চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত (১৯২৫ - ২০২০) (ছবি: বাসব দাশগুপ্ত)
পশ্চিমরাঢ় অঞ্চলের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তর পাণ্ডিত্য ছিল প্রগাঢ়। পেশাগত ভাবে তিনি আজীবন ছিলেন স্কুলশিক্ষক। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ অঞ্চলের ইতিহাসচর্চায় তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন ওই অঞ্চলের অন্যতম পুরাতাত্ত্বিক, ইতিহাসকার ও ক্ষেত্রসমীক্ষক বিষ্ণুপুরের মানিকলাল সিংহ। যদিও জীবনের প্রথমদিকে চিত্তরঞ্জনবাবু ভড়া নামের একটি জায়গায় শিক্ষকতা করার ফলে মানিকবাবুর সান্নিধ্য সেভাবে লাভ করতে পারেননি, কিন্তু কিছুকাল পরে তিনি বিষ্ণুপুর হাই-স্কুলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হওয়ায়, দুজনে আরও অনেক বেশি একত্রে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং উভয়ের প্রচেষ্টায় প্রত্নতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্ব গবেষণার অনেক নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়।
প্রত্নতত্ত্ব বা পুরাতত্ত্ব তাঁরা যে পদ্ধতিতে গবেষণা করতেন তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল কি না, সে বিষয়ে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যেতে পারে, তথাপি এই দুই গবেষক যে এক সুবৃহৎ কর্মযজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছিলেন একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই কর্মযজ্ঞের মূল বিষয়বস্তু ছিল স্থানীয় পুরাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বগত উপাদান সংগ্রহ করা, সেগুলির মূল্যায়ন করা এবং সংগৃহীত উপাদানগুলিকে সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এই উদ্দেশ্যে বিষ্ণুপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহালয় স্থাপন তাঁদের উদ্যমের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
আর এক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জনবাবুর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিষ্ণুপুর শাখা তথা আচার্য যোগেশ্চন্দ্র পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালাটিকে গড়ে তোলাই শুধু নয়, তিনি বহু বছর ধরে এই সংগ্রহশালার সম্পাদক থেকে তার শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা করে গেছেন। এই সংগ্রহশালাটিকে বিশদে জানার জন্য তিনি একটি বই রচনা করেন, বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ, বিষ্ণুপুর শাখার প্রকাশনায়। বইটির নাম—‘আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন, পরিচিতি ও বর্ণনামূলক তালিকা’। নাম থেকেই বইটির বিষয়বস্তু প্রতীয়মান। প্রসঙ্গত, এই পুরাকীর্তি ভবনটিকে পুরাতাত্ত্বিক উপাদানের আধার বলা যেতে পারে। দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন ডিহর, বিষ্ণুপুর সংলগ্ন এলাকা, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায়, প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংগ্রহ করে এখানে রাখা হয়েছে। প্রাপ্ত উপাদানগুলি সংগ্রহ করে আনার ব্যাপারে চিত্তরঞ্জনবাবুর অবদান বিপুল। এই বইতে সেই উপাদানগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ নথিবদ্ধ করার দুরূহ কাজটিও তিনি সম্পন্ন করে গিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, মানিকলাল সিংহ যেভাবে বাঁকুড়া তথা দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের সংস্কৃতির ব্যাখ্যা করেছেন, চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তর গবেষণার বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং ব্যাখ্যা তার থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এর মূল কারণ, চিত্তরঞ্জনবাবু অনুমানভিত্তিক কোনো কথা বলতেন না। কোনো বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগে যেটুকু পড়াশোনা করা দরকার তা তিনি করতেন এবং সম্ভাব্য সকলপ্রকার তথ্যের তুলনামূলক আলোচনা করে নিজের মতামত প্রকাশ করতেন। তাঁর গবেষণা-উন্মুখ মন এবং প্রত্নতত্ত্বের গবেষণায় তন্নিষ্ঠভাবে দীর্ঘদিন নিজেকে নিয়োজিত রাখার স্থৈর্য তাঁর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যকে স্কুলশিক্ষকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বহু উঁচুতে উত্তীর্ণ করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ, গবেষণাতেই ছিল তাঁর প্রাণের আনন্দ।
চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্তর গবেষণার মূল বিষয়কে সংক্ষিপ্ত করে আমরা বলতে পারি, তা ছিল বৈষ্ণবধর্ম, কৃষ্ণলীলা, বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণবধর্মের প্রচার, বিষ্ণুপুরের রাজন্যবর্গের বৈষ্ণবধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করার ধারা এবং, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মন্দিরগাত্রে যেসব পোড়ামাটির অলংকরণ রয়েছে সেগুলোর নিবিড় পর্যবেক্ষণ। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, লীলাময় মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাঁকুড়া হিতৈষী’ পত্রিকায় ১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে এবং ১৯৮০-র দশকের শুরুতে প্রকাশিত চিত্তরঞ্জনবাবুর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলি। এই প্রবন্ধগুলিতে তিনি বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত মহিষমর্দিনী মূর্তিগুলি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করেন। তাঁর রচিত এই প্রবন্ধগুলি মৌলিক এবং জরুরি তথ্যসংবলিত।
মানিকবাবুর মৃত্যু চিত্তরঞ্জনবাবুকে শোকগ্রস্ত করলেও কর্মবিমুখ করতে পারেনি। তাঁর হাত ধরেই যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু তার পরিসর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি চাইতেন এই অঞ্চল নিয়ে গবেষণার কাজ আরও বেশি করে হোক। এব্যাপারে তাঁকে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে দেখেছি। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বাইরের লোকজনকেও অনুপ্রাণিত করতেন বিষ্ণুপুর সম্পর্কে গবেষণার জন্য। এককথায় বলা যেতে পারে বিষ্ণুপুরকে বিষ্ণুপুরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি চেয়েছিলেন এই অঞ্চলের গবেষণার বিষয়বস্তু ছড়িয়ে পড়ুক ভারত তথা সমগ্র বিশ্বে।
চিত্তরঞ্জনবাবুর বইগুলি এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধগুলি পাঠ করলেই একটা জিনিস উপলব্ধি করা যায়—ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর একটা ব্যক্তিগত মতামত ছিল। তিনি নিজে উদারনৈতিক মনোভাবাপন্ন ছিলেন। তাই তাঁর লেখনীতে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানুষের ব্যাবহারিক জীবন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাসের উপর আস্থা রেখেও তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল প্রাক-মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে শুরু করে বিট্রিশ শাসনের আগে পর্যন্ত। চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত রচিত বইগুলি পড়লেই এটি স্পষ্ট ধরা পড়ে। তাঁর লেখালিখির মূল্যায়ন করতে গিয়ে একটা কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁর বইয়ে কোথাও কোনো ভুল ব্যাখ্যা নেই। এর মূল কারণ চিত্তরঞ্জনবাবু তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল কখনও তত্ত্ব থেকে তথ্যে নিয়ে যাননি, বরং সবসময় চেষ্টা করেছেন প্রাপ্ত তথ্যকে তত্ত্বে প্রতিষ্ঠা করতে। গবেষণার মূল কথাতেই বলা আছে তত্ত্ব থেকে তথ্যে না গিয়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করলে তা অনেক বিজ্ঞানসম্মত হয়।
তাঁর বহুলপঠিত ‘বিষ্ণুপুরের মন্দিরা টেরাকোটা’ বইটি লেখা হয়েছে মন্দিরগুলির সরজমিন ক্ষেত্রসমীক্ষা করার পর। বৈষ্ণব সংস্কৃতির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্মের ব্যবহার ওনার মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল।
তবে যতদূর জানি, এই বইটি লিখে তিনি নিজে বোধহয় খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাই লেখার প্রয়োজন বোধ করলেন ভারতসংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা। প্রথম বইটার প্রেক্ষাপট আঞ্চলিক, দ্বিতীয়টির সমগ্র ভারতবর্ষ। শুধু সমকালীন ভারতবর্ষ ভাবলে ভুল হবে, তিনি তাঁর আলোচনায় এনেছেন প্রাক-প্রাচীনযুগের সিন্ধুসভ্যতার টেরাকোটা থেকে রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্প পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ পরিসর। এই প্রসঙ্গে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে আলোচনা করেছেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের মল্লভূমের প্রেক্ষাপট, বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে মল্লভূমের চর্চাচিন্তায় নবদ্বীপের প্রভাব, বিষ্ণুপুরের মন্দিরা টেরাকোটার পশ্চাদ্বর্তী তত্ত্বতাৎপর্য, বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটায় কৃষ্ণলীলার রূপায়ণ বৈচিত্র্য, বিষ্ণুপুরের মন্দিরভাস্কর্যে কবিচন্দ্রের প্রভাব ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে। এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বই বলে আমি মনে করি। প্রথমদিকে আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিষ্ণুপুরকে মালভূমির ইতিহাসে ধরলেও, পরবর্তীতে বিষ্ণুপুরকে তিনি ভারতব্যাপী ছড়িয়ে দেন এই দ্বিতীয় বইটির মাধ্যমে। এই বই তাঁর অধ্যাবসায় ও পাণ্ডিত্য প্রতিফলিত করে। প্রসঙ্গত, এই বইটির পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী জানিয়েছেন, “বিষ্ণুপুর মন্দিরের টেরাকোটা তার নিজস্ব গড়নগঠনের ভঙ্গিতেই বিষ্ণুপুরের। অথচ তার সেই নিজস্বতা অর্জনের রসায়নে, আদল তৈরির আদিমতম লগ্নে কখন, কোন্ ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে ভারতের নানাপ্রান্তের নানান শিল্পধারার প্রেরণাময় উপাদান। চিত্তরঞ্জনবাবুর অনুসন্ধানী দৃকপাত সম্ভাব্য সমস্ত উপাদানকেই তুলে ধরেছে তাঁর এই বইটিতে।”
মন্দিরটেরাকোটা বাদ দিয়েও মূর্তিতত্ত্বের উপর তাঁর পাণ্ডিত্য সূচিত করে তাঁর রচিত শেষ বইটি—‘দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গের মূর্তিশিল্প ও সংস্কৃতি’। বইটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিত্তরঞ্জনবাবু বলেছেন, এর লক্ষ্য হল, দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জৈনমূর্তিগুলির আর্বিভাব এবং জৈনধর্মের প্রচার ও প্রসারের বিষয়টি তুলে ধরা। বইটির বিষয়বস্তুর মধ্যে ঢুকলে মেলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলির পরিচিতি এবং ব্যাখ্যা। আমরা পাই তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা এবং ক্ষেত্রসমীক্ষায় তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ।
সবশেষে, একটা কথা বলব, দাশগুপ্ত মহাশয়ের লেখালিখির গুরুত্বের মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর অবস্থানগত বহু জিনিস নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। অর্থাৎ তাঁর কাছে উপলব্ধ আর্থিক ক্ষমতা, লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার অভাব। এধরনের গবেষণার জন্য যে সুযোগ-সুবিধা দরকার হয়, তা তিনি পাননি। তাঁর এইসব গবেষণা বহু কষ্টসাধ্যের ফল। চলতি কথায় বলতে পারি, এইভাবে ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ মানুষ বর্তমানে সত্যিই দুর্লভ। তিনি অবহেলিত ছিলেন গবেষক হিসেবে, তাই হয়তো তাঁর পাণ্ডিত্যের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। আজকে তাঁর প্রয়াণে নতুন ভাবনার আলোকে তাঁর কর্মজীবন ও পাণ্ডিত্যকে ভাবার সুযোগ এসেছে। তাঁর ক্রিয়াকাণ্ডের সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর গবেষণামূলক কাজ, তাঁর মূল্যবোধ, মানবিকতা বোধ, এসব কিছুরই সামগ্রিক পরিচর্চা করা দরকার।