সফি মল্লিক মশায়ের লেখাটার (যারে তুমি নিচে ফেল…) দুটো দিক আছে।
১) স্থায়ী চাকরি থেকে চুক্তিবদ্ধ নিয়োগে চলে আসা
২) ব্যাপক কর্মী সংকোচ।
প্রথমটা নিয়ে নানা রকম তর্ক আছে।
ক) স্থায়ী কর্মীরা কাজ না করেই মাইনে নেয়। যেহেতু তারা স্থায়ী তাই তাদের ছাঁটাই করা যায় না। চাকরি হারানোর ভয় না থাকলে এরা কাজ করে না। এটা অবশ্য খুব বেশি প্রযোজ্য একেবারে নীচুতলার কর্মীদের জন্য। তেমনটাই প্রথমে ছিলো। প্রথমদিকে সাফাইকর্মী, ফরমাস খাটা কর্মী, সুরক্ষাকর্মীদের ওপর প্রয়োগ করা হলো। খ) এর ফলে যে নতুন সংস্থাগুলির জন্ম হলো, তারা তাদের প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য কর্মী নিয়োগ করলো। ফলে কর্মসংস্থান বাড়লো।
এতে কাজ হলো। হ্যাঁ, সত্যিই কাজ হলো। কিন্তু, তার কারণ কর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা নয়। যে প্রতিষ্ঠানগুলি এইসব কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলো, সেই প্রতিষ্ঠান কম কর্মী দিয়ে আগের তুলনায় ভালো কাজ করার জন্য কাজগুলোর যথাসম্ভব যন্ত্রায়ণ ঘটালো। ভ্যাক্যুয়াম ক্লিলার, ফ্লোর ক্লিনার, টয়লেট ক্লিনার এলো। কাজ আগের চাইতে ভালো হলো। যন্ত্রায়ণের খরচ বহন করলো, এই সব কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ সংস্থাটি। সে, কম মজুরিতে কর্মী নিয়োগ করে খরচ পুষিয়ে নিলো।
মূল সংস্থাটি এই কর্মীদের, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর ভাতা(যদি থাকে), গ্র্যাচুয়িটি, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাকার নানান আর্থিক দায় থেকে মুক্ত হলো। ফলে, ওইসব কাজের হিসাব রাখা, পরিদর্শন করা – এই কাজগুলিও কমলো। ঐসব ক্ষেত্রেও কর্মী সংকোচে সুবিধা হলো।
কিন্তু খরচ যে খুব কমলো, তা বুক ঠুকে বলা যাবে না। কারণ, সাফাইকর্মী-ফরমাসখাটাকর্মী-সুরক্ষাকর্মী মিলিয়ে ১০জনের শ্রমবাহিনীর যা খরচ (তাদের সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়ে), একটা সংস্থা তার মুনাফা রেখে এর চেয়ে বেশি ছাড়া কম টাকায় পরিষেবা দেবে না। তাহলে এসব করা কেন ?
দুটি কারন –
১) যে স্থায়ী কর্মীরা ওইসব কাজ করতেন, তাঁরা ইউনিয়ানভুক্ত কার্মী। ফলে তাদের নানা দাবি দাওয়া ইত্যাদি সামলানোর হাত থেকে রেহাই পেলো মূল সংস্থা। এর একটা অন্য দিকও আছে। স্থায়ী কর্মী যাঁরা ইউনিয়ানের আওতায় ছিলেন, তাঁদের একটা নূন্যতম আত্মসম্মানবোধ ছিলো। এঁদের যা খুশি বলা যেতো না। এঁদের দিয়ে যা খুশি করানো যেতো না। কিন্তু এই চুক্তিবদ্ধ সংস্থার কর্মীরা নীরাপত্তাহীনতার কারনে তেমন নয়। এঁদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ, বাড়ির কাজ অনায়াসে করিয়ে নেওয়া যায়।
২) যে সংস্থা এই কাজের বরাত পেলো, তারা মূল সংস্থার নীতিনির্ধারকদের বছরে একটা মোটা টাকা ঘুস দেয়। এটা নিয়ে অনেকেই হয়তো আপত্তি করবেন। বলবেন এতে তো মূল সংস্থার ক্ষতি। হ্যাঁ ঠিক তাই। কিন্তু সেই ১৯৮০ থেকেই একটা ধারা শিল্প ও ব্যবসা মহলে প্রবল হয়ে উঠেছে। এরা মূলতঃ পেশাদার পরিচালক (Professional Management)। এদের সাথে যুক্ত হয়ে যায় সংস্থার “মালিকেরা”ও। পাব্লিক লিমিটেড কোম্পানীতে যার ১০-১২% শেয়ার আছে তারাই দন্ডমুন্ডের কর্তা। মূল টাকাটা আসে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ হিসাবে। সেই ঋণের টাকা কোথায় যায়, তা আজকে আর বিশদে বলার প্রয়োজন নেই। এরা সংস্থার মুনাফাতেও খুব একটা আগ্রহী নয়। শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে এদের কোন মাথাব্যথাই নেই। তাতে এদের যতোটুকু ক্ষতি, তার অনেকগুণ বেশি টাকা এরা অসৎ উপায়ে কামিয়ে নেয়। এরা শুধুই ব্যক্তিগত ফায়দা বোঝে। এরা নিজেদের যোগাযোগ, ক্ষমতা (আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক) কাজে লাগিয়ে অনৈতিকভাবে ব্যবসা/উৎপাদন চালায়। এর শুরু সঞ্জয় গান্ধীকে দিয়ে। টাটা মোটরস বা হিন্দুস্থান মোটর্সের মত সংস্থাকে শুধু ক্ষমতার দাপটে বঞ্চিত করে ছোট গাড়ি বানানোর লাইসেন্স পায় মারুতী। সে গল্প এখন সকলেরই জানা। এরপর এই ধারাটি পুষ্ট হয় মালিয়া, ছাবারিয়া এদের হাত ধরে। এখন এই ধারাটিই ভারতের শিল্পমহলের মূল ধারা। এরা শুধুই নিজেদের পকেট ভরতে উৎসাহী। তাতে সংস্থা চুলোয় গেলে যাক। এই শ্রেণীটি ধ্রুপদী মার্ক্সীয় সংজ্ঞায় বুর্জোয়া কিন্তু এদের ঠিকঠাক ধরতে গেলে বরং লুম্পেন বুর্জোয়া বলাটাই সঙ্গত।
এবার দ্বিতীয় বিষয়ে আসা যাক। নতুন সংস্থা ও কর্মসংস্থান। এটা সত্যি, যে নতুন সংস্থা তৈরি হলে কিছু কর্ম সংস্থান তো হয়ই। কাজ নিশ্চই খুব জরুরি, কিন্তু অন্য একটা বিষয়ও কম জরুরি নয় – সম্মান। কাজ যাই হোক না কেন, তাতে সম্মান থাকাটা জরুরি মানুষের বিকাশের জন্য। এই সব সংস্থার কর্মীরা সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। ফলে তাঁদের পক্ষে সম্মান নিয়ে ভাবাটাই বিলাসিতা। অথচ সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ সম্মানবোধ হারিয়ে ফেললে সমাজেরই ক্ষতি। এটা শুধুই সাফাইকর্মী-ফরমাসখাটাকর্মী-সুরক্ষাকর্মীদের বিষয় নয়। গত শতাব্দীর ৮০র দশকের থেকে শতাব্দী পার হতে হতেই অন্য সমস্ত কাজ, যা এতোকাল সাদা কলারের কাজ বলে গণ্য হতো, তা, বেসরকারি এমনকি সরকারি সংস্থাতেও “আউটসোর্স” হতে শুরু করে। ফলে বিশাল সংখ্যক কর্মী নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে ফেলেন।
সমস্ত ধরনের কাজের যন্ত্রায়ণ আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, কোন একটা কাজ মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ছাড়া হবে না এটা হয়তো আর বলা যাবে না। ফলে সমস্ত ধরনের কাজে মানব-শ্রমের প্রয়োজন কমতে কমতে একদম তলানিতে। এতে শিল্প ও ব্যবসা মহল আপাততঃ খুব খুশি। উৎপাদন বাড়ছে, খরচ কমছে, ঝামেলা কমছে। প্রাথমিক বিনিয়োগ বাড়ছে অনেকটাই। কিন্তু তার জন্য ব্যাঙ্ক আছে। কিন্তু সমস্যার শুরু সেখানেই। ব্যাঙ্ক কার টাকায় চলে ? সোজা উত্তর, সাধারণ মানুষের টাকায়। মানুষ ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। সেই টাকা ব্যাঙ্ক নানান উদ্যোগে খাটায়। মানুষ যে টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখে, সেটা কোথায় পায় ? রোজগার থেকে। মানুষের হাতে কাজ না থাকলে সে ব্যাঙ্কে জমা করার টাকা কোথায় পাবে ? কাজেই আজ না হলে কাল ব্যাঙ্কের পুঁজিতে টান পড়তে বাধ্য। টান যে পড়েছে তার একটা নমুনা আমরা পেয়েছি নোটবন্দীর সময়। মানুষ বাধ্য হলো হাতের টাকা ব্যাঙ্কে জমা করতে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার দৈনিক উচ্চসীমা বেঁধে দেওয়া হলো। ফলে যতো টাকা আপনার হাতে ছিলো তার পুরো টাকাটা আপনার হাতে ফিরে এলোনা। ব্যাঙ্কে জমা থাকলো। ব্যাঙ্কে টাকার যোগান বাড়লো। এসব নিয়ে বিস্তর কথা হয়ে গেছে। অধিকারীজনে প্রচুর লিখেছেন। ফলে আমার আর ব্যাখান করার প্রয়োজন নেই।
এ তো গেল বিনিয়োগের সমস্যা। এবার বিনিয়োগ যদিবা কোনমতে পাওয়া গেলো। উৎপাদনও হলো। প্রচুর হলো, ফলে উৎপাদন ব্যয় কমলো। কিন্তু মানুষের কাজ নেই, ফলে হাতে টাকা নেই, উৎপাদিত পণ্য/পরিসেবা কিনবে কে ? ক্রেতা নেই। এবার শুরু হবে অন্য সংকটটি। যাদের হাতে টাকা আছে তারা মুষ্টিমেয়। তারা আর কতো কিনবে ? একটা ৪/৫জনের পরিবার তো আর দশটা টিভি, বারোটা গাড়ি, তিরিশটা টুথপেস্ট, নব্বইটা জামা কুইন্টাল কুইন্টাল চাল, গম,সবজি, মাছ মাংস কিনতে পারে না। তাহলে ?
উপায় একটা আমার মনে হয়েছে। কাজের সময় দিনে ৪ ঘন্টা করা হোক (মজুরি না কমিয়ে)। প্রয়োজনে সমস্ত বাণিজ্যিক সংস্থা ২৪ ঘন্টা খোলা থাক। ৬ শিফটে কাজ হোক।
৪ ঘন্টার ৬ শিফটের দাবি তুললেই সাংঘাতিক আপত্তি উঠবে - তাহলে ওভারহেড ৫গুন বেড়ে যাবে। ভীষণ ক্ষতি হবে। অথচ, এই যে প্রতি কাজে ৫ জন লোক বেড়ে গেল, এর মানে ক্রেতার সংখ্যা ৫গুন বেড়ে গেলো। তাতে চাহিদা অন্ততঃ ৫ গুন তো বাড়বেই। চাহিদা বাড়লে বিক্রি বাড়বে। বিক্রি বাড়লে উৎপাদন বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়লে উৎপাদন খরচ কমবে। উৎপাদন করচ কমলে লাভ বাড়বে। তাতে কার লাভ !! আমি অর্থনীতির লোক নই। তাই আমার প্রস্তাবে ভুল থাকতেই পারে। যাঁরা এ বিষয়ে অধিকারী মানুষ তাঁরা মতামত দিন।
সুন্দর বিশ্লেষণ । ধন্যবাদ কল্লোল । আমি এটা আপনার অনুমতি পেতে পারি অন্য কোনো সোশ্যাল মিডিয়াতে বা বন্ধুমহলে শেয়ারের জন্য ?
এ সব শিল্পব্যবসায়ীদের প্রায় সবারই দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে । দেখুন না কেমন খেয়া পারাপারের মত যখন-তখন এদেশ-ওদেশ করে বেড়ায় ! অবস্থা খারাপ দেখলেই পালাবে !
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাটা খুব ভাবেলো। এটা
শেয়ার করতে গেলে কি কপি পেস্ট করে নাম দিয়ে করবো?