ডিট্রয়েটের এক পুরান বাসায় আমি এই নোটবুকটি পাই। চামড়ার কভারে মোড়ানো। নীল কালিতে লেখা। কোন তারিখ নাই লেখার নিচে। নোটের কভারে নাম আছে হামিদুর রহমান। আমি হামিদুর রহমানকে খুঁজছি। তার এই টুকরো গল্পগুলি আমাকে একটি মাস্টারপিস লেখার আইডিয়া দিয়েছে। হামিদুর রহমানকে আমার দুইটি কারণে দরকার।
এক, তার অনুমতি নেয়া। যেহেতু আমি তার কিছু গল্প বা স্মৃতিচারনাকে ব্যবহার করব।
দুই, দুয়েকটা বিষয়ে স্পষ্ট হওয়া তার সাথে কথা বলে। কেননা তার লেখা টুকরো গল্পগুলি অনেকটাই ছাড়া ছাড়া, অনেক অংশ অস্পষ্ট।
এই লেখাটিতে আমি হামিদুর রহমানের নোটবুক থেকে কয়েকটি অংশ তুলে ধরেছি। এক দুই নাম্বারিং করে দিচ্ছি আলাদা করার জন্য। মূল নোটবুকে এরকম কিছু ছিল না।
~~~~~~
এক -
আজ আমি একটা চমৎকার জিনিস বের করতে পারছি, এবং এই বের করার ফলে আমার ভেতরে অস্বস্থি হচ্ছে। ডাউনটাউনের যে পুরনো বইয়ের দোকানে আমি নিয়মিত যাই, (যেটার কথা আগে লিখেছি, না লিখে থাকলে পরে লিখব) সেখানে মেয়েটাকে দেখলাম তার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজছে। ওই মেয়েটা, যার কথা আগে লিখেছি কি? আরিয়ানা, যে তার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজছিল ঐদিন। তার বয়ফ্রেন্ডের নাম হাওয়ার্ড। বা এরিক। ঠিক মনে নেই। যাইহোক, এই মেয়ে দেখলাম উদ্বিগ্নভাবে তার হাঁটাচলা করছে, ও মানুষদের জিজ্ঞেস করছে লম্বা মতোন একটা ছেলেকে তারা দেখেছে কি না। ছেলেটার চুল লাল, কানে রিং, পরনে ছিল গোল গলার টি শার্ট।
সবাই উত্তরে না বলছে।
মেয়েটা বিড় বিড় করছে, এই এখানেই তো ছিল। এতো তাড়াতাড়ি কোথায় গেল।
আমি একটা বেঞ্চির মত জায়গায় বসে ছিলাম। মেয়েটার উদ্বিগ্নতা দেখে আমার মজা লাগল। এই মেয়ে এভাবে কি প্রায়ই তার বয়ফ্রেন্ডকে হারিয়ে ফেলে। বা তার বয়ফ্রেন্ড কি এভাবে তাকে প্রায়ই ফেলে রেখে হাওয়া হয়ে যায়?
মেয়েটা আমার সাথেও কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি এদিকে কাউকে যেতে দেখেছেন, লাল চুলের ছেলে?
আমি বললাম, না দেখি নি।
মেয়েটি দ্রুত পায়ে অন্যদিকে চলে গেলো। দেখলাম কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।
বইয়ের দোকানের বুড়ো জোসেফ আমাকে দেখছিল। ইদানীং ওখানে প্রায়ই যাওয়ায় তার সাথে খাতির জন্মেছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড দেখি অদ্ভুত। তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। আরেকদিনও দেখেছি মেয়েটা একা একা তাকে খুঁজছে।
জোসেফ বলল, সে আজ পাঁচ বছর ধরে এভাবেই খুঁজে চলেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, মানে কী?
জোসেফ বলল, মানে এই মেয়েটা আমাদের এলাকাতেই থাকে। খুবই ভালো মেয়ে। কিন্তু জানি না কেন তার মাঝে মাঝে মনে হয় তার এক বয়ফ্রেন্ড আছে, যে তাকে বসতে বলে নাই হয়ে গেছে। এরপরই সে এরকম করে।
আমি বললাম, এটা নিয়মিত হয়?
জোসেফ বলল, হ্যা মাঝে মাঝেই।
সবখানে হয় নাকি?
জোসেফ বলল, না, শুনেছি আমাদের বইয়ের দোকানে আসলেই এরকম করে।
তাহলে এখানে কি আসলেই তার কোন প্রেম হয়েছিল?
জোসেফ বলল, না। পুরনো এমপ্লয়ীরা জানিয়েছে আগে এই মেয়ে আসতো না। পাঁচ বছর আগে একদিন সে আসে। ঐদিনও তার বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজেছিল।
কী অদ্ভুত এক ব্যাপার।
আমার ইচ্ছা হয়েছিল মেয়েটির সাথে এ ব্যাপারে আরো কথা বলি। কিন্তু বইয়ের দোকানে তাকে আর পেলাম না। আরেকদিন পেলে কথা বলব। জানতে হবে এর পেছনে কী আছে। প্রতিটা পাগলামির পেছনে কারণ থাকে।
তবে আপাতত আমার একটা থিওরি আছে। আমার মনে হয় এই মেয়েটি যখন পুরনো বইয়ের দোকানে আসে, স্তুপ স্তুপ বইয়ের ভেতরে থাকা কোন এক চরিত্র তার ভেতরে ঢুকে যায়। আমার এটি মনে হয়েছে। কেন মনে হয়েছে এর কোন ব্যাখ্যা নেই। তাও লিখে রাখলাম।
~~~~~~
দুই-
আজ একজন রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করলাম। চালাক প্রকৃতির লোক। তার সাথে আলাপ করতে করতে আমি ঘরবাড়ি নিয়ে ভাবছিলাম। অর্থহীনতার বোধ সম্ভবত আমাকে আক্রান্ত করে তখন। আমার মনে হচ্ছিল, বাক্সের মতো আমাদের ঘরবাড়ি। আমাদের ঘরবাড়িতে দরজা, ছাদ ইত্যাদি থাকে। বিশালতা থেকে এভাবেই আমরা নিজেদের আলাদা করে রাখি। আর এই বাক্স কীভাবে বানানো হবে, কীভাবে করলে সুন্দর হবে, ইত্যাদি নিয়ে ভেবে সময় ব্যয় করি। টাকা ব্যয় করি এর পেছনে। এগুলি সম্ভবত আমাদের ভুলে থাকার চেষ্টা যে, আমরা এই ঘর আসলে বানাচ্ছি বিশালতা থেকে নিজেদের আলাদা করতে। ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ করতে। কারণ বিশালতা আমাদের কাছে অসহনীয়।
~~~~~~
তিন-
আমাকে যখন একজন প্রস্টিটিউট বললো সেক্স ইজ অভাররেটেড, তখন বুঝলাম আসলেই তাই। শাউয়া, এই সহজ জিনিস আগে কেন বুঝতে পারলাম না!
~~~~~~
চার-
কীয়ের্কেগার্ড বললেন, জীবন যাপন করতে হবে অবশ্যই সামনে দিয়ে, আর বুঝা সম্ভব একমাত্র পেছন দিয়ে।
ইংরাজিতে, Life can only be understood backwards; but it must be lived forwards.
এটার আসল অর্থ হলো খুবই স্যাড। লাইফ একইসাথে বুঝা ও লিভ করা সম্ভব না।
আমার ধারণা কীয়ের্কেগার্ড এটাই বুঝিয়েছেন।
আমার ডার্টি মাইন্ড অবশ্য অন্য একটা কিছুর সাথে এই জিনিসরে রিলেট করতে চাচ্ছে। সেটা আর লেখলাম না।
~~~~~~
পাঁচ
মজার ঘটনাটা আজ ঘটলো। রফিকুন্নবী সাহেব প্রায় জেলে যেতে বসেছিলেন।
আমার দেখা একমাত্র দার্শনিক রফিকুন্নবী।
তিনি তার ছেলেমেয়েদের শার্টকে প্যান্ট ও প্যান্টকে শার্ট নামে চিনিয়েছেন। চেয়ারকে টেবিল এবং টেবিলকে চেয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শিখিয়েছেন।
অবশ্য এসবের কারনে তার সমস্যা হয় নি। এগুলি কেউ জানতো না।
সমস্যা হয়েছে তার ছোট ছেলেকে এলিয়েন বানানোতে। তিনি শুরু থেকেই এমনভাবে বুঝিয়েছেন যে ছেলেটিও বিশ্বাস করে সে এলিয়েন। তার ভাই বোনেরাও।
শেষ পর্যন্ত, গতকাল স্কুলের অদ্ভুত ঘটনাটা। ওয়ারেন সিটিতে এমন আর কখনো হয় নি।
তবে রফিকুন্নবীকে জেলে দেয়া হয় নি।
অবার্ন হিলসের একটা মানসিক হাসপাতালে প্রাথমিক ভাবে রাখা হয়েছে।
কাউকে দেখা করতে দিচ্ছে না। নাহলে আমি গিয়ে কথা বলে আসতাম। রফিকুন্নবী সাহেবের প্রতিটা কাজের পেছনে শক্ত লজিক থাকে। আমার ধারণা এসব লজিক বুঝার মত কেউ থাকলে তাকে অতিস্বত্তর ছেড়ে দিবে। হি ইজ এ জিনিয়াস।
~~~~~~
ছয়-
কিছু মদ খেয়েছিলাম আজ, এম্প্যাথি ওয়াইন, আর কয়েকটা বিয়ার, কিন্তু বুঝলাম না কেন মাতাল হচ্ছি না আজ, কোনো একটা কারণ আছে নিশ্চয়ই। মাতাল যে হই নাই তা কীভাবে নিশ্চিত হলাম? সুলায়মান মৃধা সাহেবের সাথে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো। কখনো কোন জড়তা অনুভব করি নি, বা ঘুম ঘুম কাজ করে নি। মৃধা সাহেব মুরুব্বী মানুষ। আমাদের গ্রামের লোক। বাপ চাচার বয়েসী। তার ছেলেরা এখানে থাকে, আশেপাশেই। ট্রয় বা ওয়ারেন। তিনি সঠিক মনে করতে পারছেন না। মাত্র তিনদিন হলো এসেছেন, সাত সমুদ্দুর তেরো নদী (আসলেই এটা সাত সাগর তেরো নদী নাকি আমি জানি না) পার হয়ে। ডিট্রয়েট রিভার দেখতে এসে নাকি পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর ডাউনটাউনে হেঁটে হেঁটে কীভাবে যেন এসেছেন আমার দরজার সামনে। আর আজই আমি এতো মদপান করলাম। মাতাল হয়ে গেলে হয়ত তাকে চিনতামই না। বা দরজাই খুলতাম। পড়ে থাকতাম বিছানায় বা মেঝেতে।
সুলায়মান মৃধা চাচা একটা ধবধবে শাদা পাঞ্জাবী পরে এসেছেন। আমার কিচেনে বসে আছেন।
আচ্ছা, এটা লেখতে লেখতে আমার মনে পড়লো, গতবছর উনার ছেলে বা ভাতিজা কেউ একজন আমাকে জানিয়েছিলো এক সন্ধ্যায়, এমনই তো মনে পড়ছে…যে উনি মারা গেছেন…
~~~~~~
সাত-
অন্ধকার আমার ভালো লাগে। গভীর কালো অন্ধকার। যে অন্ধকারে মানুষ বেঁচে আছে কি না বুঝা যায় না।
~~~~~~
আট-
গতবছর যে মেয়েটার সাথে আমার প্রেম হয়েছিল সে আমাকে বলেছিল, (আবেগের বশবর্তী হয়েই সম্ভবত) মৃত্যুর পরে স্বর্গে গেলে সে আমাকে পাবে।
এই জিনিসটা নিয়ে পরে আমি অনেক ভাবলাম। সেই ভাবনাটা এখানে লিখে রাখার প্রয়োজনবোধ করছি।
আমি ভেবে দেখেছি যে, আরো কিছু মেয়ের সাথে আমার প্রেম হয়েছে। তারাও নানা সময়ে এরকম কথা আমাকে বলেছে। এখন যদি ধরে নেয়া যায় এদের মিনিমাম দুইজন মেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে মারা যায় ও স্বর্গে যায়, তাহলে কী হবে! আমাকে কী তখন দুই টুকরা করে বিধাতা তাদের দিবেন, বা বন্টনটা কীভাবে হবে, আমার চিন্তাটা এই নিয়ে।
আমাকে উদাহরণ হিসেবে না নিলে অন্য কাউকেও নেয়া যায়। ধরা যাক একজন ব্যক্তিকে তিনজন ভালো ব্যক্তি স্বর্গে চাইল, এবং তারা মারা গিয়ে স্বর্গেই গেল। তখন এই এক ব্যক্তিকে তিনজনের কাছে কীভাবে দেয়া হবে? দ্রৌপদিকে পাঁচ স্বামীর মাঝে যেভাবে দেয়া হয়েছিল, এইভাবে নিশ্চয়ই হবে না।
আমার ধারণা, তাদের প্রত্যেককেই একটা কপি দেয়া হবে।
অর্থাৎ, আমাকে তিনটা মেয়ে চাইলে, স্বর্গে তারা পাবে তিনজনই আমাকে, তিনটা কপি।
আর এদিকে আমি অন্য কাউকে স্বর্গে চাইলে ও স্বর্গে গেলে (যার কোন সম্ভাবনা নাই) আমি যাকে চাইছি তার এক কপি পাবো।
আবার আমি যাকে চেয়েছি ও স্বর্গে কপি হিসেবে পেয়েছি, সে স্বর্গে গেলে ও আরেকজনকে চাইলে সেই আরেকজনের কপি পাবে।
এইভাবে জিনিসটা চলবে।
ফলে, একসময় আমার ধারণা, স্বর্গবাসীরা বুঝতে পারবে বা অনুমান করতে পারবে তার সঙ্গীটি আসলে ঐ ব্যক্তি না যাকে সে চেয়েছিল। এ এক ভিন্ন লোক।
তখন স্বর্গবাসীরা একটা অর্থহীনতার বিমর্ষে আক্রান্ত হবে।
এই কারণে আমি আসলে কখনোই স্বর্গে যেতে চাইব না। নেভার।
~~~~~~
নয়-
জীবনে এতো রহস্য কেন এটা নিয়ে আমি ভেবেছি। আমার এই লেখাগুলি হয়ত সেইসব রহস্য কিনারা করার এক চেষ্টা। আমি একসময় খুবই যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতাম। সেইসময়ে, বা তার কিছু পরে রফিকুন্নবীর সাথে আমার দেখা। এরপর থেকে রহস্য নিয়ে আমার ভাবনা চিন্তার অনেক বদল হয়েছে।
রফিকুন্নবী বলেন, কী মিয়া এইসব কী কও! মিস্ট্রি থাকব না? তাইলে থাকলো কী! মিস্ট্রি ইজ দি ইন্ট্রিগ্রাল পার্ট, ইন্ট্রিগ্রাল বুঝো তো, মানেই হইল ধরো মূল একটা জিনিস, অব লাইফ। তাই মিস্ট্রি কখনো সলভ হয় না।
আমি বললাম, সলভ হয় তো। অনেক হয়। শার্লক হোমসীয় কার্যকলাপ হয় তো।
রফিকুন্নবী তখন বিরক্তির সাথে আমার কথা উড়িয়ে দেন। বলেন, ধুর মিয়া! মিস্ট্রি কখনো সলভ হয় না, একটা গেলে ঐ জায়গায় আরেকটা আসে। সলভ দিয়া মিস্ট্রি বিষয়ে ভাবা হইল একটা ফান্ডামেন্টাল মিসটেক। ভাববা রিপ্লেসমেন্ট দিয়া। মানে ঐ রহস্য সইরা কোনটা আসলো।
রফিকুন্নবী এভাবে কথা বলেন। দার্শনিক হিসেবে তিনি উৎকৃষ্ট। কিন্তু তার সব কথা আমি বুঝি না।
~~~~~~
দশ-
শ্যামাকান্ত মজুমদারের একমাত্র ছেলে একদিন সূর্যগ্রহণের দিনে ঘুম থেকে উঠে বলল সে ঈশ্বরের পুত্র।
শ্যামাকান্ত তাকে ঘর থেকে বের করে দিলেন।
১৭ দিন নিরুদ্দেশ থাকার পর ছেলেটি ফিরে আসে।
ঘরের সদর দরজায় ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রেখে শ্যামাকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবার নাম কী?
ছেলে বলল, শ্যামাকান্ত মজুমদার।
শ্যামাকান্ত মজুমদার এরপর ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেন।
~~~~~~
এগারো-
কীয়ের্কেগার্ডের দর্শনের সারমর্ম আমি এভাবে করতে পারিঃ
রেজিনাকে বিয়ে করলে পস্তাতে হবে, না করলেও পস্তাতে হবে।
বিয়ে করলে পস্তাতে হবে, না করলেও পস্তাতে হবে।
পস্তাতে হবে।
~~~~~~
বারো-
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের খেলার জায়গার পাশে বড় এবং বহুদিনের পুরনো একটা আমগাছ ছিল। আমাদের খেলার অনেক টেনিস বল গাছটি খেয়ে ফেলতো।
আমি এতে কখনো কিছু মনে করতাম না। কারণ আমি বুঝতাম যে, সে একটি গাছ। তার জন্য এটাই স্বাভাবিক। তার আর করার কিছু নেই। সে তার ঝাঁকড়া বাস্তবতাকে আসলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে বল এতে হারিয়ে যায়। বা এর মধ্য দিয়ে চলে যায় অন্য কোন পৃথিবীতে। অন্য কোন গ্রহে। হয়ত।
কিন্তু প্রতিদিন বল হারানোর জন্য আমার মা আমাকে মারতেন।
তিনি কি বুঝতে পারতেন না ছোট বাচ্চাদের খেলার সময়ে বল হারানোটা স্বাভাবিক? কোনও দিন কি তিনি বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন?
আমার আসলে জানা নেই।
আমার দাদা মানে পিতামহ যখন মারা গেলেন, এরপর গাছটিকে বিক্রি করে দেন আমার পিতা মাতা। বহুদর্শী, বহুপ্রাচীন বয়স্ক এক ঝাঁকড়া আমগাছ।
আমার খুব খারাপ লেগেছিল সেদিন।
কিন্তু এখন আমি অনুভব করি, এই এতোদূরে যখন বাস করি, তখনো সেই বয়স্ক, পুরনো গাছটি আমার সাথে সাথে আছে। আমি তার পাতার শব্দ, আমি তাকে স্পর্শ করে যাওয়া বিহ্বল বাতাসের শব্দ, আমি তার মাঝে বসবাস করা অজস্র জীবনের ফিসফিসানি সবই যেন শুনতে পাই।
~~~~~~
তেরো-
প্রেমের বাত্তি জ্বালাইয়া
দেখো তারে নিরখিয়া
হৃদমন্দিরে বিরাজ করে
হাছনরাজা ধরে নাম।
বাত্তি জ্বালাইয়া দেখো শ্যাম ॥
দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী (১৮৫৪-১৯২২)
~~~~~~
চৌদ্ধ-
রফিকুন্নবীকে আমাকে বেশ কয়েকমাস আগে একবার বলেছিলেন, আমি রফিকুন্নবী, কখনো মদ খাই না।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী বললেন! এই কয়দিন আগেও তো আমার সাথে বারে গেলেন!
রফিকুন্নবী আরো অবাক হয়ে বলেন, ঐটা আজকের আমি নাকী!
এই ধরণের চিন্তাকে দর্শনে সম্ভবত আত্মপরিচয়ের সংকট বলে। থিসিয়াসের শিপ টিপ। এ বিষয়ে কিছু জিনিস ভাবার আছে।
~~~~~~
পনের-
মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে গিয়ে আমি জীবন দেখেছি।
দর্শন হলো দর্শনের ভুল বুঝাবুঝি।
~~~~~~
ষোল-
আজ সকালে হাফিজ মজুমদারের খবরটা টিভিতে দেখলাম।
তাই গত সপ্তাহে তার সাথে দেখা হবার ঘটনাটি লিখে রাখি।
সেদিন বিকেলে বার্লিংটন মলের সামনে হাফিজ মজুমদারের সাথে দেখা। উনি কয়েক বছর আমার সাথে কাজ করেছিলেন। সেই সুবাধে তার সাথে আমার পরিচয়। আমার দেখা ইন্টারেস্টিং মানুষের ছোট তালিকায় ইনি আছেন।
আমাকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসলেন তার বললেন, পুকার জালায় বাঁচি না মিয়া। পুকের ওশুদ কিনতে আইছি। বেবি রচ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বেবি রচ কী?
আশেন বইসা কথা বলি।
হাফিজ মজুমদার আমাকে নিয়ে গেলেন একটা কফিশপে। সেখানে কফি খেতে খেতে তার সাথে আমার কথা হয়।
কফি খেতে খেতেই বললেন তিনি, বেবি রচ হইল একধরনের ককরচ। মানে তেলাপুকা। তবে সাইজে ছোট। পিচ্চি সাইজের। মারাত্মক যন্ত্রণা হইছে আমার এদের নিয়া। যেইদিকে যাই ঐদিকেই বেবি রচ আর বেবি রচ। লাট আব বেবি রচেস ইন মাই লাইফ, অল অভার।
শেষ কথাটা বললেন একটু দার্শনিক টোনে, হতাশার সুরে।
তিনি আরো বললেন, একটা কবিতা আছে না? চুল তার কবেকার অন্ধকার…মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন?
আছে তো। সেটার সাথে বেবি রচের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক হইল, এই জিনিস যখন আমি ভাবতে বসি, ধরেন অন্ধকার কালো চুলযুক্ত এক মাইয়ার সামনে কবি বা আমি বইসা আছি, তখন আমার খালি মনে হয় ঐ চুলে কিলবিল করতেছে বেবি রচেস। এই হইল গিয়া আমার অবস্থা। মেন্টাল প্রেশার, বা কোন জায়গায় ওরা গেছে টের পাইতেছেন আপনে?
হুম।
অবশ্য আমি অলওয়েজই এইরকম বেশি ভাবতাম। আপনারে আগে বলছি তো এইগুলা। ঐ যে ছোটবেলায় গোয়েন্দা গল্প পড়তে বইছিলাম। ছোট বেলা না অবশ্য কলেজের পরেই মে বি। ঐ সময়, ঐ যে ব্যোমকেশ বক্সী। যখন ব্যোমকেশের বিয়া হইল, আমি আর পড়তে পারলাম না। খালিই মনে হয়ত এই অজিত তো আসলে মিছা কথা বলতেছে। আসলে সে সত্যবতী মানে ব্যোমকেশের বউয়ের প্রতি উইক। এই কারণেই পইড়া আছে। বা ফেলুদার গল্পে তোপসে কেন ফেলুদার জীবনে কোন নারী দেখাইল না। স্বাভাবিক জিনিস কখন অমিট করা হয়? যখন এতে কোন প্রবলেম থাকে? কি সেই প্রবলেম ছিল? হালার এইগুলাই আমার মাথায় আসতো। আর আমি আরো রহস্যের ভিতর পইড়া যাইতাম। বাল এই কারনে আর এগুলি পড়া হয় নাই। পড়া হয় নাই অবশ্য ভালো হইছে। সময় বাঁচছে। টাইম ইজ, ইউ নো, প্রেশাস!
কথাবার্তা বলে ঠিক উঠার আগে আগে হাফিজ মজুমদার আমাকে বললেন, আপনার বাসায় বেবি রচেস হইলে দুইটা কথা মনে রাখবেন। এক, এরা খানাখাদ্য ছাড়া অনেকদিন বাঁচতে পারে বাট পানি ছাড়া পারে না। তাই আপনার প্রথম কাজ হইব পানি আটকাইয়া দেয়া। বাই এনি মিনস।
বলে থামলেন।
তারপর বললেন, আর দ্বিতীয় কথাটা হইল, কিছু মহিলা বেবি রচ আছে একবার পাল খাইয়া মানে, ঐ সেক্স কইরা আর কি, যে স্পার্ম নেয়, সেইটা দিয়া আজীবন বাচ্চা পয়দা কইরা যায়। ভেরি স্ট্রেঞ্জ কেইস। তবে এর সম্পর্কে আমি পুরা শিওর না। আর এই কথাটা আপনে কেন মনে রাখবেন সেইটাও আমি ঠিক বলতে পারব না। বাট মনে হইল এইটা আপনার মনে রাখা দরকারী।
টিভিতে হাফিজ মজুমদার তার স্ত্রীকে খুন করে পুলিশের হাতে ধৃত হয়েছেন খবরটা দেখার পর আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বেবি রচ নিয়া তার এই আলাপের মধ্যেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে।
আমি এই রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করব। বা করতে পারি।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার সামনে একটা বেবি রচ দেখতে পাচ্ছি। খালি বিয়ারের ক্যানের উপর বসে বিয়ার খুঁজে বেড়াচ্ছে। এদের আবার এলকোহলে আসক্তি আছে।
~~~~~~
সতের-
একজন লেখক যা লেখেন তা দিয়েই কেবল তিনি না, বরং তিনি যে অনেক কিছু লেখেন না, সেগুলাও তিনি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লেখক বা একজন থিংকারের ক্ষেত্রে।
কারণ আমরা যখন কোন লেখা দেখি, তখন কনসিসটেন্ট আর্গুমেন্ট দেখি। বা দেখি যে লেখক কেমন সুন্দরভাবে গল্পটাকে বা যেকোন জিনিস নিয়ে লিখে গেছেন।
আমরা এর মাধ্যমেই উক্ত লেখককে বিচার করতে থাকি।
কিন্তু আসলে ঐ লেখক ব্যক্তিটির লেখাটিকে ফাইনাল ওয়ার্ক ধরে নিলে, এই লেখার আগে ও এর প্রসেস প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি লেখক কীভাবে চিন্তা করেছেন তা অগুরুত্বপূর্ণ নয়।
যেকোন সৃষ্টির মূলে রয়েছে ক্যাওস। এই লেখক ব্যক্তিটিও এক দূরন্ত ক্যাওসের, একটা টারময়েলের ভিতর দিয়ে যান। সেই ক্যাওস হলো পরস্পর বিরোধী চিন্তার, নানা খণ্ড খণ্ড চিন্তার, নিজেকে সন্দেহ করার, ডিল্যুশনের, এমনকী আত্ম প্রবঞ্চনারও। এটি হলো আন এডিটেড ভার্সন।
ফাইনাল ওয়ার্ক লেখাটিকে আমরা যেভাবে গ্রহণ করতে পারি, আন-এডিটেড ভার্সনের লেখক বা থিংকারকে ঐভাবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ফলত, একজন লেখক বা চিন্তক একটা মিজারেবল লাইফ লিড করতে থাকেন বলে আমার মনে হয়। তার সর্বদা এই বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়, যেন কেউ তার আন-এডিটেড তথা অসম্পাদিত ব্যক্তিস্বত্তা দেখে না ফেলে। কারণ এটি সে নিতে পারবে না, তখন আরো একটি বা একাধিক জাগতিক সমস্যায় পড়ে যেতে হবে লেখককে।
এই সমস্যার কারণে অধিকাংশ ভালো লেখকের সম্পর্কগুলি তেমন ভালো হয় না। এবং, এই কারণেই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোনলি থাকেন বলে আমার মনে হয়।
~~~~~~
আটারো-
চমকপ্রদ ঘটনাটি হলো ডিট্রয়েট রিভারের পাশে গতকল্য একজন লোক মারা গেছেন। তার নাম ক্রেইগ জিলরয়। বয়স বাষট্টি।
তিনি সকাল বেলায় নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছিলেন। আর তখনই লাশটাকে দেখতে পান। স্রোতের টানে পাড়ের দিকে এসে ভীড়েছে। পলিথিনে মোড়ানো। ঠিক যেমন লরা পালমারের মৃতদেহ এসে ভীড়েছিল, এবং দেখতে পেয়েছিল পিট মার্টেল।
মিস্টার জিলরয় এগিয়ে যান, এবং লাশটির মুখ দেখতে বাঁধন খুলে পলিথিন সরান। একটা মেয়ের মুখ ছিল। মেয়েটি হেসে উঠল। নদীর অশান্ত তরঙ্গের মতো সে হাসির শব্দ।
মিস্টার জিলরয় সহ্য করতে পারলেন না। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
এজন্যই আমি বলি সকল সময় অস্বাভাবিক জিনিসের জন্য তৈরি থাকা ভালো। তাতে কখনো অত্যধিক অবাক হতে হয় না। ফলে এহেন দুরাবস্থা আসে না।
এই যেমন আমি প্রায়ই অনেককে দেখতে পাই, যারা মারা গিয়েছেন। মদ্যপান বেশি করলে সাধারণত দেখি। এ নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা আর নাই।
একসময় খুব ভাবতাম। আমার মনে হতো আমি কি তাহলে মারা গেছি? তা না হলে মৃতরা কেন আসবে আমার কাছে?
রফিকুন্নবীকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি মিটি মিটি হেসে উত্তর করেছিলেন, যেদিন মদ ও মাগির পার্থক্য করতে পারবেন না সেইদিনই বুঝবেন আপনে মইরা গেছেন।
~~~~~~
উনিশ
গত কয়েকদিন আগে বার্মিংহামে মাথায় পট্টিবাঁধা একটি লোকের সাথে আমার স্বাক্ষাত হয়। তাকে দেখে আমার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। কারণ তার চেহারা ও বেশভূষা গুয়াম এপলোনিয়ারের মতো।
এবং বিস্ময়কয় ভাবে সে গাইছিল এপলোনিয়ারের কবিতাই,
The angels the angels in the sky
One’s dressed as an officer
One’s dressed as a chef today
And the others sing
ফলে, আমি এগিয়ে যাই ও তার সাথে কথা বলি। সে আমাকে জানায় তার নাম মার্ক। যখন তার বয়স নয় বছর তখন সে স্বপ্নে দেখেছিল কালো একটি মেয়ে তাকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। আচাড় দিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলছে। মেয়েটির গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। জিভ দিয়ে বের হচ্ছে আগুন। কোমড় পর্যন্ত লম্বা চুল।
অনেকদিন সে বুঝতে পারে নি এটা আসলে কী ছিল।
একদিন বুঝতে পারে সে কালী’কে দেখেছিল।
আমাকে সে জিজ্ঞেস করল আমি হিন্দু কি না।
আমি না বললাম। আমি হিন্দু নই।
এবং আমি থাকে বললাম কালী হচ্ছেন কাল, এবং কালই সকল কিছু, যেহেতু আমরা কালেই বহমান।
মার্ক বলল, বিগ ব্যাং, সময়ের শুরু। এবং আরো আরো অনেক বিগ ব্যাং, যেগুলি নিয়েই মহাকাল, মহামায়া। মাঝে মাঝে কালের স্রোত উলটা পালটা হয়ে যায়।
আমি বললাম, হতে পারে।
মার্ক আমাকে বলল, অনেকেই আমার সাথে গুয়াম এপলোনিয়ারের মিল খুঁজে পায়, এবং আমি আসলে এরকম ছিলাম না ছোটকাল থেকে।
সে তার বিভিন্ন বয়েসের ছবি আমাকে দেখাল।
আমি দেখলাম আসলেই সে এরকম ছিল না।
মার্ক বলল, আমি হঠাত করেই ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে। শেষবার জেল থেকে ছাড়া পাবার পর থেকেই। ছয় বছর আগের কথা। তখন আমি এপলোনিয়ারকে চিনতামও না। আমি এখন ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে মোনালিসাকে চুরির অভিযোগে। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমি বলছি আমার বন্ধু পিকাসোও এর সাথে জড়িত।
মার্কের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ হলো না। সে চলে গেল।
এই ঘটনা এখানে লিখছি কারণ কাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মোনালিসাকে চুরির অভিযোগে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এই স্বপ্নটিকে আমি নিছক স্বপ্নই মনে করতাম। কিন্তু আরেকটু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেছে।
আমার সংগ্রহের বইগুলির মধ্য থেকে একটা বই খুঁজতে গিয়ে আমি দি এক্সপ্লয়েটস অব এ ইয়াং ডন জুয়ান নামক এরোটিক উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পেয়েছি। যেটি গুয়াম এপলোনিয়ার তার বন্ধুকে পিকাসোকে দিয়েছিলেন।
~~~~~~
বিশ-
গত আটারো দিন ধরে গোছল করতে পারছি না। বাথরুমের বাথটাবে এই অস্বস্থি নিয়ে গোছলের কথা ভাবা যায় না।
এর শুরু অনেক আগে। ডিট্রয়েটে একটা বারে ভয়ানক এক সংঘর্ষের খবর আপনারা রেকর্ড ঘাঁটলে পাবেন। অর্গানাইজড ক্রাইম তথা মাফিয়াদের মধ্যেকার সংঘর্ষ। কয়েকজন আন্ডারকভার এফবিআই এজেন্টও ছিল সেখানে।
ওই দিন আমি বারের সামনের জায়গাটিতে অল্প সময়ের জন্য গাড়ি পার্ক করে দাড়িয়েছিলাম। তখনই হুলস্থুল শুরু হয়। গুলির শব্দ, কাচ ভাঙার শব্দ। আমার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। আমি স্টিয়ারিং ধরে স্থির বসে থাকি।
একটা সুন্দর চেহারার মেয়ে, রোজমেরি যার নাম আমি পরে জেনেছি, সে মরো মরো হয়ে আমার গাড়িতে এসেছিল।
আমি দরজা খুলে দিলে সে একটি বড় প্যাকেট ভেতরে ছুড়ে দেয়।
তারপর কয়েকটি বুলেট আসে। আমার গাড়ির গা ঝাঁঝরা করতে থাকে। সাথে সাথে মেয়েটিকেও।
আমি প্রাণ বাঁচাতে গাড়ি নিয়ে কোনরকমে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।
ওই প্যাকেটে যে জিনিসটা পেয়েছিলাম, অমূল্য। ডেনিশ গোল্ডেন এইজের একজন শিল্পী র্যামব্র্যান্টের আঁকা ওয়েল অন ক্যানভাস দ্য স্টর্ম অন দ্য সি অব গ্যালিলি।
আমি এটি চুরি যাবার খবর পড়েছিলাম।
ছবিটিতে দেখানো হয়েছে গ্যালিলি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ নবী যিশু তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে বন্ধ করে দিচ্ছেন।
ছবিটি আমি কিচেনে রেখেছি। একটি শাদা চাদর দিয়ে ঢেকে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে চা খেতে খেতে আমি এর দিকে তাকিয়ে থাকি।
আমার মনে হয় যে, এই ছবিটি আসলে বিবিলিকাল ঐ ঘটনার না। বরং, এটি আমাদের বর্তমান সময়ের। অথবা সকল সময়ের। যখন আমরা একটি উত্তাল অনিশ্চয়তাময় জগতে বাস করছি। ঝড় এবং ঝড় আমাদের বিধ্বস্থ করে দিচ্ছে। যুদ্ধ, দূর্যোগ, মহামারী। এইসব সামষ্টিক স্ট্রাগলের সাথে ব্যক্তির নিজস্ব স্ট্রাগল। তার জীবনযুদ্ধ, মান অভিমান অপমান ও ট্রমা। সকল কিছু মিলিয়ে তার বেঁচে থাকা। যেন এরই চিত্র ছবিটা।
এই ছবি নিয়ে রোজমেরির সাথে আমার কথা হয়। লালচুলের মেয়ে।
সেই আমাকে এই কথা প্রথম বলেছিল, একজন সত্যিকার গড কখনো স্যাক্রিফাইস চান না। কারণ বান্দা প্রিয় বস্তু স্যাক্রিফাইস করে ফেললে, এই বস্তুর প্রতি তার মায়া কমবে না। বরং বাড়বে। বান্দা তখন নিজেকে অপরাধী ভাবতে থাকবে। এবং এক পর্যায়ে সে ভাববে সে অনিচ্ছায় কাজটি করেছে। সে চায় নি করতে বরং গডই তাকে দিয়ে এটি করিয়েছেন। এভাবে ধীরে ধীরে প্রিয় বস্তুর প্রতি মায়া ও গডের প্রতি তার ভক্তি এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকবে, আর সময়ের সাথে সাথে মায়া শক্তিশালী হবে। এমন একটা সময় আসবে যখন বান্দা গডকেই অস্বীকার করবে। এইভাবে গড তার বান্দাকে হারাবেন। তাই বিবিলিকাল ইব্রাহিম যখন প্রিয় পুত্ররে কোরবানি দিতে যান তখন গড এটা বন্ধ করান। কারণ তিনি জানতেন এটাই একমাত্র উপায় ভক্তের ভক্তি অক্ষুন্ন রাখতে।
ইভেন, নুরুন্নবী পর্যন্ত এই চিন্তা শুনে অবাক হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন আমাকে, এটা খুবই ভালো চিন্তা। কিন্তু যেই রিসোর্স থেকে আপনে পাইছেন বলতেছেন, ওইটা আমি নিলাম না।
নুরুন্নবী বিশ্বাস করতে চান নি রোজমেরির কাছ থেকে আমি এটি পেয়েছি। তিনি বিশ্বাস করেন না আমার বাথরুমের বাথটাবে নগ্ন হয়ে রোজমেরি বসে থাকে। শীতের সময়েও।
আগে কম কম হতো। মাসে কয়েকদিন। এবার প্রায় আটারো দিন হয়ে গেল, সে যাচ্ছে না।
বাথটাবে পর্দা আছে অবশ্য, সমস্যা নেই। তাও বাথরুম করতে আমার কেমন জানি লাগে। মাত্র কিছুদূরে একটা নগ্ন নারীকে রেখে (হোক পর্দার আড়ালে) হাগা মুতা শোভন কিছু না। তাও কেবল হাগলে বা মুতলে কথা ছিল না, এগুলা আবার মুছতে হয়, এটাই বেশি লজ্জার।
~~~~~~
একুশ-
নুরুন্নবী আমাকে অনেক দিন আগে একটা পুরনো বই দিয়েছিলেন। স্যার ফ্রান্সিস বার্টনের দ্য উইট এন্ড উইজডম অব ওয়েস্ট আফ্রিকা।
স্যার বার্টনই একমাত্র ব্যক্তি যার নাম নিতে হলে আমি স্যার বলি। এইরকম লোক এমন যে, পরমেশ্বর এদের সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠান এবং এদের কাজকর্ম দেখে অবাক বিস্ময়ে স্বগোক্তি করেন, এই হালায় করতেছেটা কী এইসব!
বিস্ময়কর স্যার বার্টনকে একবার একজন যাজককে বলেছিলেন, ফাদার, আমি গর্বের সাথে বলতেছি যে, ডেকালগের সমস্ত পাপই আমার করা হয়েছে।
উইট এন্ড উইজডম অব ওয়েস্ট আফ্রিকা বইটি চমৎকার। কিন্তু এটি যেদিন পড়ি সেদিনই একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটে।
আমি রাতে স্বপ্নে দেখি স্যার বার্টন মুসলিমের ছদ্মবেশে আরব দেশে আছেন। তিনি তাবুর বাইরে বের হয়েছেন প্রস্রাব করতে। প্রস্রাবের বেগ ছিল বেশি, বার্টন ছিলেন কিছুটা আনমনা। ভারতে থাকতে যে পোষা বানরের দল তিনি কাছে রাখতেন বানরদের ভাষা শেখার জন্য, তাদের কিছু কথা তার মনে পড়ছিল।
তিনি দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে লাগলেন। এটি দেখে ফেললো এক আরব কিশোর বালক।
সম্বিৎ ফিরে ফেলেন স্যার বার্টন। তিনি বুঝতে পারলেন মহাভুল হয়ে গেছে। মুসলিমরা কখনো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে না। তিনি ভারতে থাকতে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছদ্মবেশে মক্কা মদীনায় আসবেন, তখন নিবিড়ভাবে মুসলিমদের আচার আচরণ বেশভূষা পর্যবেক্ষণ করেছেন। খৎনা পর্যন্ত করিয়েছেন যাতে ধরা না পড়েন। কিন্তু এভাবে ধরা পড়ে যাবেন ভাবেন নি।
মানবিক হৃদয় বার্টনের। কিন্তু তার চাইতেও বেশি এডভেঞ্চার প্রিয়। এত কাছে এসে মক্কা না দেখে তিনি কি ফিরে যাবেন?
শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হলো। তিনি বাধ্য হলেন করতে। দৌড়ে গিয়ে ছেলেটাকে ধরলেন। শক্তিশালী বার্টন, আর্মিতে ছিলেন। ঐসময় সিংগেল কম্ব্যাটে তিনি একা যত শত্রুকে সামলাতে পারতেন সেনাবাহিনীর আর কেউ তা পারতো না। তার এই আসুরিক শক্তিমত্তার জন্য তারা ডাকত রাফিয়ান ডিক।
ছেলেটা কিশোর, ক্ষীণকায়।
বার্টন কাল বিলম্ব করলেন না। ছেলেটি আঞ্চলিক আরবি ভাষায় বলতে চাইছিল ছেড়ে দিন আমাকে। কিন্তু পুরো উচ্চারণ করতে পারলো না। ঘাড় মটকে দিলেন বার্টন, শক্ত হাতে।
মক্কা মদীনা দেখা হয়েছিল তার। হয়েছিল আরো অনেক এডভেঞ্চার।
কিন্তু এই ছেলেটি তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। ইসাবেলের সাথে সেক্সের সময়েও ভেসে উঠতো ওই কিশোরের মুখ। তার অস্ফুট আঞ্চলিক আরবী উচ্চারণ, ছেড়ে দিন।
স্বপ্নে আমি দেখি, বার্টনকে এক পর্যায়ে সাড়াশি হাতে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঐ কিশোর। আর শক্তিশালী বার্টন, দুনিয়ার বিস্ময় স্যার ফ্রান্সিস বার্টন হাঁসফাঁশ করতে করতে দৌড়ে যাচ্ছেন।
আমার দম বন্ধ লাগে। ঘুম ভেঙে যায়।
স্বপ্নে আমার মনে হয় আমিই সেই কিশোর, আবার আমিই বার্টন।
এইজন্য আমি বইটি আর পড়ি না।
~~~~~~
বাইশ-
অধ্যাপক নুরুন্নবী সাহেবের এক বন্ধু সাইকোলজির অধ্যাপক ছিলেন। ভদ্রলোক প্যারা সাইকোলজি নিয়ে কাজ করতেন। মানুষের জন্মের ভেতরে তার আগের জন্মের নানা স্মৃতি বাহিত হয়ে আসে, এই নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।
তার ধারণা ছিল, আত্মা বারে বারে আসে, নানা দেহে, নানা রূপে, কিন্তু ভেতরে তার কিছু কিছু জিনিস একইরকম থাকে।
ভদ্রলোক মারা যাবার সময় তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লকারে রেখে যান। আর বলেন যান, মরার পরে তার আত্মা কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ করে লক খোলার কোড বলে যাবে।
ভদ্রলোক মারা যাবার তিন মাস পরে নুরুন্নবী গিয়ে লকারটি খুলে ফেলেন। অন্যরা এতে আশ্চর্য হয়ে যান।
তার মানে কি সাইকোলজিস্ট বন্ধুর আত্মা সত্যি সত্যি তার সাথে যোগাযোগ করেছে? অর্থাৎ, এইভাবেই কি ভদ্রলোক প্রমাণ করে গেলেন তার তত্ত্ব কাজ করে?
নানা ভাবে প্রশ্ন করা হলেও নুরুন্নবী এর কোন উত্তর দেন নি। অবিশ্বাস্য ভাবে গুম মেরে বসে থাকতেন। যেন তিনি পণ করেছেন কোন কথা বলবেন না।
ইউনিভার্সিটি থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, প্যারাসাইকোলজির রিসার্চ সংস্থা থেকে লোক এসেছে, এছাড়া এসেছেন কলিগ ও জুনিয়র অনেক অধ্যাপকেরা। নুরুন্নবী তাদের সাথে কথা বলেছেন, কিন্তু উক্ত প্রসঙ্গ এলেই তিনি কথা বন্ধ করে দিতেন।
এখনো অনেক লোক লেগে আছে তার পেছনে এই উত্তরের জন্য।
আমি ঘটনাটি যখন জানলাম তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাহিনী কী?
তিনি কিছুক্ষণ নিরব থেকে খুব আস্তে করে বলেছিলেন, কিছু জিনিস গোপন থাকলেই ভালো। এট লিস্ট, সময়ের আগে এইগুলি প্রকাশ হওয়া ভালো নয়।
~~~~~~
তেইশ-
কৃপাসিন্ধুর বাবুর কথা কি কেউ জানেন? তার হঠাত করে গুম হয়ে যাবার কথাটি।
একদিন খবর পাওয়া গেলো সুস্থ মানুষ কৃপাসিন্ধু করে গুম মেরে গেছেন। তিনি আর কথাবার্তা বলেন না। তার দৃষ্টি কেমন শূন্য হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিছেন।
তার স্ত্রী বলেন, কথা বলেন না ক্যান আপনে?
কৃপাসিন্ধু কিছু বলেন না।
তার স্ত্রী বলেন, এইবার কিছু খান। সাগু কইরা দেই, পেট খারাপ নাকি?
কৃপাসিন্ধু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। কোন উত্তর করেন না।
বড় ছেলে শ্যামল এসে বলে, আব্বা আপনার কী হইছে? শরীর খারাপ নাকি?
কৃপাসিন্ধু ফিরেও তাকান না।
কৃপাসিন্ধুর দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানেরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এভাবে না খেয়ে, না কথা বলে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই মারা যাবেন।
তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন তারে। ডাক্তার বলেছেন অতিরিক্ত ডিপ্রেসন। মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু তার আগে তো তারে খাওয়াতে হবে কিছু। পানিও খাচ্ছেন না ভদ্রলোক।
অতএব, স্যালাইনের পথে হাঁটতে হলো।
মানসিক ডাক্তারের কাছে নেবার পরে কৃপাসিন্ধু বাবুর আরো কিছু সমস্যার কথা জানা গেলো। তিনি ভয় পান। তার প্রথম স্ত্রীকে ভয় পান। যে স্ত্রীকে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। তার প্রথম ও শেষ প্রেম। ভদ্রমহিলা বিশ বছর আগে খুবই অস্বাভাবিক ভাবে খুন হয়েছিলেন, দুই বছরের শিশুপুত্র সহ। ঐ মৃত্যুর ছয় মাস পরে কৃপাসিন্ধু দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন। খুনির নাম পরিচয় কিছুই জানা যায় নি।
কৃপাসিন্ধুর সমস্যাটির শুরু দুই সপ্তাহ আগে। প্রতিদিন সকালে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ার স্বভাব তার। দুই সপ্তাহ আগে, এক শনিবারে, শাহ আব্দুল করিমের গান “রঙ্গের বাহাদুরী আজ গেলো কই” এর সুরে মাথা দোলাতে দোলাতে তিনি পড়লেন শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালটির প্রবীণ নার্স ধরা পড়েছে। এই নারী ভয়ংকর। শুধুমাত্র মজার জন্য সে গত ত্রিশ বছর ধরে সদ্য জন্মানো নবজাতকদের বদলে দিত।
দুঃখ প্রকাশ করে হাসপাতালটি একটি বিবৃতি ছেপেছিল।
এবং এই মহিলা কোন কোন কেবিনে নবজাতকদের জন্ম নেয়াকালীন সময়ে কাজ করেছিল, তার তথ্য সরবরাহ করেছিল আগ্রহীদের কাছে। কৃপাসিন্ধু সেটি জোগাড় করেছিলেন ঐদিনই।
এরপর থেকেই তিনি গুম মেরে যান।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। যদিও এই যোগসূত্রটি কেউ বুঝতে পারেন নি। না তার স্ত্রী ছেলে মেয়ে, না ডাক্তারেরা। অনেক কিছুই আসলে বুঝা যায় না তথ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে। অনেক কিছুই বিভ্রান্তিময়।
শেষবার যখন কৃপাসিন্ধুকে দেখি, তিনি হুইল চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন বলে মনে হলো না। খুব সম্ভবত তিনি তখন বাস্তবতা থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে অন্য জগতে চলে গিয়েছিলেন।
~~~~~~
চব্বিশ-
অনেকদিন আগে একটা লোক ছিল। যে জাল দিয়ে প্রজাপতি ধরতো। প্রজাপতি শিকারই ছিল তার নেশা ও পেশা।
সে তার জাল নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত।
প্রজাপতি যে খুব ধরা পড়তো এমন নয়। কোনও কোনও দিন একটিও ধরা পড়তো না।
এমনই এক নিদানের দিনে, সবচাইতে অত্যাশ্চর্য ও মায়াবী প্রজাপতিটি ধরা দিয়েছিল লোকটির জালে। যে প্রজাপতির এক একটি ডানার মূল্য অর্ধ পৃথিবীর যাবতীয় মূল্যবান প্রস্তরাদির সমান।
এমন প্রজাপতি, বিচিত্র গাত্রবর্ণ ও দেহাবয়ব তার, শিকারী আগে কোনওদিন দেখে নি।
তার এঁকে প্রজাপতি বলেই মনে হলো না।
সে জাল ঝেড়ে ফেলে দিল তাকে।
নতুন প্রজাপতি ধরার আসায় জাল পাতলো আবার।
সে বুঝতেও পারলো না আসলে, কী সে ফেলে দিয়েছিল।
~~~~~~
পঁচিশ-
আমার এরকম হয় কেন আমি বুঝতে পারি না। মাত্র কয়েকটা বিয়ার খেলাম কিন্তু এরই মধ্যে আমার খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
আমার মনে হচ্ছে আমি, নুহ ইবনে মানসুরের লাইব্রেরী পুড়ে যাওয়া আগুনের শিখা দেখছি। আগুন উপরে উঠে যাচ্ছে, দাঊ দাঊ, রাতের অন্ধকারকে স্পর্শ করে করে।
আমার প্রিয় বইগুলি, প্রাচীন সব জ্ঞানপুস্তক, যেগুলি আমি দিনরাত বসে বসে পড়েছি একাগ্রচিত্তে, সেগুলি পুড়ে যাচ্ছে।
আমারই দেয়া আগুনে।
আর আমি ইবনে সিনা, যুগপৎ আনন্দ ও বেদনার সাথে আগুন দেখছি দাঁড়িয়ে।