“যদি কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না থাকেন, কবি হতে পারবেন না।” এ মন্তব্য যিনি করলেন তাঁর নাম নেজওয়ান দরবিশ। আল-জজ়িরা টেলিভিশনে মনশ ফিরাক ভট্টাচার্যকে একটা সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন নেজওয়ান। ঝুঁকি নেজওয়ান নেন, কারণ যেখানে তাঁর বসবাস সেখানে ঝুঁকির কোনো কমতি নেই—ইজরায়েলের জেরুসালেম। দিনের পর দিন তাঁকে নির্দয় দখলদারি সেনা, আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সরকার আর রক্ত পিপাসু ধর্মীয় চরমপন্থীদের মুখোমুখি হয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের ঠিক আগে যে সাত লক্ষ ফলিস্তিনি-আরব মানুষকে নবগঠিত ইজরায়েল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাকে আরবিতে অল-ন্যাকবা বলা হয়, তেমনই এক শরণার্থী পরিবারের সন্তান নেজওয়ান। তাঁর জন্ম জেরুসালেমে ১৯৭৮ সালে। কাজেই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজ়া অঞ্চলের উপর ইজরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে ১৯৮৭ সালে যে ফলিস্তিনি প্রতিবাদ বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে তারই মধ্যে নেজওয়ানের বড়ো হওয়া।
এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা কোনো কবির কাছে রুখে দাঁড়ানোর কবিতা ছাড়া আর কী-ই বা আশা করা যেতে পারে? মেহমুদ দরবিশ, সমিহ্ অল-কাসিম, তওফিক জ়িয়াদ, ফদওয়া তওকান, হান্নান অশরওয়ি ও নেজওয়ানের পূর্বসূরি অন্যান্য কবিরাও তো লিখেছেন তেমনই কবিতা।
কিন্তু এইসব বিশিষ্ট কবিদের থেকে নেজওয়ানের স্বর ভিন্ন। তাঁর স্বর অনেকটা দ্ব্যর্থক, অনিশ্চিত। বহু স্তরীয়। চিরাচরিত ধারার বাইরে। এবং যাবতীয় স্টিরিওটাইপে ভরা চলতি উপমা বর্জিত। আরবি কবিতার যে পরম্পরাগত ধারা, নেজওয়ানের কবিতা তা থেকে ভিন্ন এই নিরিখেও যে তাঁর কবিতার একটা বড়ো গুণ হল তা চাঁছাছোলা—
একদিন জেগে উঠব আমি
একদিন জেগে উঠব আমি, আর তা বলব
আমি কুর্দ, জেগে উঠব একদিন
এবং তা বলে দেব
আমি আমাজ়িগ, তোমার স্বর
জেগে উঠবে একদিন
আমি, যে আরবকে তুমি চেন
জেগে উঠবে একদিন
এবং তা বলবে
ওরা এবার বিদায় হয়েছে সালাদিন।
(আমাজ়িগ—উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর মানুষ, যাঁরা নিজেদের বলেন ‘আমাজ়িগ’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘স্বাধীন মানুষ’। ইংরেজিতে তাঁদের বলা হয় Berber। সালাদিন—দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকে মিশরকে কেন্দ্র করে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সালাদিন, কুর্দ মুসলমান। ১১৮৭ সালে হাত্তিনের যুদ্ধে খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধা ‘ক্রুসেডর’-দের পরাজিত করে তাঁর বাহিনী জেরুসালেম পুনর্দখল করে। কথিত আছে ১৯২০ সালের ২৪ জুলাই মায়সালুনের যুদ্ধে ফরাসিরা সিরিয়াকে পরাস্ত করে দামুশ্ক দখল করে নেওয়ার পর সালাদিনের সমাধিতে লাথি মেরে ফরাসি জেনারেল অঁরি জোস্যফ য়্যুজ্যান গুরো বলেন, “জেগে ওঠ, সালাদিন, আমরা ফিরে এসেছি। এখানে আমার উপস্থিতি চন্দ্ররেখার ওপর ক্রুশের জয়কে পবিত্র ঘোষণা করছে”)
সিরিয়ার দামুশ্ক-এ সম্রাট সালাদিনের সমাধি
নেজওয়ান তাঁর অনেক কবিতাকেই নানা বর্ণের ইতিহাসের পোঁচে ঢেকে রাখেন—সাম্প্রতিক ও প্রাচীন ইতিহাসের পোঁচে, যা দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা। ২০০৩ সাল। গাজ়া-র দক্ষিণাঞ্চলে শত শত ফলিস্তিনি বসতবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। তারই মুখোমুখি অহিংস প্রতিরোধে অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক মঞ্চ ইনটারন্যাশনাল সলিডারিটি মুভমেন্ট (আইএসএম) কর্মীরা। ১৬ মার্চ তেমনই এক কর্মী মার্কিন তরুণী র্যাচেল এলিয়েন কোরি-কে একটা বুলডোজার পিষে মেরে ফেলল। ইজরায়েল সরকার তদন্ত কমিটি বসাল। রিপোর্ট মিলল—‘দুর্ঘটনা’, র্যাচেলকে দেখতেই পায়নি বুলডোজার-চালক। অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ সহ একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ঘটনার কঠোর নিন্দা করেছিল। নেজওয়ান একটা কবিতা লিখেছিলেন—‘বলো’।
(ওপরে) ইজরায়েলি সেনার বুলডোজারকে মাইক হাতে থামাতে চেষ্টা করছেন নিরস্ত্র র্যাচেল কোরি। (নীচে) বুলডোজার তাঁকে পিষে দেওয়ার পর
বলো
বলো তো আমায় জওয়ানকে সেই জওয়ান সিংহ?
এবং কেমন করে সে বাতাসে লাফিয়ে উঠেছিল
ওকে যখন ওরা তাড়িয়ে নিয়ে শিকার করল
মসরারা থেকে শেখ জররা অবধি
আমাকে সেই রোগাসোগা অকুতভয় লোকটার কথা বলো
এবং কীভাবে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটা গোটা স্কোয়াড্রন
কলন্দিয়া চেকপয়েন্টে
কিন্তু পরাস্ত করতে পারেনি তাকে
আমাকে বলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির কথা
প্রথম বসন্তের কাঠবাদাম গাছের মতো যখন তাকে
মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছিল বুলডোজার
এ সব বলে দাও ওদের সক্কলকে
যারা বলছে, আমরা হেরে গেছি।
(ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে গাজ়া-তে ঢুকতে গেলে কলন্দিয়া চেকপয়েন্ট পার করতে হয়। কবি এখানে কোন্ ঘটনার কথা বলছেন সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা কঠিন। ২০২০ সালেই এখানে দুটি ঘটনা ঘটে মে মাসে একটি ‘অটিস্টিক’ যুবককে এখানে গুলি করে খুন করে ইজরায়েলি সেনা। তাঁর সঙ্গে থাকা পরিচর্যাকারী সেনাদের এ কথা জানানো সত্ত্বেও যে সে বিকলাঙ্গ। আগস্ট মাসে এক বধির বৃদ্ধ সেনার ‘হল্ট’ কম্যান্ড শুনতে পাননি বলে তাঁকেও তৎক্ষণাৎ গুলি করা হয়। কলন্দিয়া চেকপয়েন্টে এমন ঘটনা আকছার ঘটে।)
কবিরা সকলেই জানেন সাবলটার্নের দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস কখনও লেখা হয় না। তাই তাঁর কাব্যিক কষাঘাত—
গোটা গপ্পোটাই বানানো
আমি অন্তত কক্ষনো বিশ্বাস করিনি তোমায় খুন করা হয়েছে, তোমার
রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গিয়েছে একেবারে ভূমধ্যসাগর এবং
সমুদ্র তা পান করে ফেলেছে।
(বানানো)
তবে ইতিহাস নিয়ে কবিতা কী জাদু বুনতে পারে তার সেরা উদাহরণ এটি—
আর্মানি কোনিয়াক
ইয়েরভান থেকে এক বোতল কোনিয়াক
রাখা আছে আমার হেঁশেলের টেবিলে
ঠিক সেই ইতিহাসের মতোই ছিপি আঁটা
তেমনই নীরব
যদি সেটা ভেঙে ফেলি হারিয়ে ফেলব আমি একশো বছরের
ভালোবাসা
আর যদি সেটা খুলি, পূর্বজরা
এখানে ঝুলে রয়েছে যারা সাদা-কালো
নেমে আসবে দেয়াল থেকে
তুলে নেবে পেয়ালা আমার সাথে
আমি জানি ভুলে যাওয়া একটা ইতিহাস
আমি জানি কেন কোনিয়াকের ওই বোতলখানা
সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে একমেবাদ্বিতীয়তম…
যদি ভেঙে ফেলি হারিয়ে ফেলব আমি একশো বছরের ইতিহাস
আমার লোকেদের।
আবার দারুণ বিপর্যয়ের দিনকালে কবিদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তাঁর মনের সংশয় উঠে আসে ‘বিন্ত জবীল’ কবিতায়—
বিন্ত জবীল
যত রূপক আমার, চিত্ররূপ, আনুষঙ্গিক শব্দ সব:
ভেঙে পড়া বৃদ্ধারা
অসুস্থ ঘুমন্ত বিছানায়
আর আমিও তো ভাঙা, বসে আছি, ভোরের ঠিক আগে,
শূন্য চোখে তাকিয়ে আছি টিভিটার দিকে
প্রার্থনার চেষ্টায়
তাদের জন্য যারা বিন্ত জবীলে প্রতিরোধ চালাচ্ছে রাতভর
(কীভাবে প্রার্থনা করা যায় বলো তো
বিশ্বাস করার মতো যখন কিচ্ছু বাকি নেই)
কিছুক্ষণ পরে
ভোর দৃষ্টিগোচর করে মৃতদের
এবং আমি শুতে চলে যাই, ভাঙা
তাদের কাছে ঋণের ভারে ভাঙা
যারা আরও একটা ভোর উড়িয়েছিল
বিন্ত জবীলের পাহাড়ে পাহাড়ে।
(দক্ষিণ লবনাঁ-র একটি শহর বিন্ত জবীল, যাকে বলা হয় ফলিস্তিনি প্রতিরোধের ঘাঁটি। ২০০৬ সালে যুদ্ধ করেও সে শহর দখল করতে পারেনি ইজরায়েল।)
বিন্ত জবীল শহরের ওপর ইজরায়েলি সেনার হামলা
হয়তো আক্রান্তদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করার বেশি একজন কবির আর কিছুই করার থাকে না। ‘সবরা ও শতিলাগামী দুঃস্বপ্নের বাস সফর’ নামের কবিতায় পেয়ে যাই এমন পঙ্ক্তি—
‘আমি জানি ওরা নাতাশাকে হত্যা করেছে, আমার তিন বছরের মেয়েটাকে
(কিন্তু আমার তো কোনো মেয়ে নেই)
গত বছর নয়াদিল্লিতে একটি সাহিত্যসভায় এসে নেজওয়ান দরবিশ একটা কথা বলেছিলেন, “এ সময়ে বিভিন্ন সমাজে এবং বিভিন্ন কবির মধ্যে নয়া উপনিবেশবাদের জন্যেই এই অন্ধকার যুগে কবি হওয়া খুব কঠিন হয়ে উঠছে।” কী বোঝাতে চাইছিলেন নেজওয়ান, তার ইঙ্গিত মেলে ‘সংরক্ষিত’ নামে তাঁর এই কবিতা থেকে—
“বসতে চেষ্টা করেছিলাম একবার
আশার খালি একটা সিটে
কিন্তু ‘সংরক্ষিত’ শব্দটা
সেখানে বসেছিল হায়নার মতো।”
১৯৬৫ সালে মেহমুদ দরবিশ একটা কবিতা লিখেছিলেন—‘পরিচয়পত্র’। তার এই পঙ্ক্তিটি সম্ভবত কোনো আরব কবির লেখা সবথেকে বিখ্যাত পঙ্ক্তি—“লিখে নাও, আমি আরব”। কিন্তু নেজওয়ান দরবিশ হাঁটলেন বিপরীত পথে। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই তিনি তাঁর একটি কবিতার নাম দিলেন ‘পরিচয়পত্র’, এবং সেখানে আত্মপরিচয়ে তিনি হয়ে গেলেন কুর্দ, আর্মানি, সিরীয়, তুর্ক, ককেশাস, আমাজ়িগ, ইরাকি, মিশরীয়, আরামীয়, হিজাজ়ি এবং আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়িত এক ইহুদি—
“আমার বাড়িতে একটা জানালা আছে যেটা গ্রিসের দিকে খোলে
একটা মূর্তি রয়েছে সেটা নির্দেশ করে রুশের দিকে, চিরদিন সুগন্ধী বাতাস বয়ে আসে হিজাজ় থেকে
আর আছে একটা আয়না। তার সামনে দাঁড়ালেই পলকমাত্র আমি দেখি
আমি বসন্তের বাগানে ডুবে গেছি
শিরাজ়ে আর ইসফাহানে আর বুখারায়
এর থেকে কম কিচ্ছু যে, সে আরব হতেই পারে না।”
নেজওয়ান দরবিশ আরব কবিতায় নয়া দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। তাঁর স্বর শুনতে আমরা বাধ্য হই, আর ভার্জিল-কে উদ্ধৃত করে বলতে পারি ‘হৃদয়ে পেরেক মেরে গেঁথে’ নিতে।
ভারি সুন্দর লেখা। বড্ড ভাল লাগল।
কবিতাগুলো নীলাঞ্জন অনূদিত। বাকি লেখাটাও কি অনূদিত? নাকি পাকিস্তানি মানুষ বাংলায়ই লিখেছেন?