‘আমি খ্রিস্টান সন্ন্যাসী।’ এই উচ্চারণে শেষ হল আশ্চর্য সূক্ষ্মতায় বর্ণিত একাধারে অতিকোমল এবং ভীষণ উত্তাল একটি দৈহিক সম্পর্ক। আলেকজান্দ্রিয়ার এক অখ্রিস্টান নারী অক্তাভিয়া এবং খ্রিস্টান সন্ন্যাসী হাইপা-র মধ্যে। অক্তাভিয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিল হাইপা সমুদ্রদেব পসিডনের তাকে পাঠানো উপহার। আরবি ভাষার সাহিত্যে এ একেবারে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু ইউসেফ জিদান তাঁর লেখা অজাজিল (ইংরেজি তরজমায় Azazeel) নামের উপন্যাসে সেসম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে সবিস্তারে, যদিও এক সন্ন্যাসীর প্রলুব্ধ হওয়ার কাহিনি ছাড়াও এ উপন্যাসে বলা আছে আরও বহু কিছু।
এ শতকের মোড় থেকেই আরবি সাহিত্য জোরকদমে ঢুকে পড়েছে আন্তর্জাতিক সাহিত্য-চর্চার দুনিয়ায়। আরবি সাহিত্যে বহু সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক তো ছিলেনই, ইদানীংকালে তাঁদেরই পাশাপাশি উঠে এসেছে একগুচ্ছ নতুন নক্ষত্র—রবাইঅল-মধুন (ফলিস্তিন। জন্ম ১৯৪৫), ইনাম কচাচেহ্ (ইরাক। জন্ম ১৯৫২), আহমেদ সদাওয়ি (ইরাক। জন্ম ১৯৭৩), রজাঅল-সানি (সৌদি আরব। জন্ম ১৯৮১) প্রমুখ।
এই তালিকাতেই অন্যতম নাম ইউসেফ জিদান। ১৯৫৮ সালে তাঁর জন্ম মিশরের নীলনদের তীরের সওহাগ শহরে। আরবি ও ইসলামি ইতিহাসচর্চায় তিনি সুপণ্ডিত। বর্তমানে তিনি বিবলিওথেকা আলেকজান্দ্রিনা-র পাণ্ডুলিপি বিভাগ ও জাদুঘরের ডিরেক্টর। সুফি দর্শন, বিশেষ করে ইব্ন আরবি-র বিষয়ে তাঁর গভীর চর্চা রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে ইসলামের দর্শন ও আরবি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে উল্লেখযোগ্য লেখালিখি। তাঁর প্রথম উপন্যাস অল-নবতি (The Nabatian) প্রকাশিত হয় ২০০৫ সালে। দ্বিতীয় উপন্যাস জিলঅল-অফা (The Shadow of the Serpent) প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। সে উপন্যাসকে অনেক পাঠকেরই মনে হয়েছিল, ‘জ্ঞান-বাহুল্যময়’। অজাজিল প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। এ উপন্যাস প্রকাশের পরেই সাহিত্যিক হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন জিদান, এবং বইটি বিখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর অ্যারাবিক ফিকশন’ লাভ করে। উপন্যাসটি ইংরেজিতে তরজমা করেছেন জোনাথান রাইট, এবং সে তরজমা ২০১৩-এ লাভ করেছে ‘বানিপাল প্রাইজ ফর অ্যারাবিক লিটারারি ট্র্যান্সলেশন’। এরপরে জিদানের আরও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ২০১৩ সালে—মহাল (Places) এবং গুয়ানতানামো। অজাজিল অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, ইতালিয়ান, উর্দু, পর্তুগিজ সহ ১৪টি ভাষায়।
নব্য আরবি সাহিত্যের কেন্দ্রে রয়েছে ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ, পুনর্পাঠ। অজাজিল ব্যতিক্রম নয়। এ উপন্যাসে উঠে এসেছে সাধারণাব্দ পঞ্চম শতকের একটি তীব্র বিতর্ক—জিশু খ্রিস্ট মানুষ ছিলেন নাকি এক ঐশ্বরিক সত্তা। অজাজিল ঘিরেও তৈরি হয়েছিল তীব্র বাদানুবাদ। অনেকেই জানবেন, জিশু খ্রিস্টকে কেন্দ্র করে সেই বিতর্ক মিশরীয় চার্চ এবং পশ্চিমি খ্রিস্টান দুনিয়া দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং চার্চের তরফে শেষে বিতর্কটিকে ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। কাজেই ২০০৮ সালে অজাজিল প্রকাশিত হওয়ার পরেই কোপ্টিক অর্থডক্স চার্চ যে উপন্যাসটির নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি তুলে সেটির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। সে মামলায় অবশ্য এই চার্চ হেরে গিয়েছিল। অবশ্য আরবি দুনিয়ায় সাহিত্যিকদের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা মোটেই এই প্রথম নয়, নাগিব মহফুজ (মিশর ১৯১১-২০০৬) এবং হায়দার হায়দার (সিরিয়া। জন্ম ১৯৩৬) প্রমুখ বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিকের বিভিন্ন উপন্যাসও নিষিদ্ধ করা হয় ‘ইসলাম ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার’ অভিযোগে। মুসলমান মৌলবাদীরা তাঁদের বিরুদ্ধে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ ফতোয়াও জারি করেছিলেন। কোপ্টিক চার্চ অতি সংখ্যালঘু হওয়ায় তেমন কিছুই অবশ্য করতে পারেনি। তবে মিশরের অত্যন্ত প্রভাবশালী বিশপ—বিশোই—বইটিকে ‘খ্রিস্টান দুনিয়ার কাছে পরিচিত জঘন্যতম পুস্তক’ তকমা দিয়েছেন।
উপন্যাসটির মূল কাহিনি হল, হাইপা নামের এক নবীনের সন্ন্যাসী হওয়া ও চিকিৎসাশাস্ত্র পাঠের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ার কাহিনি। সিরিয়ার প্রাচীন শহর আলেপ্পোর একটি প্রাচীন খ্রিশ্চান মঠের ধ্বংসাবশেষে মিলেছে হাইপা নামের এক খ্রিশ্চান সন্যাসীর আত্মজীবনীর পুঁথি। সুপ্রাচীন অরামায়া (আরামিয়াক) ভাষায় লেখা, সাধারণাব্দ পঞ্চম শতকে। উপন্যাসটির আঙ্গিক হল, তারই এক একটি পাতার আরবি তরজমা। আসোয়ান শহরের মানুষ হাইপা। কিন্তু হাইপার অখ্রিস্টান মা খ্রিস্টান ধর্ম নেওয়ার পর হাইপার বাবা যখন তাঁর মাকে খুন করে সেই নবীনের পক্ষে সেশহরে থাকা অসহ্য বেদনাময় হয়ে ওঠে। তা থেকে পালাতেই শুরু হয় তার যাত্রা। আক্সিম, আলেকজান্দ্রিয়া, জেরুসালেম, সিনাই ইত্যাদি বহু জায়গার খ্রিস্টান মঠে কিছুকাল করে কাটানোর পর নিয়তি তাকে নিয়ে যায় সিরিয়ার প্রাচীন শহর আলেপ্পা এবং ওরোন্তেস নদীতীরের (অধুনালুপ্ত) শহর আন্তাকিয়াতে।
ইউসেফ জিদানের এই উপন্যাসে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক চরিত্র—আলেকজান্দ্রিয়ার নারী-দার্শনিক, গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইপেশিয়া (জন্ম আনুমানিক ৩৫৫, মৃত্যু ৪১৫ সাধারণাব্দ), আলেজান্দ্রিয়ার কুলপতি (আর্চ বিশপ) সিরিল (৩৭৫-৪৪৪ সাধারণাব্দ), কনস্ট্যানটিনোপোলের আর্চ বিশপ নেস্টোরিয়াস (জন্ম চতুর্দশ শতকের শেষে, মৃত্যু ৪৫১ সাধারণাব্দ) প্রমুখ। জিদানের করা চরিত্রায়ণে সিরিল একাধারে নিষ্ঠুর, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ভীষণ খামখেয়ালি এবং নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এবং উপন্যাসের মূল চরিত্র হাইপা প্রত্যক্ষ করেন বহু ঐতিহাসিক ঘটনাও। যেমন, সিরিলের প্ররোচনায় এক উন্মাদ ভিড়ের হাতে অপরূপ সুন্দরী ও বিদুষী হাইপেশিয়ার হত্যা। হাইপেশিয়ার ভয়াবহ যন্ত্রণাময় মৃত্যুর বর্ণনায় সাহিত্যিক হিসেবে যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন জিদান, যে-কোনো লেখকের কাছে তা স্বপ্ন। যেখানেই অসহিষ্ণুতা মাথা চাড়া দেবে, শেষপর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হবে আলেকজান্দ্রিয়ার সেই নির্দয়, উন্মাদ ভিড়ের সমবেত চিৎকার—‘বেশ্যাটার চামড়া ছাড়িয়ে নে।’
তার এমনই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকেই উড়ান নেয় কল্পনা—হাইপা যখন নবীন, বিশের কোঠায়, তাকে প্রলুব্ধ করেছিল অক্তাভিয়া নামের এক অখ্রিস্টান নারী। বহু বছর পরে সেই অক্তাভিয়াই আপ্রাণ চেষ্টা করে হাইপেশিয়ার প্রাণরক্ষা করতে, এবং তাকেও পিটিয়ে মারে সেই উন্মাদ ভিড়। অক্তাভিয়ার মৃত্যু হয় আক্ষরিক অর্থেই হাইপার পায়ের কাছে, যদিও সেদিন সেই সন্ন্যাসীকে চিনতে পারেনি অক্তাভিয়া।
চিকিৎসক হিসেবে হাইপা হয়ে ওঠে দারুণ পারদর্শী। বিভিন্ন রোগীদের যেভাবে চিকিৎসা করেন তিনি তার বর্ণনাও জ়িদানের এই উপন্যাসে রয়েছে সবিস্তারে, আর তা ভারী কৌতূহলোদ্দীপক। বিশেষ করে ‘শয়তানের কুয়ো থেকে জলপান’ করা এক বণিকের চিকিৎসা।
জীবনে একজন নারীতেই প্রলুব্ধ হননি সন্ন্যাসী হাইপা। লেখক তাঁকে নিয়ে গিয়েছেন আরও এক নারীর প্রতি আকর্ষিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। সে নারীর নাম মার্থা। চার্চসংগীতের একটি দলের প্রধান তিনি। মার্থা দরিদ্র, যুবতী এবং বিধবা। তাঁর সংগীতের দলটি এসেছে হাইপার মঠে হাইপারই তদারকিতে সংগীতের তালিম নিতে। মার্থার স্বর্গীয় রূপ আর অপাপবিদ্ধতা হাইপাকে বিপর্যস্ত করে দেয়। উবে যায় তাঁর তপশ্চর্যা। এদিকে এক রোমান সৈনিক মার্থাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। শেষে পরিস্থিতি এমনই হয় যে আলেপ্পো ছেড়ে পালানো ছাড়া মার্থার কাছে আর কোনো বিকল্প থাকে না। এমতাবস্থায় মার্থা হাইপাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। ততদিনে চিকিৎসক হিসেবে হাইপা প্রতিষ্ঠিত, কাজেই দিনগুজরানের সমস্যা নেই। এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে থাকেন হাইপা, একটা লড়াই চলতে থাকে তাঁর অন্তরেও এবং শেষপর্যন্ত তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এ হল, অজাজিল-এর (বাবিলজেবুব, বিলজাবুল, ইবলিস, শয়তান, অহিরমান-এর) প্রলোভন। প্রসঙ্গত, ইহুদি কিংবদন্তিতে অজাজিল এক অপদেবতা, এক পতিত দেবদূত।
জিশু খ্রিস্ট মানুষ ছিলেন (অর্থাৎ ইঙ্গিতে যা ট্রিনিটির বিশ্বাসকে অস্বীকার করে) না ঈশ্বরের পুত্র, এই বিতর্ক অসাধারণ কাহিনিবিন্যাসে উঠে এসেছে অজাজিল উপন্যাসে। ৩১৯ ও ৪৩৯ সাধারণাব্দের মধ্যে চলতে থাকা এই বিতর্কের ফলেই মিশরের পৃথক চার্চ হিসেবে কোপ্টিক চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তম শতকে ইসলামের উত্থানের আগে পর্যন্ত মিশরের অধ্যাত্মজগতে ছিল কোপ্টিক চার্চেরই রমরমা। এ উপন্যাস জৈব আকাঙ্ক্ষা ও কামনার উপাখ্যানও বটে। অক্তাভিও এবং মার্থা উভয়েই পরমাশ্চর্য সুন্দরী এবং উভয়েই হাইপার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ সাবা মেহমুদ লক্ষ করেছেন, ‘এ উপন্যাসের প্লট দৈহিক কামনা এবং মঠের জীবনের তপশ্চর্যার মধ্যে দুলতে থাকে। দ্বন্দ্ব চলতে থাকে ব্যক্তিগত স্তরে এবং ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে।’
উদ্বেল প্রেম আর তপশ্চর্যার মধ্যে দ্বন্দ্বের বর্ণনাতেই শুধু পাঠককে চুম্বকের মতো টেনে রাখেন না জিদান, টেনে রাখেন মিশর ও সিরিয়ার আশ্চর্য প্রাকৃতিক বর্ণনাতেও। তেমনই জিদানের কলমের জাদুতে উঠে এসেছে তাক লাগানো ক্যাথিড্রাল, আভরণহীন মঠ, অক্তাভিও-র প্রাসাদোপম বাড়ি, মার্থার জীর্ণ কুটিরের অনুপুঙ্খও।
নিজে তো লেখালিখি করি, তাই একটা বিষয়ে আমার জিদানের প্রতি ঈর্ষা হয়—পাণ্ডুলিপি কেন্দ্রের ডিরেক্টর হওয়ায় কী দুষ্প্রাপ্য সব পুঁথিই না তাঁর হাতে এসেছে। ইয়ান লিয়াঙ্কের ‘দ্য ড্রিম অফ ডিং ভিলেজ’ পড়ার সময়েও আমার এই অনুভূতি হয়েছিল। তাঁর সুযোগ ছিল এইচআইভি সংক্রমণের নানা নথি দেখার। ইতিহাসভিত্তিক কাহিনি লিখে রসোত্তীর্ণ সাহিত্যসৃষ্টি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। খুব কম সাহিত্যিক সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন। ‘দ্য গসপেল অ্যাকর্ডিং টু জিসাস খ্রাইস্ট’ এবং ‘বালতাজার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা’ উপন্যাস দুটিতে হোসে সারামাগো যা পেরেছেন, ইউসেফ জিদানের অজাজিল ছুঁয়েছে সেই উচ্চতা।