অনেক ব্যাপারেই অন্যদের সাথে আমার মতে মেলে না -- অবশ্য তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই! সেদিন এয়ারপোর্টে এক প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীর সাথে আলোচনা হচ্ছিলো -- চীনের 'গ্রোথ মডেল' নিয়ে। ভদ্রলোককে আমি একটু জোরাজুরিই করছিলাম, ওঁর মত কি তা বলার জন্য। আমি তো বারবারই বলে যাচ্ছিলাম যে চীনের মডেল মেনে চললে পাকিস্তানের ক্ষতি বই লাভ কিছু হবেনা। উনি একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন "হ্যাঁ, লোকের বোঝা দরলার যে ও মডেলটা খুব বেশিদিন টেঁকার মত কিছু নয়। আশা করি আমাদের দেশটা ওদের পথে চলবে না।'
চীনের প্রতি পাকিস্তানের যে একটা বাড়াবাড়ি রকমের মোহ আছে সে ব্যাপারটা আমার কোনকালেই পছন্দ হয় না। কত তাবড় তাবড় ব্যবসায়ী আর ডিক্টেটারদের দেখেছি চীনের অর্থনৈতিক গ্রোথ মডেলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু আমাদের দেশের ভবিষ্যতের ওপরে এর কতখানি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে এঁরা কোনদিন ভেবেও দেখেন না।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। চীনের অর্থনীতি এমন নড়বড় করতে করতেও কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়ে আরো পড়াশোনা করতে আমারও ইচ্ছে হয়। চীন নিজেদের যতজন লোককে পভার্টি লাইনের বাইরে বার করে আনতে পেরেছে সে সংখ্যাটা আজকের সারা দুনিয়ায় গরিব লোকের মোট সংখ্যার ওপরে কম প্রভাব ফেলেনি। তেমনি আবার এমন অনেক তথ্য-পরিসংখ্যানও আছে যেগুলোর কথা চীন-অনুরাগীরা ভুলেও তোলেন না।
চীনের অর্থনীতি এখন আগের চাইতে অনেক বেশি খোলামেলা হয়েছে, কিন্তু এর পেছনে ওখানকার "কমিউনিস্ট পার্টির' লম্বা ছায়া রয়েছে,খুব লাভজনক মওকা না থাকলে সে পার্টি কোন উন্মুক্ততার ধার ধারে না। রিচার্ড ম্যাকগ্রেগরের একটা চমৎকার বই আছে - "দি পার্টি : দি সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অফ চায়না'স কমিউনিস্ট রুলার্স'। রিচার্ড লিখেছেন যে চীনের গল্পের আসল মজা কিন্তু ওদের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে নয়; কমিউনিস্ট পার্টি কীভাবে সব ব্যপারে সেই পুরনো ধাঁচের কমিউনিজমের মতো নিজেদের কর্তৃত্ব করার রাস্তাটা বানিয়ে নিলো সেই ঘটনাটা আরো অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।
এই পার্টি আগে খোলাখুলি কাজকর্ম করতো, এখন অবশ্য নেপথ্যে থাকাই এঁদের বেশি পছন্দ। জানাই তো আছে যে আড়ালে থাকলেও পুতুলনাচের সুতো কার হাতে! আগে পার্টিকর্মী হিসেবে চাষী মজুরদের নেওয়া হত, এখন সে কাজটা সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছাত্রদের বা পেশাদার লোকেদের দেওয়া হয়। পার্টিকে সবদিক থেকে রক্ষা করার জন্য একটা রীতিমতো সংগঠনই তৈরী আছে। বিরোধীরা যাতে চরম শাস্তি পায় সেদিকে এই সংগঠনের কড়া নজর থাকে। জোচ্চুরি জালিয়াতির দায়ে কেউ ধরা পড়লে তাকে আগে পার্টির কাছেই জবাবদিহি করতে হয়। আদালতে তাদের তোলা হবে কিনা সেটা পার্টির ইচ্ছে। এমনকী চীনের অনেক "ডেমোক্রেটিক' দলও এঁদের কথামতই চলে। দলের নেতা কে হবেন, তা পার্টি ঠিক করে দেয়, দলের বাজেটও। এক কথায় বলতে গেলে চীনে এই পার্টিকে বাদ দিয়ে কোন রাজ্যই নেই। পার্টি নিজেই হলো রাজ্য, বা বলা ভালো পার্টি যেমনটি বলে দেবে রাজ্য হবে ঠিক তেমনটিই। পার্টিকে বাদ দিয়ে কোন স্বাধীন আইনও নেই দেশে। ২০০৯ সালে চীনের "সুপ্রীম পিপল'স কোর্ট' থেকে "পিপল'স কংগ্রেসের' সামনে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছিলো। তাতে স্পষ্টই বলা আছে যে আদালতের বিচারপতির আনুগত্য সবার আগে পার্টির কাছে, তারপরে রাজ্যের কাছে, তারপরে জনগণের কাছে, আর সবশেষে ... আইনের কাছে।
রিচার্ড ম্যাকগ্রেগর যাকে বলেছেন সমাজের প্রতি চীনের "মানলে মানো, না মানলে ভাগো নীতি' ঠিক সেই জিনিষটাই আমার খুব অপছন্দের। এই নীতির ফলে সাধারণ লোকের সামনে সরকার যা বলছেন তাই মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোন রাস্তা খোলা থাকছেনা, অবশ্য তার বদলে অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা জুটছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই "সুযোগসুবিধা' যে সবসময় খুব কাজের জিনিষ তা নয়। গিনি কো-এফিশিয়েন্টের হিসেব অনুযায়ী চীনের সমাজে অসাম্য দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। বিলেত আমেরিকার থেকে অসাম্য বরং চীনে অনেক বেশি। হালেই "হিউম্যান রাইটস ওয়াচ'এর রিপোর্টে বেরিয়েছে যে চীনের "হুকোউ ব্যবস্থা' কীরকম অন্যায্য একটা ব্যপার। এর নিয়ম হলো কোন শহরের বাসিন্দারা যদি বাড়ির রেজিস্ট্রি করান তবেই কর্মক্ষেত্রের সুযোগসুবিধা আর বাচ্চাদের পড়াশোনার সুবিধা পাবেন। এর ফলে গ্রাম এলাকা থেকে যে হাজার হাজার মানুষ শহরে কাজ করতে আসেন তাঁরা সবাইই ঐসব সুযোগসুবিধা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশের সাধারণ মানুষের অধিকারই বলুন, কি চলা-বলার স্বাধীনতাই বলুন, সবকিছুই কিন্তু পার্টির ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরে ঝুলে আছে। এমনকী "ওয়ান চাইল্ড পলিসি' না মেনে জন্মে যাওয়া প্রচুর বাচ্চা একেবারে নিখোঁজই হয়ে গিয়েছে, তাদের নিয়ে সরকার বা আদালতের কোন মাথাব্যথা নেই। এইই কি মানুষের নাগরিক অধিকার? পাকিস্তানের যেসব লোকজন চীনের গুণ গান তাঁরা নিজেরা আসলে সাচ্ছল্য আর সুরক্ষার তুলোর ঘরে দিব্যি মোড়া রয়েছেন। সাধারণ মানুষের থেকে সে ঘর বহুদূরে।
পাকিস্তানে ধনীলোকের অভাব নেই। একটা বিত্তবান সমাজই আছে যাদের কোনদিক দিয়ে কোনকিছুরই অভাব নেই। দেশের যাবতীয় সুযোগসুবিধা এঁরা স্রেফ কিনে ফেলতে পারেন। তার পরেও ফেলে ছড়িয়ে এঁদের পয়সার কমতি হয়না। দেখেছি চীনের মডেল মেনে চলার জন্য এঁরাই সবচেয়ে বেশি গলা ফাটান। এঁদের কাছে তো পড়াশোনা বা চিকিৎসা কিংবা অন্য সবরকম নাগরিক সুবিধা শুধু পয়সা দিয়ে কিনে আনা যায় এমনই কোন ব্যপার। যাদের পয়সা নেই তারা কীভাবে এই জিনিষগুলো পাবে সে নিয়ে এঁরা কোনদিন মাথা ঘামান না।
পাকিস্তান যদি একটা সংগঠিত দেশ হিসেবে থাকতে চায় তাহলে কখনোই চীনের রাস্তায় হাঁটলে তার চলবে না। চীনের উদ্ধত পার্টি হয়তো মনে করেন যে তাঁরা যা ভালো বোঝেন দেশের জন্য সেটাই ঠিক। আমাদের মতো দেশের পক্ষে ঐ পন্থা কোনমতেই ঠিক নয়। আর যাতে ঐ ব্যবস্থা এদেশে না চালু হয় তার জন্য আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিৎ। কোন রাজনৈতিক পার্টি ঠিক করে দেবে যে সারা দেশের জন্য কী ঠিক আর কী ভুল, এ কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না। আমি চাই আমাদের দেশে একটা স্থায়ী টেঁকসই অর্থনীতি থাকুক। কালই বিশাল বড়লোক হয়ে গিয়ে পরশুই আবার কাঙাল হয়ে যাবার অর্থনৈতিক মডেলের আমি সবরকম ভাবে বিরোধিতা করি।
মূল লেখা ঃhttp://www.pakistantoday.com.pk/2011/06/13/comment/columns/on-the-party/
অনুবাদ - কৃষ্ণকলি রায়