"দিল্লি যাচ্ছেন"? লাহোরের ইমিগ্রেশন অফিসপ্রায় খেঁকিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমি সম্মতি জানাতে বল্লেন"থার্ড ম্যাচটা জেতা চাই ই। আর তিন শূন্য হলে তো কথাই নেই।" একটু দুরেই এক্জন মা তার দু বছরের বাচ্চাকে বোঝাবার চেষ্টা করছেন খেলনা ক্রিকেট ব্যাটটা স্ক্যানিংএর জন্য যেন সিকিউরিটির হাতে দিয়ে দেয়। বোঝাই যাচ্ছে দুই বছরের শিশুও ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত। তার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তার মা ব্যাটটা ছিনিয়ে নিয়ে স্ক্যানিংএর জন্য পাঠিয়ে দিলেন, "ক্রিকেট বলতে একেবারে পাগল" জানিয়ে দিলেন সব্বাইকে। কেউই অবশ্য অবাক হল না। এই উপমহাদেশে এটা একেবারে অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যবহার। ক্রিকেট নিয়ে ক্ষ্যাপামি। আর ম্যাচের ফল ভালো না লাগলেই প্রবল বিলাপ।
অবশ্য দিল্লির উড়ানের সময়েও আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না যে ফিরোজ শাহ কোটলার মাঠের কোনো টিকিট যোগাড় করতে পারব কিনা। আমার সহযাত্রী ছিলেন একজন ক্রিকেট ব্যাটের ব্যবসাদার। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম ব্যাট নিয়ে বাতিকের সালতামামি। রাহুল দ্রাবিড়ের স্ত্রী নাকি বলেছিলেন যে রাহুলের স্যুটকেসে যদি মাত্র একটাই সেট জামা কাপড় দিয়ে দেওয়া হয় তো রাহুলের কিছু আসে যাবে না, কিন্তু, রক্ষে করো বাবা, ক্রিকেট ব্যাটের ওজনে কয়েক গ্রামের তফাৎও যেন না হয়। ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলুড়েদের উপর আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা আছে। তাঁরা যে ধরনের আত্মত্যাগ করেন সেটা অনেকেরই নজরে আসে না।
তো, ঐ ব্যাট ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে আমার ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহটা আবার ভালো মতনই চাগিয়ে উঠল। তাই দিল্লিতে নেমেই আমার প্রথম কাজ হল কী করে একটা টিকিট যোগাড় করা যায়। প্রায় সবাইই জানালেন ব্যাপারটা অত সহজ নয়। স্বাভাবিক। ভাবুন একবার লাহোরে খেলা হচ্ছে ইন্ডিয়া আর পাকিস্তানের আর আপনি স্টেডিয়ামে গেছেন যদি একটা টিকিট পাওয়া যায় এই আশায়। কিন্তু মশাইরা, আমার কহানি মে টুইস্ট হ্যায়। ইন্ডিয়া তো অনেকগুলো ম্যাচই হেরে গিয়েছে। লোকের উদ্দীপনা একটু কম থাকারই কথা। প্লাস সেই রবিবার ছিলো দিল্লির গত বাইশ বছরের মধ্যে শীতলতম দিন। সকাল সাতটায় আমি স্টেডিয়ামে হাজির। পাগলামি? নাঃ। ঐ লাহোর এয়ারপোর্টের বাচ্চাটার মতন আমিও ক্রিকেট খ্যাপা।
ইন্ডিয়ায় একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করেছি যে লোকে ঠিক টের পেয়ে যায় আমি ভারতবাসী নই। অটো থেকে স্টেডিয়ামে ঢুকবার মুখেই দেখি একজন আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে মানে বেশ প্যাট প্যাট করেই তাকিয়ে রয়েছে। তো আমি হাসি মুখেই ওনার দিকে এগিয়ে গেলাম। হাত বাড়িয়ে বল্লাম "আমি এসেছি পাকিস্তান থেকে- লাহোর। তো হাল চাল কেমন বুঝছেন?" "আরে, আরে ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া। স্বাগতম।" সে-ও খুব উৎফুল্ল ভাবে আমাকে জানায়। "টিকিট ফিকিট পাওয়া যাবে একটা?" আমি জোরে জোরেই প্রশ্ন করি। সে জানায় সেটা অসম্ভব। আমি চারদিকে তাকাই। একজনের মুখ দেখে মনে হল এ বোধয় ব্ল্যাক করবার ধান্দাতেই আছে। "তো কেউ কোনো টিকিট বিক্রি করবে না?" আমি প্রশ্ন রাখি, তার দিকে তাকিয়েই। আমরা এবার হাঁটতে শুরু করতেই সে ও তৎক্ষনাত আমাদের পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করে দেয় আর একটা ফোন নম্বর লেখা কাগজের টুকরো আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে "পরের ট্র্যাফিক সিগন্যাল পৌঁছে একটা কল দিন"। আমি জানাই আমার কাছে সেলফোন নেই। "বেশ তো আমার সাথে সাথেই চলুন।"
তো এই ভাবেই আমি পৌঁছে গেলাম ক্রিকেটের স্বর্গে। যদিও ঐ বিক্রেতা আদৌ মুসলিম ছিলেন না কিন্তু কে জানে কেন নিজেকে মিস্টার কুরেশি বলে উল্লেখ করছিলেন। কেন? ঠিক জানি না, কিন্তু বোধহয় সরকারি প্রচারে তাঁর বিশ্বাস ছিলো একজন পাকিস্তানি নিশ্চয়ই অন্য ধর্মের লোকের সাথে লেনদেন করবে না! ধুর, ধর্ম আবার কী? ঐ খানে একটাই ধর্ম আর সেটা হচ্ছে ক্রিকেট। প্রায় পাঁচগুণ দাম দিয়ে টিকিটটা পেলাম। তা হোক, ইন্ডিয়া পাকিস্তানের খেলা বলে কথা।
এবং সেই মিস্টার কুরেশি আমাকে অকাতরে আর জ্ঞান দিলেন। ক্রিকেট যে কত দিক দিয়ে মানুষকে ধরে রেখেছে সেটি জানালেন। নাকি ২০১১ সালের ম্যাচের সময় ভারতীয় টাকায় ৭৫,০০০'এর দাঁও-ও মেরেছেন ব্ল্যাকে টিকিট বেচে। তা, উনিও একজন ক্রিকেটপ্রেমী যদিও ওনার প্রেমের উদ্দেশ্য একটু আলাদা।
ম্যাচ অবশ্য জমেছিল। যদিও ইন্ডিয়ার ব্যাটিং তেমন আহামরি কিছু ছিল না কিন্তু যুবি আর ধোনির কিছু মারকাটারি স্ট্রোক মনে রাখার মতন। জিতল ইন্ডিয়াই। কেন না দুর্দান্ত ফিল্ডিং করে প্রায় ৩০-৩৫ রান বাঁচিয়ে দিল আর ঐটাই হল জয়ের কারণ।
ভারত পাকিস্তানের ম্যাচ দিল্লিতে বসে দেখলে উত্তর ভারতের পাকিস্তান বিরোধী মনোভাবটাও বেশ টের পাওয়া যায়। কয়েকটা স্লোগান তো বেশ পরিষ্কারভাবে ধর্মবিদ্বেষী। আমার পিছনেই বসেছিলেন সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে একজন, বন্ধুরা তাকে পন্ডিতজী বলে ডাকছিলেন। আমার টীম পাকিস্তানের টী শার্ট পরাটা তার আর কিছুতেই হজম হচ্ছিল না। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলেন, "পাকিস্তান আজ জিতলে আর জ্যান্ত ফিরতে হবে না" বা "কাসভের মতন সব পাকিস্তানীকেই ফাঁসিতে লটকে দাও"। শুধু পাকিস্তান বিরোধী নয়, স্লোগানগুলো ছিলো মুসলিম বিরোধীও। লাহোরে শেষ যে ইন্ডিয়া পাকিস্তান ম্যাচ হয়েছিলো তার সুর কিন্তু অন্যরকম ছিল। সচীন মাঠে নামলে গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানিয়েছিল। সেই খেলায় ভারত জিতলে লাহোরবাসীরা ভারতীয়দের আলিঙ্গন করতেও ভোলেন নি। স্টেডিয়ামের বাইরে ভারতীয়রা খেলা জিতে নাচতে শুরু করলে লাহোরের ঢোলওয়ালারা সোৎসাহে ঢোল পিটিয়ে ছিলো। ক্রিকেট তো সবাই ভালোবাসে কিন্তু স্টেডিয়ামে এসে পরস্পরের জাতি বিদ্বেষটাকে কি না উগরে দিলেই নয়? খুব কি একটা উপর উপর ব্যাখ্যা দিলাম? আমার বন্ধুরা, যারা এর আগে দিল্লিতে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ম্যাচ দেখেছিল, তাদের অভিজ্ঞতাও কিন্তু আমারই মতন।
টীম পাকিস্তানের শার্ট দেখে রেগে যান নি যারা, সেই জনা দশেক ভারতীয় হয় কশ্মিরী নয় ভারতীয় মুসলমান। ফিস ফিস করে আমাকে জানিয়ে গেলেন "আমারা কাশ্মিরী আর পাকিস্তানকেই সাপোর্ট করছি।" টীম পাকিস্তানের শার্ট পরে তো আর আসা যায় না তাই তারা সকলেই সবুজ রংএর সোয়েটার পরে এসেছিলেন। সবুজ - তা সে যে কোনো শেডের হলেও হোলো। মেনে নিচ্ছি একজন বালোচও এইরকমই ভেবে থাকেন।এবং এটাই বড়ো দুঃখের। যাই হোক, স্টেডিয়ামের ভিতরে কোনো অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে নি। অনেক ভারতীয় মুসলিম, টীম পাকিস্তানের শার্ট পরা আমার সাথে ছবি তুলতে চাইলেন। তারাও ফিস ফিসিয়ে শুধু এইটুকুই জানিয়ে দিলেন "আমরাও মুসলিম", নিশ্চয়ই ঐ পন্ডিতজীর আধিপত্য অনেক বেশী ছিলো দিল্লীতে আর কোনোই সন্দেহ নেই পকিস্তানেও ঐ পন্ডিতজী টাইপের লোক অর্থাৎ মোল্লাদের রমরমাও কিছু কম নয়। তবু জানিয়ে রাখি পাকিস্তানে আমরা আমাদের অতিথিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি ।
আমি ম্যাচের শেষ পর্যন্ত রইলাম। মিসবাহ ট্রফী নিলেন আর ততক্ষণে পন্ডিতজীও কেটে পড়েছেন। স্টেডিয়ামে সবুজশার্টের দল দু হাত তুলে খুব উল্লাস জানালো ডিসেম্বরের সেই হিম শীতল সন্ধ্যাবেলায়।আমি তো দিল্লীকে ভালোবাসি, ভালোবাসি ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টীমকে আর সব থেকে ভালোবাসি ক্রিকেট প্রেমকে। ভারতীয় দলের সমর্থক এইসব পন্ডিতজী ও তাদেরই অপরপক্ষ পাকিস্তানের মৌলবাদীদের সড়িয়ে দেওয়াই উচিৎ। এরা কেই ক্রিকেট প্রেমী নন। এদের কাছে ক্রিকেট একটি অজুহাত মাত্র। বিদ্বেষ ছড়ানোর আর একটা উপায়। এর কোনো যুক্তি নেই। সেটা বোধহয় দুই বছরের শিশুটিও জানে।
মূল লেখাঃ http://www.pakistantoday.
অনুবাদঃ দীপ্তেন