এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ইন নদীর শহরে

    অংশু ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২১ জুলাই ২০২০ | ২৪২৩ বার পঠিত
  • নভেম্বরের শেষাশেষি। সেখানকার ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে গিয়ে হাজির হলাম ইন্সব্রুক। ছোট্ট সুন্দর সাজানো পশ্চিম অস্ট্রিয়ার একটি শহর। ইউরোপীয় শহর বলতে যে ছবিটি আমাদের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। সেই তেকোনা ঢালু ছাদের পরপর উঁচু বাড়ি রাস্তার দুপাশে, আর চওড়া রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলছে কয়েকটা। অবশ্য সাইজে ছোটো হলে কী হবে, এর বয়সের কথা শুনলে হোঁচট খেতে হয়। অন্তত আটশো বছরের পুরোনো এর ইতিহাস। তেরো শতকে এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় আল্পসের গোড়ায় একটি বেড়ে উঠতে থাকা বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে।

    হ্যাঁ, এই ছোট্ট শহরটা ঠিক একদম আল্পসের কোলে। শহরের অনেক জায়গাই আছে, যেখান থেকে যেদিকেই তাকাই শুধুই আল্পস। পরপর বরফঢাকা চূড়া, আলো পড়লেই ঝলমল করে ওঠে। আর আরও মজা হল, ইউরোপের অনেক শহরের মতোই, রোদ এখানে খুব দুর্লভ নয়। সপ্তাহের চার-পাঁচদিন গড়ে রোদ-ঝলমলে থাকে। বর্ষাকালটা বাদ দিলে। আমার ঠিক এইরকম আন্দাজ ছিল না। ভেবেছিলাম লন্ডন, বা খুব কাছের মিউনিখের মতো, বা একটু দূরের ভিয়েনারমত; মেঘে ঢাকা আকাশই হবে এখানে আমার হোস্ট। তাই প্রথম দিন রোদ দেখে যখন বলে উঠেছিলাম আজ আমার ভাগ্য সত্যিই ভালো, তখন পাশ থেকে আন্দ্রে বলেছিলেন যে এরকম ভাগ্য আমাদের প্রতিদিনেরই সঙ্গী হবে। যদিও আন্দ্রে নিউজিল্যান্ডের লোক, বর্তমানে ইন্সব্রুকে আছেন একই কাজের জন্য আমার সঙ্গে। আমরা আরও একটি বিষয় নিয়েও অনর্গল হতে পেরেছিলাম, যা প্রায় বাকি সবার কাছেই হিব্রু ঠেকেছিল। ক্রিকেট। আমিও মন খুলে কথা বলছিলাম কারণ তখনও বিরাট কোহলিরা নিউজিল্যান্ডে গিয়ে হোয়াইট ওয়াশ হওয়া শুরু করেননি।

    অস্ট্রিয়া বেশ একখানি বেশ ছোট্টোখাট্টো দেশ। অন্তত উত্তরে জার্মানি, আর পশ্চিমের ইতালির তুলনায়। এমনকি আকারের দিক থেকে উত্তর-পশ্চিমের সুইজারল্যান্ডও বেশ বড়ো। তবে পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে হাঙ্গেরি বা অন্য স্লোভাক দেশগুলো সেই তুলনায় প্রায় সমান মাপের। অন্তত দু-দশকের জায়মান রাজনীতির পরে আজ যে স্থিতাবস্থা হয়েছে, সব নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেবার পর। অস্ট্রিয়া ম্যাপে লম্বার তুলনায় চওড়ায় বেশি বড়ো। তাই উত্তর-দক্ষিণের বদলে পূবে-পশ্চিমে ভাগ করে নেওয়াটাই সুবিধের। তিরোল, মানে যে প্রদেশটিতে ইন্সব্রুক শহরটা, সেটা অস্ট্রিয়ার একেবারে পশ্চিমে, ইতালির লাগোয়া। রাজধানী ভিয়েনা ঠিক এর উলটো দিকে, মানে অস্ট্রিয়ার পূর্বকোণে। ইন্সব্রুক থেকে দূরত্ব প্রায় সোয়া ছ-শো কিলোমিটার। ট্রেনে ছ-ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মতো লাগে পৌঁছাতে।

    ইন্সব্রুক নামকরণ হয়েছে এর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা একটি ছোট্ট মিষ্টি নদীর নাম থেকে, ইন। আল্পস থেকে নেমে এসে কলকল করে ছুটেছে তিরোল-এর মধ্যে দিয়ে, পশ্চিম থেকে পুবে। মাঝখানে পেয়ে গেছে তার এই সাথী-শহরকে, ইন্সব্রুক—যে নিজে যেতে পারছে না তার সঙ্গে, কিন্তু বার্তা পাঠিয়ে দিচ্ছে এই নদীর সঙ্গে বাকি অস্ট্রিয়াকে। নদীর ওপরে একটি ছোটো সাঁকোয় দাঁড়িয়ে এরকমটাই মনে হচ্ছিল আমার।

    হয়তো এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে, বা অন্য কোনো কৌশলগত কারণে থাকতে পারে, (অধম রাষ্ট্রচালনার ব্যাপারে বিশেষ পটু নয়) ডিউক ফ্রাইডেল তাঁর বসবাসের পাঠ তুলে আনেন ইন্সব্রুকে, চোদ্দোশো কুড়ি সালে। এই ডিউক ফ্রাইডেলের একটা ডাকনাম চালু আছে ইউরোপে, যার খুব কাছাকাছি যায় এই বাংলা বিশেষণটি—ট্যাঁকখালির জমিদার। তিনি শুরু করেন এক বিরাট প্রাসাদের নির্মাণ তার জন্য দরবার বসাবার জন্যে। এই প্রাসাদেই আছে এক সোনালি ছাদ, এই গোল্ডেন ডাখল, সত্যিকারের সোনায় মোড়া। আজকের ইন্সব্রুক-এর প্রধান পরিচায়ক যদি একটিমাত্র পিকচার পোস্টকার্ড হয়, তাহলে তাতে থাকবে এই গোল্ডেন রুফের ছবি।

    অবশ্য এই সোনার ছাদ আসলে প্রাসাদের একটি ব্যালকনির ছাদ বা রোদ ছাউনি। এটা অবশ্য ডিউক ফ্রাইডেলের দান নয়। এটি যার অবদান, মানে প্রথম ম্যাক্সিমিলান, তিনি ইন্সব্রুক-এর ইতিহাসে প্রধানতম নায়ক। পনেরোশো সালে, এমনটি শোনা যায় তিনি তাঁর দ্বিতীয় বিবাহের স্মৃতিকে অজরামর করে রাখার জন্য, প্রাসাদের বারান্দায় এই সোনার রোদ ছাউনি নির্মাণ করেন। শুধু এই প্রাসাদের জন্যই নয়, সমগ্র ইন্সব্রুক-এর ইতিহাসে প্রথম ম্যাক্সিমিলান একটি সোনার সময়। অর্থাৎ আমার ক্ষুদ্র ইতিহাসজ্ঞান বলে, যে পরীক্ষায় ম্যাক্সিমিলান-এর রাজত্বকাল বর্ণনা করো প্রশ্ন আসলে চোখ বুজে পথনির্মাণ, সরাইখানা, কূপখনন, রাজ্যজয়, গাছ লাগানো ইত্যাদি লিখে পাতা ভরিয়ে দেওয়া যাবে।

    অবশ্য শুধু রাজা ম্যাক্সিমিলানই নয়, মধ্যযুগের আল্পসের কোলে এই ছোট্ট শহরটা যে আর সবাইকে ছাপিয়ে বেড়ে উঠেছিল, তার আরও একটা বড়ো কারণ হল এর অবস্থান এবং সহজগম্যতা। গোটা ইউরোপকে যদি উত্তর-দক্ষিণ ভাগ করার চেষ্টা করি, তাহলে দেখা যাবে ইন্সব্রুক দাঁড়িয়ে আছে ঠিক মাঝামাঝি। ফলে ব্যাবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রচুর লোক ইন্সব্রুককে ছুঁয়ে যেতেন। এভাবেই ইন নদীর ধারে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে এই জনপদ। বারোশো উনচল্লিশ সাল নাগাদ যা একটি পুরোদস্তুর শহরের মর্যাদা পায়। তারপর হফসবারগ রাজবংশ ইন্সব্রুককে তাদের রাজধানী করে নেন, যে কথা আগেই বললাম।

    সেই সোনার ছাদ ছাড়াও প্রথম ম্যাক্সিমিলিয়ানের আর-এক কীর্তি, হফকিরশে। উচ্চারণটা গুলিয়ে ফেললুম বোধহয়। রোমান অক্ষরে বানানটা জার্মান ভাষায় সি এইচ, বাংলা হিসেবে সাধারণত খ উচ্চারিত হয়। তবে এক্ষেত্রে সঠিক কী বলতে পারব না। আমার জার্মান জ্ঞান, আমার ধারণা আমার হিব্রু জ্ঞানের তুলনায় কিঞ্চিত বেশি। তবে ব্যাবহারিক তুলনায়, গুণীজনেরা মত দিয়েছেন উভয়ই সমান। তো এই হফকিরশে ম্যাক্সিমিলান নির্মাণ করেন তাঁর অন্তিম বাসস্থান হিসেবে। অর্থাৎ কিনা তাঁর কবরস্থান হিসেবে। তাঁর বিবাহের মতো তাঁর মৃত্যুও ইতরজন যেন ভুলতে না পারে, তার জন্য এখানে তিনি নির্মাণ করেন বৃহৎ সব ব্রোঞ্জের মূর্তি, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় যোদ্ধাদের আদলে। অর্থাৎ যাদের আমরা নাইট হিসেবে জানি। তাই মূর্তিগুলোর চলতি নামও ব্ল্যাক নাইটস। এই আনাড়ির ইতিহাস নিয়ে এত কচকচির কারণ হল, গুণী পাঠকেরা যখন অস্ট্রিয়া বা ইন্সব্রুক যাবেন (আমার কথাতে অবশ্য নয়, তাদের সদ্‌গুণই), তখন যেন এগুলো দেখতে না ভোলেন। অবশ্য চাইলেও ভোলা যাবে না। এই শহরের মাঝখানে দশমিনিট চক্কর কাটলেই এসব দুবার করে চোখে পড়বে, এতই ছোট্ট এই ইন্সব্রুক।



    মধ্যযুগের পরে, বা যুগসন্ধিক্ষণে অস্ট্রিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রে চলে আসে ভিয়েনা। ইন্সব্রুক বা আর সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে। এমনকি আর আজকের বিশ্ব রাজনীতি বা প্যান-ইউরোপীয় রাজনীতিতেও ভিয়েনা অনেক তা-বড়ো শহরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। তবুও ইন্সব্রুক তার নিজস্ব যে কয়েকটি জায়গা ধরে রেখেছে, তা হল সংস্কৃতি আর পড়াশোনা। আমার নিজস্ব ধারণা ইউরোপের সংস্কৃতি ব্যাপারটা খুব ছড়ানো-ছিটানো। মানে এক-এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশ এক-একরকমের। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের সঙ্গে মধ্য ইউরোপের এই অঞ্চলের বেশ মিল আছে। বিভিন্ন জাতির পাশাপাশি অবস্থান এই অঞ্চলের সংস্কৃতির অনেকগুলো মুখের জন্ম দিয়েছে। আবার পাশাপাশি আছে লোকায়ত সংস্কৃতি, যেখানে আল্পসের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরা তাদের নিজেদের মতো করে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন। এবং একে অন্যের থেকে অনেকটাই আলাদা।

    এই নিয়ে বলছিলেন একদিন ডিনার টেবিলে রিখারডহুলে। যিনি জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন এবং কাজও করছেন এই ইন্সব্রুক শহরে। এখানকার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক তিনি। আমিও কর্মসূত্রে গেছি সেই বিভাগেই। অর্থনীতির পাশাপাশি সংগীতেও আগ্রহ খুব। বললেন যে একদা এই তিরোলের প্রতিটি উপত্যকা নিজস্ব লোকসংগীত ঘরানা ছিল। তার আক্ষেপ ভুবনীকরণ এখানেও থাবা গেড়েছে। তারপর গুলিয়ে দিয়ে এখন কেবল ঘোলা জল হবার অপেক্ষা। আমরা সবাই সমান, কেউ কারও থেকে আলাদা নয়, তাই কারও নিজস্বতাও থাকবে না আর।

    গোটা পৃথিবীর কাছে ইউরোপের যা প্রধানতম অবদান বলে বিদগ্ধজনেরা স্বীকার করেন, সেই ইউরোপীয় সংগীতের ইতিহাস পড়লে খটকা লাগে যে হয়তো বা জার্মানি-অস্ট্রিয়ারই সংগীত ইতিহাস পড়ছি। হ্যাঁ, এই দুটি পাশাপাশি দেশ থেকেই বেরিয়ে এসেছেন পাশ্চাত্য সংগীতের সব মহারথীরা। প্রথমবার জেনে চমকে গেছিলাম যে পশ্চিমি সংগীতের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, বাখ-বিঠভেন-মোজার্ট, তিনজনেই জন্মেছিলেন জার্মানভাষী এই দুই দেশে। এ ছাড়াও আছেন। অবশ্য একথাও ঠিক শিল্প-সাহিত্য-সংগীত তাদের কাম্য উচ্চতা পায় রাজারাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতায়। এবং আমার মামুলি ইতিহাস জ্ঞান থেকে দেখি, যে পশ্চিমে অনেক ধনী সাধুপুরুষ এগিয়ে এসেছিলেন এ বিষয়ে। এমনকি পশ্চিমি ধ্রুপদি সংগীতকে গুণীজনেরা অভিহিত করেন থাকেন কোর্ট মিউজিক বা চেম্বার মিউজিক হিসেবে। অস্ট্রিয়ান রাজন্য ও সামন্ত সমাজ এ ব্যাপারে কার্পণ্য করেননি কখনোই। আবার পাশাপাশি দেখি যে আজ যারা পশ্চিমি সংগীতের মায়েস্ত্রো, তাঁরা অনেকেই শেষ জীবন কাটিয়েছেন ফরমায়েশি গত লিখে, অনাহার থেকে বাঁচতে। আমার আবার এক গাল মাছি।

    সেসব তত্ত্বকথা থাক। যেটা সবচেয়ে লক্ষ করার মতো তা হল, বাকি অস্ট্রিয়ার মতোই ইন্সব্রুক-এও দেবতার সম্মান পান ডব্লিউ এ মোজার্ট। বাখ, বিঠভেন কিন্তু সেই মর্যাদায় থাবা বসাতে পারেননি। এমনটি কেন, বহুজনকে জিজ্ঞেস করেও কোনো ভরসাযোগ্য উত্তর মেলেনি। অধমের সংগীত বাবদ জ্ঞান বিদগ্ধজনের হাসির খোরাক সেটা সর্বসমক্ষে স্বীকার করতে লজ্জা নেই। কিন্তু পণ্ডিতেরাও তো এ তিনজনের মধ্যে কোনো ইতরবিশেষ করেন না বলেই জানি। মোদ্দা কথাটা হল, এই প্রায় চারশো বছর বয়সেও ওলফগ্যাং আমেদিউস মোজার্টের জাতি যা খ্যাতি, বা বলা ভালো তাঁর নামমাহাত্ম্য নিয়ে যা কাড়াকাড়ি, তা দেখলে মহেন্দ্র সিং ধোনিও লজ্জা পাবেন। চকোলেটের র‍্যাপার থেকে মিউজিক বক্সের প্রচ্ছদ, সবেতেই তিনি সর্বত্রই সেই পেছনে আঁচড়ানো কোঁকড়ানো সোনালি চুল আর ভাসা ভাসা দুই চোখের সেই মুখচ্ছবি উপস্থিত।

    এই মোজার্টের কপিরাইট নিয়ে বেশ একটি মজা হয়েছিল একদিন সন্ধ্যায়। ইন্সব্রুক ইউনিভার্সিটির সেই আলোচনাচক্রে হাজির আরও কয়েকজন ততটা প্রবীণ নয় সদ্য আলাপিতের সঙ্গে এক সন্ধ্যায় বেরিয়েছি একত্রে ডিনার সারব বলে। প্রস্তাবটা শেষ বিকেলে দিয়েছিলেন ম্যাথিয়াস আর অলিভার, দুজন জার্মান সহযোগী। যেহেতু কাজ শেষ হলেই আমরা যে যার নিজের দেশে ফিরে যাব, এবং ভবিষ্যতে আবার সাক্ষাৎ হবার সম্ভাবনা খুব বেশি না, এমনটা ভেবে আমি ও আরও অনেকেই তৎক্ষণাৎ রাজি। সেই মতো দিনের শেষে হোটেলে ফিরে গিয়ে জামাকাপড় বদলে, বা বলা ভালো আরও দু-একটা সোয়েটার, ওভারকোট চাপিয়ে রাতের কনকনে ঠান্ডা বশে রাখবার জন্য, আবার এসে মিললাম সেই সোনার ছাদের তলায়। বাকি পাঁচজন মিলে ম্যাথিয়াস আর অলিভারকে যুগ্ম দলনেতা ঠাওরালাম। কারণ ওরা জার্মান বলতে, পড়তে পারেন। আমরা বাকিরা তো দোকানের দরজা বন্ধ থাকলে, দোকান খোলা থাকলেও যা হামেশাই বন্ধ থাকে ঠান্ডা হাওয়ার জন্য, কোন্‌টা ওষুধের দোকান আর কোন্‌টা রেস্তোরাঁ তাও বুঝি না।

    অথচ সেই দুজন জার্মান থাকা সত্ত্বেও, আধঘণ্টা পরেও দেখা গেল যে আমরা প্রায় একই রাস্তায় ঘুরে যাচ্ছি। সমস্যাটা সেই দুজনকে জিজ্ঞাসা করতে উত্তর পেলাম, যে যদিও কয়েকটা রেস্তোরাঁ দেখা গেছে তবে কোন্‌টা ভালো হবে বা তার চেয়েও বড়ো প্রশ্ন কোন্‌টা ট্যাঁকসই হবে তাঁরা ঠিক ঠাহর পাননি। যাব্বাবা! এবার মরিয়া হয়ে সামনে প্রথম যেটা পাব ঢুকে যাব ভাবছি, এমন সময় দেখি উলটো দিক থেকে আর-একটা দল আসছে, যার সদস্যরা আমাদের পরিচিত, মানে একই সম্মেলনে এসেছেন। এ দলে অবশ্য প্রবীণদের ভিড় বেশি, এবং কোনো এক কাকতালীয় কারণে স্থানীয় অস্ট্রিয়ানদের সংখ্যা বেশি। এদের রেস্তোরাঁ খুঁজতে কোনো বেগ পেতে হয়নি এবং তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ফেলেছেন। এরাই বাতলে দিলেন যে সামনে একটি সুবিধার রেস্তোরাঁ আছে এবং খুঁজে পেতেও অসুবিধে হবে না, বাইরে মোজার্টের নামের ফলক লাগানো আছে। মানে মোজার্ট সে হোটেল কাম রেস্তোরাঁয় কিছুকাল বসবাস করেছিলেন আর কি। আমরা তো তাই লাফাতে লাফাতে ছুটলাম এবং ম্যাথিয়াস খুঁজে বের করলেন সেই রেস্তোরাঁ আর তার মোজার্ট ফলক। তারপর সেটা ছ-সেকেন্ড পড়েই দেখি তার খ্যাঁকখ্যাঁক হাসি। আমরা তার এমন রসের কারণ শুধোতে সে বলল মোজার্ট মহাশয় এখানে ছিলেন ঠিকই কিন্তু সাকুল্যে আড়াই দিন। সেটাই এমন শ্লাঘার বিষয় যে হোটেল কর্তা সেই ঘটনাই মার্বেলে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছেন। বুঝলাম একেই বলে নামমাহাত্ম্য।

    তো সেই ডিনার আড্ডায় আরও এক শিক্ষালাভ হয়েছিল। কূপমণ্ডূক আমি ভাবতাম ইউরোপিয়ানরা সবাই বুঝি খুব নিয়মনিষ্ঠ সময়ানুবর্তী লোক। মেপে কথা, কয় মেপে খাবার খায়, ঘড়ি ধরে নিদ্রা যায়। আর আমরা বাঙালিরাই হচ্ছি আধুনিক পৃথিবীর যাযাবর বেদুইন। নিয়ম ভাঙতে আর আড্ডা দিয়ে রাত কাবার করতে আমাদের জুড়ি নেই। বিশেষত এই শর্মা তো আরও এক কাঠি বাড়া। বাড়ির লোকে বকে বকে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সুতরাং ঘাড় ধরে না তুললে আমি উঠছি না এমন একটা জাঁক পকেটে রেখে বসে ছিলাম। তারপর ইউরোপীয় ডিনার যেমন শুরু হয় আর কি। রুটির টুকরো চিবোনো আর হাজার রকম গল্প। টুকরো-টাকরা ব্যক্তিগত বিষয় জেনে নেওয়া। জার্মানরা দেখলুম এসব ব্যাপারে বিশেষ স্নব নয়।

    তারপর মেন্যু ঠিক করতে গিয়ে আর-একদফা ঝামেলা। এখানেও সেই দুজনই তাদের জার্মান যোগ্যতার কারণে বাছাইকারী নেতা। কিন্তু তাঁরাও দেখলাম কয়েক মিনিট মেনুকার্ডটিকে পড়ে, এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এর তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। শেষে দেখে বললেন, যে যদিও এটা জার্মানেই লেখা, তবুও খাদ্য বিষয়গুলো তাদের এতটাই অচেনা নামে যে বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছেন না। বিশেষত বিদেশি অতিথিদের জন্য তারা বিপদ ডেকে আনতে চাইছেন না আনাড়ির মতো। আমাদের আবার একগাল মাছি। তখন অলিভার খোলসা করলেন, যে উত্তর জার্মানি আর দক্ষিণ জার্মানি তথা অস্ট্রিয়া অঞ্চলের ভাষায় এত তফাত যে এমনটা হতেই পারে। আর তারা দুজনেই হামবুর্গ অঞ্চলের লোক, জার্মানির উত্তরস্য উত্তরে। এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রত্যেকেই জুয়া খেলতে শুরু করলেন। মানে যে নামটা পছন্দ হয় তাতেই হাত রাখতে শুরু করলেন। আমি সেটাও না করে ঘোষণা দিলাম যে মাছ খাব। মানে কোনো মাছের পদ সহ ডিশ। আগের সন্ধ্যার সরকারি ডিনারে মাছের পদটি মুখে লেগেছিল। শুনেছিলাম এখানে পাতে যা দেওয়া হয় সবই ইন নদীর ফসল। সেটা আর-একবার চেখে দেখে নিই। আর তা ছাড়া বিদেশ-বিভুঁইয়ে বাঙালি সন্তানের মুখরক্ষার ভার মাছ ছাড়া আর কার হাতেই বা দেওয়া যায়।

    তবে ডিনার পর্বের এখনও বাকি আছে। অর্ডার নিয়ে সুন্দরী ওয়েট্রেস চলে যাবার পর আবার শুরু হল আলাপ। বিষয় থেকে বিষয়ে ভাসছি যেন বানের জলে কলার ভেলার মতন। এরই মধ্যে কিঞ্চিৎ পানীয়। এ বিষয়ে ভাষার অবতার বোধগম্যতা সমস্যা হয়নি অবশ্য। এবং তারপর অপূর্ব ক্রিম ও গাজরের স্যুপ। যদি অভয় দেন তো বলি, ইউরোপীয় কন্টিনেন্টালস্যুপ এখনও চিনে স্যুপকে দশ উইকেটে ইনিংসে হারাবে। তা চিনেরা সারা পৃথিবী যতই তাদের খাবারে ছেয়ে ফেলুন না কেন। তারপর একসময় প্রধান পদটিও এসে গেল। অবশ্য মাছ বাদে তাতে আছে চটকে মাখা আলু সেদ্ধ আর একজামবাটি সালাদ, যার অনেকগুলো পাতা যে খাদ্য আগে জানতাম না। সেদ্ধ মাছটি একাই যদিও কাফি ছিল। ট্রাউট জাতীয় কোনো মাছ, বিঘৎ খানেক সাইজ। ইন নদীতে প্রায় সারা বছরই পাওয়া যায় এমনটাই শুনলাম। অস্ট্রিয়ান জার্মান নামটাও শুনেছিলাম, কিন্তু ওইটুকু মাছের অত বড়ো খটোমটো জার্মান নাম মনে রাখার মতো এলেম আমার নেই।

    কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। স্থানীয় নদীর মাছ এখনও কী সুন্দর এ দেশে পাওয়া যায়। আর আমার দেশে কোনো নদীকেন্দ্রিক শহরে স্থানীয় মাছ চাইলেই একই দুঃখী দুঃখী মুখের উত্তর, আগে পাওয়া যেত এখন সব শেষ। অন্তত আমি যে মফস্বল শহরে জন্মে বড়ো হয়েছি তারও কয়েকটি মাছ বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু আজ তারা প্রায় ডোডো পাখির দলে নাম লিখিয়েছে। জনসংখ্যা একটা বড়ো ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই। তবে রক্ষণাবেক্ষণের সদিচ্ছাটাও জরুরি কথা।

    এইরকম ভাবতে ভাবতে কথা কইতে কইতে পাতের খাবারও এক সময় শেষ হয়ে গেল। এরইমধ্যে ঘরের এক কোণে আমাদেরই কাছে বসে হাওয়াইয়ান গিটার জাতীয় এক তারযন্ত্রে লোকসংগীতের সুর তোলা শুরু করলেন এক ওস্তাদ। হয়তো আমাদেরই জন্য। রিচার্ড-এর কথা মনে পড়ে গেল। তিরোলের সব পাহাড়ের উপত্যকায় একটা না একটা নিজস্ব সংগীত আছে। প্রৌঢ় ওস্তাদ হয়তো তাদেরই কোনো একটার বাহক আজও। ভীষণ ভালো আর চেনা লাগছিল সুর। লোকগানে বুঝি এরকমই হয়। একসময় গান শেষ করে গুণীও তাঁর যন্ত্র গোটালেন। আমাদের আড্ডার তবুও বিরাম নেই। বিশেষত অলিভার আর ম্যাথিয়াস, এবং ব্রায়ান, নরওয়ের। কে যেন একবার বললেন কাল সকালেই আবার...। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, আমাদের সকলেরই কাল কেবল বসে শোনার পালা, কারোরই কোনো প্রেজেন্টেশন নেই। সুতরাং খালি হয়ে গেল রেস্তোরাঁ। সুন্দর পরিবেশিকা এসে বিল দিয়ে চলে গেলেন। একসময় গির্জা থেকে মধ্যরাত্রির বারোটি ঘণ্টা পর পর ভেসে এল। থেমেও গেল। আমি তখন ভাবছি কোথায় গেল ইউরোপীয় নিয়ম মানার তাগিদ। শেষমেষ সেদিন যখন হোটেলে ফিরে এলাম, আগের তারিখ তখন বহুক্ষণ হল তামাদি হয়ে গেছে। বিছানায় যেতে যেতে ভাবলুম জার্মানরা আড্ডা দেওয়াতেও জার্মান।



    পরদিন লাঞ্চের আগে সম্মেলন শেষ হল। তাই লাঞ্চে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে। আবার ধীরে ধীরে আড্ডা জমতে শুরু করল। এবার আমরা বসলাম ইউনিভার্সিটির সমাজবিদ্যা বিভাগের কাফেটেরিয়ায়। তাঁরা বলেন মেনসা। মানে মানুষের বেঁচে থাকার রসদ যেখানে পাওয়া যায়। অবশ্য পাওলা, যিনি ইতালীয় কিন্তু গবেষণার সূত্রে আছেন ইংল্যান্ডের সাসেক্সে, তিনি এই মেনসা শব্দের মধ্যে সভেনিজম বা প্যাট্রিয়ার্কি খুঁজে পেলেন। মেনসা বলতে কেবল পুরুষদেরই অধিকার বোঝায়। কিন্তু খাদ্যের প্রয়োজন তো উভয়েরই। তবুও এই শব্দই নাকি চলে আসছে জার্মানে। এবারের আড্ডায় যদিও কেবল তাত্ত্বিক আলোচনা চলছিল, যাতে সাধারণ পাঠকের তেমন আগ্রহ থাকার কথা নয়।

    লাঞ্চের শেষে এবার বিদায় নেওয়ার পালা। আবার একপ্রস্থ ই-মেইল ঠিকানা আদান-প্রদান ও কে কী কাজ করছেন তার খবরাখবর বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি। এইসব সেরে হোটেলে না ফিরে আমি বেরিয়ে পড়লাম শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরতে, পায়ে হেঁটে। সঙ্গী পাবলো আর ব্রায়ান। পাবলো মেক্সিকোর লোক, গবেষণা করছেন স্টেটসের ইন্ডিয়ানায়। স্ত্রী ও ছ-মাসের নন্দিনী এখন ওর সাথেই আছেন, থাকছেন। পার্স খুলে মেয়ের ছবি দেখালেন। বড্ড ভালোবাসেন বোঝা গেল। আর দীর্ঘদেহী ব্রায়ান আদতে নরওয়ের লোক, কিন্তু গবেষণার বিষয়ে আছে তানজানিয়া। তাই বেশ কিছুকাল তানজানিয়ায় কাটিয়েছেন। গবেষণা করছেন অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই তিনজন মিলে চষতে শুরু করলাম শহরটাকে। খুব বেশিক্ষণ দিনের আলো থাকবে না, তাই প্রথমেই গলিঘুঁজিগুলো দেখতে লাগলাম উঁকি মেরে।

    আগেই বলেছি ইন্সব্রুক ছাঁচে ঢালা ইউরোপীয় নগরী। ঠিক মাঝখানটা জুড়ে আছে পুরোনো শহর যা কিনা মধ্যযুগেই মূলত গড়ে উঠেছিল। এবং এখনও প্রায় তেমনি আছে। প্রাসাদ আর পুরোনো গির্জা আর মিউজিয়াম। এইটুকু শহর কিন্তু প্রায় এক ডজন মিউজিয়াম। ইউরোপের যে-কোনো শহরে মিউজিয়ামের আধিক্য খুব বেশি এবং হাজারো বিষয়ের ওপর এঁরা মিউজিয়াম বানাতে পারেন। লন্ডনে মাদাম তুসো সকলেই জানেন। সে শহরে বেকার স্ট্রিটে আবার আছে শার্লক হোমস মিউজিয়াম। তাঁর আতস কাঁচ থেকে ধোঁয়া টানার পাইপ, সবই সেখানে রাখা আছে। যদিও শার্লক হোমস সত্যিকারের কেউ কখনোই ছিলেন না। এ যাত্রায়ই মিউনিখে চোখে পড়েছিল মাছ আর পাখি শিকারের জাদুঘর, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিকারের অস্ত্রশস্ত্র থেকে হালফিলের বন্দুক-পিস্তল, যা দিয়ে মাছ মারা যায় বা পাখি, এবং পাখি, মাছ ইত্যাদি মমি করে রাখা আছে। ইন্সব্রুকে আছে রাজকীয় জাদুঘর গোটাকয়েক। সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগল তিরোলের লোকশিল্প জাদুঘর। যেটা কিনা বেশ বড়ো একটা পুরোনো গির্জাতে তৈরি হয়েছে। মধ্যযুগ থেকে তিরোলিয়ানদের পোশাক-আশাক, ছবি, ভাস্কর্য, আসবাবের এক অপূর্ব সংগ্রহ। গোটা তিরোলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল সবের এক অনবদ্য চালচিত্র যেন।

    আমি ওই অল্প ক-দিনের মধ্যেই বার তিনেক ওখানে ঢুঁ মেরেছি। অবশ্য আমাদের সম্মেলনের লাগোয়া ছিল এটাও একটা কারণ। ইন্সব্রুকের পুরোনো শহর অঞ্চলে আছে বেশ কয়েকটা বড়ো গির্জা। স্থাপত্য চোখ টেনে রাখে। অনেক সময় গির্জাগুলো কোনো প্রাসাদ বা হলের একটা অংশ। এবং মজার কথা, ওই হলগুলো এখনও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনই একটা বড়ো হলে ছিল আমাদের সম্মেলন। ভেতরে ঢুকলে অবশ্য বোঝবার জো নেই যে হলগুলো সত্যিই এত পুরোনো। সমস্ত আধুনিক সরঞ্জাম যেমন আছে সুখসুবিধার জন্য, তেমনি ঝকমকে তকতকে করে রাখা সবকিছু, যেন কালকেই কলি ফেরানো হয়েছে। এই বড়ো প্রাসাদ আর গির্জাগুলোকে বাদ দিলে আছে কিছু মামুলি বাড়িঘর। গথিক স্থাপত্য। বাইরেটা প্রায়ই সাদা।



    শহরের মাঝখানে একটা বড়ো চত্বর। সেখানে বসেছে ক্রিসমাসের বাজার। ছোটোখাটো জিনিসপত্র আর আলোকসজ্জা, টুকটাক জিনিস। প্লাম কেক আর প্যানকেক। বিভিন্ন রকম মোমবাতি আর ক্রিসমাস ট্রি দেখতে পেলাম, যেগুলোতে স্থানীয় শিল্প কারিগরির ছাপ স্পষ্ট। একটা দোকানে দেখলাম পুরোনো ব্যবহৃত তৈজস বিক্রি হচ্ছে। মানে অ্যান্টিক শপ। এরই মাঝে দেখা হয়ে গেল এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে। টালিগঞ্জের বসত ছেড়ে এই সুদূর ইন্সব্রুকে আছেন কর্মোপলক্ষে। অবশ্য আর-একটা এরকম বাজারে দেখা পেয়েছিলাম একদল পাঞ্জাবির। কিন্তু তাঁদের কাছে গিয়ে বেশ হতাশ হতে হয়েছিল। টি-শার্ট ইত্যাদি বিক্রি করছেন, কিন্তু সবেতেই হয় স্পাইডারম্যান, হ্যারি পটার বা আমেরিকার পতাকার ছাপ। অস্ট্রিয়া বাইন্সব্রুকের কোনো ছবি নেই। ভেবেছিলাম কিছু সুভেনির করে নিয়ে যাব। কিন্তু এ তো গড়িয়াহাটেও পাওয়া যায়।

    এরই মাঝে পাওয়া গেল এক সান্তাক্লজকে। বাইসাইকেলের পেছনে মিউজিক বক্স বাজিয়ে ইতরজনকে সংগীতসুধা বিতরণ করছেন। এভাবে আমরা এসে পড়েছি নতুন শহরে। অবশ্য তফাত বেশি কিছু নয়। সেই প্রায় একই ধাঁচের বাড়িঘর, আকারে বড়ো। আর সাজানো দোকানপাট। উৎসবের মরশুম চলছে বেশ বোঝা গেল। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে উপচে পড়া ভিড়। ফ্যাশান বুটিকগুলো বেশ সেজে আছে দেখলুম। এখানকার পোশাক-আশাক দেখলে মনে হতেই পারে যে শহরের বয়স তো তেমন নয়। আবার এসব পোশাক যাদের অঙ্গে ওঠে তারাই আসলে মনে হয় ওই পোশাকগুলিকে কৃতার্থ করেন। সত্যি বলতে কি অস্ট্রিয়ান মেয়েদের মতো সুন্দরী খুব কম দেশেই আছেন। এবং এক-আধজন নয়, গড়পড়তা সব মেয়েদেরই চোখ ফিরিয়ে দেখতে হয়। জার্মানদের মতোই ভরাট দেহের গড়ন, কিন্তু লাবণ্য ঢেলে দিতে ভগবান কার্পণ্য করেননি। আবার ব্রিটিশদের মতো থ্যাবড়া নাক-মুখ নয়, বেশ টিকলো নাক চোখ। অবশ্য পরে যেটা বুঝেছিলাম, অস্ট্রিয়ান মেয়েদের এতো সুন্দরী লাগার কারণ, অন্তত আমাদের চোখে, তা হল ওদের বেশিরভাগের মাথার চুল কালো ও সোজা। ইউরোপের অন্যদের মতো কটা নয়। দক্ষিণ ইউরোপে অবশ্য কালো চুল অনেকটাই সহজলভ্য, যেমন ইতালিতে। তবুও এরকম ঝাঁকে ঝাঁকে সুন্দরী...

    বাকি ইউরোপের মতো ইন্সব্রুকেও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় সাত-তাড়াতাড়ি। ছটা বাজতে না বাজতেই। আবার খোলা হয় সকাল দশটার আগে নয়। মানে দোকানদারেরাও ওখানে অফিসবাবু। বিবি সাহেব কথাটাই বোধহয় বেশি প্রযোজ্য হবে। এমন নয় যে রাত দশটা অবধি খোলা থাকলেই আমি কিনে কিনে ছয়লাপ করে দিতাম। কিন্তু উলটেপালটে দেখতে তো আর পয়সা লাগে না। তাই ছটার পরে দোকানের কাচে নাকের ডগা ঠেকিয়ে জিনিসপত্র দেখতুম। আবার অনেক বেশি রাত অবধি খোলা থাকে ক্লাব, ক্যাসিনো আর রেস্টুরেন্ট। আমরা সাধারণত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিনার সারতুম। ওখানেও মুম্বাই কলকাতার মতো রাস্তার মোড়ে হাতে-গরম পাওয়া যায়, রোল চাওমিন-এর বদলে পিৎজা আর পাস্তা আর বার্গার। ইন্সব্রুক হল দক্ষিণ ইউরোপে বাইসাইকেল টুরিস্ট আর ব্যাকপ্যাকারদের জংশন। তাদের সুবিধার জন্যই গজিয়ে উঠেছে এইসব খাবারের দোকান। এ ছাড়াও পাবেন বাইসাইকেল ট্র্যাক, সারা শহর জুড়ে।

    আর যারা স্কিইং করতে চান তাঁদের জন্য ইন্সব্রুক তো স্বর্গ। আল্পসের অন্যতম সেরা উইন্টার স্পোর্টসের জায়গা ইন্সব্রুকে। এমনকি এইটুকু শহরে দু-দুবার হয়ে গেছে উইন্টার অলিম্পিকস। একবার উনিশশো ছিয়াত্তরে, আর-একবার কবে যেন। স্কিইংয়ে ব্রায়ানের কিছু আগ্রহ আছে, সেই এইসব কিঞ্চিত তথ্য দিল। তারপর বোঝাতে লাগল স্কিইং-এর ইজি রুট, মিডিয়াম আর হার্ড রুট। মানে ট্র্যাকের ঢাল বা অন্য বাধা-বিপত্তির হিসেবে এইরকম ভাগ করে নেওয়া হয়। ইন্সব্রুকে নাকি তিন রকম রুটই পাওয়া যায়। ঠিক হল পরদিন সকালে গিয়ে সরেজমিন দেখে আসা যাবে। অবশ্য পরদিন স্কিইংয়ের ট্র্যাক অবধি পৌঁছোনো গেল না, বিচ্ছিরি মেঘলা আকাশের জন্য। সেদিন কেউই নাকি ট্র্যাকে নামবেন না। আমরা তাই কিছুদুর গিয়েই ফিরে এলাম। এই ট্রাকগুলো ঠিক ইন্সব্রুকে নয়, এটা তো উপত্যকা, নীচু জায়গা। আশেপাশে আল্পসের ওপরে যে গ্রামগুলো আছে বিভিন্ন উচ্চতায়, সেখানেই এই স্কিইং ট্র্যাকগুলো তৈরি হয়েছে। কিছুদূর বাসে করে গিয়ে তারপর কেবল কারে যেতে হয়। এরই মাঝে দেখা হয়ে গেছে সাজসরঞ্জাম। মহাকাশ অভিযানের কথা মনে করিয়ে দেয়। শুনলাম অন্যতম ব্যয়বহুল খেলা এই স্কিইং। খুব কম লোকই সব সরঞ্জাম কিনতে পারেন। বাকিরা ভাড়া করে নেন মনে। পড়ে গেল দেখেছি বটে শহরে এইরকম দোকান যারা সরঞ্জাম ভাড়া দেন।

    শহরে ফিরে এসে ইন নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম আলপাইন চিড়িয়াখানায়। মানে এই চিড়িয়াখানা সমস্ত দ্রষ্টব্য আল্পসের বাসিন্দা। অনেক জন্তুই আছে যারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। চেষ্টা চালানো হচ্ছে প্রজাতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার। চিড়িয়াখানায় দেখলাম বাসিন্দাদের পরিবেশকে গড়ে তোলার কী অপরিসীম চেষ্টা। যাতে তারা ঘরছাড়ার কষ্ট ভুলে যায়।
    ইন নদী এই শহরটাকে ঠিক আধা-আধি না হলেও, উত্তর-দক্ষিণে ভাগ করেছে। উত্তর দিকটা ধীরে ধীরে উঁচু হতে হতে মিশে গেছে আল্পসে। নদীর উপর জায়গায় জায়গায় আছে সাঁকো, যার কোনো একটার উপর দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকালে এই ব্যাপারটা চোখে পড়ে। উত্তর অংশ প্রধানত বসবাসের জন্য, আর আছে এই চিড়িয়াখানা।



    দক্ষিণ অংশটা আকারে বড়ো, আর এখানেই আছে সব প্রাসাদ, মিউজিয়াম, হল আর গির্জা। নতুন দোকানপাটও মোটামুটি এইদিকে। নতুন পুরোনো সব বাড়িঘরই একই ইউরপিয়ান ধাঁচের। এইসবের মধ্যে খালি বেখাপ্পা লাগে ইউনিভার্সিটির সমাজ-অর্থনীতি বিভাগের বাড়িটা, যাকে সবাই বলে SOWI, মূলত জার্মান নামের আদ্যক্ষরগুলো জুড়ে। আমি ওখানেই গিয়েছিলাম। অত্যাধুনিক পাঁচতলা কংক্রিটের ছাদওয়ালা এক বিশাল বাড়ি। আপাদমস্তক কাচে ঘেরা। আমেরিকার আধুনিক শহরগুলোতে যা আমরা দেখতে অভ্যস্ত। এই ছোট্ট আপাদমস্তক ইউরোপীয় শহরে কেমন যেন বেমানান। এমনকি মূল ইউনিভার্সিটি বিল্ডিংও অতি প্রাচীন পনেরো শতকের এক স্থাপত্য। তারই অপত্য যেন মূর্তিমান কালাপাহাড়। অবশ্য আলাদা ভাবে দেখলে এই বিল্ডিংটাও অসামান্য সুন্দর, ভেতরে বাইরে সর্বত্রই অস্ট্রিয়ান শিল্পবোধের নমুনা। তবুও এই শহরে কেমন যেন একপাশে দাঁড়িয়ে আছে বেখাপ্পা। এই এক ছবি মনের মধ্যে রেখে ছেড়ে আসলাম এই শহর। যাব এবার ভিয়েনায়, রাতের ট্রেনে। সঙ্গে রয়ে যাবে এই ছোট্ট একটি শহরের কয়েকদিনের ভালোলাগার গল্প।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২১ জুলাই ২০২০ | ২৪২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sq | 176.***.*** | ২৩ জুলাই ২০২০ ০৭:৩৫95436
  • "অস্ট্রিয়া বেশ একখানি বেশ ছোট্টোখাট্টো দেশ। অন্তত উত্তরে জার্মানি, আর পশ্চিমের ইতালির তুলনায়। এমনকি আকারের দিক থেকে উত্তর-পশ্চিমের সুইজারল্যান্ডও বেশ বড়ো। তবে পূর্বে বা দক্ষিণ-পূর্বে হাঙ্গেরি বা অন্য স্লোভাক দেশগুলো সেই তুলনায় প্রায় সমান মাপের। অন্তত দু-দশকের জায়মান রাজনীতির পরে আজ যে স্থিতাবস্থা হয়েছে, সব নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেবার পর।"

    Austria: 83,879 km2 (32,386 sq mi)

    Switzerland: 41,285 km2 (15,940 sq mi)

    Slovak Republic: 49,035 km2 (18,933 sq mi)

     

  • অংশু | 2401:4900:1044:d8a3:ddde:b341:a455:***:*** | ০১ আগস্ট ২০২০ ১৩:২৮95797
  • Sq আপনিই ঠিক। আমি অন্য কিছু লিখতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছি। অনেক ধন্যবাদ শুধরে দেওয়ার জন্য।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন