হঠাৎ এমন একটা বিটকেল প্রবন্ধ লিখতে বসলাম কেন? পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে, নভেল করোনা ভাইরাস তো এই সেদিনের ব্যাপার! তাহলে "রুমাল" আর "বেড়াল" এর মধ্যে সম্পর্কটা কোথায়?
আসল কথা, করোনা ভাইরাস এর অতিমারী বিলেতে একটু বেশি মাত্রায় সমস্যা সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপার দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ, এশিয়ান (মানে উপমহাদেশীয়, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রী লঙ্কা), এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষেরা এই নতুন রোগটিতে আক্রান্ত হলে, তাঁদের মৃত্যুর সম্ভাবনা শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে বেশি। এই ব্যাপারে স্বভাবতই এই গোষ্ঠীর লোকেদের মধ্যে খানিকটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সেই সঙ্গে অনেক রকম "তত্ত্বের" পর্যালোচনাও আরম্ভ হয়েছে।
ব্রিটেনের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্স (সংক্ষেপে ও এন এস) মে মাসের সাত তারিখ সেই মর্মে দুটি স্টাডি প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটস্যাপ, টুইটার, ফেসবুক এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমগুলোতে চাপান-উতোরের ঝড় ওঠে, গত কয়েকদিনের বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলনের ফলে সে ঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে বই কমেনি!
পরিষ্কার দুটো দলের সৃষ্টি হয়েছে - একটা দলের বক্তব্য এই মৃত্যুর প্রধান কারণ জেনেটিক, বা অন্য কোন জৈবিক কারণ আছে (ভিটামিন ডি'র অভাব, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের প্রকোপ এশিয়ানদের মধ্যে বেশি, ইত্যাদি)। দ্বিতীয় দলের কথা, ওসব বায়োলজিক্যাল কারণ-ফারণ নয়, এর প্রধান কারণ হচ্ছে কয়েকশো বছরের অবহেলা ও বর্ণবৈষম্য।
মহা মুশকিল! তাই অগত্যা সরণ নিলাম কার্ল সাগানের! ক্রিটিকাল থিংকিং ব্যাপারটা প্রধানত এনার সুবাদেই শেখ! বিশেষত তাঁর একটি প্রবন্ধ থেকে - The Fine Art of Baloney Detection । এই Baloney ব্যাপারটিকে ইতালিয়ান খাবারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না! এটির অর্থ সহজ ভাষায় বোকার মতো কথা। ইংরিজিতে, মানে প্রাকৃত ভাষায় ওই B দিয়েই আর একটি কটুকাটব্য ব্যবহার করা হয়, সেটা আর লিখলাম না! সেটার আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় "ষাঁড়ের গোবর!"
সাগান কয়েকটি সহজ প্রশ্ন দিয়েছিলেন, যেগুলোর উত্তর পেলে থিওরিটা Baloney কি না সেটা বোঝা যাবে।
১। অন্য কোনো সোর্স থেকে ব্যাপারটা সম্মন্ধে একই তথ্য পাওয়া যায় কি না।
ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপীয় অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর দ্বীপের তুলনা করে দেখা যাক! আফটার অল, ব্রিটেনের বেশির ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষই এই আফ্রো ক্যারিবিয়ান গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
ইতালি :- ২৩৬৬৫১ জন অসুস্থ, মৃতের সংখ্যা ৩৪৩০১; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৫৬৭
বেলজিয়াম :- ৬০০২৯ অসুস্থ; মৃতের সংখ্যা ৯৬৬৫; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৮৩৩
ফ্রান্স :- ১৫৬৮১৩ অসুস্থ; মৃতের সংখ্যা ২৯৩৯৮; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৪৫০
জার্মানি :- ১৮৭৪২৩ অসুস্থ; মৃতের সংখ্যা ৮৮৬৭; প্রতি মিলিয়নে মৃত ১০৭
সে ক্ষেত্রে,
জ্যামাইকা :- ৬১৫ অসুস্থ; মৃতের সংখ্যা ১০; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৩
সাউথ কোরিয়া :- 12085 অসুস্থ; মৃত ২৭৭; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৫
ভিয়েতনাম :- ৩৩৪ অসুস্থ; মৃত ০: প্রতি মিলিয়নে মৃত ০
জাপান :- ১৭৩৮২ অসুস্থ; মৃত ৯২৪; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৭
ভারত :- ৩২৪৪৮২ অসুস্থ; ৯২৪৭ মৃত; প্রতি মিলিয়নে মৃত ৭।
দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় দেশগুলোর সামগ্রিক পারফরম্যান্সই খারাপ! কিন্তু যে দেশ থেকে এই BAME (ব্ল্যাক, এশিয়ান, Minority এথনিক) মানুষেরা আসেন, তাদের পারফরমেন্স কিন্তু মন্দ নয়!
২। থিওরিটা নিয়ে বিতর্কের প্রয়োজন (কার্ল সাগান)
খুব সত্যি কথা। এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখেছি সেটা হচ্ছে একটা পরিসংখ্যান। যাকে বলে statistical এনালাইসিস। বিলেতে BAME মানুষদের মৃত্যুর ব্যাপারটা সত্যি বিজ্ঞান সম্মত কি না, সেটা জানতে হলে ভাইরোলজিস্ট, ইমিউনোলজিস্ট, ডাক্তার, সামাজিক বিজ্ঞানী, সবাইকেই দরকার।
সেই বিতর্ক এখনো হয়নি, বা করা সম্ভব হয়নি। তাই মনে হয়, এখনই ব্যাপারটার পিছনের কারণ খুঁজবার সময় বোধহয় এখনো আসেনি।
৩। অন্য কোনো সম্ভাব্য থিয়োরীর কথা কি ভাবা হয়েছে? (সাগান)
১০ মে'তে বিবিসির খবরে বলা হয়, শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর সম্ভাবনা (কোভিড ১৯ থেকে) ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বেশি; পাকিস্তানী ও বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে এই আশংকা ৫০ - ৬০% বেশি; ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ৩০ - ৪০% বেশি।
কোনো আর্থসামাজিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা বিবিসির তরফ থেকে দেওয়া হয়নি!
১৯৪৭ সালে অগাস্ট মাসে বরাতের মাটিতে দুটি দাগ কেটে দুটি (এখন তিনটি) দেশের জন্ম দেওয়া হয়। এই পরিসংখ্যানের একটি অর্থ হয়, যে সেই দাগ কতবার ফলে ভারতীয়রা পাকিস্তানী ও বাংলাদেশিদের থেকে "কি করে জানিনা" করোনা ভাইরাসের থেকে প্রাণে বাঁচবার মতো একটা মিউটেশন এর বলে বলীয়ান হয়ে ওঠেন!
একেবারে আমাদের ছোটবেলায় পড়া লামার্কের ইনহেরিটেন্স অফ একওয়ারড কারেক্টর্স! যেন জিরাফের গলা লম্বা হওয়ার সেই সাত পুরোনো ভ্রান্ত থিওরির মতো!
৪। Occams Razor (যাকে বলা যায়, একটি সমস্যার সহজ ব্যাখ্যা থাকলে সাধারণত সেই ব্যাখ্যাটিই সঠিক)
বহু বছরের বৈষম্য, অশিক্ষা এবং রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে আজকে BAME মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি নির্দেশকে মেনে চলতে চান না। সেটা আশ্চর্য্য কিছুই নয়। ব্রিটেনে গত দশ বছরের সরকারি নীতি, ইমিগ্র্যান্ট বিরোধিতা, ইসলামোফোবিয়া, এবং অধুনা Windrush কেলেঙ্কারি, গ্রেনফেল টাওয়ারের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের বিরুদ্ধে এমন মানসিকতা (বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলমানদের ক্ষেত্রে) গড়ে ওঠ মোটেই আশ্চর্য্যজনক নয়। ফলে সামাজিক দূরত্ব আর কোয়ারেন্টাইন অনেক ক্ষেত্রেই করা সম্ভব হয় নি!
আফ্রো ক্যারিবিয়ান এবং মুসলমান পরিবারগুলো অনেক সময়েই ছোট জায়গার মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়, সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক কারণে। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা অনেক সময়েই এমন কাজ করেন যাতে তাঁরা কোনো পিপিই ছাড়াই মানুষের কাছে আসতে বাধ্য হন (যেমন বাস ড্রাইভার ও রেস্টুরেন্টের ওয়েটার অনেক সময়েই পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী)। ফলে এঁদের মধ্যে সংক্রমণও বেশি ছড়িয়েছে\
করোনা ভাইরাস সমস্যা থেকে যদি কিছু শিখতে পারি, তা হচ্ছে এই - আজকে আমরা যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তার জন্যে আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ক্রিটিকাল চিন্তা!
আশা করি আরো অন্যান্য আজগুবি কন্সপিরাসি থিওরীকেও আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো!
সবাই সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
একটা প্রশ্ন, ভারতে মৃত্যু প্রতি মিলিওনে ৭ লিখেছেন, কিন্তু যে কোনো সাইটেই প্রায় ৩% (কমবেশী) দেখেছি মৃত্যুহার। এটা কি তবে অসুস্থ নয়, মোট জনসংখ্যার হিসেবে করা?
#বুঝভুম্বুল।
আমি 'ডাটা' নিয়েছি worldometer থেকে। যে বিশেষ দিন এই লেখাটা লিখেছিলাম, এটা সেই বিশেষ দিনের খবর।
এই ইনফরমেশন পরিবর্তনশীল। বিশেষত, আর্টিকলটা লিখেছিলাম ভারতের লকডাউন চলাকালীন। লকডাউন ওঠার পর ভারতবর্ষের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে (সেটাও ওয়ার্ল্ডোমিটার গুগল্ সার্চ করলেই পাবেন।)
সাবধানে থাকবেন, ভালো থাকবেন।
(রাজর্ষি রায়চৌধুরী)
স্পষ্ট লেখা। পাঠকদের ভাবালেই সিদ্ধি।