পণ্ডিতেরা বলেন সংবিধানের একটা বড় কাজ হলো সাধারণ মানুষকে নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা করা। নিগ্রহ? কে করে মানুষকে এই নিগ্রহ? অন্য মানুষ। ।শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। মানুষেরই হাতে মানুষ লাঞ্ছিত হয় রোজ। মানুষেরই হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সংবিধানের দরকার।
আমরা নিজেদের সমাজেই সংখ্যালঘুদের সাথে কি রকম বৈষম্যমূলক আচরণ করি তা ভাবতে লজ্জা লাগে। ভেবে দেখুন দূর সাগরপারের কোনো দেশে যদি কোনো মুসলমানকে খানাতল্লাশী করা হয়, অথবা তাঁর সাথে কোনরকম বৈষম্য হয়, সে খবর শোনামাত্র আমরা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিতে কসুর করিনা। কিন্তু সেই আমরাই নিজেদের দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর দিব্যি চোখ রাঙিয়ে ফতোয়া জারি করি যে আমাদের অনুমোদন ছাড়া কোনকিছু করার স্পর্ধাও যেন তাঁরা না দেখান।এর থেকে বড় দ্বিচারিতা আর কী হতে পারে?
কিছুদিন আগে লাহোরে আহমদী সম্প্রদায়ের সাথে জেরকম ব্যবহার করা হলো তা বড়ই দুঃখজনক। অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে ওঁদের 'উপাসনার জায়গা'গুলো নাকি বড্ড বেশি মসজিদের মত দেখতে। সেই জন্য পুলিশ গিয়ে সেখানে চড়াও হয়ে দেওয়াল থেকে সমস্ত কোরাণের বাণী মুছে দিলো, আর প্রচুর ইস্তেহার ঝুলিয়ে দিয়ে এলো যাতে কোনমতেই আর উপাসনাগৃহগুলিকে মসজিদের মত না দেখায়। উপাসনার জায়গা কেমন দেখতে হওয়া উচিৎ বা তাকে কি নামে ডাকা উচিৎ সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই ঈশ্বর কোনো বিধান দেননি। কিন্তু স্বর্গত জিয়া-উল-হক সাহেবের কৃপায় আমাদের পাকিস্তানে এইরকম হওয়াটাই বিধান।
সত্যি বলতে কি আহমদীদের সাথে এই ধরণের বৈষম্য সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই চলে আসছে। কে যে মুসলমান আর কে নয় তার বিচার করা কোনমতেই রাষ্ট্রের কাজ হতে পারেনা। কিন্তু পাকিস্তানে এরকম হয়েছে, হয় আজও। এদেশের রাজনীতিতে জাফরুল্লা খান সাহেবের মত বিদগ্ধ মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বরং উল্টোটার অভাব নেই। স্বর্গত ভুট্টো সাহেবকেই দেখুন না। রাজনৈতিক চাপে পড়ে উনি সংবিধানের দ্বিতীয় ধারাও ওপর জোর দিয়েছিলেন --আহমদীদের 'অমুসলমান' বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। অবশ্য তার মানেই এ নয় যে উনি আহমদীদের ওপর অত্যাচার করার ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। আজ যে সমস্ত অত্যাচার হচ্ছে তার কারণ অন্য।
কারণ -- মূলত জিয়া-উল-হকের কার্য্যকলাপ।আহমদী ধর্মাচরণ আর এর প্রচারকে হক সাহেব অপরাধের গোত্রে ফেলে দিয়েছিলেন। ওঁদের 'উপাসনার জায়গা'কে মসজিদ বলে উল্লেখ করা চলবেনা এই ফতোয়াও তিনিই জারি করেছিলেন। পাকিস্তানের ইংলিশ প্রেস, যারা নিজেদের 'লিবার্যাল' বলে গর্ব করে লেখাপত্র ছাপিয়ে থাকে, তারাই ১৯৭৪ এ আহমদীদের 'অমুসলমান' বলে দাগিয়ে দেওয়া নিয়ে বেবাক খুশিতে মেতেছিলো। নামী খবরের কাগজগুলোতে লেখা হয়েছিলো যে ''আহমদী 'সমস্যা'র অন্তে দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলো''। পাকিস্তানি সংবিধান কখনোই 'কনস্টিট্যুশন অফ ফীলিং' হিসেবে তৈরী হয়নি -- এই শব্দটা প্রোফেসর নোয়া ফেল্ডম্যানের থেকে ধার করলাম। মার্কিন সংবিধানে দেশে অন্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা করাটাই নিষিদ্ধ। কাজেই অন্য ধর্মের লোকেরা কিছুটা অপাংক্তেয় অনুভব করতেই পারেন। আমাদের সংবিধানে অবশ্য সেরকম কোনো বিধান নেই। কিন্তু আমাদের নিজেদের এইসব বৈষম্যমূলক ব্যবহারই অন্য ধর্মের মানুষকে অপাংক্তেয় করে দিচ্ছে।এর মত খারাপ জিনিষ আর কি হতে পারে?
রাষ্ট্র সরাসরি ধর্মীয় বৈষম্যের আইন চালু করছে তা হয়তো বলা যাবেনা। কিন্তু দেশের মানুষ যখন নিজেদের মধ্যে ধর্মের ভেদাভেদ গড়ে তুলছে রাষ্ট্র যে তাতে মদত দিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। লাহোরের ঘটনাটার কথাই ভেবে দেখুন না। পুলিশ বারেবারে আহমদী মসজিদ থেকে কোরানের শরিয়ত মুছে দিয়েছে। যদি আজ আহমদীরা বা অন্য ধর্মের কেউ এসে মসজিদের দেওয়াল থেকে কোরান শরিয়ত মুছে ফেলতে চায় তাহলে তাদের হাল কি হবে? শুধু মসজিদই কেন, যদি কেউ কোনো মন্দির বা গীর্জা থেকে ধর্মীয় বাণী মুছতে যায় তার কি হবে? কোন সন্দেহ নেই যে ধর্মীয় অপরাধের তকমা দিয়ে তাকে শাস্তির কাঠগড়ায় তোলা হবে। মুসলিম দেশ হলে হয়তো বা তার প্রাণদন্ডই হয়ে যাবে। কিন্তু এইক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মকে 'রক্ষা' করার দোহাই দিয়ে এরকম বারবার করা হচ্ছে, কেউ একে অপরাধ বলে মনেও করছেন না। আমি শুধু পুলিশদের দোষ দিচ্ছিনা। দেশের জনমত আর আইন এই দ্বিচারিতার ভিত্তি গড়েছে, একা পুলিশকে দোষ দিয়ে কি লাভ?
পাকিস্তানীদের মধ্যে যাঁরা মুসলমান নন তাঁরা তো কোনরকম ধর্মীয় স্বাধীনতার আশাই করতে পারেননা। তাঁদের ধর্মের কোনো কিছু যদি কোনো গোঁড়া মুসলমানের চোখে 'বেচাল 'ঠেকে তো সেই মুসলমান ভাই সোজা গিয়ে থানায় নালিশ ঠুকে দিতে পিছপা হননা। আর পুলিশের কাছে সে নালিশ রীতিমতো গ্রাহ্যও হয়। নিজেদের দেশে আমরা আহমদীদের সাথে যদি এমন ব্যবহার করি তাহলে অন্য কোনো দেশে মুসলমানদের সাথে বিষম ব্যবহার করা হয়েছে বলে গলা ফাটাবার মুখ আমাদের কী করে থাকবে? আর সেই সব দেশে অন্তত পুলিশ ধর্মের ভিত্তিতে কারুর ওপর চোটপাট করাকে আইনী স্বীকৃতি দেয়না।
আমাদের আসল সমস্যা হলো যে ধর্ম নিয়ে ন্যূনতম সহিষ্ণুতা দেখাতেও আমরা অরাজী। পাকিস্তানে যাঁরা মুসলমান হয়ে জন্মাননি বা কোনভাবে 'অমুসলমান'এর তকমা পেয়েছেন তাঁদের নির্বিচারে হুমকি দিয়ে কোণঠাসা করে রাখতে আমাদের এতটুকু বাধেনা। নিজেরই দেশে এঁরা রাতদিন ভয়ে ভয়ে কাটান। পাকিস্তানের আহমদীদের দেখুন, শিয়া সম্প্রদায়কে দেখুন, হিন্দুদের দেখুন, খৃষ্টানদের দেখুন, ছবিটা সর্বত্রই এক। অথচ ইসলাম ধর্মের কোথাও কি এমন নির্দেশ আছে যে অন্য ধর্মের লোকদের ওপর অত্যাচার করতে হবে? আমরা নিজেদের নৈতিকতায় জলাঞ্জলি দিয়ে সেটাই করে চলেছি। আমার পাকিস্তানি ভাইবেরাদরেরা এ'কথা শুনলেই ইজরায়েলের কথা তুলে কত কিছু বলবেন। ইজরায়েলাকে 'দুষ্টুলোক' বলে দেখাতে পাকিস্তান ভারি পটু। কিন্তু আমি জোর দিয়ে বলবো যে ইজরায়েল অন্তত ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেদের নাগরিকদের ওপর বৈষম্য দেখায়না। সে দেশটা ইহুদী, কিন্তু ওখানে ইহুদী নাগরিক আর খৃষ্টান নাগরিকেরা সমাজের কাছে একই ব্যবহার পেয়ে থাকে। ইজরায়েলের অন্যন্য নীতিতে কী খারাপ আছে কী ভালো আছে সেই নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। আমরা এখানে ধর্ম ও নাগরিকতা নিয়েই কথা বলতে বসেছি।
কিন্তু ভেবে দেখুন আমাদের যে কারুর সাথেই তো এমন হতে পারতো। ঘটনাক্রমে যদি আমি বা আপনি আহমদী বা অন্য কোনো ধর্মের পরিবারে জন্মাতাম তাহলে এই আমাদেরই অত্যাচার, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তায়াহীনতায় দিন কাটতো। একজন মুসলমান নিজের ধর্মে ঠিক যতখানি বিশ্বাস, যতখানি আস্থা রেখে চলেন একজন অমুসলমানের কাছেও তাঁর ধর্ম তো ঠিক ততখানিই। তাহলে সেই বিশ্বাস, সেই আস্থার জন্য তাঁকে বারবার এমন হেনস্থা হতে হবে কেন? আমি জানি রাতারাতি সমস্ত আহমদী বিরোধী নিয়ম কানুন দেশ থেকে উবে যেতে পারেনা। আর নিয়ম কানুন গেলেও মানুষের মন থেকে খুব সহজে এই বৈষম্য মুছে যাবে সে আশাও আমার নেই। কিন্তু অন্তত একটা কাজ আমাদের করতেই হবে।যাঁদের মধ্যে সামান্যতম নৈতিকতা, মানবিকতা আছে তাঁদের আজ এগিয়ে এসে এই ধর্মীয় বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে হবে।লাহোরে যা ঘটেছে, সারাদেশেই যা ঘটছে তার প্রতিবাদ করতে হবে। নেই।আজ এই যে আহমদীদের পক্ষ নিয়ে এতগুলো কথা বললাম এর জন্য পাকিস্তানে আমায় কত সমালোচিত হতে হবে তা আমার অজানা নেই।তবু এই কথা আমি বারবার বলে যাবো। কারণ ,এর মত সত্যি কথা আর কিছু নেই।
মূল লেখাঃ http://www.pakistantoday.com.pk/2012/05/06/comment/columns/the-insecure-majority/
(লেখক লাহোরবাসী আইনজীবী)
অনুবাদঃ কৃষ্ণকলি রায়