গে বলি,ভর্তি করতে চাই, কিন্তু কোথায়? উনি বলেন, আপনার বাড়ি থেকে তিনটে হাসপাতালে ভর্তি করা যায়। কেপিসি, বাঙ্গুর আর কলেজ স্ট্রিট মেডিকেল। আমি বলি, বাঙ্গুরে জায়গা পাওয়া যাবে কি? উনি বলেন, দেখে বলছি কোথায় বেড আছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই উনি আবার ফোন করেন। "বাঙ্গুরে বেড ফাঁকা আছে। অ্যাম্বুলেন্স দপ্তর থেকে ফোন আসবে।" মিনিট পনেরোর মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স অফিসার ফোন করে নাম ঠিকানা এবং পথনির্দেশ নেন। এবং বলেন, ড্রাইভার ফোন করবে। তার কিছুক্ষণের মধ্যে বিকাশ বেরা নামে এক ভদ্রলোক ফোন করে নাম, ঠিকানা, পথনির্দেশ নেন এবং জিজ্ঞেস করেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা। না বলাতে বলেন, হলেও চিন্তা নেই , অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে, স্যালাইন‌ও আছে। আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি দিতে পারেন? উনি বলেন, "আমার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মী যাবে। আমরা মেডিকেল কলেজ থেকে যাচ্ছি। দুপুর দুটোয় পৌঁছালে কি অসুবিধা হবে? তাহলে ভাত খেয়ে বেরতে পারি।" বলি, খেয়েই আসুন। ড্রাইভার বিকাশ বেরা ও তার সঙ্গী পৌনে দুটোতেই আমার বাড়ির দরজায় হাজির হন। আমাকে মা'র সঙ্গে এক‌ই অ্যাম্বুলেন্সে নিতেও রাজি হন। অ্যাম্বুলেন্স অফিসার বলেছিলেন, পেশেন্টের সঙ্গে কেউ উঠতে পারবেন না। অ্যাম্বুলেন্স চলতে শুরু করলে জিজ্ঞেস করি, আপনারা ভাত খেয়েছেন তো? বিকাশ বলেন, তখনও ক্যান্টিনে রান্না শেষ হয়নি। কতটা মানবিকতা থাকলে একজন বয়স্ক রোগীর জন্য এই তৎপরতা দেখা দিতে পারে! মনে মনে প্রণাম জানাই।

    বাঙ্গুরের নিউ বিল্ডিংকে কোভিড ওয়ার্ড করা হয়েছে। একতলায় বড় হলের দু'দিকে মোট দশটা বেড। একটাই ফাঁকা ছিল। মাকে বসিয়ে দেখলাম নেটের পার্টিশনের ওপারে জনা দশেক জুনিয়র ডাক্তার প্লাস্টিকের আলখাল্লা, মাস্ক টুপি গ্লাভস পরে কর্মব্যস্ত। কোনো এসি নেই। ছোট লাইন দেওয়ার পর আবার একপ্রস্ত জিজ্ঞাসাবাদ। প্রতিটি ওষুধ ওঁরা দেখে দেখে লিখলেন। ইতোমধ্যে মা'র এক্স রে এবং ইসিজি হয়ে গেল। আমাকে বাইরে দাঁড়াতে বললেন। আধ ঘণ্টা পরেও আমার ডাক আসছে না দেখে ভিতরে গিয়ে দেখি বেডে মা নেই। বললেন, ৪৬৭ নম্বর বেডে ভর্তি হয়ে গেছেন। বাড়ি যান।। ফোন যাবে।

    এরপর বাঙ্গুর থেকে প্রথম দিকে দিনে দু তিনবার পরে প্রতিদিন দুপুরে ফোন করে মা'র প্রতিটি প্যারামিটার বলা হতো। নার্স ভিডিও কলে মা'র সাথে কথা বলিয়ে দিতেন। স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে মানসিক কাউন্সেলর ফোন করে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করেন। ভরসা দেন, মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন।
    বাঁশদ্রোণী থানা থেকে আমাদের কোয়ারেন্টিন পিরিয়ড বলে দিতে ফোন আসে। কর্পোরেশন থেকে ফোনে আবাসন স্যানিটাইজ করতে আসবে বলে এবং আমরাও চাইলে টেস্ট করিয়ে নিতে পারি। ১১১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্য ফোন করে খোঁজখবর নেন এবং কর্পোরেশনের কর্মীকে বুধ ও রবিবার আমাদের বর্জ্য আলাদাভাবে নেওয়ার দায়িত্ব দেন।
    হাসপাতালে মা'র জলখাবার ছিল চারপিস পাউরুটি, দুটো ডিম সেদ্ধ, দুটো কলা আর এক কাপ দুধ। দুপুরে পাতলা মুসুর ডাল, পাঁচমিশালি তরকারি ও বড় দু'পিস মাছের ঝোল। রাতে ডাল তরকারির সাথে মাংস বা পনির বা সোয়াবিন বা ডবল ডিমের কারি।

    গত ১০ তারিখ মা'র ছুটি লেখা হয়। স্বাস্থ্য দপ্তর সুস্থ রোগীকে বাড়ি ফেরাবার জন্য যে ব্যবস্থা করেছে তা-ও অভাবনীয়। কলকাতার বাইরের বাসিন্দাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স এবং কলকাতার বাসিন্দাদের জন্য ওলা। সেই হিসেবে মা'র ওলাই প্রাপ্য। কিন্তু হাসপাতালের ডিসচার্জ বিভাগ বৃদ্ধা মহিলাকে কিছুতেই একা ছাড়তে রাজি না। প্রসঙ্গত বলি আমিও কভিড পজিটিভ এবং হোম কোয়ারেন্টিনে আছি।
    অবশেষে অ্যাম্বুলেন্স ১১ তারিখ বিকেলে মাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়।


    আরও পড়ুন: করোনা ও বাঙ্গুরঃ যা শুনলাম, যা দেখলাম

    মা যে হল ঘরে ছিলেন, তার এ মাথা থেকে ও মাথা এত দূর যে শেষ অব্দি মা'র চোখ পৌঁছাতো না। সারাদিন লাঠি দিয়ে ঘর আর বাথরুম মোছা হতো। নার্সদের ব্যস্ততার কোনো সীমা ছিল না। সকাল থেকে রাত তাঁরা এ রোগী থেকে ও রোগীর মাথার কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন।হাগিজ পাল্টে দেওয়া, পরপর ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়ানো, ইনজেকশন দেওয়া, অনেককে খাইয়েও দিতে হতো। দুপুরে বাড়ির লোকদের সাথে ভিডিও কলে দেখা করিয়ে দিতেন তাঁরাই। সারারাত তাঁরা কেউ না কেউ হলঘরে পায়চারি করতেন। মা'র হাসপাতালে থাকাকালীন ওই ওয়ার্ডে একজনেরও মৃত্যু হয়নি। খান দশেক বেড ফাঁকা ছিল বেশ কিছুদিন।

    এই চোদ্দ দিনের ঘটনার ঘোর এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বুঝতে পেরেছি,
    ১) বয়স্ক মানুষদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার।
    ২) স্বাস্থ্য দপ্তর তার প্রথম দিককার অনভিজ্ঞতা কাটিয়ে উঠে ব্যবস্থাপনায় সুচারু হয়ে উঠেছে।
    ৩) বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক নিটোল।
    ৪) গত দিনগুলোতে যত ফোন আমার এসেছে প্রতিটি ফোনের ওপারে একটি করে মানবিক কণ্ঠস্বর আমি শুনেছি। আমার সব প্রশ্নের উত্তর তাঁরা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে দিয়েছেন।
    ৫) এখন যেহেতু কভিড রোগীর একটা বড় অংশ হোম কোয়ারেন্টিনে বা সেফ হোমে আছেন তাই সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া যাচ্ছে। বয়স্কদের অগ্রাধিকার। এবং এই পরিষেবা পেয়েছি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।তাই ব্যবসায়ী প্রাইভেট হাসপাতাল পরিত্যাগ করে আম জনতার সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভর করি সবাই। এখানেও পরিচ্ছন্নতার ত্রুটি নেই। আর, স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার।


    আরও পড়ুন: কোলকাতায় কোভিড পরীক্ষার হালহাকিকত

    এখানে আমার কথা একটু না বললে বৃত্তটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমার মা'র ২৩ তারিখ জ্বর আসায় ২৪ তারিখ থেকে আমি মা'র দেখাশোনা করি। ২৬ তারিখ একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ায় খেতে দেওয়া, ওষুধ খাওয়ানো, জ্বর ও অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা , থার্মোমিটার ধোয়া, মা'র বাসন মাজা সব‌ই করি ডবল মাস্ক পরে। তবু এক‌ই পাখার হাওয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা দুজনেই নিঃশ্বাস নিয়েছি। আর অসচেতনতা বশত গ্লাভস পরার কথা মনে হয়নি। ২৭ তারিখ দুপুরে মা'র টেস্ট হয়। আমার প্রথম ৯৯.২ জ্বর আসে সেদিন সন্ধ্যায়। অদ্ভুতভাবে জ্বরটা সারা শরীর জুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জ্বালা করা এক অস্বস্তি । আমি তৎক্ষণাৎ আমার কিছু জামাকাপড় ও টুকিটাকি নিয়ে একেবারে চলে আসি মা'র কাছে। পরদিন থেকেই ক্যালপলের সাথে অ্যাজিথ্রাল ৫০০ খেতে শুরু করে দিই।

    ২৯ তারিখ স্বাস্থ্য দপ্তর ফোনে মা'র পাশাপাশি আমার খবর‌ও নিতে থাকে। সকালে বলি আমার ৯৯ জ্বর। দপ্তরের ডাক্তার বলেন, " আজ আগে মাকে ভর্তি করে দিয়ে আপনি শান্তিতে কাল আপনার টেস্ট করান।" এই বাক্যটি আমাকে পরম শান্তি ও শক্তি দেয়। ২৯ তারিখ ভর্তি পর্ব শেষে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। পরদিন জ্বর নিয়ে উবরে করে আমার টেস্ট করতে যাই। কিন্তু রোববার টেস্ট হয়না। সোম থেকে শনি সকাল সাড়ে নটা নাগাদ আধার কার্ড নিয়ে ওল্ড বিল্ডিং এ গেলেই টেস্ট হয়। স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে আমাকে এও বলা হয় যে, আমি যদি বাঙ্গুরে গিয়ে টেস্ট করি এবং আমার যদি পজিটিভ আসে তাহলে ভবিষ্যতে আমার কোনো জটিলতা হলে সরাসরি বাঙ্গুরে ভর্তি হতে পারব। তাছাড়া বাঙ্গুরে ভর্তি থাকা মা'র কেয়ার গিভার আমি-- সে কারণেও। পরদিন সোমবার লকডাউন। আমি বাড়িতেই র‌ইলাম। ইতোমধ্যে কাউন্সিলরের তত্ত্বাবধানে দু বাড়ি স্যানিটাইজ‌ও হয়ে গেছে। বেলায় কর্পোরেশন থেকে ফোনে এক ভদ্রমহিলা জানালেন, আগামীকাল আমার পাড়াতেই কোভিড টেস্ট হবে জাগ্রত সংঘে।

    আমি পরদিন ১ সেপ্টেম্বর পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথে পৌঁছে দেখি সুন্দর ব্যবস্থা। দুর্গা মঞ্চের মাথার ওপর পাখা ঘুরছে আর অনেক প্লাস্টিকের চেয়ার সম্ভাব্য রোগীদের বসার জন্য। জনা কুড়ি মানুষ অপেক্ষায়। আমি নাম লিখিয়ে বসলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত ভদ্রলোক বললেন, যাদের উপসর্গ আছে এবং পরিবারের কেউ পজিটিভ আছেন তাদের অগ্রাধিকার। পাঁচ মিনিটেই টেস্ট করে ফিরলাম। এটা ট্রু কালার র‌্যাপিড টেস্ট। শুধু ডান নাক থেকে নেয়। রাতেই কর্পোরেশনের তৎপরতায় জেনে গেলাম, আমি পজিটিভ এবং রিপোর্ট স্বাস্থ্য দপ্তরে চলে গেছে।

    পরদিন সকালে কর্পোরেশন থেকে ফোনে একটা ফর্ম ফিলাপ হল। এসেও জেনে নিলেন আমার নাম ঠিকানা বয়েস এবং আমার ব্যবহার করার মতো সম্পূর্ণ আলাদা বাথরুম আছে কি না।যদি না থাকে ওঁরা আমাকে সেফ হোমে চোদ্দ দিন রাখতে পারেন। আমার কোনো অসুবিধা সেখানে হবে না। বললাম আমার সম্পূর্ণ আলাদা বাথরুম আছে। তখন ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের আতা বাগান হেল্থ সেন্টারের ডাক্তারের ফোন নম্বর দিয়ে ফোন করতে বললেন। ডাঃ অরূপ ঢালিকে ফোন করতে উনি আমার কী কী উপসর্গ এবং কোনো ওষুধ খাই কিনা, সুগার, প্রেসার আছে কিনা জানলেন। আমার জ্বর আর মাথা যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নেই। তখন ক্যালপল ৬৫০, ভিটামিন সি আর মাল্টিভিটামিন খেতে বললেন। ১৪+৩=১৭ দিন হোম আইসোলেশনে থাকতে বললেন। এবং কোনো অসুবিধা হলে ফোন করতে বললেন। আর একটা অক্সিমিটার সাথে রাখতে বললেন।

    আমি আমার পারিবারিক ডাক্তার নির্মল মুখার্জির তত্ত্বাবধানে আগে থেকেই ছিলাম। সকাল থেকে রাত যতবার প্রয়োজন হয়েছে ওনাকে ফোন করেছি, উনি ফোন ধরেছেন। হোয়াটসঅ্যাপ করেছি, ওষুধ বলে দিয়েছেন।আমি পরম নিশ্চিন্তে র‌ইলাম।এক ফোনেই যেন পৃথিবী আমার সামনে এসে দাঁড়াবে।সূর্যাবর্ত আর উদীচী দুই আবাসনের প্রতিবেশী ও বন্ধুরা আমাকে প্রতিদিন ফোন করে কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়েছে,এনে দরজার বাইরে রেখে গেছে।কিন্তু আমার সেই যে ২৭ তারিখ থেকে জ্বর, তা আর কমে না। ৯৮.৬ থেকে ৯৯.৬ এর মধ্যে তার আসা যাওয়া। রোজ দুপুরে জ্বর আসে। সঙ্গে মাথা ভার। ওষুধ বলতে ক্যালপল ৬৫০, A to Z, সিলিন, জিঙ্কোনিয়া। জ্বর পিছু ছাড়ছিল না বলে Zocef 500 দিনে দু'বার গতকাল পর্যন্ত একটা কোর্স শেষ করলাম। আজ পনেরো দিন অতিক্রান্ত।

    করোনা একটু কঠিন‌ ইনফ্লুয়েঞ্জা। ছোঁয়াচে।সবসময়েই কিছু ক্ষতি করার চেষ্টায় থাকে। প্রথমে ভাবে সর্দি কাশিতে পেড়ে ফেলবে। তারপর পেটখারাপ ঘটাবে, তারপর মুখের সব স্বাদ কেড়ে নেবে,তখন রোগীর খেতে ইচ্ছে করবে না।ব্যস করোনার পোয়াবারো। দুর্বল করে বিছানায় মিশিয়ে দেবে।ভয় পেলে স্যাচুরেশন কমে যাবে। তখন হাসপাতালে পাঠিয়ে করোনার শান্তি। কিন্তু তার সব চেষ্টা বানচাল করতে লড়াই জারি রেখেছি। শুধু একটাই ওষুধ, গান্ডেপিন্ডে প্রোটিন খেতে হবে, পেট ভরে খেতে হবে। খাবার হজম করার জন্য সকালেই একটা করে pan 40 খেয়ে নিতে হবে। দিনে চার বার অন্তত গার্গল। একটু ঈষদুষ্ণ জল দিনে চার লিটার খাওয়া। ব্যস করোনার কেরামতি শেষ।


    আরও পড়ুন: করোনা নিয়ে প্যানিক কোরোনা

    গত মার্চ মাস থেকে সারা দেশ জুড়ে মিডিয়া যথেষ্ট মিথ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় স্বামীর দুঃসহ মৃত্যুর ঘটনাকে টিভিতে গুণিতকের হারে বারবার দেখিয়ে মানুষের মাথায় মৃত্যুভয় গেঁথে দিয়েছে।আমার তো মনে হয়, আমরা যদি তাকাই দেখতে পাব, ভারতবর্ষে প্রতিদিন টিবি, ক্যানসার, অপুষ্টি, হার্ট এ্যাটাক, নিমুনিয়া, রক্তাল্পতা,গৃহহিংসা, রাষ্ট্রীয় হত্যা ইত্যাদিতে যে পরিমাণ মৃত্যু ঘটছে তার তুলনায় কোভিডে মৃত্যুর পরিসংখ্যান অনেক কম এবং সুস্থতার হার অনেক বেশি।

    তাই মিডিয়াতাড়িত আতঙ্কিত মৃত্যুভয়ে জর্জরিত না হয়ে আসুন লড়ে যাই। হাসপাতালে যারা ফাইভ স্টার বন্দোবস্ত চান তাদের জন্য অবাঙ্গালি ব্যবসায়ীদের দোকান খোলা। আমরা অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ সরকারি হাসপাতালে ভরসা রাখি।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৫১৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রঞ্জন | 122.18.***.*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:১৯97295
  • আমার বয়েস সত্তর। আপনার লেখায় ভরসা এবং দিশানির্দেশ পেলাম।


      

  • সুকুমার ভট্টাচার্য্য | 157.4.***.*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৯:৫৩97301
  • সরকারী ব্যবস্থা সব সময় অবাণিজ্যিক এবং মানবিক। বিক্ষিপ্ত সমস্যা কিছু যে তৈরী হয় না তা নয়। তবে সেগুলো নগণ্য এবং বেসরকারী হাসপাতালগুলির প্রচার।


    আমি ব্যক্তিগতভাবে সরকারী হাসপাতালে বিশ্বাস করি সবসময়।

  • বিতান ভৌমিক। | 103.66.***.*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:১৬97305
  • স্বাস্থ্য আমাদের স্বাভাবিক অধিকার। কিন্ত অধিকারভঙ্গের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওপরের ভরসা জোগাল। আর বোঝা স্বাস্থ্যকর্মী চাপের এত মানবিক ভূমিকা অভিভূত করে দেয়।

  • কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় | 2405:201:a001:c08a:c9e0:45ac:2703:***:*** | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩০97310
  • কাজরী দেবী কে অভিনন্দন ।   তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার এমন বিশদ, তথ্যণিষ্ঠ, সাবলীল বর্ণনা পড়ে অনেকেই আস্থা ফিরে পাবেন এবং মনে বল পাবেন । বাজারি মিডিয়ার বিভ্রান্তির মধ্যে এটি কার্যকর হতে পারে আশা করি।

  • Abhyu | 47.39.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৪:৪৭97324
  • শুধু বয়স্করাই নন। আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বন্ধু, বয়স পঁচিশ হবে, করোনা হয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতাই মিলে যাচ্ছে। হাসপাতালে ভালো খেতে দেওয়া, ফোনে প্যারামিটার বলা ইত্যাদি। অবস্থা তো খুবই খারাপ, পরিকাঠামো নেই - এ সব বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য দপ্তর (বিশেষতঃ ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীরা) যা করছেন তা অসাধারণ।


    আর এই সেফ হোমের কনসেপ্টটা অন্য রাজ্যে আছে? 

  • Kakali deb | 45.127.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:৩৯97332
  • খুব ভাল লেখা হয়েছে . এই অভিজ্ঞতা অনেকে র  কাজে লাগবে। অনেকেই মনে সাহস ফিরে পাবেন .

  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 59.93.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৯:৫০97335
  • সবার, আরও অনেক পাঠকের, কাছে পৌঁছনো দরকার এ লেখার। একেবারে আত্মীভুত অভিজ্ঞতা। এবং সরকারি ব্যবস্থার মানবিক চিকিৎসার মুখ। ক'দিন আগে আমি গুরুচণ্ডালীর পাতাতেই বেসরকারি এবং হাঁ-মুখ কর্পোরেট ব্যবস্থার ২ কোটি টাকা পর্যন্ত বিল নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম।


    ৩টি বিষয় আমরা ভেবে দেখবো - (১) স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। রাষ্ট্রের তরফে কোন দান বা দাক্ষিণ্য নয়। (২) কর্পোরেট দস্যুদের হাত থেকে স্বাস্থ্যকে রক্ষা করার জন্য ধাপে ধাপে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন বিনা স্থায়ী কোন সমাধান নেই। (৩) প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির অন্তত ২.৫-৩% করতে হবে।


    তবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে লেখিকা করোনার দফারফা করার যে পদ্ধতি বাৎলেছেন সেটা কিন্তু বিপজ্জনক। করোনার মেকানিজম ৯ মাস কেটে যাবার পরেও বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকেরা অপরিমেয় পরিশ্রমের পরেও সামান্যই বুঝে উঠতে পেরেছেন। সেখানে টোটকা পরিহার করাই ভালো, কেবল মানসিক শান্তি হতে পারে।

  • সুমিতা পাল বিশ্বাস | 110.225.***.*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:১৯97341
  • খুব ভরসা পেলাম।

  • Dr,Alpana Ghosh | 2405:201:9801:17dd:d4b7:59d:4191:***:*** | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:১৬97356
  • সাধারণ মানুষ আপনার লেখা পড়ে ভরসা পাবে ।সবার পড়া দরকার কারণ মানুষের মনে যে ভীতি আছে সেটা দুর করা দরকার ।সরকারি নির্দেশিকা মেনে ঠাকুরের উপর ভরসা রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

  • সোনালী গুহ | 115.187.***.*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০২97358
  • কাজরীর লেখা এই অভিজ্ঞতা আমাদের ভরসা দিল।এটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে যাক।সরকারি ব্যবস্থার প্রশংসা করি।

  • তাপস গিরি | 2409:4060:299:3ffd:1a32:1d36:5217:***:*** | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৯:২৩97365
  • বর্তমান পরিস্তিতে একটি প্রাসঙ্গিক লেখা। করোনা নিদানকালে করোনাকে ভয় না পেয়ে, আসুন সবাই আমরা ওর বিরু লড়াই করি। গুজবে কান না দিয়ে  কতগুলি সাবধানতা অবলম্বন করলে আমরা করোনাকে জয় করবো।

  • শর্মিষ্ঠা ঘোষ | 103.3.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০২১ ২১:১৭496567
  •  এত মানবিক হতে পারে হসপিটাল। আমি জলপাইগুড়িতে থাকি। এখানে সরকারি   হসপিটালে ভর্তি হলে,রোগী কে একাই    টয়লেটে যেতে হয়  স্যালাইন সহ।  কেও থাকেনা সাহায্যের জন্য। হুঁ ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে যায়। বাঙ্গুর কে স্যালুট।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন